গতেন মেন
বুক হোম
৩২ কলেজ বো, কার্লকাতা-
প্রকাশক £
তড়ি
ৎ কুমার মজ্জুম
বুক হোম এ
৩২, কলেজ বে
কলিকাতা-_-৯
প্রচ্ছদ ৪
- স্বখেন গ্রপু
মুদ্রক £
রাজধানী প্রিন্টিং
১১৭।১,) বিগ্গি ৰ
ি্ পনবি
পাজি ৪৪ রা
মূল্য নয় টাক।
বিদ্রোহী কৈবষট
স্বর্গত মহারাজ তৃতীয় বিগ্রহপালের বাধিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষে
মহাভারত পাঠ হচ্ছিল। মহারাজের মৃতার পর থেকে প্রতি বসরই
এ উপলক্ষে শীস্ত্রাদি পাঠ করা হয়ে থাকে । পাঠ পুরো এক
মাস চলবে । লোক সমাগম মন্দ হয় না। হিন্দ, বৌদ্ধ, জৈন
সকল সম্প্রদায়ের লোকেরাই আসে । জাতি ধর্ম বয়স নিধিশেষে
মহাভারত সকলের কাছেই অতি প্রিয়। বহুবার শুনে শুনেও তৃপ্তি
হয় না।
বিশেষ করে এবার ধিনি পাঠ করছেন, বয়সে তরুণ হলেও
ইতিমধোই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে । অতি স্বললিত তার
কণ্ঠস্বর, আর অপূর্ব তার বাখ্যা! আর প্রকাশভংগি সেই» জন্যই
এবার লোকের ভিড় আরও বেশী। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল।
পাশা খেলায় রাজ্য হারিয়ে পঞ্চ পাণ্ডব আর দ্রৌপদী বনবাসে
চলেছেন, পাঠক ঠাকুর সেই কাহিনী তার নিজস্ব ভংগিতে বর্ণনা
করে চলেছেন । নগরের লোক মাথা চাপড়ে বিলাপ করছে ;
দুর্দিন ! দুর্দিন! আনাদের অনুষ্টে আর সখ শান্তি নেই । এই অধর্জের
রাজ্য কখনোই টিকতে পারবে না। চারদিকে কি সমস্ত ছুলক্ষণ
দেখা দিয়েছে ! দেখ ন!, দিনের বেলায়ই শিবারা কেমন অশুভ ডাক
ডেকে উঠছে । আস দিশালোকে এমন উক্কাপাত, এ কি দেখেছে
কেউ কখনও!
প্রাসাদকক্ষে গান্ধারী অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝাচ্ছেন, মহারাজ,
আমার মিনতি শুমুন। এখনও ওদের পাঁচ ভাইকে ফিরিয়ে আনুন,
ওদের ইন্দ্রপ্রস্থে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করুন। ওরা তো! বেশী চায় না,
এতেই ওরা সন্ষ্ট থাকবে।
তা আর হয় না, হয় না রানী, ছুর্যোধন এতে কিছুতেই সম্মত
হবে না । সে কারও কথাই মানবে না। ভাল হোক আর মন্দ হোক,
যা হবার হয়ে গেছে । একে আর ফেরানো যাবে না।
কেন যাবে না, নিশ্চয় যাঁবে। ছুধোধন যদি মানতে না চায়, ওকে
বন্দী করে রাখুন । ও তো! পুত্র নয়, কুলের কলঙ্ক। ওর পাপে আমরা
সবাই পাগী। আর সেই পাপে সমস্ত রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
রানী, তুমি কি পাষাণ? বার বার সেই একই কথা বলবে!
পরের পুত্রের জন্য নিজের পুত্রদের বিসজ ন দেব, মা হয়ে এমন কথা!
কেমন করে বলছে! তুমি ?
ইা!, মা হয়েও এ কথা বলতে হয় আমাকে । এ অনাচার ধর্মে
সইবে না। তাই তো যে দিকে তাকাই সেই দিকেই নানা রকম
ছুলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।
রানী, আমি সকল দিক দিয়েই অন্ধ, তুমি যতই দেখাও, আমি
কিছুতেই দেখতে পাব না ।
মহারাজ, ঘরে বাইরে সবাই বলছে, যে রাজ্যের রাজা তার
ভাইদের উপর এমন অধর্ম করে, সে রাজ্যের কল্যাণ নেই ।
রানী, আমি শুধু অন্ধ নই, বধিরও | তুমি যতই শোনাও আমি
কিছুতেই শুনব না । হয় না, হয় না, হয় না, যে পথ দিয়ে এত দূর
এগিয়ে এসেছি, সেই পথই নির্ধারিত পথ। এখন আর ফেরবার
উপায় নেই।
মহারাজ বিগ্রহপালের বিধবা পর্বী রাষ্ট্রকুটনন্দিণী শংখদেবী
মেয়েদের নিদিষ্ট জায়গায় তার মর্যাদা অনুযায়ী আসনে পাথরের
মুক্তির মত নিশ্চল হয়ে বসেছিলেন । পাঠক ঠাকুণ্রে কাহিনীর
দিকে তার মন ততটা নেই, তার কান উচ্চকিত হয়ে আছে তার
কাছাকাছি যে সব মেয়ের আছে তাদের বলাবলির দিকে । কিন্তু
বিদ্রোহ কৈবর্ত ৩
সে কথ বুঝবার উপায় নেই। তার স্থির নি্ষম্প মুখে, তার উদাস
দৃষ্টিতে কৌতৃহলের রেখা মাত্র নেই। তার মুখের দিকে তাকালে
সম্ভ্রম জাগে, আর জাগে সহানুভূতি । কিন্তু সেই সহানুভূতি মুখে
প্রকাশ করবার মত সাহস নেই কারও । লোকমুখে এ কথা! প্রচলিত
হয়ে এসেছে মহারাজ বিগ্রহপাল তার শেষ বয়সে নামেই মাত্র রাজা
ছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে ন| হলেও রাজদণ্ডটা মহারানী শংখদেবীর
হাতে ন্যস্ত ছিল! আজ তার সপত্ী পুত্রের রাজত্বে তার এই ছূর্দশ। ৷
তীর উপযুক্ত পুত্র কুমার রামপাল কারাগারে, আর তিনি নিজেও
প্রাসাদে বন্দী জীবন যাপন করে চলেছেন । মহারাজ দ্বিতীয়
মহীপাল প্রকাশ্যে তাকে রাজমাতার সম্মান দিলেও ভিতরের কথাটা!
জানতে লোকের বাকী নেই। এককালে ধিনি রাজ্যের সবময়ী
কত্রা ছিলেন, এখন তীর স্বাধীন ভাবে চলবার ফিরবার, মন খুলে
কথা বলবার স্থযোগটুকু পর্যন্ত নেই। কিন্তু তার মুখ দেখে তার
সামান্য আভাসটুকুও পাবার যো নেই। কারাগারে বন্দী পুত্রের
কথা মনে করে কেউ কোন দিন তাকে কাদতে দেখে নি। লোকে
আশ্চর্য হয়ে বলাবলি করে, কর্ণাটের মেয়েদের মন যেন লোহা দিয়ে
গড়া । আমাদের গৌড়ের মেয়ে হলে কেঁদে ভাসিয়ে দিত। কথাটা
মিথ্যে নয়, শংখদেবী যেমন কাদতে জানেন না, তেমনি আনন্দে
উচ্ছৃসিত হয়ে উঠতেও জানেন না। তার চলা বল! ভাব ভংগি সব
কিছুই অতি সংযত- নিস্তরংগ প্রশান্ত সমুদ্রের মত | সেই জন্যই
তার মনের ভিতরে প্রবেশ করবার পথ খুঁজে পাওয়। কঠিন।
মহাভারতের কাহিনী শুনতে শুনতে মেয়ের নানা জনে নানা-
রকম কথা বলে চলেছিল । একজন বলছিল, যুবিষ্টির তো! ছুর্যোধনের
বড় ভাই, আর ছুধোধন তার সংগে এমন ব্যবহারট। করল! ছি ছি!
আরও যেন কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আর একজন তাকে বাধা দিয়ে
থামিয়ে দ্রিল, আহ. তুই থামতো! নেকী, যেন কিছুই দেখেন না,
শোনেন না, বোঝেন না, একেবারে ছধে ধোয়। বেলপত্তরটি। ধুশু
৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
হুর্যোইন আর ধুধিষ্টিরই চোখে পড়ল, আর আমাদের দেশে কি চলছে
এখন? এক বাপের তিন ছেলে, তাদের মধ্যেই এই অবস্থা,
ছুর্যোধন আর এমন কি বেশী দোষ করল ? তা বটে, প্রথম কথাটা
স্বীকার করে নিল। এরপর ছজনে গলার স্বরট। একটু নামিয়ে এই
বিষয়ট! নিয়েই বিশ্রস্তীলাপে মেতে গেল ।
শংখদেবীর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন ত্তিনি কোন এক গভীর
চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন । তাকে দেখলে কারও মনেই সন্দেহ জাগতে
পারত না যে তিনি উৎকর্ণ হয়ে তাদের মৃছ্ধ উচ্চারিত কথাগুলো
ধরবার জন্য জাল পেতে বসে আছেন । কোন কোন কথা ধরতে
পারছিলেন, কোন কোন কথ। পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু
বিষয়টা এতই পরিচিত যে সেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শব্দগুলোর সাহায্যেই
তিনি তাদের বক্তব্যট! মোটামুটি বুঝে নিতে পারছিলেন ।
চুপ চুপ চুপ, মহারানী এদিকে আসছেন । সংগে সংগে সমস্ত
গুঞ্জরণ থেমে গেল। সভাসত্যই পট্টরাজমহিষী নন্দ! দেবী তার
নতিস্থলদেহ নিয়ে হেলে ছলে মৃছ্মন্দ গতিন্হ এগিয়ে আসছেন ।
তশীর পেছন পেছন একজন অনুচহী চামর বাজন কবে করতে
আসছে। পাঠক ঠাকুর তখন কুন্টী আর পাগুবদের বিদায় পর করুণ
সরে বর্ণনী করে চলেছেন। কিন্ত নেয়েদ্রে মন দেদিকে নেই,
তাদের সবার দষ্টি আর মন একই দিকে নিবদ্ধ । মুক্ত গবাক্ষের
উচ্ছল আলোক সম্পাতে মহারানীর মহার্ছা বত্বুভূষণ ক্ষ সুটী-
ফলাকার মত ছ্যূতি বিকীর্ণ করছে । মেই তীক্ষ আলোকন্ুচী
চেয়েদের চক্ষু আর হাদয়কে যেন বিদীর্ণ করে চলেছে।
ংখদেবী তর আগমন সম্বন্ধে চেতন ছিলেন কিনা ত। তখর
াব ভংগি দেদে বোঝার উপার ছিল না| নন্দ। দেবী ঘখন সামনে
এসে অবনত হয়ে তকে পারে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন, তখনই
যেন তিনি তাকে প্রথম দেখলেন | প্রণামের উত্তরে মাথায় হাত
দিয়ে তাকে আশীবাদ করে বললেন, কল্যাণ হোক । পেছন পেছন
বিদ্রোহী কৈবর্ত €
একজন ভৃত্য একটি আসন বহন করে নিয়ে এসেছে । পথশ্রমে
ক্লাস্তা নন্দা দেবী সেই আসনে গ। এলিয়ে দিয়ে একটু আরামের
নিঃশ্বাস ছাড়লেন ।
তোমার আর ছুই বোন কোথায়? তারা এল না? প্রশ্ন
করলেন শংখদেবী ।
নন্দ! দেবী উত্তর দিলেন, না, এল না তার! ।
কেন?
বলেছিলাম, কিন্তু ওরা আসতে চাইল না ।
ও | শংখদেবী সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করলেন। তারপর কিছুট!
স্বগতঃ, কিছুটা প্রশ্বের স্থরে বললেন, রাজ্যপাল কোথায়? বহুদিন
তাকে দেখি ন !
রাজ্যপাল ? সে শিকারে গেছে ! তার ফিরতে দেরী হবে।
শিকারে? কিন্ত ফিরতে দেরী হবে কেন? কোথায় গেছে
শিকার করতে ?
কোটাটবীতে।
কোটাটবী! চমকে উঠলেন শংখদেখী, সেকি! সে তো
এখানে নয়, সে তো গোৌড়রাজ্যের প্রত্যন্ত দেশ। এ দেশ থেকে
কেউ কখন সেখানে শিকার করতে যায় ! তুমি বলছ কি নন্দা?
নন্দ দেবী উত্তর দিলেন, শিকারট। উপলক্ষ, আসল কথা দেশটা
দেখবার জন্ত ওর ঝেৌোক চেপেছিল। অনেকদিন ধরেই এই নিয়ে
গীড়াগীড়ি করছিল। ওর মা নিষেধ করেছিল, আমরা সবাই নিষেধ
করেছিলাম, এমন কি মহারাজ স্বয়ং নিজেও। কিন্তু কিছুতেই
মানিয়ে রাখ। গেল না। বিষম জেদ তো, অবিকল ওর বাপের মত।
শেষকালে মহারাজ বাধ্য হয়ে বললেন, কি আর করা যাবে, যাক
তবে। তবে ভয়ের কিছু নেই। একজন বলাধ্যক্ষের অধীনে এক-
দল সৈম্ত তার নিরাপত্তার জন্য তার সংগে দিয়ে দেওয়! হয়েছে।
বিষম জেদ তো, অবিকল ওর বাপের মত, কথাটা মনের মধ্যে
৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
খচ. করে বিধল, কিন্তু কথাটা গায়ে না মেখে শংখদেবী বললেন,
কাজট! ভাল হয়নি নন্দা। তোমরা ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে
দিলে না কেন? ও কোনদিন আমার কোন কথ! অমান্য করে না।
নন্দ দেবী হেসে বললেন, সেদিন আর নেই মা। আপনার
সেই আদরের নাতি কি আর এখনও তেমনি আছে বলে মনে
করেন? এখন সে বড় হয়ে উঠেছে, তার মন এখন বাইরের দিকে ।
আপনার আমারকথ! কি আর এখন তার মনে ধরবে ! কি করবেন,
এই তো! সংসারের নিয়ম ।
শংখদেবী ভ্র-কুঞ্চিত করে কি একটু ভাবলেন, শেষে গলার স্বর
নীচু পর্দায় নামিয়ে এনে বললেন, একটা কথা সত্যি করে বলবে
নন্দ, তোমরা! কি রামপালের মতই €কেও সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন
করে ফেলতে চাও নাকি ?
নন্দ! দেবী যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ছি ছি ছি, এ কি কথা
বলছেন মা! এসব মিছে কথা কে বলেছে আপনাকে ; আমর।
ওর জন্য-__নন্দা দেবী কথার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন । আরও ছু
একট অসংলগ্ন কথা আর অসমাপ্ত বাক্য যোজনার পর অবশেষে
বললেন, আমি এখন যাই তা'হলে।
সে কি, এই মাত্র তে। এলে ! শংখদেবী বিন্ময়ের সুরে বললেন ।
আমার কি আর নিশ্চিন্ত মনে পুণ্য কথ! শুনবার যো আছে!
একটু যদ্দি না থাকি, প্রাসাদের সমস্ত কাজে বিশুংখল! দেখা দেবে।
এইজন্য অনেক কিছু থেকেই আমাকে বঞ্চিত থাকতে হয়।
কথাটা শেষ করেই আর দেরী করলেন না, যে ভাবে এসেছিলেন,
সেই ভাবেই প্রস্ান করলেন । তার পেছনে সেই অনুচরী আগেকার
মতই চামর ব্যঞ্জন করে চলল। -াঁরও পেছনে চলল আসনবাহক
রত্াসন কীধে নিয়ে। সমস্ত মেয়ের! স্থির দষ্টিতে সেই দ্রিকে তাকিয়ে
রইল। মেয়েদের ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বলে উঠল অলঙ্গমী,
সর্বনাশী ! স্বগতোক্তি নর, স্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারিত, সবাই শুনতে পেল।
বিদ্রোহী কৈকর্ত ণ
কে, কে এই ছুঃসাহসিকা, চমকে উঠল সবাই । শংখদেবীর
কৌতুহলী চোখ ছুটি ভিড়ের মধ্যে সন্ধান করে ফিরতে লাগল । কিন্তু
তাকে আর খুঁজে পাওয়। গেল না। কথাটা সম্ভবত স্বগতোক্তি,
মনের চাপ] দেওয়। ঝঝট। কেমন করে হঠাৎ সশব্দে বেরিয়ে গেছে।
কিন্ত বলার সংগে সংগেই সে সামলে নিয়েছে আপনাকে ।
এমন সময় বিছ্যৎ শিখার মত চঞ্চল একটি মেয়ে হঠাৎ কোথেকে
এসে প্রণামের ভংগিতে শংখদেবীর পায়ের উপর পড়ল।
কি রে, কি খবর ? শংখদেবী মৃছু গুঞ্তনে প্রশ্ন করলেন ।
খবর জরুরী ।
তবে যা, বল গিয়ে দ্বিতীয় সংকেত ।
বেশ, বলেই মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
মেয়েরা আবার মন দিয়েছে মহাভারতে । পাচ ভাই আর দ্রৌপদী
বনবাসে যাত্রা! করেছেন । নগর ছেড়ে গ্রামের পথে এসে নেমেছেন
তারা । কিন্ত তাদের পেছন পেছন নগরের লোক দল বেঁধে আসছে।
তার! বলছে, আমরাও যাৰ আপনাদের সংগে । এই অধর্মের দেশে
আমরা কেউ থাকব না। আপনাদের যে গতি আমাদেরও সেই
গতি। যুধিষ্ঠির তাদের অনেক করে বুঝিয়ে বলছেন__ আপনার!
ফিরে যান, যে বার ঘরে ফিরে যান। আমাদের সংগে কোথায়
যাবেন আপনারা ? আমাদের সংগে গেলে অশেষ ছঃখ ভোগ
করতে হবে।
হয় হোক, তার। নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে উত্তর দিল, সাধুসংগে মৃত্যুও
শ্রেয়; । মেয়ের মন দিয়ে এই কাহিনী শুনছিল, কিন্তু হঠাৎ চার-
দিকে একটা কোলাহল উঠল, শংখদেবী অচৈতন্য হয়ে আসন থেকে
মাটিতে পড়ে গিয়েছেন । কি হোল, কি হৌল-_সবাই উত্তেজিত,
সবাই চঞ্চল, চারদিকে ডাক হাক পড়ে গেল-_-ক্ হোল? কি
হোল?
এই ছুঃসংবাদ শুনে পাঠক ঠাকুর সেদ্িনকার মত পাঠ বন্ধ করে
৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
উঠে গেলেন । রাজভ্ত্যদের নির্দেশে দোলাবাহকেরা! শংখদেবীকে
দোলায় চাপিয়ে তখর নিজের কক্ষে বয়ে নিয়ে গেল। সেই সংগে
একজন লোক ছুটল রাজবৈদ্যের সন্ধানে ।
কিছুক্ষণ সেবা] শুশ্রুার পর শংখদেবী একটু যেন সংজ্ঞা ফিরে
পেলেন । কক্ষমধ্যে অনেক লোক জড় হয়েছিল, স্বয়ং মহ রানীও
ছিলেন। নানা জনে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন । কিন্তু
শংখদেবী ঘাদের কোন কথার উত্ধর দিত পারলেন না, নির্বোধের
মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন
কি মা, কিছু বলন? নন্দাদেবী ঝুঁকে পড়ে মুখের কাছে
মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলেন ।
শংখদেবীর মুখ থেকে একট! অক্ফুট কাতরোক্তি বেরিয়ে গেল।
সংগে সংগে তর সবাংশ থর থর করেকেপে উঠল। তাঃপর
আবার তীর চোখ ছুটি বু্ধে গেল, সমস্ত শণীর নিস্পন্দ স্থর, এক
জন প্রাচীনা বলে উঠ'লন, মাথায় জল দাও । আর এখন কেউ
কোন কথা বোলো না।
একটু বাদে আবার তিনি চোখ যেললেন। রাজন্গৈও ঠিক
এই সময় কক্ষমধ্য প্রবেশ করলেন ।
এ কি ঘরের মাধ্য এত লেক কেন? রাজবৈদ্ভ ঘরে ঢুকেই
টঞ্ কণ্ঠে প্রশ্ব করলেন প্রশ্ন নয়, যেন প্রচণ্ড একটা ধমক।
রাজবৈদ্ধের উগ্র মেজাজের কথা কারও কাছেই অজান। নয়। সবাই
ব্যস্ত হযে এক একে বেধিয়ে যেতে লাগল, ব'কী রঃল শুধু তিন-
জন। রাজবৈগ্ভ এবার তাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এই
দির অর্থ নুস্পষ্ট। ছুজন তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
থাকাটা প্রয়োজন ।
নন্দ| দে ী মিন্তির স্থরে বললেন, আমি থাকি?
কোন প্রয়েজন নেই, রাজবৈগ্ধ কঠিন কঞ্ছে বলে উঠলেন ।
রাজকীয় মর্যাদায় অ'ঘ'ত লাগলেও নন্দ। দেবী সেটাকে হজম করে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৯
নিয়ে নিঃশবে বেরিয়ে গেলেন। যেদাসী রোগিণীর মাথার ধারে
বসে বাতাস করহিলঃ সে তার শিজের কাজ করে চলল । মহারানীর
এই ছুরবস্থা দেখে সে ভারী খুশী, ভিতরে ভিতরে হাসছিল। রাজ-
বৈগ্ভ রোগিণীর নাড়ী ধরে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন । শেষে
মাথ: তুলে দ'সীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, গরম জল নিয়ে
এস, জলটা যেন ফুটন্ত গরম হয়।
দ্রাসী উভয় সংকটে পড়ল। মহা"শনী য'বার আগে ইংগতে
জানিয়ে গেছেন, সে যেন এ কক্ষ ছেড়ে আর কোথাও ন। যায়।
নির্দেশের তাৎপর্ধ কি, সেটা তার ভাল করেই জান! আছে । এ
অবস্থায় কি করা উচিত বুঝতে না পেরে সে নিঃশব্দে যা করছিল,
তাই করতে লাগল ।
তুমি কি কানে কঘ শোন নাকি? রাজবৈদ্য ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গর্জন
করে উঠলেন।
দাসীর আর যাই দোষ থাক না কেন. শ্রবণ শক্তির দোষ যে
নেই সে কথাটা সংগে সংগেই প্রমাণিত হয়ে গেল। এই যে শিযে
আসছি, বলতে বলতে সে যেন পালিয়ে বাচল:
দাসী চলে যেতেই রাজবৈগ্ঠ হরিগুপ্ত খোলা দরজাটার সামনে
গিয়ে বাইরে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলেন, না, কেউ নেই,
কোথাও । আশ্বস্ত ইয়ে শয্যাপার্থ্বে ফিরে এসে নীচুম্বরে ডাকলেন,
রাঁজমাতা, চোখ খুলুন
শংখদেবী এই ভাকটুকুর জম্থীই অপেক্ষা করিলেন । এশার
চোখ মেলে একটু মৃছ হাসি হেসে বললেন, কি জরুরী সংবাদ নিয়ে
এসেছেন বলুন ।
হ্যা সংবাদ আছে--কতগুলো ছঃসংবাদ। কিন্তু আমি জানি,
যত বড় ছঃসংবাদই হোক ন। কেন, তাই শুনে আপ'ন হতবৃদ্ধি হয়ে
পড়বেন, তেমন ধাতু দিয়ে বিধাতা আপনাকে গড়েন নি ।
এরা কতটুকু সময় দেবে বুঝতে পারছি না। আমি সংক্ষেপে
১০ বিদ্রোহী কৈবতত
বলছি, আপনি শুনে নিন। প্রথমত বামপালকে কারাগার থেকে
বার করে নিয়ে আসার জন্য যে প্রচেষ্টা চলছিল, এক জন প্রহরীর
অসতর্কতার ফলে সেই কথাটা ওদের কানে পেটছে গেছে ।
বলেন কি! মথনকে ওরা এর মধ্য জড়িয়ে ফেলতে পারেনি
তো?
না, সে দিক দিয়ে একটুর জন্য বেঁচে গেছি আমরা । যে ছুজন
প্রহরী এ ব্যাপারে সংশ্রিষ্ট ছিল, শেষ মুহূর্তে ওদের ছুজনক্ে সরিয়ে
ফেল! গেছে । কাজেই আর কারও নাম প্রকাশ হবার আশংক।
নেই। তবে ওরা ভীষণভাবে সজাগ হয়ে গেছে । ওদের তো ভয়
পাবার কথাই। সামন্তদের মধ্যে অনেকেই ভিতরে ভিশুরে রাজার
বিরুদ্ধে । কিন্ত প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণ। করবার মত সাহস কারও
নেই। আমাদের লোক গিয়েছিল তাদের কাছে, কিন্তু তারা এক
পা এগোয় তে। ছু পা পেছোয়। তবে এ কথা ঠিক, আজ যদি
রামপাল বাইরে থাকত এদের মধো অধিকাংশই তার সংগে যোগ
দিত। একটুকুর জন্য কি স্থযোগট।ই যে হারালাম আমর! !
কতগুলে। ছুঃসংবাদর আছে বলেছিলেন, একটা মাত্র বললেন,
আর কি কি আছে বলে ফেলুন এক এক করে । আমার মূনের ধাতু
তো! জানাই আছে আপনার, তবে আর এত ইতস্তত করছেন কেন?
হ্যা বলছি, একটু অপেক্ষা করুন। বৈদ্ঠ হরিগুপ্ত আবার খোলা।
দরজাটার কাছে গিয়ে উকি মেরে দেখে এসে বললেন, মই পরি-
কল্গনাট। প্রকাশ পাধার পর থেকে রামপালকে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা!
হয়েছে ।
শৃংখলাবদ্ধ? শংখদেবী কথাট। টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন,
পরে নিজের মনে মনে বললেন, তা তে! হবেই । এর ফলে কত
কিছু ঘটবে, কে বলতে পারে! হ্থ্যা বলুন, তারপর ?
আজ ওর! রাজ্যপালকে এক দল সৈন্যের সংগে রাজধানী থেকে
কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছে ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১১
শংখ দেবী বললেন, সে কি আজই মাত্র গেছে? তবে ষে
শুনলাম কোটবটবীতে নাকি শিকারে ন! ভ্রমণে গেছে-_-
হরিগুপ্ত উত্তর দ্রিলেন, এই কথাই ওর প্রচার করেছে বটে ।
আমরা কিন্তু এ কথা বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করি না। আমাদের
মনে হয় রাজধানীর বাইরে কোথাও তাকে আটক করে
রাখবে ।
ংখদেবী' তাঁর কথার সমর্থন করে বললেন, আমারও কতকটা
সেই রকমই মনে হয়েছিল ।
আরেক কথা, আজই অ'র এক জন ধরা পড়েছে ওদের হাতে ।
সেও রামপালের মতই কারাগারে বন্দী হয়ে আছে।
কে,কে সে? এইবার তার স্বাভাবিক ধেধ হারিয়ে উত্তেজিত
কঞ্ে বলে উঠলেন শংখদেবী।
হরিগুপ্ত হেসে বললেন, এত উৎকন্ঠিত হবেন না। ওর] কারা-
গারে পাঠিয়েছে শূরপালকে ।
শংখদেবী বিশ্মিত কে প্রশ্ন করলেন, শুরপালকে ? কিন্তু কেন?
ওরা সন্দেহ করছে, সেও এই বড়ষন্ত্রের সংগে জড়িত আছেশ। আবার
এও হতে পারে এই উপলক্ষে মহারাজ তার ভবিষ্যৎ পথ-কণ্টককে
দুর করবার চেষ্টা করছেন। কিছুই অসম্ভব নয়।
হ্যা, কিছুই অসম্ভব নয়, প্রতিধ্বনির মতই বলে উঠলেন শংখ-
দেবী । কিন্তু আমি ভাবছি এ অবস্থায় রামপাল আর রাজ্যপালের
প্রাণের আশংকা নেই তে। 1
হরিগুপ্ত একটু চিন্তা করে বললেন, এ আশংকা একেবারেই নেই,
এমন কথা জোর করে না বলতে পারলেও একটা কথা বলতে
পারি, রাজা এদের গায়ে হাত দিতে সত্যসতাই ভয় পান। তর
ভয় দেশের প্রজার! এতে ক্ষেপে উঠতে পারে । অমাত্য বরাহস্বামী
রামপালের মৃত্যুদণ্ডের জন্য গীড়াপীড়ি করছেন কিন্তু রাঁজাকে
কিছুতেই সম্মত করাতে পারেন নি।
১২ বিদ্রোহী ঠৈবর্ত
দুরে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল, কে যেন দ্রুত পদে চলে
আসছে । দুজনে একই সংগে সেই শব্দ শুনতে পেয়ে সচকিত হয়ে
উঠলেন। হরিগুপ্ত বললে-, রাজমাতা, এই মুহুর্তে আবার অটৈতন্য
হয়ে যান শংখদেবী বৈগ্ের নির্দেশ ঘথোচিত ভাবে পালন
করলেন । হবিগুপ্ত হাতের নাড়ী ধরে নিবিষ্ট চিত্তে বসে রইলেন ।
তশর কপালে উদ্বেগ ও ছুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে।
আর এক জন দাসী এসে ঘরে ঢুকল । বৈদ্ধের উদ্বিগ্ন মুখের
দিকে তাকিয়ে "স শংকিত কণ্ে প্রশ্ন করল, কেমন বৃঝছেন 1
হবিগুপ্ত হতাশার ভংগিতে মাথ। ছুলিয়ে বললেন, না, রকমট।
বিশেষ ভাল ঠেকছে না । ঘন ঘন মুছণ হচ্ছে কিনা । কিন্তু যাকে
গরম জল নিয়ে আসতে বলেছিলাম সে কোথায় গেল?
দাসী উত্তর দিল, জল গরম করা হচ্ছে । হয়ে এল বলে, এক্ষুনি
নিয়ে আসবে । মহারানী আমাকে পাঠিয়ে দিলেন, যা তুই শিয়রে
বসে বাতাস কর গিয়ে * ভাল হয়েছে, এসেছ । যাও তো মা লক্ষ্মী
দৌড়ে গিয়ে একমুঠো সরষে নিয়ে এসো । যাবে আর আসবে,
দেরী করব না।
দাসী আদেশ পেয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। শংখদেবী চোখ
মেলে তাকালেন । হরিগুপ্ত একটা চিঠি বার করে শংখদেবীর হাতে
দিয়ে বললেন, এই নিন মথনদেবের চিঠি । তিনি এর উত্তর চেয়ে
পাঠিয়েছেন । আপনার বিচার বুদ্ধির উপর তার অসীম নির্ভরতা ।
আজ রাত্রির মধ্যেই এর একটা উত্তর লিখে রাখবেন । আপনি কিন্তু
শয্যা ছেড়ে উঠবেন না। মনে রাখবেন আপনার জীবন সংশয়
ব্যাধি। আমি কাল সকালে আবার আপনাকে দেখতে আসব।
তখন উত্তর নিয়ে যাব।
শংখদেবী প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, এর কি আপনাকে মনে মনে
সন্দেহ করে?
না, আমি কারও সন্দেহের পাত্র নই । ক্ষ্যাপাটে আর বদমেজাজী
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৩
লোক বলে আমার খ্যাতি আছে। সেই খ্যাতিই আমাকে বর্মের
মত রক্ষা করছে।
শংখদেবী বললেন, তাই যদ্দি হবে, তা হলে আজ ওর!
আপনাকে এমন করে আগলে রাখতে চাইছে কেন ? নন্দার তো
ঘর ছেড়ে যাবার ইচ্ছ। একেবারেই ছিল না। আমি চোখ বুজে
থাকলেও ওর মুখের ভাবটা স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম । সে নিশ্চয়ই
আসার অশ্রস্থতাঁর জন্য দুর্ভাবনায় নয়। আমার স্বাভাবিক মৃত্যু
হলে ওরা তো হাফ ছেড়ে বাচত। বলতে গেলে আপনি ওকে বল
প্রয়োগ করে ঘর থেকে বার করে দিলেন । আপনার উপরে
সন্দেহ যদি নাই থাকবে, তবে এমন করে আপনাকে পাহারা
দেবে কেন?
একটু ভুল করলেন, হরিগুপ্ত হেসে বললেন, আমাকে নয়, এরা
পাহারা দিচ্ছে আপনাকে । এরা ভয় করছে, পাছে আপনি প্রশ্ন
করে বাইরের খবরাখবর জেনে নেন।
শংখদেবী একটু ভেবে বললেন, কে জানে হয়তে৷ আপনার
কথাই ঠিক। হঠাৎ একট! কথা মনে করে তার মুখের ভাব বদল
গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন, কিন্তু একটা কথা বলুন, আপনি
ক্ষ্যাপাটে আর বদমেজাজী মানুষ এটাই কি সত্য কথা ?
সত্যি কথা বই কি, নগরশুদ্ধ সবাই তাই বলে । ন। হলে তার!
বলবে কেন ?
তা বলুক, কিন্তু অ'মার বিশ্বীস হয় না। আমি এতদিন ধরে
দেখে আসছি আপনাকে, কিন্ত কই কোনদিন তো আপনার ক্ষ্যাপাটে
স্বভাবের পরিচয় পাইনি! আর কোনদিন ঘে মেজাজ দেখিয়েছেন
আমাকে সে কথাও তে। মনে পড়ে না। বরঞ্চ _
হরিগুপ্ত সপ্রশ্ন দর্ঠিতে তার মুখের দিকে তাকালেন ।
শংখদেবী তার কথা শেষ করলেন, আপনার কাছ থেকে চিরদিন
সহানুভূতি আর সুমিষ্ট ব্যবহীরই পেয়ে আসছি।
১৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
হরিগুপ্ত একটু সময় চুপ থেকে তারপর বললেন, আপনি
রাজমাতা, পৃজনীয়া।
ক্ষ্যাপাটে লোকেরও তা৷ হলে পাত্রীপাত্রের বিচার বিবেচনা
থাকে?
শংখদেবীর লঘু পরিহাস দীমা তরল কণঠস্বরে হরিণের বিশ্বয়ের
অবধি রইল না। সংকটের পর সংকটে যাঁর জীবন ক্ষতবিক্ষত, সে
কেমন করে এমন অবিচলিত থাকে। মনে হয়, কিছুই যেন তার
গায়ে লেগে থাকে না। দ্রত গায়ের শব্ধ শোনা যাচ্ছে। বোধ
হয় দাসী সরষে নিয়ে ছুটে আসছে।
ছুই
কিছুর মধ্যে কিছু না, হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন ? আশ্চর্য
কথা তো! প্রথম অমাত্য বরাহস্বামী মন্তব্য করলেন। রাজা
মহীপাল বললেন। আশ্চর্যের কি আছে এতে ? কিছুদিন থেকে এ
রকম তো মাঝে মাঝেই হয়ে আসছে । রাজবৈদ্ভ বলছেন, এ এক
কঠিন ছুরারোগ্য ব্যাধি । একদিন এই রোগেই হয়তো তার প্রাণান্ত
ঘটবে ।
বরাহস্বামী অধৈধের স্বরে বলে উঠলেন, এই কথা তে। সেই
কবে থেকেই শুনে আসছি । কিন্তু কই, তার লক্ষণ তো দেখছি না
কিছুই । শুধু তাকে একবার স্বচক্ষে দেখবার জন্যই একদিন মহাভারত
পাঠ শুনতে গিয়েছিলাম । একটুকুর জন্য দর্শনের সৌভাগ্যও
হয়েছিল। দেখলাম স্বাস্থ্য তো বেশ ভালই আছে, কোন দিক
দিয়ে কোন বিকৃতি লক্ষ্য করতে পারলাম না। সেই শ্বেত পাথরের
গড়া অক্ষয় অটুট মৃত্তি, সেই অনম্থুকরণীয় কথার ভংগি, সেই অমায়িক
হাসি, কিছুই যেন পরিবর্তন হয়নি । আজ থেকে বিশ বছর আগে
যেমনটি দেখেছিলাম, এখনও অবিকল তাই । দেখে মনে হয় যেন
মন্ত্রসিদ্ধা। এই বয়সে শুধু দেহের গঠনই নয়, প্রভাত চন্দ্রিমার শেষ
লাবণ্য রেখাটুকু এখনও আকড়ে ধরে আছেন। আর এই মায়ার
জাল ছড়িয়েই তিনি আপনার কার্ধ সিদ্ধি করে আপছেন। অদ্ভূত-_
এমনটি আর দেখিনি |
প্রথম অমাত্য বরাহস্বামী, মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক পকল্মনাভ, মহাঁ-
প্রতিহার কীতিবর্া আর রাজা! এই চার জন রাষ্ট্রের গৃঢ় বিষয় নিয়ে
১৬ বিজ্রোহী কৈবত
পরামর্শ করছিলেন। শংখদেবীর অন্তুস্থতার কথাটা প্রথমেই উঠে
পড়ল। আর কথাট৷ তুললেন বরাহস্বামী নিজেই। কিন্তু আর
সবার সামনেই যে ভাবে তিনি তার রূপের ও রূপের মায়াজালের
উল্লেখ করে বক্রোক্তি করলেন, তাতে রাজ্যের মর্ধাদীয় একটু বাধল।
হোক প্রতিপক্ষ, কিন্তু তার মাতৃস্থানীয়া৷ তো। বটে
বরাহস্বামী রাজার মুখের ভাবে তার মনোভাবটা বুঝতে
পারলেন । কথাটা এ ভাবে না বললেও চলত । কিন্তু তখর এই
অমাত্য জীবনে শংখদেবীর সংগে প্রতিযোগিতায় বন্ধবার তকে
হটে যেতে হয়েছে, অনেক রকমে নাকাল হতে হয়েছে, সে সব কথা
তিনি কেমন করে ভূলে যাবেন ! শংখদেবী প্রথর বুদ্ধিশালিনী এ
কথা তিনি সব সময়ই স্বীকার করেন । কিন্তু বুদ্ধিবলই কি তার
একমাত্র বল? লীলাময়ী নারীর নার্টিতে হাসিতে লীলাভংগিতে যে
প্রচণ্ড যাছর শক্তি পুরুষ বরাহস্বামীর পক্ষে তা আয়ন্তের
বাইরে। এ যেন সশস্ত্রের সংগে নিরস্ত্বের অ-সম যুদ্ধ। সে জন্য
অনেক আক্রোশ তার মনের মধ্যে জমে আছে । আর তাই তার
সম্পর্কে কোন কথা বলতে গেলেই তার কথাগুলো তীর্যক রূপ
ধারণ করতে চায়।
বরাহস্বামীর কথায় একট অপ্রসন্ন বোধ করলেও রাজাকে মনো-
ক্ষোভট। মনে মনেই হজম করে নিতে হয়। বরাহস্বামীর মুখের উপর
কোন কঠিন কথ! বলবার মহ সাহস হার নেই। এটা তিনি ভাল
করেই বোঝেন যে ভিনি খর প্রথন অনাত্যের কাছে নানা দিক
দিয়েই বাধ। | আর এ বাঁধন দিনের পর দিন দঢ় থেকে দ্ঠুতর হচ্ছে ।
রাজকর্মচারীরা ও সৈম্ বিভাগ ভর প্রতি অনুগন্ত সে বিষয়ে সন্দেহ
নেই, কিন্তু তাদের মূল আনুগত্য প্রথম অমান্যের সংগে । প্রথম
অমাত্য রাজার পক্ষ থেকে ভূক্তির শাসনকর্তা, বিষয়পতি, মণ্ডলপতি,
ও বীথিপতিদের প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করেন । তা ছাড়া মহা
সান্ধিবিগ্রহিকের মাধ্যমে তিনি সামস্তরাজদের সংগে যোগাযোগ রক্ষা
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৭
করে চলেন | ফলে বলতে গেলে সমস্ত শক্তি একটি লোকের হাঁতে
কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে । কোন কারণে প্রথম অমাত্যের সংগে সংঘর্ষ
ঘটলে রাজার পায়ের তলায় দাড়াবার মত মাটি থাকবে না।
সহোদর ভাই শুরপালকে কারাগারে পাঠাবার ইচ্ছা রাজার একে-
বারেই ছিল না । আপন্তিও করেছিলেন প্রথমে। কিন্তু বরাহস্বা মীর
প্রবল ইচ্ছ'র কাছে শেষ পর্যন্ত তকে মাথা নোয়াতেই হোল । তিনি
বেশ বুঝতে পারছেন, বরাহস্বামীর মতের বিরুদ্ধতা করতে গেলে
সর্কক্ষেত্রেই এইরকম পরিণতি ঘটবে । কিন্তু বুঝলেও এর কোন
প্রতিকার নেই। তবে একটা কথা, বর'হস্বামী সত্য সত্যই তার
মংগলাকাজ্ষী। তার রাজ্যপ্রাপ্তি থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত
সে কথার সত্যতা বহুবার প্রমাণিত হয়ছে ।
সে জন্য প্রায় সব ব্যাপারেই তশীকে তার মতেই মত দিয়ে
চলতে হয়। তিনি যথাসম্ভব মতানৈক্যট। এড়িয়ে চলতে চান ।
তবে তিনি আজ একট্ুমনঃক্ষুপ্ণ হয়েই বললেন, আপনি কি বলতে
চান তিনি অশ্ুস্থতীর ভাণ করছেন? রাজ্বৈদ্ক হরিগুপ্ত বলছেন,
তখর অবস্থা আশংকাজনক । তাঁর কথা তো উডিয়ে দিতে
পারবেন না ।
বরাহামী একবার রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার
পর বললেন, না, ঠিক ত1 আমি বলছি নী। তবে ছুটে ব্যাপার
এমন সংগে সংগে ঘটল যে এটাকে আকস্মিক মনে করে নিশ্ন্ত
হওয়া যায় না। আগের দিন বিকেলবেলা রামপালকে শৃংখলিত
করে রাখবার নির্দেশ দেওয়া হোল। পরদিন সকালবেলা শুরপালকে
কারাগারে পাঠানো হোল, আর স্থানান্তরিত করা হোল রাজ্য-
পালকে । আর ঠিক সেদিনই বিকেলবেলা মহাভারত পাঠ শুনতে
শুনতে উনি মুছিতা হয়ে পড়লেন । অথচ তার আগে তাঁর কোন
+কম অন্থস্থতার লক্ষণ দেখ যাঁয় নি, আপনারাই এ কথা বলছেন ।
এটাকে কাকতালীয় বাঁপার বলে উড়িয়ে দেওয়৷ যায় কি ? আমার
বি
১৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বিশ্বীস, যে কোন ভাবেই হোক, সমস্ত সংবাদগুলো ওঁর কানে
এসেছে । যড়মন্ত্রটা প্রকাশ হয়ে পড়ায় উনি হয়তো! মনে করেছেন,
ওদের ভিতরকার গোপন কথা সব কিছুই ফাস হয়ে গেছে । এই
উত্তেজনা ও আত্তংকের ফলেই হয়তো এমন ঘন ঘন মৃছণ হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের বৃদ্ধির বহরটা এখনও ওঁর কাছে ধরা পড়েনি। উনি
তো জানেন না, এই ষড়যন্ত্রে আসল বাপারট। সম্পর্কে আমরা
এনও সম্পূর্ণ অন্ধকারে ।
সম্পূর্ণ অন্ধকারে ? এ কথা আপনি কেন বলছেন ? মহাপ্রতীহার
কীন্তিবর্মা মৃছুত্বরে প্রতিবাদ জানালেন । আমাদের সতর্কতার ফলে»
রামপালদেবের এই ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়ে পড়েছে আমাদের
গুপ্তচরেরা এ বাপারে খুবই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে, সে বিষয়ে
কোনই সন্দেহ নেই ।
বরাহস্বামী ন্ট স্বরে বললেন, না, এই ষড়যন্ত্রের আসল স্বরূপট!
এখনও প্রকাশিত হয়নি। রামপালকে শুংখলিত করা হয়েছে,
ঠিকই করা হয়েছে শিস্ত মূল ষড়যন্ত্রকারী সে নয়। যড়যন্ত্র করা
হয়েছে বাইরে থেকে । আমর! সন্দেহক্রমে শুরপাল আর রাজ্য-
পালকে াটক করেছি বটে, কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে তাদের কি
ভূমিকা ছিল তা আমরা এখনও জানি না । এমনও হতে পারে এবং
এটা হওয়া খুবই সম্ভব যে বাইরের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও স্থুস্থ
শরীরে নিজ নিজ জায়গায় বসে পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্ততি
চালাচ্ছে ।
রাজ। ব্লালেন, আপনি একটু বেশী ভয় করছেন । আমার তো!
মনে হয়, বাইরে যদি আর কেউ কেউ থেকেও থাকে, তবে তারা
এখন প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত । এরপর আর শীগগির কেউ মাথা
তুলতে সাহম পাবে না।
এ বিষয়ে আমি কিন্তু আপনাদের মত অতট1 নিশ্চিন্ত হতে
পারছি না।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৯
বরাহম্বামী মন্তব্য করলেন। পরে মহাপ্রতীহার কীতিবন্নাকে
উদ্দেশ করে প্রশ্ন করলেন, পলাতক প্রহরী ছুটে! ধরা পড়েছে ?
কীতিব£1 মুখ কাঢু মাচ করে বললেন, না, ওদের পাওয়!
যায় নি।
এখনও পাওয়া! বায় নি। আজ তিন দিন হয়ে গেল, আর কবে
পাওয়া যাবে? অথচ যখন বড়মন্ত্রটার কথ। জানা গেল, তখনও ওরা
নগরেই উপস্থিত ছিল। ছিল কিনা?
কীন্তিবর্ণা একটু থতমত খেয়ে বললেন, ছিল বলেই হে৷
শুনেছিলাম ।
ছিল বলেই শুনেছিলেন £ বরাহস্বামীর কণ্ে ব্যংগের স্থুর ফুটে
উঠল। এইত আপনার লোকদের কাজের ধারা । একটু আগেই
এদের কৃতিত্বের কথা খুব ফলাও করে বলছিলেন ন। ? ভাল কথা,
পলাতক প্রহরীদের পরিবার পরিজনদের আটক করা হয়েছে তো ?
ওদের উপর ভাল মত চাপ দিলে কিছু কিছু গোপন কথা বেরিয়ে
পড়তেও পারে।
কীন্তিবর্মী এ কথার কোন উত্তর দিলেন ন। |
কই, কিছু বলছেন না যে?
পড়া না শেখা ছাত্রের মত মুখখানা কীচুমাচু করে কীব্তিবর্মা
বললেন, ওদের দুজনের কারও বাড়ীতেই কোন লোক নেই, সবাই
পালিয়েছে ।
অপদার্থ যত সব! বরাহস্বামী গর্জন করে উঠলেন, আপনাদের
চোখের সমুখ দিয়ে পালিয়ে গেল. আপনারা সব চোখ বুজে ছিলেন ?
কীতিবমা আত্মপক্ষ সমর্থন করবার জন্য বললেন, আমর ওদের
আটক করবার জন্য দার্ডিকদের পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু একটু দেরী
হয়ে গিয়েছিল, আর সেই ফাকে_
এ ভাবে সময় হারিয়ে পাঠাবার মানে কি? ওর কি আপনার
প্রেরিত দাপ্ডিকদের অভ্যর্থনা করবার জন্য বসে থাকবে? মেয়ে
২০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মানুষ, ছেলে পিলে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে সরে পড়া এত সহজ কথ নয়।
বলতে গেলে আগনারাই ওদের স্বযোগ করে দিয়েছেন। তা
ছাড়৷ তারা' যে এই নগরের মধ্যেই আপনার, চোখে ধুলো দিয়ে
কোথাও ডুব মেরে নেই, এমন কথাই বা কে জোর করে বলতে
পারে!
মহাপ্রতীহারের দূরবস্থা দেখে রাজ তাকে সাহায্য করতে
এগিয়ে এলেন-_ন1 না, এত সাহস কি ওদের হবে ?
বরাহস্বামী বললেন, যোগ্যতা যাদের আছে, সাহসই বা থাকবে
না কেন? দেখছেন না, ওদের হাতের কাজ কি রকম পাকা ? যেই
মুহুর্তে আমরা ষড়যন্ত্রটা টের পেয়েছি, তখনই কথাটা! ওদের কানে
পৌছে গেছে, আর সংগে সংগে ওরা ওদের থা করণীয়, নিখুত
ভাবেই সম্পন্ন করেছে । আমাদের বহু ভাগ্য, একটুর জন্য রক্ষা
পেয়ে গেছি আমরা । কিন্ত সেজন্য আমাদের কিছুমাত্র কৃতিত্ব নেই।
মূর্খ প্রহরীটা বদি তার স্ত্রীর কাছে এ নিয়ে গল্প না করত অথবা ওর
স্ত্রী পেটের কথা পেটেই চেপে রাখতে পার, ত1 হলে ওদের এই
যড়যন্ত্র নিশ্চয়ই সফল হোত । আর রামপাল যদি কোনমতে বেরিয়ে
আসতে পারত, তাহলে অবস্থাট1 কি দাড়াত ভেবে দেখেছেন এক-
বার? এ রাজ্যে তাকে সাহায্য করবার লোকের অভাব নেই । তা
ছাড়! সামন্তদের মধ্যে অনেকে তার সংগে ভিড়ে যেত ।
না না, এ কথা ঠিক. নয়, মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক পদ্মনাভ আপত্তি
জানিয়ে বললেন, আমি ওদের সব খবরই পেয়ে থাকি। সামস্তদের
মধ্যে প্রায় বাই আমাদের পক্ষে । কেউ কেউ অবশ্য নিরপেক্ষ কিন্তু
আমাদের প্রতিপক্ষের মংগে কেউ যোগ দিতেন না।
বরাহস্বামী স্থির দর্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর
ধীরে ধীরে বললেন, তুমি বুঝি তাই মনে কর? আমার ধারণা, তা
নয়। শুনেছি সমন্ত রাজ্যগুলিতে ্ [নর পক্ষে গোপন প্রচার
কার্ধ চলেছে। মুক্ত হপ্ডে অর্টছইটীকি ছল হচ্ছে। এই
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২১
সংবাদের কিছুটা হয়তো অতিরঞ্রিত হতে পারে, কিন্তু সবটাই মিথ্যে
নয়। আর এমনই অপদার্থ আমরা, আমাদের বুকের উপর বসে ওরা
এই সমস্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এদিকে আমরা পরম নিশ্চিন্তে
বর্সে আছি।
আক্রমণের লক্ষ্য বস্তটা কে মহাপ্রতীহারের সে কথা বুঝতে
বাকি ছিল না। তবু এই প্রসংগে কোন কথা না বলাই তিনি শ্রেয়
মনে করলেন।
কিন্তু তিনি চুপ করে থাকতে চাইলেও বরাহস্বামী তাঁতে বাদ
সাধলেন। প্রশ্ন করলেন, মথনদেবের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা!
হচ্ছে তো ?
কীতিবর্ী বললেন, হ্যা গত তিন মান ধরে নিয়মিতভাবে পালা
করে করে তার ওখানে লৌক নিয়োগ করা হচ্ছে।
তাদের কাছ থেকে কি খবর পাচ্ছেন ?
না, তার সম্বন্ধে সন্দেহ অমূলক | তিনি ধর্মপ্রণ শান্ত্রজ্ঞ লোক,
শীস্ত্রর্ঠা নিয়েই মেতে থাকেন। বাড়ীতে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত
আছে, সারাদিন পূজো চলছে। নগরের বহু লোক এখানে গৃজো
দিতে আসে।
হু” তা তো আসলেই । কিন্তু কারা কারা আসে !
অত কি আর বলা বায়! জাগ্রত দেবতা কিনা, বহু লোকই
পৃজে। দিতে আসে ।
বরাহস্বামী মুখবিকৃতি করে বললেন, এই আপনার খবর? কিন্তু
এর জন্য আর লোক নিয়োগ করবার প্রয়োজনট1 কি? নগরের যে
কোন লৌকই তো এই খবরটা রাখে। আপনার লোকেরা কি
সেখানে শুধু লৌকের মেল! দেখতেই যায়?
কীন্তিবর্ষী মাথা চুলকোতে লাগলেন ।
মথনদেবের পুত্র কাহু,রদেব কি করছেন ?
তিনি স্থল-বাণিজ্য করেন ।
২২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তা তো করেন, কিন্তু আর কি করেন ? তার পিছনে লোক রাখা
হয়েছে তো? শুনতে পাই তাকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামস্ত রাজা-
গুলিতে দেখা যায়।
কীন্তিবর্মী বললেন, হ্যা সে কথা ঠিক । তিনি বাণিজা ব্যপর্দেশেই
সে সব অঞ্চলে যাতায়াত করে থাকেন ।
সামস্তরাক্তদের সংগে তার দেখা শোন হয়?
তা হয় বই কি। বাণিজ্যে গেলে প্রথমেই রাজসভায উপ-
টৌকনাদি দিয়ে অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়, এটাই তো সাধারণ
রীতি ।
তা বটে। মথনদেবের ভ্রাতুপ্পুত্র শিবরাজদেবের খবর কি ?
তিনি সম্প্রতি কর্ণীটে গেছেন ।
কর্ণটে, কেন?
ভ্রমণ উদ্দেশ্যে । কর্ণীট যে তার পূর্বপুরুষের দেশ ।
মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক প্রশ্ন করলেন, আপনার কি এ'দেক উপর
সন্দেহ আছে নাকি?
'বরাহস্বামী পালট! প্রশ্ন করলেন, কেন, তোমার নেই ?
মহাসান্ধিবিগ্রহিক প্রশ্নের ভংগি শুনে বুঝলেন, এ ক্ষেত্রে সন্দেহ
না থাকাটা! অযোগ্যতার পরিচায়ক । তাই আপনাকে শুধরে নিয়ে
বললেন, হ্যা, তা-তা সন্দেহ তো একটু থাকতেই পারে ।
বরাহস্বামী বললেন, কর্ণীটরাজ্য থেকে আগত সমস্ত লোকের
উপরেই আমার সন্দেহ ।
আমি তাদের কাউকে বাদ দিতে পারি না। তা ছাড়া আমার
দঢ বিশ্বাস শংখদেবী সমস্য কিছুর সংগে জড়িত আছেন।
রাজ! প্রতিবাদ করে বললেন, আপনার এই ধারণা আমি
কিছুতেই দূর করতে পারলাম না। স্বীকার করি তিনি খুবই
বুদ্ধিমতী, কিন্তু বাইরের সংগে কোন রকম যোগাযোগ করবার
স্থযোগ তার নেই। সত্য কথা বলতে গেলে তিনি প্রাসাদের মধ্যে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৩
বন্দিনী অবস্থায় আছেন। বাইরের কোন লোক তার সংগে একা
দেখা করতে পারে না। অষ্টপ্রহর তার পেছনে লোক রয়েছে ।
মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক পল্পনাভ বললেন, একে স্ত্রীলোক তাতে বৃদ্ধ,
কিইবা তিনি করতে পারেন ! তার জন্য এত ভাবছেন কেন ?
বরাহস্বামী হেসে বললেন, তুমি নবাগত, পুরানে৷ দিনের অনেক
কথাত তোমার জান! নেই। তা হলে এমন কথা কখনোই বলতে
না। স্ত্রীলোক বলে একে সামান্য মনে কোরে! না। স্বগীয় মহা-
রাজের শেষ জীবনে ইনিই ছিলেন গৌড়ের সবাধিনায়িকা । সেদিন
পদে পদে তার সংগে শক্তির পরীক্ষা হয়েছে আমাদের। অনেক ক্ষেত্রে
হঠতেও হয়েছে আমাকে, এ কথ। অস্বীকার করতে পারব ন|।
পল্মানাভ আশ্ত হয়ে বললেন, বলেন কি?
বরাহস্বামী বললেন, চেদীরাজছুহিতা যৌবনগ্রী দেবী যখন
মহাঁরানী হয়ে এলেন, আমরাও তখন সেই সংগেইএসে ছিলাম। স্বগীয়
মহারাজের অনুগ্রহে চেদী থেকে আগত আমদের মধ্যে অনেকেই
রাজ্যের উচ্চ উচ্চ পদে অধিষিত হয়েছিলেন । রাজমাতা যৌবনশ্্রী
চিরদিনই রুগ্না ছিলেন । শেষ পধন্ত রোগে ভূগে ভূগেই শডিনি মারা
যান । কিন্ত তিনি মার! যাবার কিছুদিন আগে রাষ্ট্রকুটনন্দিনী শংখ-
দেবী এমে এই রাজসংসারের হাল ধরলেন । শুধু মাত্র ধরা নয়,
মুষ্টিগত করে বসলেন। তারই ফলে এক এক কুরে চেদী থেকে আগত
উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পতন ঘটতে লাগল, আর রাষ্ট্রকুটবংশীয়
লোকের! সেই সমস্ত স্থান অধিকার করে বসছিল। একমাত্র বাকী
রইলাম আমি-__হংস মধ্যে বকো যথা । সে এক কঠিন সংকটের
দিন। দিন দিনই আমার হাতের সুঠৌ আলগা! হয়ে আসছিল।
স্বর্গীয় মহারাজ শেষ দিকে বেশ কিছুদিন শব্যাশায়ী ছিলেন । তখন
শংখদেবীকে অতিক্রম করে তার কাছে পৌছানে। সহজ ছিল না ।
সেই ছুর্দিনে চেদী থেকে আমরা যারা এসেছিলাঘ তাদের প্রভাব
প্রতিপত্তি স্বযোগ সুবিধা সব কিছুই সংকুচিত হয়ে আসছিল । শংখ-
২৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
দেবী সুষ্ঠু পরিকল্পন। নিয়ে কাজ করে চলেছিলেন। সমস্তই দেখতে
পারছিলাম, বুঝতে পারছিলাম, কিন্ত প্রথম অমাত্য হয়েও আমার
হস্তক্ষেপ করবার কোন ক্ষমতা ছিল না। মহারাজ, আপনার মনে
আছে তে। সে সব দিনের কথা ?
আছে বই কি, রাজা সমর্থন সৃচক ভংগিতে মাথ! নাড়লেন ।
শংখদেবী মহারাজের পরিবর্তে তখ4 নিজের ছেলে রামপাল-
দেবকে সিংহাসনে -বসাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন । কিন্তু
স্বর্গীয় মহারাজ রাজকুলের চিরাচরিত প্রথা ভংগ করতে সম্মত হন
নি। তখন আমাদের মহারাজাকে বিশ্ব প্রয়োগে হত্যা করবার
চেষ্টাও হয়েছে ।
বলেন কি! কীতিবর্মা ও পদ্মনাভ ছজনেই চমকে উঠলেন,
কই এমন কথা তো আমরা কোন দিন শুনিনি ।
রাজা আপৰ্তি জানিয়ে বললেন, না ন।, এ কথাটা নিশ্চিত করে
বলা যায় না। রাজবৈগ্ হরিগুপ্ত বলেছিলেন আমার বিস্ৃচিক৷
হয়েছিল ।
বেগের চোখে সবটাই কি ধরা পড়ে? বরাহস্বামী অর্থপূর্ণ হাসি
হাসলেন । তারপর তার আগেকার কথাটার জের টেনে তিনি
বলে চললেন-__আমাদের মহারাজ সিংহাসনে বসবার পর থেকে
আমরা আমাদের পুরাতন পদ ও প্রতিষ্ঠা আবার ফিরে পেয়েছি ।
কিন্ত শংখদেবী আর ব্পমপালদেবের উচ্চাশার মূল এখনও উৎ-
পাটিত হয়নি, দৃষ্টির আড়ালে তা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে ।
ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রকুটবংশীয়ের! নিস্তেজ হয়ে পড়লেও নিশ্চেষ্ট নয়।
শংখদেবীকে আমার মত এমন করে কেউ চেনে না। এ বিষয়ে আমি
নিঃসংশয় যে, দ্তিনি যেখানেই থাকুন বা যে ভাবেই থাকুন না কেন,
তার প্রতিভ। কখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারে না ।
পদ্মনাভ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, এত সব কথা৷ তো! জানতাম ন|।
হ্যাঃ তোমরা! পরে এসেছ, সেইজন্য তোমাদের অনেক কথাই
বি্রোহী কৈবর্ত ২৫
জানা নেই। কিন্তু তোমাদের এগুলি জেনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন ।
তা না হলে অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারবেনা ।
পদ্মানাভ প্রশ্ন করলেন, রাষ্ট্রকুটবংশীয়দের সম্বন্ধে এই যদি
আপনার ধারণ! তাহলে মথনদেব এখনও বাইরে কেন?
মহাপ্রতীহার কীন্তিবর্া নিষ্প্রভ হয়ে বসেছিলেন । অনেকক্ষণ
ধরে কোন কথা বলবার স্থযোগ পাননি । ত্শীর মনে হচ্ছিল এতক্ষণ
নিঃশব্দ হয়ে থাঁকাট। তার পক্ষে ঠিক শোভা পাচ্ছে না। তাই তিনি
ফস্ করে বলে উঠলেন, আমিও সেই কথাই বলি।
না, আপনি সে কথা! বলেন না, ব্রাহস্বামী সংগে সংগেই বলে
উঠলেন, একট আগেই আপনি বলেছেন, মথনদেবের সম্বন্ধে সন্দেহ
অমূলক, তিনি ধর্মপ্রাণ শাস্ত্রজ্ঞ লোক, তিনি শীস্ত্রর্চা নিয়েই মেতে
থাকেন ।
ক্রোধে অপমানে কীগ্তিবর্শার মনটা রিরি করে উঠল । কিন্তু
মনের ক্রোধ মনেই হজম করে নিতে হয়। বরাহস্বামীর এই কথার
সত্যিই তো কোন উত্তর নেই।
রাজা বললেন, না সেটা ঠিক হবে না। মথনদেব ব্লগরের
হিন্্রদের মধো বিশেষ জনপ্রিয় । তার গায়ে হাত পড়লে তার
প্রতিক্রিয়াট খুবই খারাপ হবে ।
বরাহস্বামী এ বিষয়ে রাজার সংগে একমত | -তিনি বললেন, সে
কথ] সত্যি । কিন্তু একমাত্র এটাই কথ। নয়, আরও কথা আছে। এই
বযন্ত্র সুদূরপ্রসারী, আর আমার বিশ্বাস মথনদেবের ভবন এর কেন্দ্র-
স্থল । কিন্ত সবই আমাদের অনুমান, তারই উপর নির্ভর করে আমর!
অন্ধকারে হাড়ে মরছ্ি | বিশেষভাবে সেই জন্যই মথনদেবকে বাইরে
রাখবার প্রয়োজন রয়েছে । তার মধ্য দিয়েই ওদের কাধকলাপ আর
স্তুগুলির অনুসরন করবার সুযোগ পাওয়া যাবে । কিন্তু আমাদের
গুপ্ত পুরুষদের মাথায় যদি আর একটু পদার্থ থাকত! আমি
দেখছি, এরাই আমাদের প্রতিপক্ষের সব চেয়ে বড় সহায় হয়ে
২৬ বিধ্রোহী কৈবর্ত
দাড়িয়েছে । এদের পেছনে অর্থব্যয় করা আর ভন্মে ঘি ঢালা
একই কথা ।
কীন্ডিবর্মা ব্যর্থ উত্তেজনায় ওষ্ঠ দংশন করলেন ।
রাজা মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক পদ্ুনাভের দিকে তাকিয়ে বললেন,
আপনার কি একটা বক্তব্য আছে বলছিলেন, সেটা বলুন এবার |
পদ্পুনাভ তার বক্তব্যট। উপস্থিত করলেন £
সমস্তাটা গুরুত্বপূর্ণ । আমি বার বার আপনাদের জানিয়েছি,
কিন্ত আপনারা এদিকে তেমন ?ষ্ি দিচ্ছেন না। আমি বরেন্দ্রভূমির
কৈবর্তদের কথা বলছি। ওর! চঞ্চল হয়ে উঠেছে, সেধান থেকে যে
সমস্ত সংবাদ আসছে সেগুলো ভাল নয়। এখানে ওখানে একটা
না! একটা গোলমাল লেগেই আছে । আমা.দর প্রতিপক্ষ যদি
ওদের এই অসন্তোষটাকে তদের কাজে লাগায় তাতে আশ্চধ হবার
কিছু নেই।
বরাহস্বামী ভ্রকুঞ্চিত করে বললেন, কেন, কৈবর্তদের কি হোল
আবার ?
পদানাভ উত্তর দিলেন, না নতুন কিছু হয়নি । বহু দিনের
অসস্ভোষ চাপ] পড়া আগুনের মত্ত ধিকি ধিকি করে জ্বলছে । হঠাৎ
মাঝে মাঝে অগ্নিশিখার রূপ নিয়ে ফেটে বেরিয়ে আসে । আমার
মনে হয় এ ব্যাপারে আমাদের রাজপুরুষদের দায়িত্বও কম নয় ।
তাদের আরও একট্র বিবেচনা করে কাজ করা উচিত ।
কিসের জন্য এই অসন্তোষ? কি চায় ওরা? রাজ! প্রশ্ন
করলেন ।
অভিযোগ এদের একটা নয়, তনেক। প্রথমত ওরা বলে,
ওদের কাছ থেকে যে ভূম্কির সংগ্রহ করা হয় তা নাকি অবৈধ ।
অবৈধ ? ভার মানে ? রাজার ভূদিতে বাস করবে, আর রাজাকে
কর দেবে না। এটা আবার কোন বিধি? ওদের কাছ থেকে কি
অত্যধিক পরিমাণ ভূমিকর সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ফী
অথবা রাজ পুরুষেরা কি অন্যায় ভাবে অতিরিক্ত শন্তের জন্য
চাপ দেন ?
না, তা] নয়। অন্য সব অঞ্চলে যেই ব্যবস্থা এখানেও তাই
উৎপন্ন শস্তের ছ' ভাগের এক ভাগ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ।
এ ছাড়া আর কোন রকম কর দেয় এরা ?
না, এদের উপর আর কোন কর ধার্ধ করা হয় নি।
রাজা আশ্চর্ধ হয়ে বললেন, তবে তো অন্ঠান্ত প্রজাদের চেয়েও
এরা স্থধে আছে। এরা কি যে বলতে চায়, আমি বুঝতে পারছি
না। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন।
পদ্মনাভ বললেন, ব্যাপারট। সম্পর্কে আমার নিজের মনেও
একটু খটকা আছে। আমি যে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পেরেছি, এমন
কথা আমিও বলতে পারি নাঁ। তবে ওরা! যেটা বলে থাকে তা
বলছি। ওরা বলে, ভূমি ওদের নিজস্ব সম্পত্তি, ওর! জন্ম সৃত্রে
তাকে ভোগ করে আসছে । তার উপর রাজার কোন অধিকার
নেই।
রাজার অধিকার নেই ! রাজা এমন অদ্ভুত কথা তাঁর জীবনে
কখনও শোনেন নি।
ওর! বলে, বহুকাল যুদ্ধ বিগ্রহের পরম ভট্টারক মহারাজ ধর্ম
পালদেবের সংগে ওদের নাকি একটা সন্ধি হয়-_
সন্ধি?
হ্যা, সন্ধি! সেই সন্ধিতে এই শর্ত ছিল, ওদের ভূমির উপর রাজা!
হাত দেবে না। তবে বিদেশী শক্তির সংগে যুদ্ধবিগ্রহ ঘটলে ওরা
সৈম্ত যোগাতে বাধ্য থাকবে। এ ছাড়া লেন-দেন এর ব্যাপারে
রাজার সংগে আর কোন সম্পর্ক থাকবে না ওদের। সেইজন্যই
ওর] বলে, ওদের কাছ থেকে যে ভূমি-কর সংগ্রহ করা হয়ে থাকে,
তা বৈধ নয়।
বরাহস্বামী এতক্ষন কোন কথা বলেন নি, এবার তিনি মুখ
২৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
খুললেন, এই শর্ত সম্বলিত কোন লিখিত পত্র তাদের কাছে আছে?
আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম তাদের, পন্নাভ বললেন, কিন্তু
তারা বলে, আমরা অশিক্ষিত মূখ মানুষ, ও সব লেখালেখির ধার
ধারি না । আমরা যুগ যুগ ধরে এই মুখের কথা দিয়েই কাজ চালিয়ে
এসেছি, কোন দিন কোন গোলমাল হয় নি। এই লেখালেখি
চুকিয়েই যত অনর্থের স্থষ্টি করেছ তোমরা । মানুষ মুখ দিয়েই কথা
বলে, তাই মুখের কথাই সব চেয়ে বড় কথা ।
বরাহস্বামী বললেন, তা হলে যে যা বলবে, তাই মেনে নিতে
হবে নাকি? ওদের মত মূখের মুখেই এ কথা সাজে । কিন্তু
তোমার বক্তব্যটা কি? ওদের কাছ থেকে ভূমি-কর সংগ্রহ বন্ধ করে
দিতে হবে ?
না না, তা বলছি না আমি । আপনি আমার কথাট। ঠিক বুঝতে
পারছেন না।
তবে সেখানকার রাজপুরুষদের এ ব্যাপারে দাঁী করছ কেন
তুমি ? তাদের ঘা কর্তব্য তাই তো তারা করছেন ।
পদ্ান্গভ এ কথার প্রতিবাদ করতে পারলেন না, কিন্তু নিঃশ্ব্ে
মেনেও নিত পারলেন না । বললেন, তাদের ব্যবহার বড় বেশী বঢ,
এমন কি আমি বিশ্বস্ত সত্রে জেনেছি সময় সময় কর সংগ্রহের জন্ত
কঠিন ভাঁবে শারীরিক নির্ধযাতনও কর! হয়ে থাকে ।
বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, ভাল হোক আর মন্দ হোক, এটাই
স্বাভাবিক রীতি । কর কেউ ইচ্ছা করে দিতে চায় না। তাই সব
সময় হাসিমুখে মিষ্টি কথা বলে কর সংগ্রহ করা যায় না। ইক্ষুর রস
নিষ্ষাশন করতে হলে প্রবল চাঁপ দিতে হয়, এও ঠিক তাই। কর
সংগ্রাহক কোন দিনই কর দাতার কাছে প্রিয় হতে পারে না।
কথাট। মহাপ্রতীহার কীক্ষিবর্নার মনে ধরল। তিনি বলে
উঠলেন, ঠিক বলেছেন ছোট লোকগুলোকে সব সময় শাসনের উপর
রাখতে হয়, কখনও প্রশ্রয় দিতে নেই। একটু প্রশ্রয় দিয়েছেন
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৯
'কি মাথায় উঠে বসবে। রাজ্যের শাস্তি সমৃদ্ধি রক্ষা করে চলতে
হলে দণ্ডকে সব সময় সন্ক্রিয় রাখতে হয় ।
মহাপ্রতীহার এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। সেই মুহুর্তের জন্য তিনি
প্রথম অমাত্যের সংগে একাত্মতা অনুভব করলেন ।
রাজ। জিজ্ঞাস! করলেন, ওদের কি এই কথাই, না৷ আরও কোন
কিছু বক্তব্য আছে?
পদ্গানীভ উত্তর দিলেন, হী, আরও আছে। গোলযোগগুলো
বিশেষ করে ঘটছে তাই নিয়েই । সেই কথাই বলছি। অনেকদিন
থেকে ওদের মাঝখানে কিছু কিছু বাইরের লোক এনে বসানো হচ্ছে।
বাইরের লোক মানে? রাজা প্রশ্ন করলেন।
বাইরের লোক মানে আমীদের এখানকার ব্রাহ্মণ, বৈশ্য প্রভৃতি
জাতির লোকেরা ওদের অঞ্চলগুলিতে গিয়ে বসবাস করতে শুরু
করেছে।
রাজা বললেন, এতে যে ওদেরই লাভ এটুকু বুঝবার মত বুদ্ধিও
কি ওদের নেই? ওরা অশিক্ষিত ধর্মাধর্মজ্ঞানবজিত- এদের
সাহচর্ষে ওরা শিক্ষার আলোক পাবে, প্রকৃত ধর্মের সংস্পর্শ লাভ
করবে, স্থনীতি ও সদাচারে অভ্যন্ত হবে-এক কথায় বলতে গেলে
অর্ধ-পশুর পর্যায় থেকে মানুষের পর্যায়ে উঠবে, এ তো ওদের বনু
ভাগ্যের কথা । এ আমরা সব সময়ই অনুমোদন করে আসছি,
করবও।
বরাহস্বামী পদ্পনাভের মুখের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে হেসে
বললেন, কিন্তু তোমার মুখের ভাবে মনে হচ্ছে, তুমি যেন এটা
ঠিক অন্থমোদন করতে পারছ না । তোমার বক্তব্যটা কি, বলেই
ফেল না।
পল্পনাভের কণস্বর এবার একটু গন্তীর হয়ে এল | তিনি বললেন,
তা হলে হয় তে। আপনাদের মতই বলতাম । আপনাদের কথার
কোনই সত্যতা নেই, এমন কথাও আমি 'বলি না। কিন্তু এরা তো
৩০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
এদের বসবাসের ভূমি সংগে করে নিয়ে যান না, ওখানে গিয়ে ওদের
ভূমি অধিকার করে বসেন। সমস্তা দেখা দেয় তখনই ।
রাজা বললেন, অ পনার কথাটা বুঝলাম । কিন্তু ভূমি তো এরা
বলপুর্বক অধিকার করেন না, রাঁজপুরুষদের সংগে ব্যবস্থা! করেই
করেন ।
পদ্দুনাভ তিক্ত হাসি হেসে বললেন, কিন্তু এই ছুর্ভাগাদদের কি
সান্তনা তাতে? যে-ভূমির উপর এদ্রে একান্ত নির্ভর, তার অংশ
যদি এ ভাবে হাত-ছাড়া হয়ে যায়, তবে ওরা কি খেয়ে বাঁচবে?
কিন্তু এইখানেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কেউ যে মিথ্যা কথ!
বলতে পারে, পরকে প্রবঞ্চন করে ছলে বলে কৌশলে নিজের কার্য-
সিদ্ধ করে নিতে পারে, এ সমস্ত কথা ওরা আগে কল্পনাও করতে
পারত না। এখন ক্রমশই এ বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠছে। কিন্তু
ওদের বাছা! বাছা! ভূমিখওগুলো৷ কেমন করে নবাগতদের হাতে চলে
যায়, এ রঃস্ত ওরা আজও বুঝতে পারে না। ওরা ওদের সমাজের
পঞ্চায়েতের কাছে গিয়ে এ সব জানায়। পঞ্চায়েত তাদের পক্ষ
হয়ে রাজপুরুষদের কাছে অভিযোগ করে, কিন্ত তাতে কোনদিনই
কোন ফল হয় না।
বরাহম্বামী প্রথমে ধৈর্য ধরে শুনছিলেন, কিন্ত শেবে তার ধের্ষের
বাধ ভেংগে পড়ল। একটু তণ্ত শ্বরেই তিনি বলে উঠলেন, তুমি
কি ওদের মুখপাত্ হয়ে কথা বলন্তে এসেছ নাকি 1
বরাহস্বামীকে সবাই সমীহ করে কথা বলে। এমন কি স্বয়ং
রাজা পর্যন্ত । তার অগ্রীতিভাজন হলে পতন অব্শ্যস্ভাবী, এ কথা৷
সবাই জানে । কিন্তু পঞ্মনাভের কি ঘে হয়েছে আজ, বহু দিনের
সঞ্চিত কথাগুলি চেপে রাখতে পারছেন না, বাধা ঠেলে বেরিয়ে
আসছে । তিনি সংযত স্বরে বললেন, না, আমি কারও মুখপাত্র
নই। ছোট বড় সকলের স্বার্থ রক্ষা করা রাজার কাজ। সেইজন্তই
নিজের চোখে আমি যা দেখেছি, সেই কথাটাই আমি জানাতে চাই,
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩১
অবশ্য যদি আপনি আদেশ করেন। বলে তিনি অনুমতি প্রার্থী হয়ে
রাজার মুখের দিকে তাকালেন ।
রাজা অনুমতি দিলেন, বেশ তো, বলুন না ।
পদ্মনাভ বলে চললেন £
বছর তিনেক আগে বরেন্দ্রীর অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য
কতকগ্চলি অঞ্চলে গিয়েছিলাম । দেশ দেখবার জন্যই গিয়েছিলাম
কিন্ত তার চেয়েও বেণী মানুষ দেখতে । জানি না কেন, এই কৈবর্ত
জাতির লোকগুলি আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। যেমন
ছেলেরা, তেমনি মেয়েরা । এমন মানুধ আমি আর কোনদিন
দেখিনি । যে অঞ্চলে গিয়েছিলাম সেখানকার রাঁজপুরুষেরা আমাকে
পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করেছিল । কথাট1 রটে গেল। ওরা মনে
করল, আমি খুব বড় দরের লোক, আমার কাছে ছঃখ জানালে হয়
তো! তার প্রতিকার হতে পারে।
ওরা টেনে নিরে যেত আমাকে ওদের মোড়লদের কাছে । তাদের
কাছে অনেক কথাই শুনতার্ম। একবার একজনের সংগে দেখা
হয়েছিল পাঁচ বছর আগেও যার দশ কুলাবাপ পরিমাণ ভূমি ছিল।
কিন্ত তখন তার এক কনাও বাকী নেই। বহিরাগত এক গ্বশ্য
পরিবার কলে-কৌশলে তার সমস্ত ভূমি গ্রাস করে নিয়েছে । আর
সেই অভাগ। এখন সেই বৈশ্বোর কাছেই দাস্বৃত্তি করছে । সে, তার
বৌ, আর তার ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের সেই ক্ষেতেই কাজ
করছে, আর ফসল উঠছে সেই বৈশ্যের ঘরে। খোঁজ নিয়ে
জানলাম, শুধু সে-ই নয়, তার মত আরও অনেকে এইভাবে জমি
হারিয়ে নি-স্ব হতে চলেছে ।
রাজপুরুষদের কাছে কথাটা বলতেই তারা সোজা অস্বীকার করে
বসল। বলল, সমস্তই বাটাদের বানানে! কথা। ভূমি সংগ্রহের
ব্যাপারগুলি সম্পুর্ণ বৈধভাবেই সম্পাদিত হয়েছে, এর মধ্যে কেউ
কোন ফাক বার করতে পারবে না। তারপর যেখানে সেখানে যার
৩২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তার কাছে যাই বলে তারা আমাকে বেশ একটু গঞ্জনাও দ্রিল। পরে
শুনেছি তারা! আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পাঠিয়েছিল যে আমি
নাকি তাদের কর্তব্য কর্মে বাধা স্থষ্টি করেছি । প্রথম অমাত্য নিশ্চয়ই
তাদের সেই অভিযোগ সম্পর্কে অবগত আছেন ।
বরাহস্বীমী বললেন, হ্যা, সেই অভিযোগ পত্র আমি নিজে
দেখেছি । এ বিষয়ে অনুসন্ধানও করিয়েছিলাম । তাতে দেখলাম
ব্যাপারট! নিতাস্তই সামান্ত, তাই এই নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করতে
চাইলাম না।
করলেই কিন্ত ভাল হোত, পদ্মুনাভ মন্তব্য করলেন, তার ফলে
আমার ভাগ্যে যা-ই হোক ন। কেন, এর মধ্য দ্রিয়ে অনেক গোপন
রহস্ বেরিয়ে আসতে পারত ।
বরাহস্বামী বললেন, তুমি কি মনে কর ওখানে কি ঘটছে না
ঘটছে, আমরা তার কোন খবরই রাখি না? কিন্তু ভাল মন্দ সব
জায়গাতেই আছে। কোথায় নেই? আর তুমিই বা ওর যা
বলেছে সমস্তই সত্য বলে মনে করে নিয়েছ কেন? এ তোমার
কোন দেশী বিচার ?
গ্দ্ূনাভ বললেন্ব, ওরা তো মিথ্যে কথ। বলতে জানে না।
বরাহস্বামী হো হো করে হেসে উঠলেন, সত্য ঘুগ সারা পৃথিবী
থেকে সরে গেছে, শুধু ওই জায়গাটাতেই বুঝি এখনও আটকে
আছে?
তার সংগে পাল্লা দিয়ে কান্তিবর্মাও হাসলেন ।
রাজ। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি আরও কিছু বলার
আছে ?
পদ্দনাভ বললেন, হা, আরও একট্র বলার আছে। এবার কিছু-
দিন আগে ওখানে গিয়েছিলাম । নন্ভুন একট! পরিবর্তন দেখে
এলাম । সেই শান্ত শিষ্ঠ সরল সাদাসিধে মানুষগ্তলি কেমন যেন
মারমুখো হয়ে উঠেছে । এট! নিয়ে ওটা নিয়ে এখানে ওখানে প্রায়ই
বিদ্রোহী কেবর্ত ৩৩
হাংগাম! বাধছে। নিজের চোখে একটা ঘটনা দেখেছিলাম । ওরা
দল বেঁধে এক ব্রাহ্মণের বাঁড়ী পুড়িয়ে ছাই করে দিল ।
কীন্তিবর্মী গর্জে উঠলেন, কি, এত বড় সাহস! তারপর--
তারপর কি হোল?
তারপর কি যে হয়েছিল, তা বলতে পারব না। তার পরেই
আমি চলে এলাম কি না।
বরাহস্বামী বললেন, এর পরে কি হয়েছিল, সে কথা আমার কাছ
থেকে শুনে নিতে পাঁর। ওই গ্রীমটার মধ্যে ওদের যতগুলি বাড়ী
ছিল, সবগুলি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছিল ।
পদ্মনাভ চমকে উঠে বললেন, এা !
আর গ্রামের সমস্ত বয়স্ক পুরুষদের প্রকাশ্ট রাস্তায় দাড় করিয়ে
কশাঘাত করা হয়েছিল ।
বলেন কি? পছুনাভ মাথার হাত দিলেন, কার আদেশে দোষী
নির্ধে(ষ নিধিশেষে এই দও দেয়! হয়েছিল ?
সেখানকার রাজপুরুষরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।
দগ্ডুদানের পর তারা এই সংবাদটা! আমাদের জানান | -*৪আমরা
তাদের এই উপযুক্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রশংস। করে পাঠিয়েছিলাম | এ
সমস্ত ক্ষেত্রে নির্দয়ভাবে দণ্ডদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়, বাতে
এই পথে আর কেউ ভুলেও যেন পা! ন! বাড়ায় ।.
ঠিক ঠিক, কীন্তিবর্ন। সমর্থন জানালেন, কোন অবস্থাতেই এর
প্রশ্রয় দেয়। চলে না।
বরাহস্বামী বললেন, তুমি বলছ ওর! শাস্তশিষ্ট মানুষ! ওদের
মুখের দিকে তাকালে প্রথমে তাই মনে হয় বটে, কিন্ত ওদের ভিতরটা
এর, বিপরীত । সময় বিশেষে ওরা বাঘ আর সাপের মতই দুর্দান্ত
আর হিংস্র হয়ে ওঠে । উপযুক্ত ওষুধ না পড়লে শান্ত হয় না।
স্বর্গীয় মহারাজের আমলে একবার বিষম ক্ষেপে উঠেছিল । তারপর
বখন উপযুক্ত ওষুধ প্রড়ল, তখন সব ঠাণ্ডা । অনেকদিন হয়ে গেছে
৩৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কিনা, ওরা বোধ হয় সে কথাটা ভুলে এসেছে । আর একবার
ভাল করে সে কথাটা! মনে করিয়ে দেয়। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ।
ব্রাহস্বামীর কথা! শুনে পদ্মনাভ বুঝলেন, এতক্ষণ ধরে বৃথাই
তিনি এ সমস্ত কথ। বলে চলেছেন । বরেন্দ্রীর অবস্থা সম্বন্ধে এরা
হয়তো তার চেয়েও ভাল করেই জানেন। আর জমস্ত জেনে
শুনেও দমননীতি চালাতে চান। এ অবস্থায় এ সম্পর্কে কোন কিছু
বলতে যাওয়া পওশ্রম মাত্র । তবু তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, কিন্ত
এই কি তার উপযুক্ত সময় 1 আপনি নিজেই তো বলছিলেন, আমরা
এমনিতেই কঠিন সংকটের মধ্যে আছি।
ই্যা, বলছিলাম । আর সেই জন্যই যেটা অবশ্য করণীয় ত।
অবিলম্থে করে ফেলা প্রয়েজন। নইলে শেষে হয়তো আর করার মত
সময় থাকবে না । কিছুদিন ধরে বরেন্দ্রী থেকে নানারকম অশান্তি
আর গোলযোগের সংবাদ আসছে । এদের মধ্যে কিছু কিছু লোক
নাকি মাত্রা ছাড়িয্বে বেড়ে উঠেছে । এত বাড়া ভাল নয়। ব্যাধি
আয়ন্তের বাইরে চলে যাবার আগেই ওষুধ প্রয়োগ করা কর্তবা ।
ঠিরু কথা, ঠিক কথা, কীন্ভিবর্ম৷ আন্তরিক সমর্থন জানালেন।
পল্পানাভ রাজার মুখের দিকে তাকালেন, কিন্তু তার মনোভাব
কিছুই বুঝতে পারলেন না । তবে মনোভাব বাই থাক না কেন,
শেষ পর্যন্ত তাকে প্রথম অমাত্যের মতেই মত দিয়ে চলতে হবে,
সভাসদদের মধ্যে এ কথা সবাই জানেন । পদ্নাভের কাছেও এ
কথাটা অজানা নয় ।
তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন, মহারাজের কাছে আমাব
একট! প্রার্থনা । বরেন্দ্রীর দায়িত্ব থেকে আমাকে অব্যাহতি দিলে
আমার পক্ষে ভাল হয়।
রাজা একটু আশ্চর্ধ হয়ে বললেন, সে কি, আপনি তে। কখনোই
কর্ম কাতর নন, তবে অব্যাহতি চাইছেন কেন? আপনি কি
আমাদের কোন কথায় মন:ক্ষুক্ন হয়েছেন ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩৫
না, না মনঃক্ষুন্ন নয়। আর কাজ যতই গুরুভার হোক না কেন
সেজন্য আমি ভয় পাই না, তাও ঠিক । কিন্তু কথা তা নয়। আসল
কথ। আমার মনে হয় ওখানকার কাজের পক্ষে আমি একা স্তভাবে
অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় । ওখানকার রাজপুরুষদের ব্যবহারে
মনে হয়, তারাও মনে মনে সেইরকম ধারণাই পোষণ করেন । তাদের
কথায় বুঝতে পারি তারা প্রতি বিষয়ে এমন কি অতি খুঁটিনাটি
ব্যাপারেও এখান থেকে বিস্তীরিত নির্দেশ পেয়ে থাকেন । অথচ আমি
তার বিন্দু বিসর্গ জানি না। সময় সময় এমনও হয় যে এখান থেকে
যে সমস্ত নির্দেশ যায় তার সংগে আমার কথার সংগতি থাকে না।
এট] খুবই অন্থুবিধাজনক-_সেখানে নিযুক্ত রাজপুরুষদের পক্ষেও বটে,
আমার পক্ষেও বটে। তারা আমাকে কিছুটা বাহুল্য বলেই হয়তে।
মনে করেন। তাদের পক্ষে এ রকম মনে করাটা! খুবই স্বাভাবিক ।
রাজ। বরাহস্বামীর মুখের দিকে তাঁকালেন। বরাহস্বামীকে
চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, তোমার অস্তুবিধাটা বুঝতে পারছি। আচ্ছা,
পরে এ বিষয়ে তোমার সংগে কথা বলব ।
তা বলবেন। কিন্তু আমার একট! প্রশ্ন বরেন্দ্রী কি আমাদের
প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল?
রাজ। বললেন, নিশ্চয় । এতদিন বাদে এমন একট! প্রশ্ন কেন ?
পদ্দন।ভ কথাট। মাটিতে পড়তে ন। দিয়েই সংগে সংগে বলে
উঠলেন, বেশ কথা, তাই যদি হবে তা হলে মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক
হিসাবে বরেন্দ্রীর দায়িত্ব আমার উপর পড়বে কেন?
বরাহস্পামী আপত্তি জানিয়ে উঠলেন, না না, ঠিক তা নয়।
এই বরেন্দ্রী অঞ্চলে ছোট ছোট সামন্ত উপসামন্ত প্রভৃতি আছে।
তাই যদি হবে, তবে বরেন্দ্রী মণ্ডল এখানকার রাজপুরুষেরা
নিযুক্ত আছেন কেন?
আব সামস্তদের প্রজাদের কাজ থেকে তারাই বা কোন নিয়মে
কর সংগ্রহ করেন?
৩৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কথাটার যৌক্তিকতা আছে সন্দেহ নেই। বরাহস্বামী সংগে
সংগেই কথাটার উত্তর দিতে পারলেন না। একটু ভেবে নিয়ে
বললেন, বরেন্দ্রী অঞ্চল সম্পর্কে এ এক বিশেষ ব্যবস্থা । এই ব্যবস্থা
দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে:
কিন্ত বরেন্দ্রী সম্পর্কে এই বিশেষ ব্যবস্থা কেন ?
এই প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা! করার মত সময় পাওয় গেল ন। ।
একজন পরিচারক দ্রুতপদে এসে সংবাদ দিল কর্ণস্বর্ণ থেকে
একজন দৃতক মহাসান্ধিবিগ্রহিকের দর্শনাকাংক্ষী
কোথায় আছেন তিনি? পদ্মনাভ ব্যগ্র কণ্ে প্রশ্ন করলেন।
পরিচারক উত্তর দিল, তিনি রাজঅতিধিশালায় আছেন ।
রাজার কাছে বিদ।য় প্রার্থনা করে পদ্মনাভ চলে গেলেন ।
বরাহস্বামী চিন্তিত দষ্টিতে তার গতিশীল মৃন্তিটির দিকে তাকিয়ে
রইলেন।
রাজাও সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলেন । পদ্দনাভ দৃষ্টির মাড়াল
হতেই বললেন, মহাঁপান্ধিবিগ্রহিকের মনটা ঝড়ই কোমল-_
রাজাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কীতিবর্মা বলে উঠলেন,
হ্যা, একেবা'র কাদা-কাদা, এমন লোককে দিয়ে এ সব কাজ-_
কিন্ত কথাটা আর শেষ করা হোল না, বরাহস্বামীর চোখের দিকে
ত্বাকিয়ে তিনি মাবঝপথেই থেমে গেলেন।
বরাহস্বামী বললেন, এমন নিষ্ঠাসম্পন্ন কাজের লেক ছুল ভ।
অদ্ভুত তার কাজের শুংখলা | তেমনি তার ব্যবহার । এই ক'বছরের
মধ্যেই দেশের লোক ও বাইরের রাজন্য বর্গের কাছে অত্যন্ত
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ।
কীতিবর্ণী বললেন, ঠিক কথ! : এ রকম লোক-_
এবারও তিনি তার কথা শেব করতে পারলেন না বরাহ্বামীর
চোখ ছুটি আরও বেশী অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে ।
কীন্তিবর্ণা এ জিনিসট কিছুতেই বুঝচ্ছে পারেন না, তিনি যাই
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩৭
বলতে যান, বরাহস্বামীর কাছে সেটাই যেন অসস্তোষের কারণ হয়ে
ঈাড়ায়। বরাহস্বামীর কথার প্রতিবাদ করে দেখেছেন বরাহস্বামী
অল্লেতেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন আবার তখকে সমর্থন করতে গেলে
আরও যেন অগ্নিশম? হয়ে যান। একটানা চুপ করে বসে থাকা!
সেটাই বা কেমন দেখায়? এই সব কারণ অনেক দিন থেকেই
বরাহস্ব'মীর বিরুদ্ধে তার ভিতরে ভিতরে বিক্ষোভ সঞ্চিত হয়ে
উঠছিল । কিন্তু বিক্ষোভের মাত্র যত বেশীই হোক না কেন, কিছুই
করবার উপায় নেই। তাই মনের ঝালটা মনেই হজম করে নিতে
হয়।
রাজ প্পনাভের সেই কথাটায় ফিরে এলেন, যাই বলুন কথাটা
কিন্তু ভবে দেখবার মত! আর সব জায়গা থেকে বরেন্দ্রীতে এই
বিশেষ ব্যবস্থা কেন ? কি আশ্চর্য, আমার নিজের মনেও এই প্রশ্নট।
কোন দিন জাগেনি। যা চিরাচরিত, সহজ সংস্কারের বশে সেই-
টাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে এসেছি ।
বরাহস্বামী আশ্চর্য হায়ে বললেন, সেকি, এ কথাটা আপনার
মনে নতুন করে জাগল? এর পিছনকার ইতিহাসটা তো! আাপনার
জানা থাকার কথা।
পিছনকার ইতিহাস? কি ইতিহাস? আমি আপনার কথাট।
ঠিক বুঝতে পারছি ন:।
বরাহস্বামী বললেন, কেবর্তেরা যে সন্ধির কথ। বলছে, তাকে
একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া! ষায় না । কথাটা মূলতঃ সত্য ৷
বলে" কি! রাজা অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন, গৌড় সআাট
সদ্ধি করতে যাবেন এই ববর কৈবর্তদের সংগে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য
নয়।
বিশ্বীসযোগ্য না হলেও উপায় নেই। পুরাতন রাজকীয় লেখ
সমূহে এ কথ। স্থস্পষ্ট ভাবে উল্লিখিত আছে। তবে একটা কথা ওর!
ভূল বলে, সদ্ধিটা পরমভট্রারক ধর্মপালদের সময়ে হয়নি, হয়েছিল
৩৮ বিদ্রোধী কৈবর্ত
পরমভট্রারক প্রথম বিগ্রহপালদের সময়ে। কৈবর্দের আজ যে
অবস্থায় দেখছেন, আগে তা ছিল না। এখন তো৷ এরা পোষ মেনে
এসেছে । কিন্ত এক সময় এরা ছিল ভীষণ দুরধর্ষ জাতি । গৌড়ের
সআটদের এদের সংগে দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসতে হয়েছে ।
আপনার কথাগুলি আমার কাছে প্রহেলিকার মতই লাগছে ।
উত্তর ভারতের একচ্ছত্র সম্রাটদের সুশিক্ষিত সৈন্বাহিনীর বিরুদ্ধে
দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এই বর্রদের পক্ষে কেমন করে
সম্ভব?
ঠিকই বলেছেন, কথাটা কিছুট। প্রহেলিকার মতই শোনাবে ।
অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক ছুবল। তা
ছাড়া আমাদের গজীরোহী, অশ্বারোহী, রথী আর পদাতিক এই
চতুরঙ্গ বাহিনী, আর ওদের সবাইকেই পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করতে হত।
কিন্ত ওদের সবচেয়ে বড় শক্তি ওদের সংঘশক্তি। সেই শক্তিকে
চূর্ণ করে দেওয়। সম্ভব হয় নিসেদিন। ওরা বার বার পরাজিত
হয়েছে, কিন্তু তাতেও ভেংগে পড়েনি, কোন পরাজয়কেই ওর!
চুড়ান্ত, পরাজয় বলে মেনে নেয়নি । সে সময় বরেন্দ্রীর এখানে
এখানে গহন অরণ্য । সেইগুলি ছিল ওদের দুর্ভেছ্/ ছুর্গ। ওদের
কোনমতেই অবরুদ্ধ করে ফেলার উপায় ছিল না। অবস্থা সংকট-
জনক বুঝলে ওরা ওদের সেই অরণ্য ছুর্গের নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে
প্রবেশ করত। গৌড়ের সৈম্তবাহিনীর সাধ্য ছিল না যে সেখানে
গিয়ে তাদের উপর হানা দেয়। কিস্তু শুধু প্রাণ বাচাবার জন্যই যে
ওরা আত্মগোপন করত তা! নয়, নিশ্চিন্ত জনপদবাসীদের মনে মতা
আতংকের স্যষ্টি করে ওরা অতফিতে এসে ঝাপিয়ে পড়ত তাদের
উপর। লোকে বলত, ওর! মানুষ নয়, মায়াবী দানব । এমন কি
একৰার ওরা রাজধানী গৌড়ে এসেও চড়াও হয়েছিল!
বলেন কি! রাজা চমকে উঠে বললেন, এতই সাহস। কিন্ত
ঘটনাটা সত্য তো, না উড়ো! কথা ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩৯
বরাহত্বামী উত্তর দ্রিলেন, না উড়ো কথা নয়। রাজকীয়
লেখমালায় এর উল্লেখ আছে। আর সাহসের কথা বলছেন,
সাহসের অভাব ওদের ছিল না। তার দৃষ্টান্ত আজও দেখ! যায়।
আমাদের সৈম্তবাহিনীর মধ্যে কৈবর্তেরাই সব- চেয়ে সাহসী বলে
পরিচিত, এ কথা সবাই স্বীকার করবে।
কিন্ত সে সময় ওদের কি আমাদের মত স্ত্রশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী
ছল ? নিয়মিত সৈন্য পোষণ করবার ব্যয় বহন করতে পারত তারা ?
না সেম্তবাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি ওদের তা ছিল ন।।
ওদের মধ্যে সমর্থ যারা তারা সবাই সৈন্য হিসাবে গণ্য ছিল । তা
ছাড়া তেমন প্রয়োজন হলে মেয়েরাও যুদ্ধে যোগ দিত ।
মেয়েরা ?
হ্যা মেয়েরা । আমাদের মেয়েদের দিয়ে এদের বিচার করবেন
না। এদের মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে কোন অংশেই হীন নয়।
ওখানে গেলে এখনও তাই দেখতে পাবেন। কিন্তু কৈবর্তদের
আরও একট জোর ছিল। কোচ, মেচ প্রভৃতি ষে সব বর জাতি
বরেন্দ্রীর নান অঞ্চলে বসবাস করত তারাও এদের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত
হয়ে বিভিন্ন সময়ে ওদের সংগে যোগ দিয়েছে । সমস্তাট! সেই জন্য
আরও বেশী কঠিন হয়ে উঠত।
রাজ! প্রশ্ন করলেন, এত সমস্ত কথ। আপনি কেমন করে
জানলেন? এর সব কথাই কি রাজকীয় লেখমালায় উল্লিখিত
আছে?
না, না, বংশানুক্রমে লোকের মুখে মুখে চলে এসেছে এ সব
কাহিনী । কীতিবর্ণ। সমর্থন করে বললেন, হ্যা, এ সব কথা আমরাও
শুনেছি ।
রাজা একটু অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, লোকের মুখের
কথা, তার কি মূল্য আছে? কতদিন আগেকার কথা, লোকের
মুখে মুখে তিল থেকে তালে পরিণত হয়ে যায়।
৪০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বরাহস্বামী প্রতিবাদ করে বললেন, ন।, না, লোকের মুখের কথ।
বলে উঙিয়ে দেবেন না। এ শুধু আমাদের এখানকার লোকের কথা
নয়। কৈবর্তদের মধ্যে এক রকম লোক আছে, ষারা গান গেয়ে
গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। এটাই তাদের বৃত্তি। এর! বিশেষ করে সেই
সব প্রাচীন দিনের যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী নিয়ে গান করে । আমি
নিজে সেই সব গান শুনছি । আমাদের এখানকার প্রগলিত
কাহিনীর সংগে-তার বেশ কিছু মিল খুজে পাওয়া যায় ।
রাজা বললেন, আচ্ছা ও কথ। থাক। কিন্তু আপনি সেই সঙ্ধির
কথা বলুন। সেই সদ্ধির শর্ত ছিল কি?
সঙ্গির শর্ত অনুসারে কৈবর্তদের বরেন্দ্রীকে আমরা স্বাধীন রাজ্য
বলে স্বীকার করে নিয়েছিলাম । তবে তার সংগে এই কথাটাও
ছিল যে, বাইরে থেকে কোন শক্তি এসে আক্রমণ করলে আমরা
উভয় পক্ষ মিলিত ভাবে তাঁর প্রতিরোধ করব ।
বটে! বটে! আপনার কথাটা সত্য হলেও আজকার দিনে
এটা বিশ্বাম কর! সহজ নয়। কিন্তু সেই সন্ধি ভেংগে গেল কেন?
সেজন্য দায়ী কে?
বর্হেস্বামীর হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি কীব্তি-
বর্মার দিকে চেয়ে বললেন, আপনার নাকি কি একটা প্রয়োজন
ছিল?
কীন্তিবর্ণ। উত্তর দিলেন, হ্যা, আমার স্ত্রী খুবই অন্থুস্থা । দায়িত
নিয়ে দেখা শোনা করবার মত লোক ঘরে নেই। তবে রাষ্থীয়
প্রয়েজনের কাছে ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে আমি চির দিনই গৌণ
বলে মনে করে থাকি।
আহা, তা কি আর জানি ন|!
কথাটা বিদ্রপোক্তি না সরল ভাবেই বল! হয়েছে, কীন্তিবর্ণ তা
ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। প্রথম অমাত্যের কথার তাৎপধ
নিয়ে এরকম মাঝে মাঝেই তাকে সংশয়ে পড়তে হয় ।
“বন্দোহী কৈবর্ত ন্
বরাহস্বামী বাঁক্তাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনার অনুমতি
পপক্পে উনি যেতে পারেন ।
নিশ্চয় নিশ্চয়, অবশ্যই ঘাওয়! উচিত, রাজা সম্মতি জানালেন ।
অনুমতি পেয়ে কীন্তিবর্মা চট্পট বিদায় নিলেন ।
রাজা সকৌতুকে হেসে বললেন, মহাপ্রতীহারকে বিদায় দেবার
জন্য আপনি হঠাৎ যেন অত্তিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন বলে মনে'
হল ?
বরাহস্বামীও হাদলেন, আমার এই হঠাৎ ব্যস্ততাট। আপনার
চোখে ধরা পড়ে গেছে? এ সব কথা নিয়ে যত কম আলোচনা হয়
হতই ভাল। কিন্তু মহাপ্রতীহার মন্ত্গুপ্তির সার্থকতা এখনও বুঝে
উঠতে পারেন না। মহাপ্রতীহারের মুখ যদি এত পাতলা হয়, তা
হলে তিনি কেমন করে তার কাজ করবেন ? আগে আমার খেয়াল
ছিল না, নইলে এই প্রদংগটা কখনোই তুলতাম না। আপনি
বলছিলেন, সেই সন্ধি ভেংগে যাবার জন্য দায়ী কে? এর সঠিক উত্তর
দেষ! কঠিন । আমাদের পক্ষের লোকেরা বলে ওরা আর ওর!
বলে আমরা ।
সন্ধি ভংগ করে ওদের লাভট1! কি? রাজা প্রশ্ন করলেন,
আমাদের পক্ষ কি বলে?
আমাদের পক্ষ ? 'ঠারা বলে, ওদের সমাজের দুরবস্থা, বিশৃংখল।
ও গৃহবিবাদের ফলে আমাদের বাব্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।
ওবা নিজেরাই আমাদের ডেকে নিযে গিয়েছিল। সেই থেকে সেই
দায়িত্ব অ.+রা এড়াতে পারছি না । আমার আগে ধিনি প্রথম অমাতা
ছিলেন তার মুখেই এ কথ। শুনেছি ।
আর ও পক্ষ? ও পক্ষ কিবলে?
ওদের মধ্যে খুব ধুরন্ধর যারা, তারা বল, ওদের ভিতরকার
বিশংখলা আর গৃহবিবাদ সবই নাকি আমাদের ্ষ্টি। আর তারই
উপলক্ষ করে আমরা নাকি ওদের উপর চেপে বসে আছি।
৪২ বিদ্রোহী কৈবত
আপনি কি মনে করেন ? কাদের কথা সতা ?
সত্য মিথ্যা ভগবান জানেন, আমি কেমন করে বলব! তবে
ওদের কথা যদি সতা হয়ে থাকে, তা হলে আমি আমার পূবৰবতীদের
যোগ্যতার অবশ্যই প্রশংসা করব । যে জালের মধো ওর জড়িয়ে
পড়ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা ওদের পক্ষে আর কোনদিন সম্ভব
হবেনা।
কিন্ত এ কি নীতি সম্মত কাজ?
বরাহস্বামী রাজার প্রশ্ন শুনে মৃছু অর্থপুণ হাসি হেসে বললেন,
নীতি সম্মত কি না? অবশ্যই নীক্িসম্মত। এর নাম রাজনীতি ।
ব্যক্তিগত নীতি আর রাজনীতি এক জিনিস নয়। প্রথমটি ব্যক্তির
পক্ষে সত্য, দ্বিনীয়টি সমস্ত রাষ্ট্রের পক্ষে । এ সম্পর্কে আপনার
সংগে আরও এক দিন আলাপ হয়েছিল |
হ্যা আপনি পরম জ্ভ্রানা কৌটিলোর কথা বলছিলেন । কিন্তু
তিনি কি এই নীতি সমর্থন করেন ?
সমর্থন নয়, এই নীতি তারই স্থঙ্ি। 'আমরা গুরুগৃতে তার গ্রন্থ
পাঠ করেই রাজনীতির শিক্ষা লাভ করেছি । এসম্পর্কে তিনি কি
বলছেন শুনুন £
“সংঘের আসন্নবত হইয়া সত্রি নামক গুঢ পুরুষগণ সংঘুগুলির
পরম্পরের মধো দোব, দ্বেষ বা রোষ, অপকারাদি নিমিত্তক বৈর ব।
দ্রোহ ও কলহের কারণ উপলব্ধি করিয়। তাহাদিগের মধ্যে অন্ু-
প্রবোশত ভেদ ঘটাইবে এবং ঝলবে “অমুক সংঘ তোমাদের সংঘের
এইরূপ অপবাদ করে । অন্ত সংঘের প্রতিও এই ভাবে বলিধ।
তাহারা উভয় পক্ষ মধ্যে ভেদ আনয়ন করিবে । পরস্পরের প্রতি
রুষ্ট ভাবাপন্ন সংঘীদিগের মধ্যে আচার্য নামক গুঢ় পুরুষগণ বিছ্তা,
শিল্প, দ্যুত ও বৈহারিক বিষয়ে বালকলহ উৎপাদন করাইবে।
তাহার সংঘমধ্যে হীনগণের সহিত বিশিষ্টগণের এক পংক্তিতে
ভোজন ও বিবাহসন্থদ্ধ নিবারণ করিবে । ***:। অথব! সংঘমধ্যে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৪৩
কোন ব্যবহার স্যাষ্যভাবে নির্নীত হইলেও তাহারা ইহার বিপরীত
নায় স্মর্থন করিয়া শুনাইবে বা বুঝাইবে। অথবা তীক্ষ নামক গৃঢ
পুরুষেরা রাত্রিতে সংঘীগণের মধ্যে কৌন বিবাদ বিষয় উপস্থিত
হইলে এক পক্ষের দ্রব্য, পশু ও মনুষ্য নষ্ট করিয়া, অপর কোন পক্ষের
উপর সেই দোষ আরোপ করিয়া! তাহাদের মধ্যে কলহ উৎপাদন
করিবে। ১১৮ বিক্রমের অবসর উপস্থিত হইলে শৌগ্ডিক ও
সৌরিকের বেশধারী গুঢ় পুরুষষগণ নিজেদের পুত্র ও স্ত্রীর মরণচ্ছলে
ইহা! প্রেতের উদ্দেশ্যে দেয় “নৈষেচনিক' নামক মগ্ভ এই বলিয়!
মদনরসযুক্ত শত শত মগ্কুম্ত সংঘের নিকট প্রাদীন করিবে । 71
অথবা! কুলটা স্ত্রীর পোষণকারী, অথবা প্রবক, নট, নর্তভক ও সৌভিক-
গণের অর্থাৎ এন্দ্রজালিকগণের বেশধারী গুঢ় পুরুষের৷ গুণচচরের
কার্ধে ব্যাপারিত থাকিয়া পরমরূপযৌবনবিশিষ্টা স্ত্রীলোক ছারা
ংঘমুখ্যদিগকে উন্মাদিত করিবে । সংঘমুখ্যেরা এই ভাবে স্ত্রীকামী
হইলে তাহাদের মধ্য হইতে অন্যতমের কোন স্ত্রীলোকের প্রতি
বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া, মিলনের, সংকেতস্থল ঠিক হইলে সেই
রমণীকে অন্য এক সংঘমুখ্য দ্বারা অন্থাত্র নেওয়াইয়া বা অন্য সংঘমুখ।
'্তাহাকে অপহরণ করিয়া নিয়াছেন বলিয়া মিথ্যা কথা রটন। করাইয়া,
সংঘমুখ্যদিগের মধ্যে তাহারা কলহ উৎপাদন করিবে । এই ভাবে
কলহ উৎপন্ন হইলে তীক্ষ নামক গুঢ় পুরুষের! তাহাদের নিজকার্য
সমাধা করিবে অর্থাৎ কোন একজন সংঘমুখ্যের হতা। সাধন করিবে
এবং রটাইয়া দিবে “এই কামুক ব্যক্তি প্রাতিকামুক অন্য ব্যক্তি বারা
হত হইগুঃছে'। অথব! এই সংঘমুখ্যগণের মধ্যে যদি কেহ ঝগড়া
করিতে না চাহেন, তাহা! হইলে সেই রমণী এই প্রকার বলিবে--
'আপনার প্রতি আমি জাতকামা হই-_ ইহাতে অমুক সংঘমুখ্য বাধ!
প্রদান করেন অর্থাৎ তিনি ইহা ইচ্ছা করেন ন।। তিনি জীবিত
থাকিলে আমি আর এখানে আপনার নিকট থাকিতে পারি না।
এই বলিয়া সে তাহার বধের আয়োজন করিবে 1৮*-**
৪৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
রাজ এ কথায় চুপ করে রইলেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখে
কোন কথা ফুটল না।
অবশেষে তার সংশয়াচ্ছন্ন ক থেকে বেরিয়ে এল, ব্যক্তিগত
ভাবে কেউ এ সমস্ত কাজ করলে বিচারে তার চরম দণ্ডের ব্যবস্থা
হোত।
বরাহস্বামী মাথা নেড়ে বললেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু এ তো!
বাক্তির প্রশ্ন নয়, এট! সমূহের প্রশ্ন । সেই মান দিয়েই এই প্রশ্নকে
বিচার করতে হবে ।
তা হলে সংসারে মূল নীতি বলে কি কোন কথ! নেই ?
বরাহম্বামী হেসে বললেন, এ সংসারের মূল কি কেউ কখনও
খুঁজে পেযেছে £ নীতির মূল বা মূল নীতির সন্ধানই বা কেমন করে
পাওয়া যাবে । আমরা স্থান, কাল, পাত্র এবং অবশ্থ! বিশেষে বিশেষ
বিশেষ বাবস্থা নিয়ে থাকি ক! নিতে বাধা হই ।
কথাটা চিন্তনীয় সন্দেহ নেই, কিন্ত রাজ সবট] পুরোপুরি হজম
কারে নিতে পারছিলেন না। একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনার
কথাটা, বুঝলাম, কিন্তু হাই বলে এমন কতগুলে! সাধারণ নীতি
কি নেই যা! সবুকালে সবক্ষেত্রে এবং সব অবস্থায় প্রযোজ্য ?
এ কথার উত্তর দেবে কে? আমাদের পিছনে অতীতের সমুদ্র,
নার কতটকু আমরা দেখে পাই £ সামনে ভবিষ্যত্তের অন্তহীন মহা
সমুদ্র, তাঁর সবটাই অন্মাদের দষ্টির বাইরে । এরমধো সীমাবদ্ধ
কাল ও দমবন্ধ পরিবেশে বর্ধত মনু আমর।-আমাদের এ প্রশ্নের
উন্র দেবার সামর্থ্য কোথায় ?
রাজ1 বললেন, কেন, ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুধরাও কি বলতে পারেন
প। ?
বরাহন্ামী সশব্দে হোসে উঠলেন, ত্রিকালচ্ছজ মহাপুরুষ ! আছেন
নাকি ভার! কোথাও? সত্যমিথ্যে ভগবান জানেন, শুনেছি সত্য
যুগে তারা নাকি সত্য সত্যই ছিলেন । কিন্তু ছুর্ভাগ্য আমার, এ
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৪৫
যুগে তেমন কোন মহাপুরুষের দর্শন লাভের সৌভাগ্য হয়নি এখনও ।
হলে জিত্ঞাসা করে নেব।
তার মুখের ভাষায় তার মনোভাব যতট। প্ররাশিত হোল, তার
চতুগুণ প্রকাশ হয়ে পড়ল তাঁর তীক্ষ ব্যংগমিশ্রিত কণ্টস্বরে ।
এই ছুঃসাহসী ' ব্রাহ্মণের এই ধরনের কথ। শুনে অভ্যস্ত । 'বে
বরাহস্বামী সবত্র মন খুলে এ সব কথা বলেন না। এ সব কথা বলবার
মত'তার ছু'চারজন অন্তরঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য লোক আছে। রাজা
তাদের মধ একজন । তিনি মাঝে মাঝে এমন এক একটা কথা
বলে বসেন, যা শুনতে রাজার ভয় ভয় করে, অথচ ওৎস্তুক্যও
জাগে।
ত্রিকালের কথা বাদ দিয়ে আমাদের এই খণ্ডিত বর্তমানের
দিকেই চেয়ে দেখুন না। এখানে বালকদের পক্ষে যে নীতি প্রযোজ্য
বয়স্ক লোকেদের পক্ষে তা প্রবোজ্য নয়, পুরুষের পক্ষে হা! প্রযোজ্য
স্ত্রীলোকের পক্ষে ত। নয়, স্থৃস্থের পক্ষে যা প্রযোজ্য অন্ুস্থের পক্ষে
তা! নয়, প্রজার পক্ষে বা প্রযোজ্য রাজার পক্ষে ত! নয়, শুত্রাদি ইতর
লোকের পক্ষে যা প্রযোজা ত্রান্মণের পক্ষে তা নয়। অন্য দিকে
দেখুন, আমাদের আর্ধদের পক্ষে যেটা ছুনীতি, আধদের কোন কোন
জাঁতির মধ্যে সেটাই নীতিসম্মত। আবার আমরা যাকে সদাচার বলে
শ্রদ্ধা করি, কেউ কেড তা শুনলে অবাক হয়ে যায়, নিজেদের মধ্যে
তাই নিয়ে তারা হাসাহাসি করে। বিভিন্ন সমাজ নিজ নিজ সংস্কার
ও প্রতিভা অনুযায়ী নিজস্ব পন্থায় নিজেদের জীবনকে নিয়মিত করে
আসছে ' তার মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসছে তাদের নীতি ।
বরাহস্বামীর কথার তোড়ে রাজার মনের খট্কাট।! আপাতত
চাপা পড়ল ।
তিনি বলে উঠলেন, কিন্তু কি অদ্ভুত শাণিত বুদ্ধি। আমি আশ্চয
হয়ে যাই, কত প্রাচীন দিনের লোক, কিন্তু কুট রাজনৈতিক
প্রতিভার দিক দিয়ে কত দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তখরা ! সেই
3৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তুলনায় আমরা-_তাদের বংশধরেরা কোথায় পড়ে আছি! এই
প্রতিভা জাতির গৌরব।
হ্যা, গৌরব তো বটেই, বরাহস্বামী সমর্থনের স্তরে বললেন, আর্য
জাতির যে সমস্ত মহামূল্য সম্পদ আছে, কৌটিল্যের রাজনীতি
নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম । আমার দৃঢ় বিশ্বাস দীর্ঘ দিন ধরে
কৌটিল্যের নীতি অগ্ুমরণ করে চলবার ফলেই কৈবর্তদের মধ্যে
আমরা এই সাফল্য লাভ করতে পেরেছি । অবশ্য এই সাফল্যকে
চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য আরও অনেক কিছু করবার
প্রয়োজন আছে। এ কথ! মিথ্যা নয়, বিদ্রোহের অগ্নি কণাগুলি
ছাইয়ের তলায় এখনও ধিকি ধিকি জ্বলহে। যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ
কণিকাটিকে নিবিয়ে ফেলা না যায়, ততক্ষণ বিশ্রাম নেবার অধিকার
নেই আমাদের !
শুনলাম ওদের মধো কোথায় কোথায় নাকি গোলমালের লক্ষণ
দেখা দিয়েছে, প্রশ্রের স্্রে রাজা কথাটা বললেন।
হ্যা, কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্ত আমাদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ
সমন্তাট])ও ঘোরালো৷ হযে উঠছে দিন দিন। রাষ্টরকুটর। যে
ষড়যন্ত্রের খেলা খেলে চলেছে, তাই নিয়ে বিব্রত আছি আমর! ।
তারই ফলে কৈবর্তদের দিকে যথোচিত দৃষ্টি দেওয়। সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের মহাপ্র তীহারেব মাথাটা একেবারে নিরেট না হয়ে কিছু
পদার্থ বদি থাকত | তার ক'জের বিবরণ শুনে নিজের হাত নিজেই
দংশন করতে ইচ্ছ! হয়। একমাত্র দণ্ড চালন! ছাড়া আর কিছুই
বোঝেন ন। তিনি! ফলে সমস্যার সমাধান করবার পরিবর্তে নৃতন
নৃতন সমন্থ। স্থপ্টি করবার ব্যাপারে ভিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়ে
আমছেন।
রাজা উদ্বিগ্ন কগে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে আমর! যেমন ওদের
গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়েছিলাম, ওরা৷ তেমনি সেই দৃষ্টান্তের অনুসরণ
না করে। আমাদের এই সংকটের সময় ওর! যদি বিদ্রোহ করে বসে-_
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৪৭
ন| না, সে ভয় করবেন না, বরাহস্বামী আশ্বাস দিয়ে বললেন, সে
শক্তি ওদের নেই। ওখানকার অবস্থা আমাদের আয়তেই আছে।
ওদের অনেক লোক প্রকাশ্যে ও গোপনে আমাদের পক্ষ হয়ে কাজ
করে চলেছে । সেইখানেই ওদের চরম ছূর্বলতা। সেটা ওদেরও
অজানা নেই।
আপনি কি এ বিষয়ে এতই নিশ্চিন্ত ?
বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, হ্যা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ।
আমি এক কালে গণিতের মেধাবী ছাত্র বলে পরিচিত ছিলাম।
আমার শণনায় বড় একটা ভূল হয় না। সামন্ত দিব্বোকের প্রভাব
সমস্ত কৈবর্তদের উপর পরিব্যাপ্ত। তার সঙ্গে আমার নিয়মিত
যোগাযোগ আছে। যতক্ষণ তিনি আমাদের পক্ষে আছেন, ততক্ষণ
কৈবর্তদের বিদ্রোহ অসম্ভব
তিন
এখন আমর! বলি বরেন্দ্রী, তাই বলে আগে এর নাম বরেন্দ্র
ছিল না।
বরেন্দ্রী ছিল নী, কি নাম ছিল তবে ?
ওরা সবাই গোঁল হয়ে বসে গল্প শুনছিল, এক সংগে কলরব করে
উঠল ।
কি নাম ছিল, ও বুড়ো ভাই, বল কি নাম ছিল ?
ভলকু বুড়ো এত সহজে পেটের কথা ছাড়ে না, রহস্তটাকে
আরও একটু ঘনীভূত করে তুলবার জন্য হাঁসি হাসি মুখে ওদের
মুখের দিকে নিশেব্দে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ । কৌতুকে তার চোখ
পিট পিট করছিল ।
ও বুড়ে! ভাই, বল না। ওর অধৈধ হয়ে উঠল।
নাম? এর নান ছিল কষ্টলি।
কট্টলি। কটুলি কি আবার একট| নাম নাকি? পিছন থেকে:
একটা ছেলে ফস্ করে বলে উঠল ।
কি, কি বললি, করলি নামটা মনে ধরল ন। বুঝি? বুড়ে। চটে
উঠল, এমন একটা নাম আছে কোথাও, শুনেছিস্ কখনও ? বরেশ্র্
নামটা ভালই, মন্দ বলছি না, কিন্তু তাই বলে কি কট্টলির মত অমন
মিষ্টি?
ওদের মধ্যে একজন বুড়োকে খুশী করবার জন্য বলল, ঠিকই
বলেছ বুড়ো ভাই, ক্টলির মত নাম হয় নাকি? কিন্ত করলি নাম
রাখল কে?
কে আবার রাখবে ? শুধু মানুযের মধ্যেই নাম রাখারাখি, আর
কেউ নাম রাখে না॥। আর সবাই যে যার নাম নিয়েই জম্মায়।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৪৯
নাম নিয়েই জন্মায়? সে কেমন কথা?
ই্যা, নাম নিয়েই জন্মীয়। এই যে সামনে গরুট! দেখছিস, ওর
এই গরু নাম দিয়েছিল কে ?
প্রশ্নটা কঠিন, সবাই নিরুত্তর হয়ে রইল ।
তবে? আমাদের গায়ের চামড়া যেমন গায়ের সংগে লেগে
থাকে, ওদের নামও তেমনি । সেই জন্যই তো যেখান থেকে যেই
আস্মুক না কেন, প্রথম দৃষ্টিতেই বলে দেবে এটা গরু, গরু ছাড়া আর
কিছু নয়।
এই কথার উপর কেউ কোন প্রতিবাদ করবার ভরসা পেল না।
নূড়ে! বলল, এই কষ্টলি আমাদের সবার মা, তার মাটি থেকেই
আমাদের জন্ম ।
একজন বলল, বা রে, সে কেমন করে হবে ? মাটি থেকে গাছ-
পাল! জন্মায়, পোকা মাকভের স্যন্তি হতেও দেখেছি, শুনেছি কাছিমের
জন্ম এই মাটি থেকেই। কিন্তু মানুষ কি কখনও মাটি থেকে জন্মাতে
পাবে? মানুষের জন্ম মায়ের পেট থেকে ।
আরে পাগল, তখন বাপ মারাই বা আসবে কোথেকে ? এ
দেশে তখন জন মনিষ্ত্ি ছিজ নাকি? তখন সারা কট্টলি ক্ন বনে
বনারণা। আর তার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াত দত্যি-দানব, দেও-
দেবতা, জন্ত-জানোয়ার, পাঁখী-পাখলা, সাপ-খোপ, পৌকা-মাকড়
আরও কত কি! কিন্তু এত পেয়েও মন ভরে-ন1 কট্টলির।
একদিন কি এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন কট্টলি। উঠে
কপালে চাপড় মেরে বললেন, হায় হায়, কোথায় গেল সে? আমার
কোল খালি, আমার বুক খালি, আমি কি নিয়ে থাকব?
সবাই বলল, মে কি গো, তে'মার কোল খালি হবে কেন?
এপাঁনে যাঁরা পায়ে হেঁটে বেড়ায়, বুকে চলে বেড়ায়, ভান!র উপর ভর
করে শুন্যে উড়ে বেড়ীয়, জলের মধ্যে যার! সশতরে বেড়ীয়, সেই
আমর সবাই তো তোমার ছিষ্টি, তোমার অভাব কিসের ?
হি
৫০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
নাঃ না, এত নিয়েও আমার স্খ নেই। সকল ছিষ্টির সেরা
ছিষ্টি সেই যদি না এল, তবে আমার সব মিথ্যা, আমার সব থেকেও
কিছু নেই।
(ক, কে, কে গো সে? শত কণ্ে প্রশ্ন উঠল।
সে এক দামাল ছেলে । স্বপ্নে দেখলাম, আমার পেট থেকে
বেরিয়ে এসেই বুকের উপর বঝশীপিয়ে পড়ল। এ টুকুন ছেলে কিন্তু
গায়ে অন্ত্রের মত বল, ছু হাতে আমার একটা মাই চেপে ধরে টো
চো করে টান মারল। সে কি টান, আমার মনে হোল সেই সংগে
সার! গায়ের রক্ত উঠে আসবে । ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলাম,
পারলাম না। ব্যথায় টনটন করে উঠল বুকটা । বড় বেদনা, কিন্তু
বড় মুখ ! এমন শ্থখ আর কোন দ্রিন পাইনি । বললাম, কে রে তু” ?
ওরে দহ্থ্য, তুই কোণ্খেকে এলি ? তুই কি আমাকে খেয়ে ফেলবি
নাকি? ও ওর মাথাটা দিয়ে আমার বুকের উপর ঢু মারতে মারতে
বলল, “আমার যে বিষম খিদে । আমি তোমায় খাব, নইলে এ খিণে
মিটবে না।”
আমি আমার গ! ছেড়ে দিয়ে বললাম, খা খা, তোর মন যা চায়
তাই কর।
তোর নাম কিরে? কিবলে তোকে ডাকর?
সে বিকট ন্তরে গর্জে উঠল- আমি কবর্ত।
পাশেই জন কয়েক পুরুষ আর মেষে একট! মাটির ঘর তুলছিল।
ভলকু বুড়োর গঞ্সের গন্ধ পেয়ে ওরা হাতের কাজ ফেলে রেখে কাছে
এসে দাড়িয়েছে । ভলকু বুড়োর গলায় যে এ৯ জোর গা1কে
জ্ঞান! সে বাঘের মত গর্জন করে উঠল--আমি কেব্ত। আর
এমন বিচিত্র তার বলবার ভংগি ঘে ছোট বড় সবার মধোই কেমন
একট উন্কেজনার শিহরণ খেলা করে গেল।
ভলকু বুড়ো একটু থেমে আবার বলে চলল, কট্ট:ল বললেন, সে
কি গর্জন। সংগে মংগে আমার ঘুম ভেংগে গেল। চোখ মেলে
বিদ্রোহী কৈবর্ত &১
চেয়ে দেখি সেই কুচকুচে কালো, কৌকড়া-কৌকড়। চুল সেই ছূর্দান্থ
ছেলেটা কোথায় মিলিয়ে গেছে! কিন্তু আমার বুকটা তখনও
টনটন করছে।
পশুপাখীদের মধ্যে পেঁচার মত বিজ্ঞ আর কেউ নেই। সে বার
কয়েক চোখের পাত! খুলল আর.বুজল, শেষে মৃছ কণ্ঠে বলল, মা
জননী, শান্ত হও। অমন উত্তল! হয়ে লাভ নেই, সব স্বপ্ন সত্য নয়,
তোমার ছেলে তোমাকে কামড়ে খাবে, এটা কি একটা কথা!
পরিষ্কার মনে হচ্ছে, এ কোন অপর্দেবতার মায়! |
ন! না, মিথ্য। নয়, এই দেখ ন। তোমরা ।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, তাই তো, মাইয়ের উপর আচড়ের
রেখা, আর বোটার কাছেই পরিষ্কার দাতের দাগ । একেবারে হাতে
নাতে প্রমাণ হয়ে গেল, এরপর আর কারও বলার মত কোন কথা
রইল না। পেঁচা নিরুত্তরে চোখ বুজল ।
কট্টলি দেবতাদের উদ্দেশ করে বললেন, ওগো! দেবতারা, আম!র
স্বপ্ন পূর্ণ হোক। মে আন্মক, আম্বক। এসে আমাকে কুড়ে কুড়ে
ছিড়ে ছিড়ে খাক, তবু সে আন্থক। সে না এলেষেসবুকিছু
মিথ্যা হয়ে যাবে।
আকাশের দেবতারা উত্তর দিলেন, তাই হোক, তাই হোক ।
বনের দেবতারা ডেবে, বললেন, তাই হোক, তাই হোক। জলের
দেবতার! সাড়। দিলেন, তাই হোক ।
কট্টলির প1 বেয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামতে লাগল। উঃ গে
কিরক্ত। লাল টকটকে রক্ত।
কিসের রক্ত গো? একটা ছেলে আতকে উঠে বলল।
ভলকু বুড়ো গর্জে উঠল--চোপ২! সবাই চুপ চুপ বলে তাকে
থামিয়ে দ্িল। ছুটে সেয়ান। মেয়ে গ! ঘে"ধার্থেষি করে দাড়িয়ে
গল্প শুনছিল। ওরা এক জন আর এক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে
ফিক করে হেসে উঠল। বুড়ো ভলকু বলে চলল, রক্তের ধারা
£২ বিজোহী কৈবর্ত
নামছে, নামছে, পা বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে নামছে । শেষে মাটিতে
নামছে । শেষে মাটিতে ভ্রোত হয়ে বয়ে চলল । সেই স্রোত নদী
হয়ে নামল । সেই নদীই তো! লালনদী, আমাদের এই লালনদী |
সেই নদীই লালনদী ? বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন উঠল।
দেখেছিস তো, তার জল এখনও কেমন লাল।
দেখেছি দেখেছি, সমস্বরে বলে উঠল অনেকে ।
সেই নদীর জলে নাইলে বাজ মেয়ের ছেলেপিলে হয়। তাই
তো! আমাদের কৈবর্তদের মধ্যে ছেলে মেয়ের এমন বাড় বাড়ন্ত।
পৃথিবাশুদ্ধ, মানুষ এ কথ। জানে । ছেলেমেয়ে পাওয়ার আশা করে
দেশ বিদেশের মেয়েরা এই নদীতে আসে নাইতে, আর যাবার সময়
ঘড়ায় ঘড়ায় জল নিয়ে যায়।
মেয়ে দুটোর খোঁপায় গৌঁজ। লাল টকটকে ফুল। বুঝি কট্টলির
রক্তের মতই লাল । গল্পট। চলতে চলতে হঠাৎ লালনদীর দ্রিকে
ভেসে যাচ্ছে দেখে ছেপেদের একজন বলে উঠল, তারপর কি হোল
গো । কট্রলি কি করল সেই কথাটা বল না।
বুড়ো! ভলকু বাধা পেয়ে চোপ, বলতে যাচ্ছিল, কিন্ত খেয়ে ছটোর
খোপায় গোঁ সেই গাঢ় রক্তবর্ণ ফুলগুলি দিকে চোখ পড়তেই
থমকে গিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ । শেষে বলে চলল, দেবতারা
ডেস্ক বললেন, ফুল যখন ফুটেছে, ফল হওয়ার সময় হয়ে এসেছে ।
এবার তোমার স্বপ্ন সকল হবে। স্ূর্ষের মন্ত্র পড়। তাতেই আশ!
মিটবে।
কট্টলি বললেন, ওগো! দেবতার।, তোমরা আমার সহায় থেকে
তারপর কট্রলি কি করলেন ?
কট্টলি আছি কালের যাছুকরী। তার ছেলেমেয়ের জন্মায়, বড়
হয়, বুড়ো হয়, মরে ঘায়। কিন্ত কট্রলির যৌবন অক্ষয়, অমর।
মুহুতে মুহুর্তে তার রং বদলায়, রূপ বদলায়, বার বার নতুন হয়ে
ফিরে আসে।
বিদ্রোহী কৈবর্ড €৩
উঠে দাড়ালেন কট্টলি। সেই লাল রক্ত মাটির উপর চন্দনের
মত জমে আছে। তাই দিয়ে বড় করে এক ফৌটা পরলেন কপালে ।
তারপর সূর্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে
লাগলেন। মন্ত্রসিদ্ধা কট্টলি, কত মন্ত্রই না তার জানা আছে! আর
সে মন্ত্রের শক্তি বজ্র মত, কেউ তাকে ঠেকাতে পারে না। প্রথমে
শুধু ঠোঁট ছুটি নড়ছিল, তারপর মৃছ গুনগুনানি, ক্রমে স্বর উচুতে
উঠতে লাঁগল। তারপর এক অঞ্জলি ধুলো ছু'ড়ে মারলেন সুধের
দিকে। এক অগ্জলিতে সারা আকাশ ছেয়ে গেল। এবার ছুই
বাহু বািয়ে দিয়ে স্থির হয়ে দীডিয়ে রইলেন কট্টপি। পাথরের
মত স্থির। শুধু ঠোট ছুটি নড়ছে।
এই ভাবে কতক্ষণ কেটে গেল । ভার পরে স্বর্ষের প্রচণ্ড তেজ
একটু একটু করে নরম হয়ে আসতে লাগল । সবাই বুঝল, এবার
কিছু একট! ঘটতে যাচ্ছে । কিন্তু কি যে ঘটবে, সে কথা কেউ
জানে না। হঠাৎ সবাইকে চমকে দ্রিয়ে আকাশ জুড়ে মেঘের
গর্জনের মত ভীষণ গর্জন উঠল । কিন্তু কোথায় মেঘ! পরিষ্ণার
আকাশ, মেঘের চিহ্টরকুও নেই। তারপর সবাই দেখতে "পেল
শে শো শো শো করে প্রচ শব্ধে উপর থেকে বিরাট কি
একটা নেমে আসছে । এ কি বড়? কিন্ত ঝড় কি কখনও
সোজা উপর থেকে এমন' করে নেমে আসে? আর ঝড়ের কি
কোন আকার থাকে? এ যে বিরাট একটা পাখীর মত । কিন্তু এত
বড় পাখী কেউ কখনও দেখেনি । তার ডানার আড়ালে সৃর্ধ যেন
ঢাকা পড়ে গেছে। পাখী নয়তে। যেন দৈত্য । হায় হায়, কি
সর্বনাশা মন্ত্র পড়ল কট্টলি। এবার আর কারও রক্ষা নেই। ভয়ে
দিশাহার' হয়ে যে যেদিকে পারে ছুটল। বে পারল গর্তের মধ্যে
ঢুকে পড়ল। পশু পাখী, সাপ খোপ, পো ন্কা মাকড় কেউ রইল ন1।
শুধু একা দাঁড়িবে রইলেন কষ্রলি । আকাশটাকে ভেংগে চুরে নেমে
আসছে পাখী । তার বিরাট ভানার ঝাপটায় গাছ পাল! পাগলের
৫৪ বির্রোহী কৈবর্ত
মত মাথা কুটে মরছে। কিন্ত কট্টলির বুকে এতটুকু কাপন নাই।
তেমনি স্থির দষ্টিচ্ষে তার দিকে ত:কিয়ে আছেন, ভাঁর ঠোট ছুটি
হাসছে।
কট্টলির মুখে হার মন্ত্র নেই। ঠোট আর নড়ছে না। দিশাহার।
হয়ে গেল পাঁধী। তাঁর তীক্ষ চোখ ছুটি এদিকে ওদিকে দিক দিগন্ধে
খু'জে বেড়ীতে লাগল, কে কেমন করে তাকে টেনে নিয়ে এল ! কে
তার রক্তকে এমন করে পাগল করে তুলল ।
কোথায় কোথায় আছে সে! খুঁজে না পেয়ে মে তীক্ষ কঠিন
স্বরে ডেকে উঠল-কাহা-কাহ।-ক্কাহা ! সে ডাক শুনে স্ষ্টিশুদ্ধ কেঁপে
উঠল । কিন্তু কট্টলি ভয় পাবেন কেন ? তিনিই তে। 'ডকে এনেছেন
তাকে । নাচের ভংগীতে এগিয়ে এসে ছুহতত নেড়ে সংকেত
জানালেন।
যেই ন!। দেখা, অমনি তীকে লক্ষ্য করে তাঁতের মত বেগে নেমে
এল পাখী । বিরাট ছুই ডান। দিয়ে জাপটে ধরবে কট্টলিকে | কিন্তু
যাছুকরী কট্টলি এত সহজে ধরা দ্রিলেন না । তিনি পক্ষিণীর রূপ
ধরে তাকে পাশ কাটিয়ে শে! করে সোজ। উপরে উঠে ফেলেন
পাখী শুন্তে শুন্যে-মহাশুন্তে উড়ে চললেন । পাখা তার পিছন পিছন
তাড়া করে ফিরতে লাগলেন । কিন্তু কষ্টলি ধরা! দিয়েও ধর! দেন
না, ছয়! দিয়ে পালিয়ে যান। থে খেলার যেই নিয়ম । এই ভাবে
সারা আকাশটাকে সাত সাতবার ঘুরে এলেন তারা । অবশেষে
কট্টলি ধরা দিলেন ।
সময় হলে কট্টলি ছুটি ডিম পারলেন। সেই ডিম ফুটে বেরিয়ে
এল পাখীর বাচ্চা নয়, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে! তাদের নাম
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন কলে উঠল, হাম্মা আর হ।ম্মি ।
ভলকু খুশী হয়ে বলল, ঠিক ঠিক। হাঁম্মা আর হাম্মি- এরাই
প্রথম কৈবর্ত। আমরা তাদেরই বংশধর । শাখায় শাখায় ভাগ হয়ে
ছড়িয়ে পড়েছি । আমরা কৈবর্তেরা যে যেখানে থাকি না কেন সবাই
বিশ্রোহী কৈবর্ত ৫৫
সর আর কট্টলির সম্ভান। হ্যা, সুর্যের সম্ভতীন আমরা, সহজ কথা
নয়। সংসারে আমাদের চেয়ে বড় কে আছে!
এক জন প্রশ্ন করল, তবে যে ব্রাঙ্মণের1! বলে__
দূর দূর, রেখে দে ওদের কথ! । ওদের মত মিথ্যাবাদী আর কেউ
আছে নাকি? যে যাই বলুক, তাদের কথায় কান পাতবিনে ।
পৃথিবীর সেরা জাত এই কৈবত? তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই। তার
চেয়ে বড় কেউ কান দিন ছিল না, হবেও না।
একট] জোয়ান ছেলে চটপট দীড়িয়ে বলল, তা তো নেই
বুঝলাম, কিন্তু আমরা যদি এতই বড়, তবে আমাদের এত ছূর্গীতি
কেন। আমর তে। উঠতে বসতে ওদের লাখি খেয়ে মরছি। তবু
আমর! সবার দের! ?
আর এক জন বৃদ্ধ ভলকুর পক্ষ হয়ে বলল, ই'1, সেরা! বই কি,
নিশ্চয় সেরা । তবে সময় অসময় সবারই আছে । অসময় পড়েছে
বলে মাথ। নুয়ে আছি, আবার শ্ত্রসময় এলে ভাগ্য ফিরে যেতে
কতক্ষণ ?
কবে সেই স্তমময় ফিরে আসবে?
আসবে, আসবে একদিন, আসতেই হবে তাকে । এত অস্থির
হলে চলে কখনও? ধেধ ধর্, ধৈষ ধর! ভলকু বুঝিয়ে তাকে
শান্ত করতে চাইল।
কিন্তু সে ছেলে শান্ত হবার নয়। তাঁর অশাস্ত দৃষ্টিতে তারই
ইংগিত ফুটে উঠেছে ।
কবে, আর কবে আসবে সে দিন! এদিকে আমরা যে শেষ হয়ে
গেলাম!
হ্যা ই, ঠিকই তে। বলেছে, শেষ হয়ে গেলাম আমরা, অনেক-
গলে। কণ্ঠের মিলিত শব্দ শোনা গেল। গল্পের মায়! যেন ছিড়ে
খান খান হরে যাচ্ছে।
ভলকু এদিকে তাকাল, ওদিকে তাকাল, কেমন যেন থ খেয়ে গেল।
৫৬ বিদ্রোহী কৈবর্
তার মুখে আর কোন কথা ফুটল না। অসহায় আর নিপ্রভ দৃষ্টিতে
সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ভলকু।
বুড়ো ভলকুকে কোন দিন এমন অবস্থায় পড়তে হয় নি। তার
গরের নেশী বিষম নেশা, মানুষকে একেবারে বুদ করে ফেলে। কিন্ত
আজ কাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। কোন এক অতীত দিনের
যাছুমাখানো। এই রোমাঞ্চকর কাহিনী! একদিন তা শ্রোতাদের মনে
সম্মোহের হ্ৃঠি করে তুলত। এখন ত| ধেন তার স্বাদ গন্ধ হারিয়ে
ফেলছে। এ যুগের মানুষের কাছে এ সব গল্প যেন আর বিকাতে
চাইছে না।
হেমাস্তর আতপ্ত রৌদে গা এলিয়ে দিয়ে স্ত্খশয্যায় শুয়ে আছে
রেন্্রী। শুয়ে শুয়ে মধুর আলস্য উপভোগ করছে । মাঝে মাঝে
হঠাৎ এক একটা দমক1 হাওয়া আসে সেই হাওয়ার ঝাপটায়
গরুয়া রংয়ের ধুলো গড়ে আকাশে, ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে -_গাছে
"ছে, পাতায় পাশায়, সবুজ ঘাসের ডগায় ডগায়, ঘরে ছুয়ারে,
সানুষের গরণের কাপড়ে, মাথায়, চুলে-কেউ অব্যাহতি পায় না।
বরেন্দ্রীর এই রংয়ের খেলায় সধাই অভ্যন্ত, কেউ কিছু মনে করে না।
এই লাল মাটির অনেক গুণ মেকথ! কে না জানে !
এই ছাল মাতে যে ফসল ফলে তার তুলনা নেই। এই লাল
মা: র দেশের মেসেরা এখানকার জমির ফসলের মতই অপর্যাপ্ত পুত্র
কনার জন্ম দেঘে চলে । লোকে বলে, সেও নাকি এই মাটিরই
জন্য । মাটি আর মেয়ে এই দুয়ের মধ্যে অচ্ছে্চ সম্বন্ধ, এই ছুয়ে
মিলে স্ৃষ্টির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বব্জ্ার উপর দিয়ে একটা দীর্ঘ পথ »াপের মত একে বেকে চলে
গিয়েছে । এ পথ গৌড়ে গিষে শেষ হয়েছে । মানুষ অবাক হয়ে এই
সু স্য বধানে। রাঁজপথের দকে তাকায়, আর বলে, আশ্চর্ধ মানুষের
ক্ষমভা। কত কাল ধরে কত মানুষ খেটে খেটে এই পথ তৈরী
করেছে! গৌড়ের লোকেরা আর ধা-ই করুক, এর জন্য তাদের
প্রশংসা করন্েই হবে। ভাবের জন্তই আমরা এমন স্থখে চলাচল
করতে পারছ । কত মহজে মাল পরের আনা নেয়া চলছে।
সবাই কিন্ত এ কথা বলে না; এমন লোকও আছে যার!
বলে এই রাজপথ হরেন্দ্রীর অভিশাপ । এই পথ দিয়েই তাদের
দেশের সোনার ফসল ধেশের বাইরে চলে যায়, নিজেদের
৫৮ বিদ্রোহী কৈবঙ
ফসল পরকে দিয়ে তারা না খেয়ে মরে। এই পথ দিয়েই
গৌড়ের সৈন্যেরা যখন তখন এসে তাদের উপর লুটে পুটে খায়,
আর নানা ভবে অত্যাচার করে।
নতুন ধানের গন্ধ ভেসে আঙ্ছে বাতাসে । পথ দিয়ে ধানে
বোঝাই মোষের গাড়ীগুলি টিমিয়ে টিমিয়ে চলেছে । মোষের
গলার ঘুর্টি বাজছে £ং ঠাং £ং ঠাং।
এই একটানা শব্দ শুনতে শুনতে কেমন যেন নেশ। ধরে যায়
বঝিমূনি আসতে চায়। সারাদিন এমনি চলেছে-_গাড়ীর পর গাড়
কণ্ত যে গাড়ী তার ঘেন শেষ নেই। |
কিছুক্ষণ বাদে বাদেই এক একট! বহর এগিয়ে আসে । তান
মধ্যে কোন কোনটা এতই বড় ষে এক জায়গায় দীড়িয়ে তার এব:
দিক থেকে আর এক দিক পর্যন্ত দেখবার উপায় নেই।
পথের ধারে ধানের ক্ষেতে ধান কাটছিল ক' জন চাষী | বাচ্চা,
জোয়ান, বুড়ো সব বয়সের লোকই আছে । দশ বারে! বছরের একট।
ছেলে হাতের কাজ বন্ধ রেখে চলমান গাঁড়ীগ্চলির দিকে তাকিয়ে
বিড় বিত করে ঠোট নাড়ছিল: সবশেষ গাড়ীটা খন চলে গেল,
তখন সে কলে উঠল, বাঁপরে বাপ, এক কুড়ি তিনট। |
এক জন বয়স্ক চাষী ওর মুখের দিকে তাকিযে প্রশ্ন করস, কি
রে, লাখুং নিজের মনে মনে কি বকছিস ?
এক কুড়ি তিনট1 গাড়ী মামা । গুণে গুণে দেখল।ম । ঠিক এক
কুড়ি তিনটা, একটাও কম নয় !
লোকটি হেসে উঠল, ক! রে বা. তুই হাতের কাজ ফেলে রেখে
গড়িয়ে দাড়িয়ে এই কর্ই করছিস নাকি? কেন, ধানের গাড়
আর কোন দিন দেখিস্নি, এই প্রথম দেখলি? ছেলেটা সেই কথার
কোন উত্তর ন। দিয়ে প্রশ্ন করল, এন্ত গাঁড়ী কোথায় যায় মামা?
কোথাও কোন উচ্ছব মাছে নাকি ?
কিসের উচ্ছন? উচ্ছব আর আমোদ আহুলাদ বলতে কিছু
বিভ্রোহী কৈবর্ত ৫5
আছে নাকি এ দেশে? সে যখন ছিল, তখন ছিল। পেটে ভাত
ন! পড়লে আর মনে ম্্খ না থাকলে কিসের আবার উচ্ছব ? এ সব
ধান চালান যাচ্ছে গৌড়ে।
ও বাবা, গৌড়ে ! ছেলেট! কপালে চোখ তুলে বলল, এত ধান
দিয়ে ওর! কি করবে মামা ?
এত ধান কি রে? এ তো .মোটে এক কুড়ি তিনটা গাড়ী।
সে আর ক'টা ধান! এ ভাবে শ'য়ে শায়ে ধান বোঝাই গাড়ী
গৌড়ে চলে যায়।
শ'য়ে শ'য়ে গাড়ী! ওবাবা! এত ধান নিয়ে ওরা কি কবে
মামা? ওদের দেশে ধান হয় না বুঝি?
হয়, হয়, হবে না কেন? কিন্তু তাতে ওদের পেট ভবে না '
এত বড় পেট, বল কি মাম1?
ওর কথা শুনে কাছাকাছি যারা ছিল, তারা সবাই হেসে উঠল।
এক জন বলে উঠল, ঠিকই বলেছিস্ রে, হয় তো! ওদের সবাংগই
পেট, তা না হলে নিচচ্ছ তো নিচ্ছেই, এক নিয়েও ওাদর খিদে মিটছে
না কেন?
ওরা যদি এ ভাবে সব ধান নিয়ে যেতে থাকে, তবে আমরা
খাব কি?
ঠিক বলেছিস্। এ কথা তো সবাই বলছে । কিন্তু শেন কে ?
কয়েকজন একসংগে বলে উঠল ।
আলোচনাটা। এবার লাখুকে বাদ দিয়েই চলল । «ক জন বলল,
মাত্র তিন বছর আগে এত ঝড় একট। আকাল গেল, কত লোক না
খেয়ে মরল। ধানুঠাকুর দিতে আর আমাদেব কম দেন না, কিন্ত
আমরা যদি ধরে রাখতে না পারি, তিনি কি করবেন? আমাদে
ধান যদি আমাদের হাতে থাকত, বে আমাদের ভাবন! ছিল কি।
মিথো বলনি, লাখুর মাম! সমর্থন করে বলল, যায় কি আর এক
ভাবে, নানা ভাবেই যায়! কোনটা সামনা দরজ। দিয়ে, কোনটা ব!
ও বিদ্রোহী কৈবর্ত
পিছন দরজ। দিয়ে । প্রথমেই দেখ না, ফসল উঠতে না উঠতেই
হাত বাড়িয়ে দেবে রাজা । রাজার হাত বিশাল হাত, সেকি অল্পে
স্বল্লে ভরে! ফসলের ছ-ভাগের এক ভাগ, তার এক মুঠো কম
দিলে চলবে না।
রাজা এত ধন দিয়ে কি করে মামা? লাখু কৌতৃহলী হয়ে প্রশ্ন
করল ।
ধান দিয়ে কি করবে আবার, খায়। মাম। হেসে উত্তর দিল।
ও বাবা, রাক্ষস নাকি ? এত ধান খায় |
রাক্ষমই তো । এত (য়ে খেয়েও ক্তার সাধ মেটেনা। শুনছি
আরও নাকি কর বারাতার মতলব আছে।
পাপাপাশি ধান »াটছিল যারা, এই আলোচনায় কেউ উদাসীন
থাকতে পারল না। সবাই ষেযার বক্তব্য বল চলল।
তা! তো করবেই, একজন মন্তব্য করল, রক্তের স্বাদ খন পেয়েছে
একবার, তখন কি আর সহজে ছাড়বে মনে করেছ। এত দিন ওর!
ই মিলে চুষে চুষে খেয়েছে, এখন শুধু হাড়গোড়গুলি বাকি আছে,
ছুদিন বু'দে তাও চিবিয়ে চিবিঘ়্ে খাবে!
এক বুড়ো চাঁধী বলল, জমির আবার কর কি? এনিয়ম কোন
কালে ছিল 'ন।॥ চাষী আর জমি কি আলাদ1? এই মাটির স্বত্ব
নিয়েই আমরা জন্মাই। আন্দ জমির উপর কর নিচ্ছে, ছু দিন বাদে
আমাদের ঘর বাড়ী, গরু ছাগল আর আমাদের বউ ছেলে মেয়ের
উপরেও হয়তো কর বস'বে। এতো নিয়ম নয়, এ হচ্ছে জুলুম,
সোজা জুলুম ।
তোমরা মোড়লরা এ নিষে রাজার কাছে জানাও না| কেন?
মোড়লরা 1? হাদালে তুমি, মোড়লদের কথা শুনছে কে! এ
নিয়ে আগের দিনে কত মারামারি কাটাকাটি হয়ে গেছে । আমর!
কি আর সহজে মেনে নিয়েছিলাম । এ কালে মিথ্যা রাজত্ব রে
ভাই, সত্য বিদায় নিয়েছে । এখন যার গায়ে জোর বেশী তার কথাই
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৬১
কথা। রাজপুরুষরা বলে রাজা যখন আছে করও তখন থাকবেই ।
রাজা আছে, কর নেই, এ কখনে। হয় না ।
লাখুমন দিয়ে এসব কথা বার্তা গুনছিল। সে আর চুপ করে
থাকতে পারলনা, ফস্ করে বলে উঠল, ঘবে না-ই বা থাকল রাজ1।
কি দরকার আমাদের রাজ! দিয়ে?
লাখুর সমর্থকের অভাব ছিল ন।| ভারা বলল, বাচ্চ1 মানুষ
হলে কি হবে, বুদ্ধি আছে লাখুর, সত্যি কথাই বলেছে_-কি দরকার
আমাদের রাজ! দিয়ে ?
লাখুর মাম! হেসে বলল, আমাদের হয়তে। দরকার নেই, কিন্তু
রাজার দরকার আছে আমাদের দিয়ে | ষাই রাজার হাত থেকে ছাড়!
পাওয়। বড় কঠিন। কিন্ত রাজার করই তো! একমাত্র কথ! নয়।
গৌড়ের বণিকদের জন্যই আমাদের দেশের এত ধান বাইরে চলে
যায়, আর আমরা ন। খেয়ে মরি । ওদের হাতে অর্থের অভাব নেই।
ফসল উঠবার আগেই ওর! চাষীদের কাছ থেকে ক্ষেতের ধান কিনে
রাখে । তারপর ফসল ওঠার সংগে সংগেই সব ধান চালান দেয়
গৌড়ে। ধানে বোঝাই যে মোষের গাড়ীগ্চলো গে”, সব তো
ওরাই পাঠাচ্ছে। এ তুম কেমন করে আটকাবে? এ নিয়ে যদি
কিছু বল, ওরা সাফ উত্তর দিয়ে দেবে, আমরা ঘা আর জোর করে
কারও কাছ থেকে ফসল কিনহি না। ভোমদের জিনিস, তোমব।
ইচ্ছ! হয় দেবে না! হয় না দেবে।
কথাটা: মধ্যে যুক্তি আছে, সবাই ভাবিত্ত হয়ে পড়ল। এক জন
বলল, কিন্তু আমরাই বা কেন ওদের কাছে বিক্রী করতে যাই?
দেশের ধান দেশে থাঁকলে সবার পক্ষেই তে। ভাল ।
লাখুর মাম! একটু ভেবে উত্তর দিল, মানলাম তোমার কথা । এ
কথা তুমিও বুঝলে, আমিও বুঝলাম, সবাই তো বুঝাবে না৷
কেন বুঝবে না? নিজের ভাল মন্দ সবাই বোঝে।
সবাই বোঝে ? উহু“ বোঝে আবার বোঝেও না। আমাদের এ
৬২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
অঞ্চলে ওর! ধান কিনতে আনছে না এধনও, তাই সহজেই কথাটা
বলে দিলে, কিন্তু আসলে কথা্ট। এত সহজ নয়। এখানে সে সময়
ধানের যে দর, ওরা তথন তার চেয়ে কিছু বেশী দর দিয়ে কিনে নেয়
গরীব চাষী ওদের কাছে ধান বিক্রী করবার দিকে ঝুঁকে পড়বে না?
তাছাড়া আরও স্ত্রবিধা আছে এতে । ওরা চাষীদের সমস্ত ধান এক
সংগে কিনে নেয়। তার ফলে ধানু বিক্রী করবার জন্য তাদের হাঁটে
হাটে ঘুরে মরতে হয় না, ঘরে বসেই যে যার পাওনা পেয়ে যায়।
প্রশ্নট। খুবই জটিল। প্রস্তাবকারী এর উত্তরে কোন কথা খু'জে
ন! পেয়ে চুপ করে রইল ।
একজন প্রশ্ন করল, কিন্ত বেশী দর দিয়ে ধান কিনে ওদের
লোকসান পোয়াতে হয় না?
লোকসান ? হ্যা, এত কাচা ছেলে কিন! ওরা ? গৌড়ে ধানের
দর সব সময়ই তাঁর চেয়ে অনেক উপরে থাকে যে।
কিন্ত এখান থেকে এত দূরে ধান বয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচা তো
বড় কম নয়, সেটাও তো! দেখতে হবে।
কিছু না, কিছু না। ওরা ও সব কথা আমাদের শোনায় বটে,
কিন্ত ওদের লাভের অংক বিরাট । সে তোমরা ধারণাও করতে
পারবে ন।। আনাদের এই ধান নিয়ে ব্যবসা করে ওরা এক এক
জন যনে হাতী হয়ে উঠেছে। দেখ না ওদের চেহারা ?
এবার আর এক জন আর এক কথা তুলল। বলল, ঠিকই
বলেছে মোড়ল, এই বণিকদের নিয়ে বু ভোগান্তি আছে আমাদের ।
ওর! পংগপালের মত দল বেঁধে আমাদের ক্ষেতে এসে পড়ছে । শে
পর্যন্ত আমাদের উচ্ছন্ন না করে ছাড়বে না। আমার শ্বশুর বাড়ীর
দেশে দেখে এলাম এক আশ্চ্ধ ব্যাপার। একেবারে অভাব্য কাও |
কি অভাব্য কাণ্ড! সবাই কৌতৃহলী হয়ে তার মুখের দিকে
ভাকাল।
বণিকের নাম চন্দ্রধর। বিরাট ধনী। ও অঞ্চলে সবাই তাকে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৬৩
চেনে। মৌড়লদের ডাকিয়ে এনে সে এক দিন প্রশ্ন করল,
তোমাদের এখানে ধানের দর কত গো? ওরা বলল, এত । চন্দ্রধর
বলল, বেশ, তোমাদের এই গ্রামের সমস্ত চাষীর ধান আমি এ দরেই
কিনে নেব। বল, তোমর! তোমাদের সব ধান দিতে রাজী আছ
ক না।
তার কথ। শুনে চাষীরা হেসে উঠল, এ সময় ধান কোথায় গো ?
আমরা তো! এখনও মাটিতে লাংগলই ছোর়াইনি মোটে । আগে
ফসল উঠুক, তবে তো। ধান ঠাবুরের আশীবাদ ছাড় ধান হয় না
কখনও । তার উপরে পোক আছে, রোখ, আছে, দেও-দেবতার
দিষ্টি আছে, এত সব বাধাবিদ্ধি পেরিয়ে তবে তো । ধানটা গোলায়
উঠতে দাও আগে, এ সব কথাবার্ী তার পরে হবে।
চন্দ্রধর বলল, আহা, আগেই হোক, আর পরেই হোক, ধান তে।
উঠবেই।
ওরা বলল, উঠুক, উঠুক, উঠক। কিন্তু না ওঠ। পর্যন্ত বিশ্বাস
নেই। সেবার মেই ঝড়ের বছরের পরের বছর পোক। লেগে সারা
গ্রামের ধান যেন পুড়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেল। এক দানা ধানও কেউ
বরে তুলতে পারে নি।
চন্্রধর দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিরে বলল, ভগবান ন।
করুন, কিন্তু তেমন অজন্মাই যদি হয় তবে তোমরা কোথ্খেকে ধান
দেবে, আর আমিই ব কেমন করে চাইব ? আমার কথাটা হস্ছে এই
যে, ধান যা উঠবে, সবটাই আমাকে দিতে হবে। আমি এক
জায়গার বপে কাজ করতে ভালবাসি । 'ধান' “ধান করে এখানে
ওখানে ঘুরে মরতে ভাল লাগে না আমার।
কিন্ত তাই বলে এত আগে কেন? ওরা আবার সেই প্রশ্ন
করল।
চন্্রধর উত্তর দিল, তোমরা গরীব মানুষ, চাষের দমর অর্থের
প্রয়োজন হয় না তোমাদের ?
৬৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
হয় বই কি, সবাই সমস্বরে উত্তর দিল, কিন্ত সে কথা কেন?
তোমরা যদি আমার প্রস্তাবে রাজী থাক, আমি তোমাদের
জমির পরিমাণ অনুসারে কিছু কিছু আগাম অর্থ দিতে প্রস্তুত আছি।
এমন আশ্চর্য কথা কেউ কোনদিন শোনেনি । জিনিস দেবার
আগেই জিনিসের দাম! একজন মোড়লের মনে খটকা লাগল, সে
জিজ্ঞাসা করল, কেন গো, ধান পাওয়ার আগেই তুমি দাম দিতে
যাবে কেন? কোন দেশে কোন কালে এই নিয়ম নেই ।
চন্দ্রধর হেসে বলল, না, এ নিয়ম অনেক জায়গাতেই আছে।
তোমরা তো নিজের দেশ ছেড়ে বাইরে যাঁওনা, তাই এ সমস্ত খবর
রাখ না। আমি তোমাদের আগাম দিতে চাইছি কেন? শোন তবে
বলছি । আমি কোন নতুন মানুষ নই, তোমাদের এখানে বনু দ্রিন
থেকেই আছি। তোমাদের কোন খবর জ।নতে বাকি নেই আমার !
তোমর! চাষীরা খুবই গরীব । অনেকেরই নিয়ম মত ছুবেলা খাওয়!
জোটে না, কেমন ঠিক বলছি কিন] ?
ওরা! বলল, ঠিক বই কি। ছুবেণ। পেট পুরে খাগ্ঘা, সে আর
ক'জনের জোটে !
এই চাষবাসের সময় সকলেএই হাতে খদি কিছু কিছু সম্বল
থাকে, তবে তাতে কি কাজের সুবিধা হয় ন।? ন। খেয়ে কেউ কি
আর ভাল করে কাজ করতে পারে?
তাকি আর পারে । ছা ছাড়া চাষের কাজে এভাবে ওভাবে
অনেক খরচ আছে। কিন্ত এই সন্বপ আমরা পাচ্ছি কোথায়;
সারা বছর টেনে টুনে খাওয়া পর1 চলে মাত্র, কিছু খে! আর বাঁচে
না।
দেই জন্যই তো! আমি তোমাদের কিছু কিছু আগাম দিখে
চাইছি ।
কিন্ত, কেন, তুমি দেবে কেন? মোড়ল আবারও সেই প্রন
করল ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৬৫
কেন দেব ন।? দম তো৷ আমাকে দিতেই হবে, ন। হয় কিছু
দিন আগেই দিলাম । এ আমার গায়ে লাগবে না। তোমরা যদি
ভাল ভাবে খাটতে পার, বেশী ফসল হবে । আর ফসল বদি বেশী
হয় তাতে তোমাদেরও লাভ, আমারও লাভ । এবার বুঝতে
পারছ তো?
মোড়ল ঘাঁড় নেড়ে বলল, ই, পারছি । কিন্তু কথাটা আমরা
ভেবে দেখি আগে, তারপর তোমাদের বলব।
এই কথা! বলে সেদিনকার মত বিদায় নিল তা1।
খবরট! শুনে গ্রামের চীষীরা মহাখুনী । অন্গাব কার সংসারে
নেই? তা ছাড়া 'াষের সময়ট।, সয়া বছরের মোক্ষম সময়, এ সময়
কিছু হাতে থাকলে কত সুবিধা । এ স্থঝোগ কেভ কোন দিন
তাদের দের ।ন। এমন শ্র্োগ কে ছান্ডে। তারা বলল, বেচে
থাক চন্দ্রধর, তাঁর ব্যবসা? উন্নাত হোক।
অবশ্য কে? কেউ বলেছিল, এত ভাল, ভাল নয়। ওর কি যেন
একট মতলব আছে ।
কিন্ক তা.দপ কথা আমল পেল ন]।
কথ বাত প্রাক। হয়ে গেন।। প্রথম খন্দট। ভালোয় ভালোয়
কাটল। এই ব্যবস্থায় ক্ষতি হয়নি কারও, বরঞ্চ লাভই হয়েছে।
সবাই সে কথ! স্বীকার করল | তার পরের বছর সময় মত বৃষ্টি না
হওয়ার জন্য ফসল কিছু কম হল। ফলে ধানের দর গেল চড়ে ।
চন্দ্রধর মোড়এদের ডাক্িয়ে এনে বলল, কই, তোমরা এখনও
তোমা দর «ান দিয়ে যাচ্ছ না যে? শুনতে পেলাম তোমাদের কেউ
কেউ কিছ দ্রিন আগেই ধান কেটে ঘরে নিয়ে তুলেছ। এমন তো
কথা ছিল ন। | কথা ছিল, তোমর। ধান কেটে আমার গোলায় এনে
পেঁছে দিয়ে বাবে। আর আমিও তোমাদের সামনে সেই ধান
মাপ করে গত বছরের *বে তোমাদের দাম দিয়ে দেব। কিন্তু
এবার দেপী করছ কেন তোমরা ?
বিজা
৬৬ বিজ্রোহী কৈবর্ত
কথা শুনে ওর! যেন আকাশ থেকে পড়ল । বলল, সে কি গো,
তোমার সংগে ব্যবস্থা হয়েছিল গত বছরের জন্য, এবার তার কি?
এবার চাষের আগে তুমি ছিলেই ন। এখানে । দেখাও হয় নি
তোমার সংগে, কথাবাত্তী তো দুরের কথা । আর এবার ধানের দর
গতবারের চেয়ে বেশী । সে দরে আমরা কেন ছাড়ব?
চন্দ্রধর চক্ষু রক্তবর্ণ করে বলল, কি, আমার সংগে ফাকি! শুধু
গত বছরের নয়, তোমাদের সংগে পাঁচ বছরের মত কথা হয়েছিল ।
সেই ব্যবস্থা মত এ দরে পাঁচ বছরের জন্য জামার কাছে ধান বিক্রি
করতেই হবে তোমাদের |
মোড়লরাও ক্ষেপে উঠে বলল, তুমি বলছ কি এ সব? পাঁচ
বছরের কথা কখনোই হয় নি। আমরা এবার আগাম নিয়েছি
তোমার কাছে?
চন্দ্রধর উত্তর দিল, আগাম সম্পর্কে সেরকম কোন কথাই ছিল
না। গত বছর তোমাদের হুরবস্থা দেখে দয়া করে কিছু কিছু
আগাম দিয়েছিলাম । কিন্তু তেমন কোন শর্ত তোমাদের সংগে
ছিল না।
ধই নিয়ে ছুপক্ষে বিষম ঝগড়। বেঁধে গেল। শেষকালে
রাজপুরুষেরা' এল ব্যাপারটার বিচার করতে । চন্দ্রধরই তাদের
খবর দিয়ে আনিয়েছিল।
কোন্ বছরের কথা বলছ? শ্রোতাদের মধ্যে ব্রকজন প্রশ্ন
করল।
কোন্ বছর আবার কি, এই তো! সে দিনের কথা । আমি আমার
বউকে আনতে শ্বশুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম । তখন সবই স্বচক্ষে
দেখে এসেছি । বিচারের সময় আমি সামনে ছিলাম । ওরা এসে
দুপক্ষের কথা শুনে বলল, তোমাদের কি মুখে মুখেই সব কথা,
লেখাপড়া কিছু নেই 1
চন্দ্রধর বলল, অবশ্ই আছে । অত কাচা কাজ আমি করি না।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ভা
ছু পক্ষ যার যার পত্র নিয়ে এপ | ছুটে। পত্র পড়েই দেখা গেল,
চন্দ্রধর ঝা বলেছে সেইটাই ঠিক।
ব্যবস্থাট পাঁচ বছরের জন্যই করা হয়েছিল, সেই কথাই লেখা
আছে। তা ছাড়া আগাম দেয়! সম্পর্কে কোন কথাই তাতে ছিলনা ।
ওরা সেই পত্র সবাইকে শুনিয়ে বলল, কি হে, তোমাদের ছুটে!
পত্রেই তো পাঁচ বছরের কথ্থা লেখা আছে, তবে তোমরা এখন তা!
মানতে চাইছন1! কেন? এ সব দুষ্ট বৃদ্ধি ছাঁড়। যে নিয়মে আবদ্ধ
হয়েছ, সেই নিয়ম মত কাজ কর, ত। নইলে তোমাদের কপালে ছখ
আছে বলে দিচ্ছি। এক! বিদেশী মানুষকে পেয়ে সবাই জোট পাকিয়ে
তার পিছনে লেগেছ, এতই সাহস তোমাদের ! দেই জন্যই বলছি,
বণিকের ঘা ন্যায্য প্রাপ্য, সেটা তাকে ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও।
নইলে এ কথ। যদি উপরে যায়, তবে তার ফল খারাপ হবে__খুব
খারাপ হবে।
চাষীরা অবস্থাট। বেগ তিক দেখে মোড়লদের মুখের দিকে তাকিয়ে
ভয়ে ভয়ে বলল, কি গো, এরা এ মব বলছে কি ? মোঁডলেরা, প্রথম-
টায় একেবারে থ' খেয়ে গিয়েছিল । শেষে তিন মোড়ল একই সংগে
চেঁচিয়ে উঠল, সব মিছে কথা, মিছে কথা বলছে বণিক ।
চন্দ্রধর বলল, কোন্ট!? সত্য আর কোন্টা মিথ্যা, সে তো পত্র
থেকেই প্রমাণ হচ্ছে । আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, এ সব চেঁচামেচি
আর ঝগড়াঝাটি আমি পছন্দ করি না।
রাজপুরুষদের মধ্যে বড় কর্তা যে, সে পত্রটা মোড়লদের
নাকের ডগ্গায় ধরে বলল, এই যে পত্রের নীচে তোমাদের তিন
মোড়লের নাম লেখা আছে । এ নাম কি তোমরা! নিজের হাতে
লেখনি ?
ওর! বলল, হ্যা, আমরা নিজেরাই লিখেছি । যা! সত্য কথা তা
বলব না কেন?
তবে?
৬৮ বিদ্রোহী কৈবতত
কিন্ত বণিক যে এ সব কথা এমন করে লিখবে তা আমর! কেমন
করে বুঝব।
কেন, নামট1 লিখবার আগে পত্রট1 পড়েও দেখনি একবাণ ?
ওরা বলল, না, পড়ে দেখিনি আমরা । মুখে যেট। স্থির হয়,
সেটাই পত্রে লিখতে হয়, এটাই নিয়ম বলে আমরা জানি । কিন্ত
মুখের কথাকে যে লেখার সময় কেউ এমন ভাবে উলটে দিতে পারে,
এ কথা কেমন করে ভাবব আমরা ?
রাজপুরুষদের ব্ড় কর্তা গরম হয়ে ধমক দিয়ে উঠলেন, তোমর!
কি বোকা! বৌঝা-ত চাইছ আমাদের । ত্যেমপা কচি ছেলে, কিছু
বোঝ না। ও সব শয়তানী আমাদের ক।ছে খাটবে ন।। ভাল চাও
তো বণকের সংগে ধেমন করে পার একটা শীমাংস। কবে নাও ত।
না হলে বাধ্য হয়ে আমাদের এ ব্যাপানে হান দিতে ইবে।
তখন শুধু ধান দিয়েই পার পাবে শা, জনি নিয়েও টান পড়তে
পারে। পরম ভট্টারক মহীপালদেবের রাজত্বে এ সমস্ত তঞ্চকতা।
চলবে না।
ঘটনাট বিবৃত্ত করে বক্তা এবার একটু থামল। কৌতুহলী
শ্রোতার! ব্যগ্রকঞ্ে প্রশ্ন করল-ত।রপর % ঘ্ারপর ?
তারপর আর কি? রাজপুরুষদের আদেশ অমাগ্য করবে কে?
শেষকালে বণিকের কথাই টিকে গেল। মোভালেরা অবশ্য সেই
পত্র নিয়ে সামন্ত দিব্যোকের কাছে গিয়েছিল । তিনি সমস্ত কথ
শুনে আর সেই পত্র দেখে বললেন, এখন আমি এর কি করতে
পারি? আজকালকার প্রিনে এমন কাচ। কাজ করতে আছে ।
মোড়লের। বলল, দশে সভায় বসে থে কথা । নিজের মুখে বলল,
সে কথাট! যে কেমন করে উলটে দিতে পারে, এ আমরা কোন দ্দিন
দেখিনি, শুণিও নি। সেই জন্যই তে! আমরা পত্রট। পড়ে দেখবার
দরকার আছে বলে মনে করিনি। আর দশের কথার চেয়ে ওই
পত্রটাই বড় হে।ল, এই বা কেমন কথা ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৬৯
এ কথার উপর সামন্ত দিব্যোক নাকি বলেছিল, ঠিকই. বলেছ
তোমরা ৷ আমর অসভ্য কৈবত্্য, গগীড়ের সভ্য লোকদের রীতিনীতি
আমরা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু বীচতে হলে আমাদেরও ওদের
সংগে ওদের মতই ব্যবহার করতে হবে। এবারকার এ শিক্ষাট।
ভূলে যেও না তোমর।।
লাখু অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনি, এবার একটু ফাক পেকে
বলে উঠল, কিন্তু ধান? ধাঁনেরকি হোল? সেই বণিক ব্যাটার
হ।তেই গিয়ে পড়ল নাকি?
কেমন করে ষলব, আমি ত চলে এলাম । তবে বুঝলাম ন দিয়ে
উপায় নেই, দিতেই হবে। কিন্তু এসব নিয়ে মানুষ বড় গরম হয়ে
আছে । যে কোন সময় একট গোলমাল বেঁধে যেতে পারে।
পিছন থেকে একজন মন্তব্য কথল, কিন্ত সামন্ত দিব্যোক কি এ
ব্যাপারে হত দিতে পারত না? ছুটো ভাল কথ শুনিয়েই তার
দায় সারল ! তার তো রাজধানীতে যাওয়া আসা আছে। আবার
শুনি রাজা নাকি তাকে খুব খাতিরও করেন।
আরে রাখো খাতির ! খাতির তো নয়, এ হচ্ছে ওদের কার্য
সিদ্ধির ফন্দি। ওরা এক দিকে আমাদের শুপ্ষ খাচ্ছে, আর এক
দিকে নানা রকম স্থযোগ স্তুবিধা দিয়ে আমাদের সমাজের মাথা-
গুলিকে কিনে নিচ্ছে। তা নইলে দিব্যোকের মত লৌক কিনা
ছি, ঠিছি দ্রিব্যোক সম্পর্কে এ সব কি বলছ তোমরা? যা
বলবা« একটু বুঝে শুনে বোলো । দিব্যোকের বাবা মহোকের কথা৷
মনে আছে তোমাদের ?
পিছনের লোকটি বড় ঠ্যাটা স্বভাবের, যে কথাটা একবার ধরে
বসে, তা ছাড়ানো কঠিন। সে উত্তর দিল, আমর! যে কথা বলি,
বুঝে শুনেই বলি। দিব্যোকের বাবা মহোক, তার কথা মনে
থাকবে না? আমাদের জন্য সেযা করে গেছে, এমন কেউ করে
না। তার ছেলে বলেই তো দিব্যোকের এত নাম ।
৭৩ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কেন, দিব্যোক আমাদের সমাজের জন্য কোন কিছুই করেনি ?
মানুষ ঝড় বেশী তাড়াতাড়ি সব কথা ভূলে যায়।
লাখুর মামার এই কথার উত্তরে পিছনের সেই লোকটি সংগে
সংগেই বলে উঠল, না! কোন কথাই ভূলে যাইনি আমরা । যত দিন
সমাজের জন্য ভ'ল কাজ করেছে, কে ন প্রশংসা করেছে তার ?
কিন্ত রাজার প্প্রিয়পাত্র হবার পর থেকে সে কি এমন কাজটা করেছে,
দেখাও আমাকে ।
লাখুর মাম! দিব্যোকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগট। কিছুতেই
মেনে নিতে পারল না। সে বলল, এই এক কথা পেয়েছ তোমর! !
কিন্তু এ সবই উড়ে। কথা । উদ্ভে। কথায় কান দিও না। করেক্্রী
আজ শক্রর চরে ছেয়ে গেছে । আমার তে। মনে হয়, এসব তাদের
প্রচার ছাড়! আর কিছুই নর । আমাদের যারা প্রধান, তাদের সম্পকে
ওরা ওদের য1 খুণী তাই ছড়িয় ফে্ড়োচ্ছে' আর আমরাও এমনি
বোকা যে, যেখানে ঘা শুনি, সেটাই বিশ্বাস করে বসি ।
কিন্তু এ সব কথা বলে আজকাল আর লোকের মুখ চাপা দিয়ে
রাখা যাঁয় না। লাখুর মামার পাশেই দাড়িয়ে ষে লোকটি ধান
কাটছিল সে খুবই ঠাণ্ডা স্বভাবের লোক। এতক্ষণ কোন কথ!
বলেনি, মুখ বুজে কাজ করে চলেছিল । সেও কিনা ফস্করে বলে
উঠল, বলি কি আর বড় সুখে মোড়ল, অনেক ছুঃখেই এ সব কথ।
বলতে হয়। মহোকের ব্যাট! দিব্যেক তাকে আমর। আগেও
দেখেছি, এখনও দেখছ। রাজার কাছ থেকে মানমর্যাদ! পেয়ে
এখন আমাদের কথা, কি আর মনে আছে তার? বিপদে আপদে
পড়ে অনেকেই "তার কাছে গিয়েছে, কিন্ত কোন কাজ পেয়েছে
কেউ? তার এক কথা; আমি কি করব, আমার কি কোন ক্ষমত।
আছে? এ কেমন কথা! তুমি আমাদের সমাজের মাথ|, তোমার
কথায় সার। সমাজ ওঠে বসে, এ কি তোমার উপযুক্ত কথা ! আসল
কথা, সৈ আর এখন আমাদের লোক নয়, সে ওদের দলেই ভিড়েগেছে।
বিদ্রোহী কৈব$ ৭১
তার কথা সমর্থন করার লোকের অভাৰ ছিল না। একজন
বলল, শুধু কি দিব্যোক, সমাজের মাথা বলছে যার! একে একে
তাদের সবার-রূপই প্রকাশ হয়ে পড়েছে । জবাই যে ষার নিজের
নিজের পৌটল! ভরতে ব্যন্ত। সমাজের মানুষ বাঁচুক আর মরুক,
তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথ! নেই।
লাখুর মাম! দিব্যোকের নিন্দা সহ্থ করতে পারে ন1। ভার
বিরুদ্ধে কেউ কোন কথ বললে মে যেমন করে পারে একটু প্রতিবাদ
করবেই। কিন্তু প্রতিবাদ করে কুলিয়ে উঠতে পারে না। ওরা যে
সব কথা বলে তা একেবারে মিথ্যা বলে উড্ভিয়ে দেবার উপায় নেই।
কিন্তু তা হলেও--তার মনের এই কিন্তুটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠছে
পারে না। তার মূল অনেক গভীরে প্রবেশ করে গেছে। দিব্যোকের
কথাটা যখন একবার উঠে পড়েছে, তখন সহজে থামবে বলে মনে
হয় শা।
তাই বোধ হয় কথাটাকে চাপ! দেবার জন্যই সে বলে উঠল,
থাক থাক, এখন ওসব কথ ছেড়ে দিয়ে কাজে হাত লাগাও ভাইর|।
কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল।
পাঁচ
প্রথমে শোন। গিয়েছিল ডাকাতের দল! রাজপুরুষেরা সেই
কথা বলত, দেশের লোকেও তাই জানত । আগেকার দিনে চুরি
বা ডাকাতি কাকে বলে কৈবর্তেরা তা জানত না। এ তাদের
জাতের ধর্ম নয়। চোর অর ডাকাত এ ছুটো শব্ধ তারা সব প্রথমে
গৌড়ের লোকদের মুখেই শুনেছে । প্রথম প্রথম তারা মনে করত
বোধ হয় কে।ন বুনো জন্ত জানোয়ার হবে। মানুষ বে কখনও এ
সব কাঙ্গ করতে পারে, এ কথ। বুঝে উঠতে ওদের অনেক দিন
সময় লেগেছিল । ওদের ছেলেপিলেরা এখনও ত।ই মনে করে
লম্বা লম্ব। শিং, লম্বা! লেজ, বাঘ সিংহের মত নরম নএম পায়ের থাবা,
তাই নি£সাড়ে চলফেরা করতে পরে, কোন সময় কোন দক থেকে
এমে পড়বে, এক মুহুর্ত আগেও তা বুঝবার উপায় নেই, চোর
ডাকাত নিয়ে ছোটর। এই ধরনের নানা একমের জগ্লীনা করে।
আবার এক রকম চোর নাকি আছে' যারা জন্ত হলেও মন্ত্র পড়ে ঘুম
পাড়িয়ে রাখতে পারে, শুধু বাচ্চাদেরই নয়, বড়দের পর্যন্ত ।
কিন্তু কৈবর্তদের সে দিন আর নেই । গৌড়ের লে।কদের সংস্পর্শে
আসবার ফলে নাদের মধ্যেও সভ্য তার কিঞ্িংঅ'লে। এদে পড়েছে ।
আগেকার চেয়ে অনেকেই বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে তারা, গৌড়েন
লোকেরা এখন সে কথা স্বীকার করে। তেমন প্রয়াজন পড়লে ছ
চারটে মিথ্যে কথ। বলার অভ্যাসটা ক্রনে ক্রনে রপ্ধ হে আপছে।
অভাব বাড়বার সাথে সাথে ছোটখাটে। টুরি-ঢামারীর কথাও শোনা
ধাচ্ছে। কিন্ত ডাকাত ? না, এদেশে ডাকাত কখনোই ছিল না।
বছর ছুই হোল, এই উৎপাঁত দেখা দিয়েছে ।
এ নিয়ে কৈবর্তদের মধ্যে চাঞ্চল্য, উত্তে্গনা আর জল্পনা কল্পনার
অন্ত নেই। বাচ্চারা ভয়ে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বেরোতে চায় না।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৭৩
পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক বসে- প্রতিকারের উপায় কি? প্রথম থেকেই
খদি একে ঠেকানো! না ষায়, তবে সমাজ বলতে কিছু আর থাকবে
না। কিন্তু কে ঠেকাবে” কেমন করে ঠেকাবে? সমজের কি
আর সেই শক্তি আছে! কৈবর্তদের মধ্যে কিছু কিছু আধুনিক
হোকরা মাথা জ গিয়ে উঠেছে, যারা গৌড়ের সভ্যতার গুণগানে
পঞ্চমুখ ' ওদের এই আছ, ওই আছ, বলে লে ওরা আর শেষ
করতে পারে না! প্রা্ীন 'স্থী বুড়োরা হাদের দিকে তাকিয়ে তিক্ত
হাসি হেসে বলে. নাও, তোমাদের মদনর ছুঃখ এবার মিটল।
অ'মাদের সভ্য হতে আর বেশী বাকী নেই ।
'কন্ত কিছু দিন ।দে দেখা গেল, বাগারট!র পিছ;ন যেন একটা
রহস্য অছে ভাকাতি শুর হবার প্র থেকে একটা জিনিস
অনেকেরই দিতে পড়েছে । এ ডাতাতরা যেন ঠিক আর সব
ডাকাতদের মনত নর। ওদের একটা বিশেষ দিকে চোখ । এ
পধন্ত ডোট বড় ধে কটা ডাকাতি হমেছে, তার কে'নটাই কৈবর্ত-
দের বাড়ীতে নয়। গৌড় থেকে বে সব 'লকরা এখ নে এসে জমি
জম] ঘর বাড়ী করে থিতু হরে ব:সহ্ছে, ওদের নজবটা তাদের দিকেই !
কেউ কেউ বনল, আমদে কৈবতদের ঘবে আছেই বা কি,
আর নেবেই বাকি! যাদের ঘরে গেলে ভাল মত কিছু পাওয়ার
আশা আছে, সেই এমস্ত শাসালো লোকেদের ঘরেই তো
ওরা খাবে।
কথ'টার মধো কিছুট। সত্যতা আছে স.ন্দহ নেই, তবে লোকের
মনের খণ্কাটা কিন্ত কাটল না। বাইরে থেকে যারা এখানে গীট
হয়ে বসোছল, তারা মাতংকিত হয়ে ধন প্রাণ বাঁচাবার জন্য রাঁজ-
পুরুষদের কাছে এসে ভিড করতে লাগল । রাজপুরুষেরাও
নিজেদের কমঠত। প্রমীণ করবার জন্য হস্ত দন্ঠ ছয়ে ছু'টাছুটি করতে
লাগল। জন্দেহ করে একে ধরে, ওকে ধরে, জোয়ান জোয়ান
ছেলেদের ধরে এনে মারপিট করে ।- কিন্তু ডাকাতি যেমন চলছিল,
৭৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তেমনি চলতে লাগল, ডাকাতদের টিকিটারও নাগাল পাওয়া
গেল লা। শুধু অকারণে নির্দোষ মানুষগুলির উপর দিনের পর দিন
এমনি ভাবে নিগ্রহ চলল | মানুষ এমনিতেই ক্ষেপে ছিল, আরও
ক্ষেপে উঠল।
লোকের মনের সন্দেহট1 ঘে অমূলক নয়, ক্রমেই তা স্পষ্ট হয়ে
উঠতে লাগল, এ পক্ষ ও পক্ষ ছুপক্ষের কাছেই । ডাকাতের রাত্রি
বেলা ডাকাতি করতে অ'সে, এটাই তাদের নিয়ম । কিন্তু ওদের
নিম আলাদা । ছ্িন বাতের বিচার নেই ওদের, যখন যেখানে
হ্যোগ পায়, অমনি সেখানে গিয়ে ছো। দিয়ে পড়ে । ঝড়ের মত আসে
আর যা কিছু পায় লুটে পুটে নিয়ে ঝড়ের মতই কোথায় মিলিয়ে যায় !
প্রকাশ্ঠ দ্রিবালৌকে বণিকদের ধানের গাড়ী লুট হতে লাগল । আজ
এখানে, কাল ওখানে | শুধু তাই নয়, একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়
এ ধরনের হামলা হচ্ছে, এখন খকরও শোনা যায়। রাঁজপুরুষেরা
ছুটোছুটি করে হয়রান হযে পড়ল । দিনে ছুপুরে নিত্যি তিরিশ দিন
যদি এই সমস্ত ঘটন] ঘউন] ঘটে, তবে তারাই বা আর কেমন করে
পারে। কৈবতেরা ওদের সংগে দেখ। হলে মুখ ফিরিয়ে হাসে । মনে
মনে বলে এবার মজ।ট1 কোক বাছাধনরা।
ডাকাতরা যে তাদের শক্র নয়, কিছু দিন বাদে কৈবর্তেরা সে কথ
বুঝতে পারল | এ পধন্ত এন্ত ঘটনা ঘটল, কিন্ত কোন কৈবর্তের উপর
হামল! হয় নি। তাদের ধানের গাড়ী অবাধে চলাচল করে। আবার
এ কথাও শোনা গেছে, এই ডাকাতরা যা কিছু লুটপাট করে তার
মধ্যে অধিকাংশ অভাবী কৈবতর্দের মধ্যে বিলিয়ে দের । সত্য না
মিথ্যা! কে জানে, কথাট। কিন্তু বায়ুবেগে ছড়িয়ে পড়ল। ছোট-বড়
মেয়ে-পুরুষ সবার কানেই একথা এসেছে । তারা বলাবলি করে,
কিসের এর। ডাকান্ত, এরাই আমাদের সত্যিকার আপন মানুষ ।
জোয়ান ছেলেরা কানাকানি করে; দেখি আরও কয়েকট। দিন, শেষে
আমরাও ওদের পথ ধরব ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত শ৫
অবস্থ! বেগতিক দেখে বণিকর। তাদের ব্যবসাপত্র গুটাতে লাগল
তার! বলে, গ্রামে শ্রামে ওদের লোক আছে, রাই ওদের খবর
যোগায় । তা না হলে দিনে ছুপুরে এমন হতে পারে কখনো । এ
অবস্থায় ধনের মারা করতে গেলে ধনও যাবে, প্রাণও যাবে । কিন্তু
বণিকরা যাই বলুক, বরেন্দ্রী থেকে গৌড়ে ধানের চালান বন্ধ হয়ে
যাবে, এ কখনোই হতে পারে না । বরেক্দ্রীর ধান না৷ হলে গৌড়ের
কেমন করে চলবে ? তাছাড়া ওদের ভয়ে বণিকরা যদি তাদের কাজ
কর্ম বন্ধ করে দেয়, তবে তাঁর ফলে সআ্াটের মর্ধাদার হানি ঘটবে,
ওদেরও সাহস বেড়ে যাবে । অবস্থাকে আয়ছে আনবার জন্য গৌড়
থেকে সৈন্য পাঠানো হতে লাগলো ।
রাজধানী থেকে খবর এসেছে, ধানের চালান যেন কিছুতেই বন্ধ
না থাকে । সশস্ত্র সৈম্তেরা গাড়ীগুলিকে রক্ষা করবার ব্যাপারে
বণিকদের সংগে থেকে সাহায্য করবে । তারপর আরও একদল সৈন্য
এল ডাকাতদের আর তাদের পক্ষের লৌকদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে |
এমন শিক্ষা যে শিক্ষা তারা কোনদিন ভুলতে পারবে «না ।
এ কথা ঘোষণ। করতে তার! দ্বিধ। করল না। নিতাস্ত সাধারণ মানুষ
যারা, তারাও বৃঝল ব্যাপারট1 বড় কঠিন অবস্থার মুখে এসে
দাড়িয়েছে ।
রাজার সৈন্যের আর রাজপুরুষেরা ঘতই গর্জীক,ডাকাতর! কিন্ত
একটুও ভয় পায় নি। প্রথম স্বযোগেই তাক! তার প্রমাণ দিল।
চার জন সশস্ত্র সৈন্স এক বণিকের এক বহর গাড়ীকে পাহারা দিয়ে
নিয়ে যাচ্ছিল । ওরা গাড়ীগুলির জন্য বনের আড়ালে ওৎ পেতে
বসেছিল । ধানের গাড়ীগুলি এসে পৌছতেই ওর তাদের ওপর
ঝাপিয়ে পড়ল । রক্ষী সৈন্যের! প্রস্তৃত হয়েই ছিল । সেইখানে একটা
খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ডাকাতরা সংখ্যায় অনেক বেশী । চারজন
সৈম্ত আর বণিক মার পড়ল । খবরটা রাজপুরুষদের কাছে বয়ে নিয়ে
যাবার মত একট1 লোক অবশিষ্ট রইল না। সৈম্দের অস্ত্রগুলি হাতে
৭৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
করে নিয়ে ওরা এগিয়ে চলল, আর মোষের গাড়ীর চালকরা যেন
বিশেষ কিছুই হয় নি এমনি ভাবে তাদের পিছন পিছন অনুসরণ
করল।
মারামারি কাটাকাটি দেখে শান্ত প্রকৃতির মোষগুলি ভয়ার্ত হয়ে
উঠেছিল। এখন নিরুদ্বিগ্ন টিত্তে পরম আরামে রোমন্থন করতে
করতে এগিয়ে চলল ।
রাজার সৈন্যদের সংগে এমন মারামারি কাটাকাটি কতই তো
হয়েছে । কিন্ত সে আগেকার দিনের কথা, তখনও কৈব্তরা এমন
ভাবে মরে যায় নি। নার্ুপর থেকে রাজপুরুষদের হাতে, সৈন্যদের
7ত টকিবতর্দের ভু লোককেই নানা উপলক্ষে প্রাণ দিতে হয়েছে ।
কিন্ত এত দিনে এশার ভাব পালট। | গবে গৌরবে ওদের বুক ভরে
উঠল । রাঁজপুরাষেরা এত সহজে এ ব্যাপারটা হজম পরে নেবে না,
এ কৃথ! বত বেবঝে । কিন্ত আপাতত ভয় করবার কথা কারও মনে
৷ /৩
ইঁ তমনে ডিহরকারু বুহশ্তগ। প্রকাশ হয়ে গেছে । ডাকাত দলের
সর্দার আবু কেউ হয়ঃ ভাদের শিয়ালমারির পরভু। পরভুর নাম
এখানকার অনেকেরই জান! আছে। এনও লোকে তার কথা
নিয়ে বলাবল করে। বছর কয়েক আগেকার কথা ।
শিঞ্পালমারির চাপাই মোড়লের ছেলে পরভু। কি চেহারা
একখান, কি ত'ত পায়ের গোছা, কি মুখ চোখ, আর কিরং-_কালো
পাথরও "এমন কলে। হয় না । পে রংঘের মধ্যে এক কৌটা ভেজাল
নেই। মথায় বাবড়ী চুল, কার পর্ষন্ত নেনে এসেছে, যেমন সিংহের
কেশর। আর কি ভার চলার ভংগ্ি, পথ চলতি মানুষ চলতে
চলতে একবার একট দন্ডিয়ে হাকে দেখে শিভ।
চাষ বাসের কাজে পর্ভূর মন ছিল ন।। ছোট বেলা থেকেই
তাঁর ধনুক আর বর্শা নিয়ে বনে জংগলে শিকারের পিছন পিছন
ছুটিত। জোয়ান হয়ে উঠল, কিন্তু স্বভাব বদলাল না। কোদাল
বিদ্রোহী কৈবর্ত ণণ
আর লাংগল ওর ছু চোখের বিষ। ও বলত চাষের কাজ মেয়ে
মানষের কাজ, ও সব আমাকে দিয়ে হবে না। লোকে ওর কথ!
শুনে অবাক। বাপ ভাইয়েরা বলে বলে হার মানল। পরতুর যেমন
কথা তেমন কাজ? চিরদিনের জেদী ছেলে, তার নিজের পথ ছেড়ে
ডাইনে বায়ে এক পা-ও যেতে রাজী নয়। লোকে বলল, বিয়েটা
হোক আগে, তার পর কাজে মন বসবে ।
কথাট। মিথ্য! নয়, যত দ্রিন ঘরে বউ না আমে তত দিন মানু
আধা মানুষ । বাড়ীর" আংগিনায় বউর প| পড়তে ন| পড়তে মেই
আধা মানুষট। পুরে। মানুষ হয়ে ওঠে । তখন আর তাকে কাজের
কথা নিয়ে ঠেলাঠোঁল করতে হয় না । এ কথ। চাষীদের অজান। নয় !
যার যার পুরানে। দিনের কথা তার] ন্ো একেবারে ভুলে বায় নি
কিন্ত সেই ব্যাপারেও মুদ্বিলা। খিয়ে দিতে হলে একট। দেয়ে
তো চাই। মেয়ের অভাব কি, এগ্রামে ও গ্রামে মেঘে তে। ক'তই
আছে। চাঁপাই মোড়লের ছেলের জন্বা মেয়ে যোগাড় কব। কঠিন
কিছু নয় । কিন্তু আমল কথা, পরসর মনের কথাটা তো! জান!
দরকার । উঠতি বয়সের ছেলে, কারও ন। কারও দিকে অবশ্যই বোখ
আছে। কিন্তু রোখট। যে কার দিকে সে কথ! কেউ বলতে খারে
না। মেলার সময়, পুজাপাবণ-উৎসবের দিনে বহু মেয়ে পরত
পিছনে ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। পরত মুচকি মুচকি হাসে, রংগব্স
করে, হাসিঠাট্ট। ছি- য়, কিন্ত ওই পধস্তই । এমন এক ছেলে, কোন
মেয়েই তার মন জয় করতে পারল ন।। ও
অবশেষে পর্ভুর এক সাংগাত ভাছুকে অনেক জের করবার পর
আসল ব্যাপারটা! জানা গেল। এখান থেকে চার ক্রোশ দূরে
শীলবনী গ্র।ম ॥ সেই গ্রামের এক মেয়ের সংগে ওর বং লেগেছে।
মেয়ের নাকি রূপের সীম নেই । পরভু মাঝে মাঝে শিকারের নাম
করে সেখানে চলে যায়, ছুদিন তিন দিন কাটিয়ে তার পর ঘরে
ফিরে আসে ।
৭৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
সবাই বলল, তাই তো, ভিতরে ভিতরে যে এত সব চলছে,
আমরা! কেমন করে জানব! আমরা মনে করেছি শিকারের যা
ঝোঁক সত্যিই বুঝি শিকার করতে যায়।
ভাছু হেসে বলল, শিকার টিকার এখন চংগে উঠেছে । শিকার
করতে গিয়ে শিকারী নিজেই জখম ।
লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেয়া হোল। ভাছ একটুও বাড়িয়ে
বলেনি । হ্যা, চোখ আছে বটে পরতুর, এমন মেয়ে কমই দেখা!
যায়। যেমনি ছেলে তেমনি মেয়ে, মিলবে ভাল । ছেলে মেয়ে
দুজনেই যখন মত করেছে বাপদের আর আপত্তির কি আছে।
প্রস্তাব পাকাপাকি হয়ে যেতে সময় লাগল না।
তবে সকলেরই তখন টানাটানির সময়। ঠিক হোল, মাস
তিনেক বাদে নবান্ন আসছে, বিয়েটা সেই সময় হবে ।
কিন্তু নবান্ন আসবাব আগেই ছুর্ঘটনা ঘটল । হঠাৎ এক দিন
চাপাই মোড়লের বাড়ীতে খবর এসে পৌছল, মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে
না। মেয়েটির নাম বল্লুকী । বল্লুকী বন-গাঁড়ুলি পূজার জন্য বনে
শালের মগ্তরী আনতে গিয়েছিল । সেই যে গিয়েছে, মেয়ে আর
ফিরে'আসেনি । ছৃদিন ধরে সমস্ত অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খু'জে তার
কোন চিহ্ন ন1! পেয়ে ওরা চাপাই মোডলের কাছে খবরটা পাঠিয়ে
দিয়েছে।
ঘটনাট। কি বুঝতে কারও বাকী রইল না। এ রকম ঘটনা এই
তো প্রথম নয়। এমন আরও অনেক মেয়ে চুরি গেছে । আর যে
মেয়ে গেছে, তাকে আর কোন দিন ফিরে পাওয়া বায় নি। কৈবর্ত-
দের মধ্যে হিন্দুও আছে, বৌদ্ধও আছে। কিন্তু সে শুধু নামেই ।
জাতে স্থান পেলেও তার! পাতে স্থান পায় নি। গৌড়ের লোকের!
তাদের অস্পৃশ্ত বলেই মনে করে। কিন্ত মেয়ের ব্যাপারে কোন
স্পর্শ-দোষ নেই। ফলে মেয়েদের রূপ-যৌবন ভয়ের কারণ হয়ে
দাড়িয়েছে । রাজপুরুষদের বা বণিকদের দৃষ্টি যাঁদের উপর পড়ে,
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৭৯
তার আর রক্ষা নেই, এমনি ভাবেই তারা অদশ্ঠ হয়ে যায়। কোথায়
যায়, কি হয় তাদের পরিণতি, সে কথা কোন দিন কেউ জানতে
পারে না। আগেকার দিনে এ নিয়ে কত রক্তারক্তি কা ঘটে
গেছে। কিন্তু কোন দিন কোন প্রতিকার হয়নি তার । আরও
উলটে শাসমদণ্ড তাদেরই মাথার উপর নেমে এসেছে । অক্ষম
কৈবর্তেরা ঘা খেয়ে খেয়ে নিজাঁব হয়ে এসেছে, এখন তারা নিঃশবে
এ সব সহা করে নিতে শিখেছে । সহ্য করে নেয় বটে, কিন্তু হজম
করে নিতে পারে না, ঘ্বণা আর বিক্ষোভের আগুন মনের ভিতরে
ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে ।
পুরানো দিনের বু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে ওর!
পরভূকে শান্ত করতে চেষ্টা করল । পরভু নিঃশব্দে ওদের কথা শুনল,
কিন্তু উত্তরে ভাল মন্দ কোন কথাই বল্ল না। মেয়েরকি আর
অভাব আছে, এক মেয়ে গেছে, কত মেয়ে পাঁওয়। যাবে-_-সবাই
বলল, মেয়ের খোঁজ কর। বলল বটে, কিন্তু পরভুর মুখের ভাব
দেখে কেউ তার কাছে কথাটা তুলতে সাহস করল না। অমন যে
অন্তরংগ বন্ধু ভাছু সেও বলল, না, আমি পারব না।
পরভূু এখন আর শিকারে যায় না। তার এত সাধের ধনুক
আর বর্শা যেখানে ছিল, সেখানে পড়ে ঘুমায়, সে এখন আর
তাদের ছু'য়েও দেখে না। কৈবর্ত তরুণীদের মন হরণ করা পরহৃর
অমন শ্ুন্দর বাবড়ী চুল, যাদের গুছিয়ে গুছিয়ে-পাট করতে তার
অনেক সময় ব্যয় করতে হোত, সেই চুল অনাদরে, অবহেলায় রুক্ষ,
জটিল আর ধুলিধূসর হয়ে উঠল! ঘরে মন বসে না পরভূর,
অধিকাংশ সময় বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সবাই. বলাবলি
করে, আহা, কি ছেল্টো কি হয়ে গেল গো! পাগল হয়ে যাবে ন!
তো! শেষ কালে ? বুড়ো চাপাই মাথায় হাত দিয়ে কাদে।
এক দ্রিন ভাছু এসে খবর দিল, পরভু সমাজের মাথা দিব্যোকের
সংগে আলাপ করতে গিয়েছিল। সবাই কৌতৃহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
৮০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তাই নাকি? কি আলাপ হাল তার সংগে? মহৎ কি কোন
আশা ভরস| দিয়েছে ?
ভাছ বলল, সে কথা বলতে না। পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম,
নূর থেকে দেখলাম । হঠাৎ ঝাড়ী থেকে বেরিয়ে হন্ হন্ করে চলে
গেল, ধরতে পারলাম না। পরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম । কিন্তু
কোন কথার উত্তর দেয় না।
এর কিছু দিন বাদেই পর্তু নিরুদ্দেশ হয়ে গেণা। কত খুঁজা-
খুজি, কিন্ত কিছুতেই তার সন্ধান প1ওয়। গেল ন।। সেই বে গেছে,
আর ফেরোন। কেউ বল সাধু হয়ে গো, কেউ বলে পাগল হয়ে
কোথায় কোথার ঘুরে মগছে, কেউ কা খলে বেচে আঁছে কি না, তাই
বাকে বলবে! বার যেমন খুনী তাত বছে | তার কখ। নিষে এখনও
মাঝে মাঝে আশসোচনা উচে।
শিয়ালমাির পচন কবির মুখ মুখ গান বাধবার অভ্যাস
আছে। পরভু আর বলুক্ীর কীনা] নিনে এক পালা গান বেধেছে।
রাখাল ছেলেরা মোষ চরাতে চরাতে মেই গান পায়।
এত দিন বাদে ভান] গেল পরত সাধুও হয় শি, প।গলও হয় নিং
মরেও ধায় নি। বে ডাকাতের দল সার। বাজা পোলপাড় করে
তুলেছে, সে নাকি এখন তাদের সর্দার । শিয়ালমা পির পরত বড়
সহজ লোক নয়। এখন কিন্ত লোকে আর ডাকতের কথ। বলে না,
“বলে আমাদের লোকেরা”, শিয়।লমা (বর জেঠেকের। গবে ফেটে পড়তে
চায়। পরভূর কথাট। প্রথমে কানাকানির মত শোন। গিয়েছিল!
পরে ভাছ খন এক দিন এসে বলল, আমার স্বচক্ষে দেখ। হয়েছে
তাঁর স.গে, আর সারা বাত জেগে তার সংগে কথা হয়েছে, তখন
আর কারও মনেই কোন রকম সন্দেহ রইল ন1।
সবাই উতস্ুক হয়ে প্রশ্ন করল, কি বলল? কি বলল?
ভাছ হু'শিয়ারী দিয়ে বলল, চুপ চুপ, এ সব কথ। বেখানে-সেখানে
নয়। যা বলবার সবই বলব, কিন্তু যাকে-তাকে নয়। আমাদের
বিক্রোহী কৈবর্ত ৮১
কৈবর্তদের অশেষ দোষ, আমরা পেটের কথা চেপে রাখতে
পারি না।
ভাছু অত্যন্ত সতর্কতার সংগে উপযুক্ত লোকদের কাছে হার য৷
বলবার সবই খুলে বলল । আর বলার পর তাদের সতর্ক করে দিল,
খুব সাবধান, এ সব কথা ঘেন আর কারও কানে না যায়। তারা
বলল, ক্ষেপেছ তুমি, এ সব কথা কি ষাকে-তাকে বলা যায়|! কিন্তু
ছু দিন যেতে ন1! যেতেই দেখ। গেল, ভার কোন কথাই কারও
অজানা নেই।
এর ক'দিন বাদে ভাছও নিরুদ্দেশ । কোথায় গেছে, বুঝতে কারও
বাকী রইল না। ভাছুর কাচা বয়সের বউটা কান্নাকাটি করতে
লাগল । আর সব মেয়ের তাকে ধমকে দিল, খাম ছুড়ি, আর
কাদতে হবে না তোকে । জের ভাগ্য ভাল যে এমন সোয়ামী।
পেয়েছিস! সে তে! আমাদের জন্যহ ওদের সংগে যুদ্ধ করছে
গেছে। আমর! সবাই বন গাড্লর কাছে পুজে। দেব__-রণে বনে
সহায় থেক? মা, ওএা যুদ্ধ জয় করে ফিরে আম্্নক । আর দরকার
বদ্দি হয়, আমরাই কি পিছিয়ে থাকব নাকি? বঁটি দিয়ে শঞ্গতান-
গুলোর নাক কান কেটে দেশ থেকে তাড়াব। রাখ এখন তোর
কান্না । এখন কি কান্নাকাটি করবার সময় নাকি ?
কথাটা রাঞ্জপুরুষদদের কানে গিয়ে পৌছতে সময় লাগল ন!।
এ ডাকাত যে সাধারণ ডাকাত নয়, এ সন্দেহ ওদের মনে আগেই
জেগেছে । কিন্তু এখন আর সন্দেহ নয়, দিনের আলোর মতই
স্পষ্ট । কিগ্ত ঢটেউ-খেলানে বাবড়ীওয়াল সেই শৌখীন ছোডাটা,
এ সব তারই কীতি! নাকি, এর পিছনে আরও কোন অবৃশ্ঠ
শান্ত কাজ করছে?
পিছনে যে বা যারাই থাক, খবরট। পাবার পর ওরা আর দের
করল না। এক দিন সকাল বেলা শিয়ালমারি শ্রামের লোক অবাক
হয়ে দেখল এক জন রাজপুরুষ জন! দশেক সৈন্ত নিয়ে পরতুদের
টি
৮২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বাড়ী ঘেরাও করে ফেলেছে। গ্রামের পঞ্চজন সামনে যেতেই সৈন্যরা
এমন তাণ্ডা দিল ষে ওদের পিছিয়ে আসতে হোল । মেয়ে পুরুষ
দুরে দাড়িয়ে বাসা-ভাংগা পাখার মত উত্তেজনা ও আতংক মিশ্রিত
কলরব করে চলল ।
এদিকে পরভূদের বাড়ীতে সৈন্যের! চাঁপাই মৌড়ল আর তার
দুই ছেলের উপর বিষম হুমকি ধামকি শুরু করে দিয়েছে-_বল
কোথায় আছে পরত, আর ন্তার ডাকাত দলের আস্ত।নাই |
কোথায় ?
বুড়ো চাপাই মোড়ল কাপতে কাপতে বলল, আমরা কিচ্ছ,
জানি না কর্তা। পর্ভূ সেই ষে কবে নিরুন্দেশ হয়ে গেছে, আর
তো ফিরে আসেনি ।
কিছু জানিস না, বটে! মোগ্জা আন্ুলে ঘি ওঠে না! জায়গা
নত চল্ আগে, জানিস কি জানিস্ না পরে বোঝা যাঁবে।
রাজপুরুষের জাদেশে টসন্যেরা চাঁপাই মোড়ল আর তার ছুই
ছেলেকে পিঠমোড়। বাধ বেঁধে নিষ়ে ওদের বাড়া থেকে পথে নামল ।
গ্রামস্তদ্ধ লোক হতবুদ্ধির মত ভাঁকিয়ে তাকিয়ে দেখল । কি করবে
ভারা, কি করা উচিত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল ন1। এমন
অবস্থায় তে। কোনদিন পড়তে হয়নি তাদের | তাদেরই চোখের
সামন। দিয়ে দৈম্সেরা ওদের ভিনজনকে ধাক্ক। মারতে মাবতে ঠেলে
নিয়ে চলল ।
€র। যখন প্রান ছাড়িয়ে বেশ কিছুট। দুরে চলে গিয়েছে, তখন
গ্রামের লোকদের সম্বিত ফিরে এল । সংগে সংগে তারা শত কে
কথা বলতে লাগল ।॥ কয়েকট। মেয়ে বলে উঠল, কেমন পুরুষ গে
তোমরা ? গ্রানের বুড়ে! মোড়ল, তাকে কুকুরের মত বেঁধে মারতে
মারতে নিয়ে গেল, আর তোমরা কোন কথাই কইলে না! পরভু
আমাদের জন্ঠ যুদ্ধ করছে। আর তার বাপ ভাইদের ধরে নিয়ে
গেল, প্রামণুদ্ধ লোক তাই দাড়িষে দাড়িয়ে দেখল ! কথাটা! অনেকের
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৮৩
ভিতরেই খেচ! মারছিল, এখন সবাই নিজের দৌবট! ঢাকা দেবার
জন্য এক এক জন এক এক রকম যুক্তি তুলল। বুড়োদের মধ্যে
কেউ কেউ বলল, পঞ্চজন মিশে পরামর্শ না করে কোন কাজ করা
যায়! আমর] কি ন্তার সময় পেলাম ? এ অবস্থায় একা কে সাহস
করে কথা বলবে? এ হা আর কারও একার কাজ নয়।
আক্রমণটা প্রধান শরুণদের উপরেই । মেয়েদের ধিককারটা
ভাদের গায়েই সব চেয়ে বেশী করে বাজল। নাদেরই এক জন
আত্মস্মর্থনের স্তরে বলল, পঞ্চজন কোন কথাই বলল না, এ অবস্থায়
আমরা কি করব একটা গোলমাল যদি হয়েই যেত, শেষকালে
আমাদের ছুবত সবাই | চিরদিনই দেখে এলাম, আমরা বা-ই করি
তাতেই দোষ।
একটা অঙ্পবয়সা মুখর মেরে বক্র মুখের কাছে হাত ঘ্বুরিয়ে
শ্লেষের স্্ররে বলে উঠল, থাম গো থাম, তোমাদের মুরোদ ঢের দেখা
গেছে । আজ খদদ ভাছু থাকত, তাহলল এমনটা ঘটতে পারত না।
এর উন্তচ্ব কেউ কেনে কথা বলল না। বলার মত মুখ নেই
কারও, অনুশোচনার অঞ্চনে সবাই ভিতরে ভিন্তরে দগ্ধে মরছিলি।
এমন স্নয় কয়েকট। ছেলে ছুট ছুটতে এসে হাজির । ওরা এক
বিচিত্র সংবাদ নিয়ে এসেছে । বড়রা যখন কি করা উচিত ছিল, কি
করা হয়নি, আর সেজন্ত কার দায়িত্ব সব চেরে বেশী, এ সব নিয়ে
আলোচনায় মও ছিল, ওরা তখন ঘটনার গতি কোন দিকে যায় তাই
দেখবার জগ্গ কৌতৃহশী হরে টৈন্তদলের সংগে কিছুট। ব্যবধান রেখে
ওদের প্রিছন পিছন অনুমরণ করে চলছিল । এখন ওর! ভীষণ
উত্তেজিত হয়ে হাপাতে চাপাতে ছুটে এসেছে । কাহিনীটা! কে আগে
বলবে, তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা । ওরা বলল, ওরা বখন মলুই
দেবতার উচু টিবিটার পাশ দিয়ে বাচ্ছিল, তখন টিবির পিছন থেকে
আমাদের লোকের! ছুটে এল ।
আমাদের লোকেরা? কেমন করে বুঝলি আমাদের লোক?
৮৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বা রে, বুঝব না! ওরা ষে হে হৈ করে ওদের উপর এসে ঝাপিয়ে
পড়ল। ॥সেকি চীৎকার! আমরা বিষম ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ।
সৈন্যগুলিও প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরেই
ওরা আমাদের বুড়ো মোড়ল আর তার ছই ব্যাটাকে সামনে নিয়ে
এগোতে লাগল। আমাদের লোকেরা তার ধনুক আর বশী নিয়ে
ছুটে আসছিল । কিন্তু সবার আগে ওদের তিন জনকে দেখে থমকে
দাড়িয়ে গেল। কিন্তু তার পরেই যুদ্ধ বাধল।
আমাদের আব সবই দাড়িয়ে দাড়িয়ে যুদ্ধ দেখছে । আমর)
ক'জন ছুটে এলাম তোমাদের খবর দিতে ।
এবার আর কত'ব্য নির্ধারণ করবার জন্য পঞ্চজনের বৈঠক বসিয়ে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার প্রয়োজন হোল ন1। কেউ কার অনুমতি
চাইল না, কেউ কারও সংগে পরামর্শ করল ন1-এক মুহুর্তে একই
ংগে সমস্ত মানুষগুলির মধো বিদ্ব্যত্তের মত কি একট? শক্তি সী রিত
হয়ে গেল।
এক কথ। ছাড়। আর কোন কথা ভাববার অবকাশ ছিল না।
.নিমেষের মধ্যে যে ধার হাতিয়ার নিয়ে মলুই দেবতার টিবির দিকে
ছুটল । ছোট, বড়, জোয়ান, বুড়ো, কেউ বাকা? রইল ন1।। জোয়ান
মেয়েরাও সেই *ংগে ছুটল। তাদের উৎসাহ কারও চেয়ে কম নয়।
"আর সমস্তগ্চলি মানুষ একই সংগে আকাশ ফাটানে। চীৎকার
করে,উউঠল । সেই বিকট চীৎক।র শুনে ভয়ীর্ত মোৌষগ্ুলি বাধন ছি'ড়ে
বিভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল । শিয়ালমারির পোৰ মান। কৈবর্ত
চাষীদের হঠাৎ একি পরিবর্তন, আর এমন ত্রাসস্থষ্টিকারী এই উচ্চ
রণহুংকার ওর কেমন করে আর্ত করল, কোথায় পেল? ক্তবে কি
কশ পরম্পরান্রমে রক্তের ধারার মধ্যেই মিশে ছিল ; দূর অতীতে
এক দিন যারা এমনি ভীম গর্জনে বনভূমি কাপিয়ে শিকারের পিছন
পিছন ধাওয়া করনত, প্রতিদ্বন্দ্বী কৌমের উপর রণ-উল্লাসে ঝাপিয়ে
পড়ত, এর তে৷ তাদেরই বংশধর । সেই স্ত্ুরের স্মৃতি কিদু ওদের
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৮৫
মধ্যে এত দিন ন্থপ্ত হয়েছিল, আজ হঠাৎ প্রবল নাড়া পেয়ে জেগে
উঠেছে 1
ছুটতে ছুটতে মলুই দেবতার টিবির কাছে বখন ওরা এসে পৌছল
তখন অনেক লোক সেখানে এসে জমেছে । খবরট। কেমন করে
পাশাপাশি গ্রামগ্ডলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে যুদ্ধ শেষ ।
সৈন্যেরা আক্রমণ সহা করতে না পেরে তিনটি মৃতদেহ রেখে
পালিয়ে গিয়েছে । আর আমাদের লোকদের মধ্যেও এক জন
প্রাণ হারিয়েছে।
কিন্ত চাপাই মোড়ল, আর তার ছুই ব্যাটা--তারা কোথায় ?
£সন্তের! কি তাদের সংগে করে ধরে নিয়ে গেছে £
নানা ওরা কেমন করে নেবে? উপস্থিত লোকদের মধ্যে
একজন বলল, ওরা নিজেরাই তখন পালাবার পথ খু'জে পাচ্ছিল ন।।
আমাদের লোকেরাই তাদের সংগে করে নিয়ে গেছে । তোমাদের
ভাছু ওদের দলের মধো ছিল ষে।
শিয়ালমারির লোকেরা আনন্দে কলরব করে উঠল ।
ওরা! যাবার সময় আমাদের কাছে বলে গেছে, ভয় নেই, ধ্কান
ভয় নেই, আমাদের শ্ুদিন আসন্তে দ্বৌ নেই আর। তোমরা সব
তৈরী থাকো, ঘরে ঘরে হাতিয়ার বানাও । যেদিন ডাক আসবে সে-
দিন সবাইকে যুদ্ধে নামতে হবে । বাচ্চারা, বুড়োর আর মেয়ের ছাঁড়।
আর কেউ সে দিন ঘরে থাকছে পারবে না । কেউ না।
শিয়ালমারির লোকেরা গর্জন করে উঠল-_নিশ্চয়, নিশ্চয় ।
কথাট। মেয়েদের মনঃপু হোল না। তারা! ঝংকার দিয়ে উঠল,
এঃ আমরা বুঝি ঘরে বসে থাকব ? তা হবে না।
আর তারা বালে গেছে' আমাদের বে বন্ধুকে আমরা এখানে
হারালাম, শিয়ালমারির লোকেরা তার মৃতদেহ নিয়ে আপনজনের
মতই যেন তার শেষ কাক্ত করে ।
তাই তো, তাই তো, শিয়ালমারীর লোকেরা ব্যস্ত হয়ে তাকে
৮৬ বিদ্রোহী কৈবঙ
দেখতে গেল। এত লোক সবাই তাকে এক সংগে দেখতে চার”
ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেল।
গোল হয়ে দাড়াও, গোল হয়ে দাড়াও কে যেন চেঁচিয়ে উঠল ।
আর বেশী বলতে হোল না, সংগে সংগে এতগুলি লোক অদ্ভুত
শংখলার সংগে মৃতদেহকে ঘিরে বৃ রচন। করে দাড়াল । এবার সবাই
দেখল রক্তে কাদায়_মাখামাধি হয়ে একটি কাচা বয়সের ছেলে মাটির
উপর লুটিয়ে পড়ে আছে। কৈশোর ছাড়িয়ে সবে মাত্র যৌবনের
প্রথম ধাপে পা দিয়েছিল । আহা রে--একট। বিলাপ-গুঞররণ সেই
বৃত্তপথ বয়ে ঘুরে ফিরতে লাগল । হঠাৎ কে যেন ডকরে কেঁদে উঠল ।
সংগে সংগে আরও কয়েকজন তার অনুসরণ করল ।
চুপ চুপ চুপ কাদতে নেই, ভিডের মধ্য থেকে কে একজন বলে
উঠল । বিচিত্র তার ক্চস্বর । যারা কাদছিল, তারা তাড়াতাড়ি
আপনাদের সামলে নিল ।
ওরা বলে গেছে, আমাদের লোকের প্রাণ নিচ্ছে, প্রাণ দিচ্ছে ।
সেজন্ত ছুঃখ নেই । আরও অনেক অনেক প্রাণ দিতে হবে। কিন্ত
শেষ পর্যন্ত আমাদের জয় হবেই ।
শিয়ালমারির লোকেরা বলাবলি করছিল একে এখানকার কেউ
চেনে না, সবাই বলছে, এ অঞ্চলের লোক নয় | "বু দেখ আমাদের
জন্য প্রাণ দিল ।
একজন বলল, হ্যা, আগে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝছি, কাছে,
দুরে-_ সারা দেশ জুড়ে আমাদের লোকেরা ঘরে ঘরে তৈরী হচ্ছে।
'তাঁ না হলে শিয়ালমারিতে এই ঘটনা ঘটবার সাথে সাথেই এর!
কেমন করে তা জানতে পারল ! এর! সকব্র ছড়িয়ে আছে। আরু
দেখ, শিকারে বাজের মত্তই এর| যেমন চটপটে, 'আর ছেমনি ওদের
ছেঁ1 মারবার কারদা। আমর! সারা গ্রামের লোক দিশাহার! হয়ে
হাঁকুতাঁশ করে মরছিলাম, মার এরা সংগে সংগেই কাজে নেমে
পড়ল ।
বিদ্রোহী কৈকর্ত ৮৭
শিয়ালমারির লোকের! সেই মৃতদেহ বহন করে নিয়ে চলল । আর
যত লোক ছিল তারাও তাদের সংগে নিল। এরই মধ্যে খবর বিদ্যুতের
মত ছড়িয়ে পড়েছে । চারদিককার গ্রামগ্চলি ভেংগে লোক আসছে ।
আসছে তো আসছেই। দেখতে দেখতে লোকে লোকারণ্য। সেই
বিপুল জনতা মৃতদেহ সামনে নিয়ে শয়ালমারিতে এসে পৌছল।
জনতার মনে বেদনার ছায়া, কিন্ত ন্তার চেয়েও বেশী গৰ আর
গৌরব। বিলাপ নেই, জয়ধ্বনিও নেই । এক অননুভূত আবেগ
আর কঠিন সংকল্পে কেমন ধীর আর নিঃশব সেই জনতা । এ এক
অভিনব দৃশ্য ।
ওর! বলেছিল আরও অনেক- অনেক প্রাণ দিতে হবে। এর
সত্যতা কয়েক দিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেল। এক দিন গভীর
রাত্রিতে ঘুম ভেংগে গেল সবার । জেগে উঠেই আগ্চনের শিখা চোখে
পড়ল । অন্ধকার শিয়ালমারি গ্রাম আলোয় আলোয় আলোময় হয়ে
উঠেছে । রাজার সৈন্যের! জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে ঘরে ঘরে আগ্চন
লাগিয়ে ফিরছে, আর যাকে পাচ্ছে তাকেই তরোর়ালের মুখে সমর্পন
করছে। সগ্ভ জেগে ওঠ মান্ুষগুলি প্রাণভয়ে ছুটোছুটি ৪করতে
লাগল। যারা পারল, পালিক়ে'প্রাণ বাঁগল। হুহু করে বাতাস
বইছিল, অগ্রিশিখা লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের পর ঘর গ্রাস করে চলল ।
পর দিন থেকে রাজাব সৈন্যের! শিকারী কুকুরের মত চারদিককার
গ্রামগুলিতে শিকাঁর খুজে খুজে ফিরতে লাগল ।লুটতরাজ, মারপিট
আর হত্যাকা চলল অবাধে । পাখরের মত অসাড হয়ে পরে রইল
মানুষগুলি, মুখ ফুটে কথা বলবার মত শক্তিটুকুও কারও রইল না,
রাজধানীতে সংবাদ পৌছল, অবস্থ! আয়ত্তে এসেছে । কিস্ত কিছুদিন
বাদেই আর এক জরুরী সংবাদ-_বরেন্দ্রীর পৃ প্রান্তে নতুন গোল-
মাল দেখ! দিয়েছে । অবিলম্বে আরও সৈন্য পাঠাতে হবে। পদাতিক
নয়, অশ্বীরোহী সৈন্য । এই ভাবে ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার চক্র
গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগল ।
পাচ
দুর্দিন, মহা ছুর্দিন !
সে বিষয়ে আর দন্দেহ কি? কিন্ত এই ছুর্দিন তো আর আজই
শুরু হয় নি। তবে হাঁ, দুর্দিন আজ চরমে এসে পৌছেছে, এ কথা
সত্য।
কিন্ত তবু কি একট্র চেতনা আছে! মরার আগে মানুষের যেমন
জ্ঞান বৃদ্ধি লোপ পান, এও তেমনি । তা নইলে পনেরোটা বিহারের
অধ্যক্ষদের এই অধিবেশনের উদ্দেশ্টটা জানিয়ে আমন্ত্রণ লিপি
পাঠালাম, তার উন্তরে আপনারা পাঁচজন মাত্র এলেন | বাকী দশ-
জন অনুপশ্টিত। এমন কি আ্ামন্ত্রণ লিপির উত্তরে কোন কথ।
জানাবার মত সাধারণ মৌজন্য বোধট্কু পর্যন্ত নেই। অথ সবাই
আমর! একই সংকটের মুখে । আর এ সো সাধারণ সংকট নয়,
আমরা ষে ক্রমবিল্প্তির পথে এগিয়ে চলেছি ।
ন্গ্রোধ বিহারের অধ্যক্ষ উপগ্প্ বললেন, রাজধানী নিকটবতী
ধারা সংকটের জীচটা তাদের গাষেই বেশী করে লাগছে। দুদের
মানুষ যেযার মনে আছে, একে অপরের খে খবর রাখে না'
এদিকে কোথাকার জল কোখায় গড়িয়ে চলেছে, সেই চেতনা
ক'জনারই বা আছে । কিন্তু এটাই সব কথা নয়, আরও কথা
আছে। হীনষান, মহাষান, বজ্রধান, কালচক্রযান, সহজযান-_
আমাদের এই সমস্ত সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে রেশরেশি এমন পর্যায়ে
আর কখনে! ওঠেনি । সবাই ষে বার নিজ নিজ প্রাধান্য বিস্তার
করতে ব্যস্ত, এই কঠিন বিপদের দিনেও সাধারণ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি
রেখে তারা পারম্পরিক ভেদবৃদ্ধিটাকে ভূলে যেতে পারছে না।
আপনি সোমপুর বিহারের পক্ষ থেকে উদ্ভোগ নিয়ে অধিবেশনের
আহ্বান জানিয়েছেন । কিন্তু পাছে এর মধ্য দিয়ে মহাযানপন্থীদের
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৮৯
নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যায়, কে জানে, হয়তো! বা! সেই কারণেই
কেউ কেউ এগোতে চাইছেন না ।
মোমপুর বিহারের অধ্যক্ষ প্রিয়রক্ষিত বললেন, উদ্যোগ কে নিল
সেটা বড় কথা! নয়, বৌদ্ধ সমাজের এই গুরুতর সমন্তাটা নিয়ে পর্যা-
লোচনা করবার জন্স আজ আমাদের সকলের সম্মিলিত হওয়াটা
অত্যাবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে । এই চরম প্রয়োজনের সময়ও আমা-
দের ভেদবুদ্ধিটাই যদি প্রবল হয়ে ওঠে, তবে সে তো ধ্বংসের পূ
লক্ষণ |
নিশ্চর | আমাদের সমাজ সেই পথেই তো চলেছে, আমরা
চোখের সামনে দেখাতে পাচ্ছি জৈনদের অবন্থাটা?, তবু আমাদের
চেতনা হয় না। এই পুগুবধনে জৈনরাই সর্বপ্রথম এসেছিল ।
আনরা তার পরে, হিন্দুর। আরও পরে । একদিন এই 'জৈনরা সমগ্র
পুণ্ড বর্ধন ও রাঢ়ে তাদের প্রভাব স্তপ্রতিষ্টিত করেছিল, এ কথা ন'
জানে কে! শুধু তাই নয়, লেকে বালে তার। ভাগীরথা পার হয়ে
আরও পৃবাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল । তারপর প্রাধান্োর প্রশ্ন নিয়ে
তাদের শুক্লাঙ্গর আর দ্রিগন্বর এই ছুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র অবত্ম-
কলহ দেখা দিন। আর তার পরশতি * অবশ্য জৈনরা এখনও
সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায় নি, কিন্ত এক কি বালে বেঁচে থাকা ? মরা
নদীর সেতার মত তারা আজ ভাদের অতীতের ক্ষীণ স্মৃতি বহন
করে চলেছে মাত্র।
কোথায় গেল তার? একজন প্রশ্ন করল ।
কোথায় গেল? বতমানের ধারা দেখে অনুমান করতে পারি,
কিছু এসেছে আমাদের সংগে, আর অধিকাংশ হিন্দুদের মহাসমুদ্রে
বিলীন হয়ে গেছে ।
ওদের সংগে আমাদের অনেক মিল, কাজেই আমাদের মধ্যে ওরা
আসবে, এট। অস্বাভাবিক কিছু নয়! কিন্তু সম্পূর্ণ বিরুদ্ধধর্মী
হিন্দুদের কবলে ওরা কেমন করে গিয়ে পড়ল ?
৯০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
প্রিয়রক্ষিত বললেন, কেমন করে গিয়ে পড়ল? সেই প্রশ্নই
তো! আজ আমাদের সামনে ।
একদিন জৈনদের যে সমস্তার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, অনুরূপ
সমস্তা কি আমাদের সমাজেও এসে ঘা মারছে না? চোখ মেলে
চেয়ে দেখুন, তার কোন লক্ষণ কি অ।পনাদের চোখে পড়ছে না ?
সধূবন বিহারের অধাক্ষ শুভদ্র বয়সে ফব চেয়ে তরুণ। নি
বললেন, আমাদের সমাজের অবস্থা সঙ্থ্োবজনক নয, সে কথা
স্বীকার করি, কিন্তু ভানংর মনে হয়, আপনার! বিপদটাকে অতিরিক্ত
রকম বাড়িয়ে দেখছেন। নদের সংগে কোন দিক দিয়েই
আমাদের তুলনা হতে পারে না। ন্বারা বত দিন আগে থেকেই
প্রাণশক্তি হারিয়ে আসছিল। ন্তা ছাড়া তাদের সব চেয়ে বড
অন্তুবিধা এই যে, এ দেশে তাদের সাহাষ্য করবার মত্ত তাদের
ধর্মীবলম্বা কোন রাজশক্তি ছিল ন|। £স দিক দিয়ে আমর।
ভাগ্যবান । শুধু ভারতবর্ষে নর, পুথিবীর দেশে দেশে আমাদের
বিজয় ?ৃব্জয়ন্তী উড়ছে । আর আম্রর। ভয় পাব হিন্দু সমাজকে £
বর্ণীশ্রামের মুঢ় বিধান ওদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে । ত। ছাড়!
শৈব, শীত আর ভাগব্তদের পারস্পরিক কলহ ও হানাহানি দিন
, দিনই উগ্র রূপ ধারণ করছে । ওর নিজেরাই ঘে মরতে বসেছে ।
ভদ্র বসে তরুণ হলেও ইতিমধ্যে ভার জ্ঞানের খাতি রাজোর
সীম ছা'ড়ঘ়ে বাইরে চলে গেছে । নিজস্ব মতামত প্রকাশের বাপারে
তার একটি বিশেষ ভংগি আছে, থেট। অনেকের কাছেই একটু রড
বলে মনে হয | প্রবীণ আচাধেরাও একটু সন্ত্রম নিয়েই তার সংগে কথা
বলেন । কিন্ত স্ভাগোধ বিহারের অধাক্ষ উপঞুপ্ধের কথ। স্বহন্্ । হভড্র
তার ধঙ্গীর শিক্ষার পাঠ সর্বপ্রথম তার কাছে থেকেই শ্রহণ করো
ছিলেন । এই একটি পাত্র স্থান যেখ|নে স্ুভদ্র কিছুট1 দ্ুবল, ছাত্রের
সেই আড়ষ্ট ভাবটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছেন ন|।
উপগ্প্ত স্থভদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তুমি
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৯১
সম্প্রতি অনেক দিন বাদে সিংহল থেকে শিক্ষা! সমাপ্ত করে ফিরে
এসেছ, এখনও সমস্ত অবস্থাট। তলিয়ে দেখবার মত সময় পাও নি।
তুমি যা বলছ তা আপাতদষ্টিতে সত্য বলে মনে হতে পারে, কিন্ত
প্রকৃত অবস্থাট! বুঝতে হলে আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
বর্ণিশ্রম ওদের ছুর্লত। মানি, কিন্তু এর মধ্যে ওদের টিকে থাকবার
শক্তিও নিহিত রয়েছে, সে কথাটাও মনে রাখা দরকার । কথাট।
একটু পরস্পরকিবরৌধীর মত শোনাচ্ছে ? কিন্ত কি কর! যাবে, বিচিত্র
এই সংসার, এখানে বিশুদ্ধ সরল রেখা ধবে এগিয়ে যাবার উপায়
নেই। সত্য আর মিথ্যা, সবলন্তা আর ছূর্বলতা এখানে এমন
অংগাংগীভাবে জড়িয়ে থাকে, ধে তাদের. পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে
দেখা বড়ই কঠিন । আর সম্গ্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিরোধের কথা বলছ ?
হ্যা, বিরোধ ওদের মধ্যে আছে, কিন্ত আমাদের নিজেদের মধ্যে যে
বিরোধ রয়েছে তা কি ওদের চেয়েকম? এটা সিংহল নয় পুণগু.বর্ধন,
সে কথাটা ভূলে ঘেও না।। যাক আর কিছুদিন, নিজেই সব
টের পাবে।
সত্য আর মিথা| অংগাংগীভাবে মিলিয়ে আছে, বিচ্ছিন্ন করলা যায়
না__এ কেমন কথা ! তীব্র প্রন্তিবাদ ঠেলে উঠতে চাইল, জোর করে
চাপা দিয়ে রাখলেন স্থভদ্র, কিন্ত মুখের ভাবে "তা চীপা বইল. না ।
প্রাক্তন ছাত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে উপগ্তপ্ত মনে মনে হাসলেন ।
প্রিয়রক্ষিত বললেন, এ কথা সবাই বলে রাজবংশ আমাদের
স্বধর্সী, রাজশক্তি আমাদের পিছনে রয়েছে, অতএব আমাদের
সমাজের উন্নতি অবধারিত | কিন্তু কীধত কি হচ্ছে? এ কথ সত্য
পরম ভট্টারক মহারাজ ধর্মপালদেব আর দেবপালদেবের সময আমর
উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিলাম 1 সমগ্র সাজাজা মধুচক্রের মত
বিহারে বিহারে পরিকীর্ণ হয়ে উঠেছিল । সেদিন সমস্ত ভারতবধষে
আমরা ছিলাম আঁদর্শস্থানীয়। দেশ বিদেশ থেকে ভিক্ষুরা এখানে
শিক্ষা গুহণ করতে আসতেন । আর আজ ? সেই অসংখ্য বিহারের
৯২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মধ্যে ক'টি টিকে আছে এখন? যতই দ্িন যাচ্ছে জীর্ণ পত্রের
মত ঝরে ঝরে পড়ছে । শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে? কেমন করেই বা
আমাদের ধর্মের প্রসার লাভ ঘটবে? প্রসার লাভ দূরে থাক,
দ্রিন দিন অধোগতি ঘটছে ।
কেন, কেমন হচ্ছে কেন? কে তার জন্য দায়ী? স্থৃভত্র প্রশ্ন
করলেন।
কেন এমন হচ্ছে ? প্রিষরক্ষিত চিস্তিত কে বললেন, কারণ তো।
একট! নয়, অনেক কারণ আছে । তবে বড় কথা হচ্ছে এই যে, আজ-
কালকার রাজাদের সন্ধন্নের প্রত্তিষ্ার জন্য সেই উদ্যোগ কই, উৎসাহ
কই ! এই বিহ্নারঞ্চলি আমাদের ধর্সের প্রাণকেন্দ্রস্বরপ | এখান থেকে
ম্ুশিক্ষা ল।ভ করলে হবে ভিক্ষুরা প্রচারকাধে সাফল্য লাভ করতে
এইজন্যই আগেকার কনের রাজারা বিহারগুলির পিছনে মুক্ত
হান্ত্ অর্থ বায় করুন| প্রধানত তাছের সাহাধ্যেই বিহারগুলি চলত,
এ কথা বললে ভূল বলা হয় না । অর এখন ব্লাজকীয় সাহায্যের মাতা
দিন দিনই কনে যাচ্ছে । কমতে কমন্তে একেবারে তলানিতে এসে
ঠেকেছে । তার কলে জ্ঞানের উজ্জ্বল বদ্তকাঞগ্চলি একটির পর একট
নিভে যাচ্ছে । যেগুলি এখনও টিকে আছে, সেগুলি কিভাবে চলছে
সে শুধু আমরাই জানি।
বীথিকাবিহারের অধ্যক্ষ বিনরপালিত বললেন, কিন্তু শুধু রাজাকে
দায়ী করলেই চলবে কেন, দোষ সবারই আছে। আগেকার দিনে
শ্রেঠীরা বিহারের জম্গ যথেষ্ট অর্থদান করত্তেন। কেউ কেউ একাই
এক একটা বিহার পরিচ!লনার দায়িত্ব গ্রহণ 'করতেন। কিন্তু এখন
তারা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন !
্টপঞ্ুপ্ত তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, আপনি যা বলেছেন ঠিকই
বলেছেন । আমরা আজকাল শ্রেঈদের কাছ থেকে খুব কম সাহায্যই
পেয়ে থাকি। কিন্তু তাদের অবস্থাও বিবেচন! করে দেখতে হবে।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৯৩
তখদের সেই বাণিজ্য কি আর এখন আছে? পাল সাভ্রাজ্য এখন
নামেই সামাজ্য । এক দিন আমাদের এই সাস্রাজ্য উভ্ভরে হিমালয়
থেকে দক্ষিণে বিদ্ধ্য পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল । শ্রে্টীদের বাণিজ্যতরী'
সেদিন অনুকূল পবনে ছুটে চলেছিল। কিন্তু আজ সাআাজ্যের চরম
হূর্দশা। পশ্চিমাঞ্চল হস্তচ্যুত হয়েছে, পূর্বাঞ্চলের অবস্থাও তাই।
পঞ্চগোৌড়েশ্বরের বিপুল সাত্রাজ্য আজ গৌড়ে এসে সীমাবদ্ধ । তাও
ঘরে বাইরে সংকট, সামন্তরাজেরা সুযোগ পেলেই বিগড়ে বসন্ছে
চাইছে । সব কিছুই ঘেন ধ্বসে পড়ছে, কোন কিছুর স্ডিরত1 নেই ।
এ অবস্থায় শ্রেষ্টীদের বাণিজ্যতরী যেন শুকনো ডাংগায় আটকে গড়ে
অচল হয়ে আছে। শ্রেঈীরা করবে কি গ আর বাণিজো যদি মন্দা
লাগে, রাজ্যের সমৃদ্ধি হতে পারে কখনও ! আমাদের রাজারা বে
বিহারগুলির প্রতি সাহায্যের মাত্র। কমিয়ে দিয়েছেন, সাজের এই
দুরবস্থাও সেজন্য কিছুট। দায়ী।
বেত্রবতী বিহারের অধাক্ষ ঘেমন বাকৃপটু নন, এতক্ষণ কোন
কথা৷ বলেন নি, চুপ করে সবার কথা শুনছিলেন । বেত্রব্তী বিহার
মনেক দিন থেকেই টলমল করছে, যে কোন সময় মুখ থুবড়ে পড়ে
যেতে পারে। তাই অধ্যক্ষের মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ | কতক্ষণ
ধরেই তার বক্তব্যটা বলি বলি করছিলেন, কিন্তু বলে উঠছে
পারছিলেন না। উপগুপ্ধের শেষ কথার পর হঠাৎ মুখের ঢাঁকনাটা
খসে পড়ল তার, ভিনি ফৌস করে গর্জে উঠলেন,হিন্দ্র মন্দির আর
চতুষ্পাঠীর সাহায্যের ব্যাপারে তো কখনও অর্থাভাবের কথা শোন!
বায় না! যত অভাব কি সব আমাদের বেল।য়? আমর] হিন্দু নই,
এটাই কি আমাদের অপরাধ ?
এক জন তার কথার সমর্থন করে বললেন, ঠিক কথাই তো?
বলেছেন ইনি। হিন্দুদের মন্দির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আর ব্রাহ্মণদের
ভূমিদানের ব্যাপারে তে। বিন্দুমাত্র কার্পণ্য দেখ! যায় না। আসল
কথা মহারাজ তো উপলক্ষ মাত্র, হিন্দু মন্ত্রী বরাহস্বামী তার ঘাড়ের
৯৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
উপর ব্রহ্মদৈত্যের মত চেপে বসে আছে, আর যা করবার সেই তো
সব করাচ্ছে। কাজেই এ সমস্ত ষে ঘটবে তাতে আশ্চর্য হবার
কিছুই নেই । যতদিন বরাহস্বামী আছে, ততদিন এই রকমই চলবে ।
স্তুদ্র বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, সে কি, হিন্দুদের ধর্মকার্ষে
রাজকীয় অর্থ ব্যয় করা হয়?
হয় বই কি। একাধিক কগ এক সংগে বলে উঠল ।
স্রভদ্র অর্ধস্বগতো কত করপেন, অদ্ভুত! আশ্চষ! পরে সকলকে
উদ্দেশ করে বললেন, শুনেছি হিন্দ্ুরাজ শশাংক সদ্ধনীদের উপর কম
নির্যাতন করেন নি। অবশ্য ত:ই বলে হিন্দুদের উপর তার প্রতিশে!ধ
নেওয়া হোক, এমন কথাও বলছি না আমি । কিন্ত হিন্দুদের ধর্ম'র
কাজে এমন অপধাপ্ত অর্থ বায় করা, তারই বা মানে কি? এর ফলে
এক দিকে আমাদের বিহারগ্লি একের পর এক লোপ পেতে থাকবে,
আর এক “দকে হিল্দদের ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে।
প্রিয়রক্ষিত মৃতু কঞ্জে বললেন, ঘটবে নয়, অনেকদিন আগে
থেকেই ঘটে অংসছে। আহাদের চোপের সামনে ঘটে চলেছে, কিন্তু
আমরাঅম্হায় ভাবে হাকিরে তাকিয়ে তাই দেখছি ।
কিন্তু আপনারা মহারাজের সংগে এ নিয়ে একটা বোঝাপড়।
করাতে চে?! কাবিন নে ; ভ্ভত্ প্রশ্ন করলেন ।
উপঞপু উন্তঠর দিলেন, হা, এ নিরে তার সংগে আামাদের আলাপ
আলোচনা হয়েছে । কিন্ধ তার এক কথা, গামি বখন রাজ্যের পালক
'ভখন আমি বৌদ্ধও নভ, ৪ লও নই, আমি সকলের রাজ।। আমার
রাজকোযে যে অর্থ আসে, ত। | বৌন্ধেন কাছ থেকেও আসে, হিন্দুর
কাছ থেকেও আনম । আর এ অর্থ বখন ব্যয় হয়, সকলের জন্যই ব্যয়
হায় থাকে।
উত্তরে আপনারা কি বললেন ?
আমরা প্রিরদর্শী অশোকের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলাম । বলেছিলাম,
আমাদের এই ধর্মই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম যা মানুষকে মুক্তির প্রকৃত
নি
বিজ্রোহী কৈবর্ত ৯৫
পথে পরিচালিত ফরতে পারে । এই সত্যকে সামনে রেখেই প্রিরদর্শী
অশোকের মত ন্যায়নিষ্ মহাপুরুষ সদ্ধর্স প্রচারের জন্য তার রাজ
কোষের অর্থ মুক্তহস্তে ব্য করতে বিন্দুমাত্র কু্ঠাবোধ করেন নি।
আপনি প্রশ্নটাকে এই দিক দিয়ে হবে দেখুন |
কি বললেন টিনি ?
আনার এই কথাটাকে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে গিরে তিনি তার
সেই এক কথাই জ!কড়ে ধবে বলেন । আনবা জানি, এ কথা তার
নিজের কথ! নব, ববাহপ্বানা এই কথ;টা তার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে
দিয়েছেন | ব্রাহক্নামীর কাছে চিনি তার নিজস্ব সন্ত বিসক্তন দিয়ে
আছেন । তার কোন ক! অথান্ত করবার মত শক্তি তীর নেই, ইচ্ছাও
হয়তো নেই । এখন সব কিছু নির্ভর করছে ব্রাতস্বামীর উপরে ।
আর ভার কলে যা ঘটবাধ হাই ঘটে চলেছে
প্রিগ্রক্ষিহ উপগ্ুপ্রে কথ'ব মংগে আর একটু যোগ করে
ফ্রিয়ে বললেন, মভারাজের সংগে এই আঙোচনার করেকদিন পরেই
বরাহস্বামী আমদের দুজনকে ডাকিয়ে পাঠালেন ।
হারপর »
শুনি বললেন আমাদের এই খজ্যো বৌদ্ধ আর হিন্দু পরম শাস্থি-
তে পাশাপাশি বপাস কবে আসছে, এর মধ্য আপনারা বিভেদ-
শষ্টিকারী এই সমস্ত প্রশ্ন তুলে পবিস্থিতিকে এমন করে দুলিয়ে
হলবেন না। চাংগতে পরে সবাই- কিন্ত গড়ছে পারে কজন ?
'্সামরা বললাম, মামানের এতদিনের এই সমস্ত বিহার রাজকীক
সাহাধোের অভাবে একটিব পর একটি নিশ্চিহ্ন হয়ে চলেছে । আপনা-
রাই বা! এট। দেখছেন না কেন ? হা নইলে তো আমাদের এ সমস্ত
অপ্রিয় প্রশ্ন তুলতে হোত না ।
বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, আহা, দেখছি কি আর নাঃ আমাদের
চোখ সবত্র । কিন্তুকি করব বলুন। সাম্রাজ্যের কি আর সে দ্বিন
আছে? আমাদের সম্পদ যে একেবারেই সীমাবদ্ধ। তব্ যেটুকু
৯৬ বিভ্রোহী কৈবর্ড
আমাদের সম্বল তাই আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগাভাগি করে খাই ।
তাত্তে কারওই হয়তো পেট ভরে না, কিন্তু মনের শাস্তি আছে তো,
কি বলেন?
ব্রই রকম অনেক মিষ্টি মিত্ি কথ। বলে আমাদের বিদায় করল।
উপগুপ্ত বললেন, ভণ্ড, বিষম ভণ্ড । মুখে মধু, অন্তরে বিষ।
এই কুটিল চক্রী মহারাজকে সামনে রেখে সমস্ত শক্তি নিজের মুষ্টিগত
করে রেখেছে । তার ইচ্ছাতেই সব কিছু চলছে ।
স্থভদ্র তিক্ত ক্চে বলে উঠলেন, আর এইটাই আনাদের সহ্য
করে. চলতে হবে? আমর! সব কিছুর অধীশ্বর হয়েও এর কাছে
উপযাচক হয়ে দিন কাটাব! কিন্তু একটা কথ। কিছুদেই বুঝি না
আমি। আমাদের এই রাজবশ ধনে বৌদ্ধ, কিন্ত নিজেও ধগের
লোকদের বাদ দিয়ে ব্রা্গণ মন্ত্রী নিয়োগ করবার দিকে তাদের এমন
ঝোক কেন?
এ তো শুধু আজকের কথাই নয়, প্রররক্ষিত বললেন, স্বয়ং
মহারাজ ধর্মপালদেবের সময় থেকে এই বীতিই তো চলে আসছে ।
হ্যা, হ্যা, সেই কথাই বলছি আমি। কিন্ত কেন? মন্ত্রী
করবার মত উপযুক্ত লোক কি তার: সদ্ধমীদের মধ্যে খুজে পাননি?
বুদ্ধ আর বিচক্ষণতা কি ব্রাক্মণদেরই একচেটিয়। ; নিজেদেব
সম্পর্কে এমন হীনমন্যত। কেন 1
হীনমন্তত]। ?£ উপঞগ্প্ত মাথা নেড়ে বললেন, আমি কিন্তু
ভিনিসটাকে ঠিক ও ভাবে দেখি না। পরমভট্ারক মহারাজ
ধর্মপালদেব আর দেবপালদেব এই প্রথার প্রবর্তন করে গেছেন ।
তার্দের সম্পর্কে ও রকম ধারণ। কর। চলে কি? আমার মনে হয়,
এর পিছনে একট? গৃঢ় উদ্দেশ্ট ছিল। হয়তো ছুই সমাজের মধ্যে
সন্ভাব স্থাপন এবং শাসনসৌকর্ষের জন্য এই ব্যবস্থাটাই তাদের কাছে
যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। যতদুর মনে হয়, তাদের এই নীতি
তাদের উদ্দেশ সিদ্ধির পক্ষে সহায়কই হয়েছিল । সেই থেকে কি
বিভ্বোহী কৈবত ৯৭
হিন্দু কি বৌদ্ধ সকলেই এটাকে একট মিলিত শাসনব্যবস্থা বলেই
মনে করে নিয়েছিল । আর তার ফলে ছুটো৷ সমাজ পরস্পর ঘনসম্বন্ধ
হয়ে এক্যবদ্ধ রূপ নিয়েছে । বাইরে থেকে রাষ্ট্রকুট, চালুক্য ব!
গুর্জর প্রভৃতি যে সমস্ত বিদেশী আক্রমণকারীরা এসেছে. তার
সবাই হিন্দু। কিন্ত এখানকার হিন্দুর বৌদ্ধদের মতই তাদের
প্রতিরোধ করে এসেছে । আক্রমণকারীর! হিন্দু বলে স্বধর্মীগ্রীতির
কারণে তাদের সংগে তারা হাত মিলিয়েছে, এমন কথা আমর!
কোন দিন শুনি নি। আজও যদি বাইরে থেকে কোন আক্রমণ হয়,
আজও সেই রকমই ঘটবে বলে আমি বিশ্বীস করি।
একজন একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, তার মানে যেই ব্যবস্থা
চলছে তাকেই আপনি সমর্থন করেন?
উপগ্তপ্ত চমকে উঠে বললেন, সেই কথাই কি বলেছি আমি?
পরক্ষণেই আবার যেন নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে বললেন,
রাজ্যের শান্তি শংখল। রক্ষার দিক দিয়ে এই নীতির কার্যকারিতাকে
অস্বীকার করতে পারি না আমি । আর হিন্দু মন্ত্রী হলেই যে রাজ।
রসাঙলে খাবে, এমন কথাও আমি মনে করি ন1।
হুভড্র আর চুপ করে থাকতে পারলেন না, বলে উঠলেন তাহলে
এই আদর্শ ব্যবস্থাই চলতে থাক। তার কগে শ্লেষের ম্থুর প্রচ্ছন্ন
রইল না।
উপঞ্ণপ্ত প্রাক্তন ছাত্রের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন ।
সেই দৃষ্টির মধ্য কি ছিল কে জানে, স্ত্ভদ্রের চোখের পাতা আপন
থেকে নেমে এল ।
আরম কি তাই বলছি? উপগ্গ্ত শান্ত সংযত কণ্ে বললেন,
জাআজ্েওর গৌরবময় যুগেও গগদেব দর্ভপাণি, কেদারমিশ্র প্রভৃতি
ভ্রা্ঘণগণ প্রধান অমাত্য ছিলেন । বে তখনকার দিনের সম্্াটর!
গ্রধান অমাত)দের মন্ত্রণা শুনতেন । কিন্তু কর্তব্যাকর্তব্য সম্পকে
সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেরাই । সেই জন্যই তাদের সময় সঞ্ধর্মের এমন
নি
৯৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
প্রসার লাভ ঘটেছিল। কিন্তু এই অধঃপতনের যুগের সআটর৷
নিজন্ব সত্তা হারিয়ে ব্রাহ্মণ অমাত্যদের হাতে আত্মসমর্পণ করে
বসে আছেন। আর ব্রাহ্মণ অমাত্যরা এই স্তবর্ণ স্থঘোগ পেয়ে
তাদের নিজ সমাজের পুষ্টসাধনে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছেন।
আমাদের ছুর্গীত্তির কারণ তো এইখানেই ।
অধ্যক্ষ কিনয়পালিত বললেন, আমি এ বিষয়ে একটা মৌলিক
প্রশ্ন তুলতে চাই। আমাদের এ ফুগের সম্রাটদের সত্যিকার পরিচগ্নটা
কি_তারা কি সদ্ধনীর্ নী হিন্দু?
প্রশ্ন শুনে সবাই চমকে উঠলেন । অধ্যক্ষ প্রিররক্ষিত একটু
অসন্তোষের স্থরে বললেন, এ আপনার কি প্রশ্ন? এমন একটা কথা
আপনার মনে জাগল কেন?
অধাক্ষ বিনয়পালিত উত্তর দিলেন, এ প্রশ্ন শুধু আমার নয়,
অনেকেই এ কখা নিয়ে বলাবলি করে থাকে । তারা বলে, আমাদের
রাজবংশে পুরুষের পর পুরুষ বরে বিদেশী হিন্দুরাজগণের কন্যার
পট্টমহাদেবী পদে রতা হরে আসছেন । তারা! প্রগ্ন তুলছে, এই
রীতির তাৎপর্য কি আর এর পরিণত্তিই ব। কি?
কলক্ষণ কেউ কোন কথ| বললেন না। অধ্যক্ষ বিনয়পালিত
তার এই প্রশ্নের উত্তরের আশায় একে একে সকলের মুখের দিকে
তাকাতে লাগলেন । অধ্যক্ষ উপঞ্চপ্থের চোখে চোখ পড়তেই তিনি
বললেন, অ'পনার এই প্রশ্রের উত্তর আমি দিচ্ছি। রাজাদের বনু
রাশী থাকতে পারে, ক্তবে পট্টমহাদেবীদের কোন এক রাজবংশ থেকে
বরণ করা হনে থকে । সাধারণ ভাবে এই প্রথ] দীর্ঘকাল ধরে চলে
আঙছে। সাধারণ লোকদের 'ববাহ আর রাজাদের বিবাহকে এক
দৃষ্টি নিয়ে দেখ! চলে না। রাঙক্জাদের বিবাহের মধ্যে রাজনীতির
প্র্নও জড়িত থাকে। প্রতিপক্ষকে আক্রনণের উন্দেশ্টেই হোক বা
আম্মরক্ষার জযতই হোক ব| ভারপানা রক্ষ। করে চলবার জন্যই হোক
বৈবাহিক সন্বদ্ধের মধ্য দিয়ে তার! অন্যান্য রাজবংশের সংগে মৈত্রী
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৯৯
স্থাপন করে থাকেন। আমাদের এই রাজবংশে এই দৃষ্টান্তের সংখ্যা
এতই বেশী ষে তার উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র । অধ্যক্ষ বিনয়পালিত
বললেন, আর্ধ উপগ্ুপ্তের এই কথা মেনে ছিলাম আমি । কিন্ত এর
গরিণতি কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে, আমি বিশেষ ভাবে সেই কথাটাই
বলতে চাই । আমরা জানি, রাজ অন্তঃপু;র পট্টমহাদেবীদের নিরংকুশ
কর্তৃত্ব! তাদের এই অধিকার চির দিন স্বীকৃত হয়ে এসেছে ।
অন্ত:পুরের অনেক ব্যাপারে রাজাদেরও তাদের শাসন মেনে চলতে
হয়। তার ফলে, এই সমস্ত পট্টমহাদেবীরা রাজ-অন্তঃপুরকে হিন্দুদের
আচার-নিয়মে দূধিত করে তুলেছেন। নিয়মিত ভাবে হিন্দুদের
পূর্জীচনা, ব্রত ইত্যাদি অনুষ্ঠান চলেছে সেখানে । রাজপ্রাসাদ
দেব-দেবী পূজার শংখ ঘন্টাধ্বনিতে মুখর । ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা
সেখানে ভাল ভাবেই তাদের আসন জণাকিয়ে বসেছেন। প্রহর
অর্থব্যয়ে দূর ভাগীরথী নদী থেকে ঘড়ায় ঘড়ায় জল আসছে । যারা
রাজ-অন্কপুরের খবরাখবর রাখেন, তাদের কাছে আরও আ.নক কথাই
শোনা যায়। আর আমাদের কুমারের জন্ম থেকে এই পরিবেশই
বধিত হয়ে উঠেছেন। এর ফলাফল কি কখনও ভাল হতে
পারে?
কেউ কোন উত্তর দিলেন না। অধ্যক্ষ বিনয়পালিত নিজেই
নিজের এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলেন, না, কখনও ভ'ল হতে পারে
না। আমাদের রাক্তাদে" আচার-আচরণ থেকেই তা৷ সুস্পষ্ট ।
অধাক্ষ সুভদ্র বললেন, কথাটা একটু খুলেই বলুন । এখানকার
অনেক খবরই আমার জানা নেই । বাজা দেশ আচাব-আচরণ সম্বন্ধে
অভিযোগট ।ক আপনার ?
অভিযোগ কি একট11 এরা সবাই তা জানেন।
কিন্ত আমি তে! জানি না, আমার জন্যই ন1 হয় বলুন ।
বিশেষ বিশেষ পৰে রাজ প্রামাদ থেকে প্রক্কাশ্যে দেবমন্দিরে ভারে
ভারে পূজা পাঠানো হয়ে থাকে । কত তার উপকরণ, আর কি
১০০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
সমারোহ ! দেখবার জন্য রাস্তায় কাতারে কাতারে লোক জমে
যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজ1 পুজ। পাঠাচ্ছেন হিন্দুদের দেবমন্দিরে।
আমরা! দেখি না দেখি না করে এড়িয়ে যাই, কিন্ত পথের মানুষ
তো! আর চোখ বন্ধ করে থাকবে না।
বলেন কি! অধ্যক্ষ স্ভদ্র বিশ্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন । তার পর
অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, এ কি সত্য ?
হ্যা সত্য, একজন অধ্যক্ষ উত্তর দিলেন, পঞ্টমহা দেবী হিন্দু, তিনি
পাঠান পুজো, মহারাজ তার কি করবেন ?
তিনি কি করবেন? অধ্যক্ষ বিনয়পালিত ফৌস করে উঠলেন?
আমি দেবমন্দিরের পুরোহিতদের কাঁছে শুনেছি, শুধু পউমহাদেবীর
নামেই যে সংকক্স হয় ভা নয়, স্বয়ং মহারাজের নামেও সংকল্প
করা হয়ে থাকে।
যিনি রাজাকে বীচাবার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি বললেন, এই
সমস্ত পুরোহিতরা মিথ্যার সাগর । ওদের দেবতাদের গৌরব
বাড়াবার জন্য ওরা যে কোন রকম মিথ্য! প্রচার করতে পারে।
বেশ, ওরা মিথ্যার সাগর, ওদের কথা বাদই দিলাম । আর এক
কর্থা বলি, মহারাজার পিতা স্বর্গ মহারাজ যখন রাষ্ট্রকটনন্দিনী
ংখ দেবীকে বিবাহ করে নিয়ে এলেন, তিনি সস্ত্রীক দেবমন্দিরে
পুজো দিতে গিয়েছিলেন, হিন্দুদের দেবতাকে ভক্তিভরে প্রণাম
করেছিলেন। এ তো! আর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মিথ্যা প্রচার নয়,
বহু লোক তা স্বচক্ষে দেখেছে। ফলে সে কথা আর কারু কাছেই
অজানা নয়।
এর ফলে সাধারণ লোকের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়। ঘটল? শ্ৃভদ্
প্রশ্ন করলেন।
হিন্দুরা মহ।খুলী । সবাই রাজাকে ধন্য-ধন্য করল। আর তার!
হাটে মাঠে ঘাটে এই নিয়ে প্রচার করে বেড়াতে লাগল । আর
নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ভগবান ওদের মধ্যে শুভ.
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১০১
বুদ্ধি জাগ্রত করেছেন। ছু দিন আগে বাপরে হোক একে একে
সবাই আমাদের মধ্যে চলে আসবে । আমি স্বকর্ণে এ কথা বলতে
শুনেছি ।
আর আমাদের সদ্ধর্মীরা ? তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল না?
উত্তেজিত? মোটেই ন। যদি উত্তেজিত হোত তবে সেটা
আনন্দের কথাই হোন । কিন্তু কোথায় উত্তেজনা? দীর্ঘ দিন ধরে
হিন্দুদের পাশাপাশি থেকে তাদের মধ্যে অনেকেই ভিতরে ভিতরে
হিন্দুমনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল । এ কথ। আগে বুঝতে পারি নি,
সেবার ভাল করেই বুৰঝলাম। ওরা আগে লুকিয়ে লুকিয়ে হিন্দুদের
দেবদেবীদের মন্দিরে গিয়ে ষে যার কামন! পূর্ণ করবার জন্য মানত
করত । পরে রাজার এই সমস্ত কার্বকলাপের কথ৷ শুনে ওদের
উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। তারা আগে যেটা! গোপনে করত,
তখন প্রকাশ্টেই তা করতে লাগল। এ নিয়ে আমাদের ভিক্ষুর!
কোন উপদেশ দিতে গেলে তারা দোজা মুখের উপর বলে দ্বিত-_-
দেখুন, আমরা গ্রামাঞ্চলের শান্তিপ্রিয় লোক। আমরা হিন্টু আর
বৌদ্ধ পাশাপাশি শাস্তিতে বসবাস করে আসছি। আপনারা এ
সমস্ত কথা বলে আমাদের মধ্যে অনর্থক কলহ-বিবাদের স্থষ্টি করে
তুলবেন ন। |
অধ্যক্ষ উপঞ্প্ত বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি। বৌদ্ধ আর
হিন্দুদের মধ্যে ঘেটুকু বিরোধ তা নগরের মধ্যেই সীমাবন্ধ। গ্রামাকলে
গেলে দেখবেন মেখানে বিরোধের লেশমাত্র নাই, তারা পরম্প্রর
মিলে মিশে বড় শান্তিতে আছে।
ষে শাস্তিকে ধর্মের মূল্যে কিনতে হয়, তেমন শাস্তি চাই না.
আমরা । অধ্যক্ষ স্ুভদ্রের কণ্ঠস্বরে তীব্র উত্তেজনা ।
এ কথাটার প্রতিবাদ করবার মত শক্তি কারু ছিল না। শাস্তির
কথাট। অধ্যক্ষ উপগুপ্তই তুলেছিলেন, তিনি একটু নিশ্রভ হয়ে
গেলেন ।
১০২ বিজ্রোহী কৈবর্ত
অধ্যক্ষ বিনয়পালিতেের বক্তব্য কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। তিনি
বলছিলেন, লোকের মুখে শুনি মহারাজ নাকি ত্রাহ্গণ পুরোহিত
ডাকিয়ে পিতার বাধিক শ্রাদ্ধের মন্ত্রপাঠ করান । এ উপলক্ষে প্রতি
বৎসর অনেক ত্রান্মণ ভোজন করানে হয়। এ সব ব্যাপারে ভিক্ষুর
সব সময়ই অবহেলিত হয়ে আসছে।
অধ্যক্ষ সুভদ্র অধৈধের সুরে বলে উঠলেন, থাক, থাক, আর
শুনতে চাই না, যথেষ্ট হয়েছে । বিনয়পালিত আরও কি যেন বলতে
যাচ্ছিলেন, বাধা পেয়ে থেমে গেলেন। স্ভদ্র বলে চললেন, একট!
কথা জানতে চাই আপনাদের কাছে । আপনারা বলছেন, সদ্ধমীদের
উপর হিন্দুদের দৃষিন্ত প্রভাব এসে পড়ছে । কিন্তু এর বিপরীতটা
লক্ষ্য করেছেন? হিন্দুদের মধ্যে জদ্ধর্জের প্রভাব পড়ছে না?
হিন্দুদের মধ্যে সদ্ধর্দে অ'শ্রয় নেবার প্রবণতাই বা কেমন ?
সকলেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন । অধ্যক্ষ প্রিররক্ষিত
ধীর স্বরে বললেন, আপনি জংগতভ প্রশ্ন তুলেছেন। ব্যক্তিগত্ত ভাবে
আমি যতট অনুভব করছে পারছি, তাতে মনে হয়, এখানকার এই
ছুই সমাজের মধ্যে হেন ধারাবাহিক ভাবে একটা অন্য ও অহিংস
পাট চলে আসছে । সেই প্রতিযোগিতায় আমরা দিন
দিন পিছিয়ে পড়ছি, আর পর-ধর্জের রীতিনীত্তি, আচার-আচরণ
একটু একটু করে আমাদের সমাজে স্থান করে নিচ্ছে । আপান্ত-
দর্টিতে তা অনি সামান্য বলে মনে হলেও ভবিষ্যতের পক্ষে এটা!
খুবই ছুলক্ষণ । আমাদের এই মহাধর্মের প্রভাব সমস্ত পৃথিব।তে
ছড়িয়ে পন্েছে। আর এখানে রাজধর্ণ হওয়। সত্বেও ভার গতি
পশ্চাৎমুখা, এট যেমন বিন্ময়কর, তেমনি শোচনীয় । এই সমস্ত
আমার মনকে উষণ ভাবে আলোডিন্ত করে তুলেছে, সেই জন্যই
আপনাদের সবাইকে আহ্বান করেছিলাম ।
অধ্যক্ষ সুভদ্র বললেন, অধ্যক্ষ বিনয়পালিত সত্য কথাই বলেছেন।
আমিও মনে করি রাজপ্রাসাদই এ জন্য মুলত দায়ী। আর রাজাকে
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১০৩
সামনে রেখে ব্রাহ্মণ অমাত্যেরা আর তাদের দলবল নান! অপকৌশলে
সদ্ধর্মের মূলোচ্ছেদ করবার জন্য দীর্ঘকাল যড়যন্ত্র করে আসছে।
যথার্থ বলেছেন, বেত্রবত্তী বিহারের অধ্যক্ষ ভদ্রশীল তার এই
কথার সজোর সমর্থন জানালেন। ম্ভদ্র তীর কথার জের টেনে
চললেন, আমার সন্দেহ হয়, ভারতবর্ষের অন্তান্ত হিন্দু রাজ্যের
রাজারা পিছন থেকে এই ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন । আমরা চার দিক
দিয়ে পরধর্মীদের দ্বারা পরিবৃত। ওরা চাইছে আমাদের ভাসিয়ে
নিয়ে যেতে । শুনেছি বরাহস্বামী এখানকার প্রাচীন অধিবাসী নন।
তার পূব নিবাস কোথায় ?
একজন উত্তর দিলেন, চেদীরাজ্যে।
হু । স্বগীয়। রাজমাতা?
তিনিও চেদীরাজবংশের মেয়ে ।
রামপালদেবের জননী?
শংখদেবী ? তিনি রাষ্ট্রকুটনন্দিনী |
তবেই দেখুন, ওরা কি ভাবে ওদের ক্ষমতার জাল প্রসারিত করে
দিয়েছে । আর আমর! নির্বেধের দল সেই জালে দিন দিনই বেশী
করে জড়িয়ে পড়ছি । আপনারা! বলেন, আমাদের রাজারা রাজ-
নৈতিক উদ্দেশ্টে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতবর্ষের হিন্দু রাঁজ্যবর্গের
ংগে মেত্রীস্মত্রে আবদ্ধ হবার জন্য বিদেশিনী হিন্দ্রু রাজকম্যাদের
পষ্টমহাদেবীর আসন দিয়ে আসছেন। কিন্তু আমরা তাঁতে কোন্
দিক দিয়ে লাভবান হয়েছি, বলতে পারেন? আপনারাই বলছেন,
সমস্ত স্ুংযাগ আমাদের হাতে থাক সত্বেও সদ্ধর্জের নির্মল জ্যোতি
আজ কৃষ্ণমেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে । অন্য দিকে আমাদের বিরাট
সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত আজ পিছোতে পিছোতে আমাদের
গৃহদ্বারের কাছেই এসে পৌছেচে। এ তো প্রত্যক্ষ, কারু বলাবলির
অপেক্ষা করে না।
উপগ্প্ত অনেকক্ষণ কোন কথা বলেন নি। শ্ুভদ্রের কথার উত্তরে
১০৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
এবার তিনি বললেন, তুমি যা বলছ, আমি তাকে একেবারে অঘুলক
বলে উাড়য়ে দিতে পারিনা। তেমন কোন প্রমাণ হাতে না থাকলেও
এ রকম একটা সন্দেহ স্বভাবতই আনাদের মনে জাগতে পারে।
একটা সতাকে কিছুতেই ভূললে চলবে না, এই হিন্দুরা এক দিক
দিয়ে দেখতে গেলে মূড ও কুসংস্কারচ্ছন্ন, অপরপক্ষে এদের ত্রাহ্মণরা
অতান্ত কৌশলী । যে কোন ম্থষোগকে অবলম্বন করে ওরা আপ-
নাদের শক্তিবৃদ্ধি করে নেয় । এব্যাপারে ওদের নীতিজ্ঞান অদ্ভুত
রকম নমনীয় |
স্বভদ্র প্রশ্ন করলেন, এরা! মূঢ় এবং কৌশলী, এই ছুটো। কথা কি
একই সংগে সত্য হতে পারে!
উপগুপ্ত উত্তর দিলেন, চূড়ান্ত সত্য না হলেও আংশিক ভাবে এবং
সাময়িক ভাবে সত্য। একটা দৃষ্টান্ত দিস্হি। বরেন্দ্রীভূমিতে কৈবর্ত
ও কোচদের মাধো আমরাই প্রথম ধর্নপ্রচার শুর করি। আমরা!
প্রথমে ওদের মিথ্যা দেবত। ও ভ্রান্ত সংস্কারগচলোকে অপমসারিত
করতে চেষ্টা করতে লাগলাম, চাইলাম ওদের মনকে ধুয়ে মুছে
পরিষ্কার করে নিতে । আমি মনে করি এটাই একটা শুদ্ধ পথ। এর
এল হিন্দু প্রচারকেরা । তারা কিন্তু আমাদের এই পথ দিয়ে গেল
না, ওর! ও'দর নিজন্ব পথ ধরল । ওদের যে সমস্ত আদিম দেব-
দেবী ও ধর্মস্থান ছিল, হিন্দু প্রচারকেরা স্বচ্ছন্দে তাদের স্বীকার
করে নিয়ে দেইধানেই তাের বদবাঁর জারশ। করে নিল।
'তারপর ক্রমে ক্রমে তাদের উপর হিন্দুরানীর রং লাগিয়ে নিংশকে
আত্মপাৎ করে শিল তাদের। দেবদেবীর সংগে সংগে তাদের
পৃজকরাও দলে দলে হিন্দূদমাঙ্জের অন্তহুক্ত হয়ে যেতে লাগল ।
শভদ্র বললেন, আপনার এই কথ শুনে একটা কথ! মনে পড়ে
গেল আমার। সিংহল থেকে ফিরবার সময় পদবরজে দাক্ষিণাত্য
ভ্রমণ কর এসেছি। সেধানকার কোন কোন জায়গায় হিন্দুদের
মধ্যে এক আশ্চর্ধ ব্যাপার দেখলাম । তাদেরই এক সম্প্রদায়
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১০৫
ভগবান বৃদ্ধকে তাদের আরাধ্য বিষ্ণুর অবতার বলে প্রচার করছে।
ভগবান বৃদ্ধের জীবন নিয়ে নানারকম অলৌকিক কাহিনী রচন!
করে চলেছে তারা । বহু অনুসন্ধান করেও এই রহস্য উদ্ঘাটন
করতে পারলাম না। শেষে ভাবলাম, অমিতাভের উজ্জ্বল জ্যোতি
--সেই অন্ধকার ভেদ করে তাদের অন্তলোকেও গিয়ে পৌছেছে,
এ বুঝি তারই অভিব্যক্তি । কিন্তু এখন দেখছি ব্যাপারটাকে আবার
নতুন ভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে ।
উপঞ্প্ত মান হাসি হেসে বললেন, শুধু দাক্ষিণাত্যেই নয়, এই
প্রচার এখানেও এসে পৌছেছে ।
হ্যা, হ্যা, এরকম একটা কথা আমাদের কানেও এসেছে, ছু
তিনজন সমর্থন করে বললেন ।
তা হলেই দেখতে পাচ্ছ কৈবর্ত আর কোচদের মন্তই বৌদ্ধদেরও
ফাদে ফেলবার ভন্ত পরিকল্পনা অনুষায়ী সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এক
নতুন জাল পাতা হয়েছে । হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই মহত বেদ-
ব্যাসরচিত বুদ্ধপুরাণ আবিষ্কৃত হে যাবে। বৌদ্ধদের মধ্যে
সরলমন! যাঁরা তাদের মধ্যে কেই কেউ যে এই ফাদে পা দেবে
না, এমন কথা জোর করে বলা যায় না।
একজন পরিচারক এস সংবাদ দিল, ভিক্ষু ত্রিশরণ অনেকক্ষণ
ধরে অপেক্ষা করছেন। কি একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে আলাপ
করতে চান তিনি। ভিক্ষু ত্রিশরণ অধ্যক্ষ প্রিয়রক্ষিতের অত্যন্ত
অনুরক্ত ও ঙি-্য শিষ্য। প্রিয়রক্ষিত বললেন, ঘাও, এখানেই নিয়ে
এসো তাকে ।
ত্রিশরণ এখানকারই প্রাক্তন শিক্ষার্থী। পরিচারকের মুখে
আহ্বান পেয়ে তিনি কক্ষের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন ।
বোমো, বোসো । অনেকক্ষণ ধরে নাকি বসে আছ! আগে
খবর দাও নি কেন? আর খবর দেবার দরকারটাই বাকি, সোজা!
চলে এলেই তো পারতে । তুমি তো আমাদের এখানকারই একজন ।
১০৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তোমার আবার সংকোচ কিসের ?
না, না, সংকোচ নয়, ত্রিশরণ সবিনয়ে বললেন. আপনারা ব্যস্ত
ছিলেন তাই আমি একট! বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে এসেছি,
সেই জন্যই বাধ্য হয়ে খবর পাঠালাম ।
কি বলতে এসেছ বল ।
ত্রিশরণ একটু অস্বস্তির সংগে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে
তাকালেন। তার মনোভাব বুঝতে পেরে প্রিয়রক্ষিত প্রশ্ন
করলেন, কি একাস্তে বলতে চাও কিছু? বেশ তো, বাইরে চল।
দুজনে কক্ষের বাইরে গিয়ে একটু পরেই ফিরে এলেন । ভিতরে
এসে প্রিয়রক্ষিত বললেন, তোমার যা কিছু বলবার আছে এদের
সামনেই বল। এরা আমাদের নিজেদের লোক, এদের কাছে সব
কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পার ।
রাজসভার বিশ্ি& সভাসদ অধিরথ তিশর৭ মার্ফৎ প্রিয়রক্ষিতকে
গোপন সংবাদ পাঠিয়েছেন । অধিরথ জানিয়েছেন, রাজার বিরুদ্ধ-
বাদী যেই দলট1 রাজাকে সিহহাসনচ্যুাত করে শুরপালদেব বা
রামপালদেবকে 1স্ংহাসনে ব্জাতে চায়, তারা অধিরথের কাছে
প্রস্তাব দিয়েছে ঘে বৌছেরা যেন তাদের পক্ষে থাকে । অধিরথ
এখনও তাদের কাছে কোন মতামত প্রকাশ করেনান। তবে তিনি
এবং বৌদ্ধ সমাজের অন্যান্য নাঠিকরা। এ প্রস্তাবে সম্মতি দিতে
আগ্রহশীল। তার কারণ রাজ মহীপালদেবের শাসনের অর্থ
বরাহস্বামীর শাসণ। আর বরাহস্বামী যত দিন এই ক্ষমতায়
প্রতিষ্ঠিত থাকবেন তত'দন জব ব্যাপারেই তিনি সদ্ধম'দের কোণ-
ঠাসা করে রাখছে চাইবে । রাজ! মহীপালদেব যে কোনদিন এই
ছুষ্টগ্রহের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবেন, তার কোনই সম্ভাবন।
দেখা ষায় না। যে কোন ভাবেই হোক বরাহস্বামীর পদ্তন ঘটাতেই
হবে। কিন্ত ব।জ। মহ।পালদেব সিংহাফনে থাকতে সে আশ বৃথ]।
সেই জন্যই এই রাজবিদ্রোহীদের সংগে যোগ দেওয়াটাকে তার!
বিশ্রোহী কৈবর্ত নি
সববোত্ধম পন্থা বলে মনে করেন। এমন সযোগ তো! সব সময়
আসে না। এ বিষয়ে তারা সবাই একমত । কিন্তু তা হলেও
তাদের সিদ্ধান্ত ধমীয় নেতাদের অনুমোদন সাপেক্ষ । তাদের
অনুমতি ছাড়া তারা এ কাজে কখনোই হাত দিতে পারেন না!
বৌদ্ধদের ভিতরকার সমস্ত অন্প্রদারের নেতারা যদি মিলিত ভাবে
এই নির্দেশ দেন, তাহলে সকল সম্প্রদায়ের বৌদ্ধরাই তা মেনে
চলবে । ভিক্ষু ব্রিশরণের মুখে অধিরথ-প্রেরিত এই প্রস্তাবটা! শুনবার
পর অধ্যক্ষদের মধ্যে বেশ উত্তেজনার ভাব দেখা গেল। এ সম্পর্কে
মাঝে মাঝে ছুটো একটা কথা শোন! গেছে বটে, কিন্তু সে নিতান্তই
উড়ো! কথা, কেউ তাকে তেমন আমল দ্রেয় নি। কিন্ত ব্যাপারটা
এত দূর গড়িয়েছে শুনে সবাই একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন ।
এক জন বললেন, ঠিক বলেছেন অধিরথ, এমন স্থযোগ
আমাদের কখনোই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
প্রিয়রক্ষিত কিন্তু একটু বেঁকে বসলেন। [তিনি বললেন,
সিংহাসন নিয়ে এই কাড়াকাড়ির ব্যাপারে আমাদের কোন্ পক্ষে
ষাওয়াট। সংগত হবে কি? তা ছাড়া শুরপালদেব বা রাঁমপালদেব
যে মহীপালদেকের নীতি অনুসরণ করে চলবেন না, তারই বা
নিশ্চয়তা কি?
স্থভদ্র বললেন, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কিন্তু তবু
মানুষ পরিবর্তন চাঁয়। আর এ কথাও ঠিক রাজ মহীপালছেবের পতন
ঘটাতে পাকলে বরাহম্বামী প্রাণে যদি বাচেও, তাকে এ দেশ ছেড়ে
তার স্বদেশে ফিরে যেতে হবে । সেটাই হবে আমাদের প্রধান সাফল্য ।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, তিনটি ক% একই সংগে ধ্বনিত হয়ে উঠল।
উপগুপ্ত হেসে বললেন, আমাদের নিরপেক্ষ থাকতে দিচ্ছে কে?
শেষ পর্ধস্ত একট] পক্ষকে মেনে নিতে হবেই । তার চেয়ে সময়
থাকতে, শ্ুযোগ থাকতে সব দিক চিন্তা করে একট পক্ষ বেছে
নেওয়াই ভাল। কিন্তু আমরা বাছবই বা কেমন করে? আমরা
১০৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
শৃরপালদেবকে যেমন চিনি, রামপালদেবকেও তেমনি চিনি। কে
কেমন, তার পরিচয় পাওয়া ঘায় তাদের কাজের মধ্য দিয়ে ।
স্ৃভদ্র একটা! প্রস্তাব দিলেন £ শূরপালদেব ও রামপালদেব
ছুইজরনের কাছ থেকেই প্রতি শ্রুতি নেওয়া হোক যে তাদের ব্রাহ্মণ
অমান্যের পরিবর্তে বৌদ্ধ অমাত্য নিয়োগ করতে হবে। অনেক
দন ধরেই তো আমর ব্রাঙ্গণ অমাত্যদের কার্ধকলাপ দেখে এলাম,
এবার একটু পরিবর্তন চাই । ছুইজনের কাছ থেকেই আমরা এই
নিশ্চয়তা দাবী করব।
একমাত্র স্্রভদ্র ছাড় আর সবাই হে?ন উঠল। উপণুপ্তও হেসে
বললেন, ত1 আর কেমন করে হবে ? ওর। ছুইজনেই যে কারাগারে ।
তাদের কাছ থেকে কেমন করে প্রতিশ্রুতি সংগ্রহ কর। যাবে ?
"1 বটে, একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন স্থভদ্র, কিন্তু পরক্ষণেই
বললেন, ন্তবে একট কজ কর! বেতে পারে, বারা এই প্রস্তাবটা
পাঠিয়েছে তাদে কাছ থেকেই এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেওয়া হোক ।
অ:পনারা বলে পাঠান, আমাদের এই সামান্ত শর্টকু প্রতিপালিত
না হালে আমর। তাদের সংগে কোন মতেই বোগ দিতে পারব না ।
এই নিঘ়ে কিছুক্ষণ ননতামত বিনিমরের পর অবশেষে সবাই
একমতে এদে পৌছলেন । কিন্ত তার পরেও একট! জায়গায় প্রশ্ন
থেকেই গেল। প্রিরবক্ষিত বললেন, সবই তো বুঝলাম, কিন্ত
যাদের এন চে! করেও এক জায়গার জড় করতে পারা গেল ন!
আমর! কেমন করে তাদের এক মতে নিয়ে আসব? এর জন্য হয়
তো প্রত্যেক অধ্যক্ষের সংগে বিস্তারিত আলাপের প্রয়োজন হবে।
সভদ্র বললেন, এ কাজ ষত কঠিনই হোক না কেন করতেই
হবে আমাদের । আপনারা ষদি বলেন, আমি ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের
গে আলাপের দায়িত্ব নিতে রাজী আছি।
শেব পর্যন্ত তাই স্থির হোল। ভিক্ষু ত্রিশরণ এই সংবাদ নিয়ে
যথাস্থানে পৌছে দেবার জন্য চলে গেলেন ।
ছু
বহু বাক্য-বিনিময়ের পর পল্পনাভকে শেষ পর্যন্ত বরাহস্বাম'র
অন্থুরোধের কাছে হার মানতে হয়। অনুরোধও বটে, কিছুটা
আদেশও বটে।
পদ্মনাভ বরাহস্বামীর শিষ্য । গুরুর অনুরোধ আর আদেশ এই
ছইয়ের মধো বেশী দূর পর্যন্ত পার্থক্য টেনে চলা যায় না। তা হলেও
পদ্মনাভ তার যথাসাধ্য আপত্তি জানিয়েছেন। বলেছেন, আমাকে
দয়া করে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দ্রিন। আমার এ সব ভাল
লাগে না, আর পারিও না আমি। আমি আমার পুরানো সেই
অধ্যয়ন আর অধ্যাপনার কাজে ফিরে যেতে চাই।
কিন্তু বরাহস্বামী তাকে কিছুতেই ছাড়তে রাজী নন। মহাঁ-
সান্ধিবিগ্রহিকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে যে কোন লোককে বসিয়ে
নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। পদ্দুনাভ বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, কর্মঠ, নির্ভর-
যোগ্য, বিশ্বাসী |
কোন কোন বিষয়ে তার স্বাধীন মতামত থাকলেও শেষ পর্যস্ত
তাকে নিজের দিকে টেনে রাখতে পারব্নে, বরাহস্বামীর এ বিশ্বাস
আছে। একধারে এতগুলো গুণ স্থবলভ নয়। তবে দোষের মধ্যে
তার মনটা বড় নরম, আর তার নীতিজ্ঞানট। প্রথর | মহাসান্ধি-
বিগ্রহিকের কাজের পক্ষে এর কোনটাই উপযুক্ত নয়, সে বিষয়ে
সন্দেহ নাই। কিন্ত সেই ক্রটিট1 সামলে নেবার জন্য তো! তিনি
নিজেই আছেন। পন্পনাভ তার সংগে পরামর্শ না করে কোন
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন না।
১১৩ বিদ্রোহী কৈবর্ত
পদ্পনীভ বলেছিলেন, এ আমার ধাতে সয় না। তাছাড়া এ
সব কাজে আমার চেয়েও অভিজ্ঞ ধারা তাদের কাউকে এই পদে
নিয়োগ করুন ।
বরাহস্বামী এই আপন্তিট। হেসেই উড়িয়ে দিলেন__ধাত ? ধাত'
বলে অপরিবর্তনীয় কোন কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
দু বুর আগে প্রথম যখন তোমাকে এই পদে নিয়োগ করা হয়,
তখন এই 'ধাত'-এর প্রশ্ন তুলে কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন ।
কিন্তু তাদের সেই আপন্তিতে আমি কান পাতি নি। এখন তারাই
স্বীকার করছেন যে, সেদিন লোক-নিবাচনে আমিই নিভূল ছিলাম |
আর অভিজ্ঞতার কথা বলছ? অভিজ্ঞতা একট] বড় গুণ সন্দেহ
নাই, কিন্ত একমাত্র অভিজ্ঞতার জোরে সব কিছু হয় না। আবার
কখনও কখনও এও দেখা যায় যে, এই অভিজ্ঞতাই সঠিক পথের
প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। এর দৃষ্টান্ত আমাদের এখানেই অনেক
দেখেছি । কোন কোন অভিজ্ঞ লোক বহু দিন ধরে অভ্যস্ত পথে
পথে চলতে চলতে একটা নির্দিষ্ট খাতের মধ্যে এমন ভাবে আটকা
পড়ে যায় যে, পরিবন্তিন্ত অবস্থায় প্রয়োজনীয় দ্রুততার সংগে তা
থেকেখ্বেরিয়ে আসতে পারে না। অবস্থাবিশেষে যে অভিজ্ঞতা
এক দ্বিন গুণ ছিল, শেষকালে তাই ক্ষতির কারণ হরে দীড়ায়।
আমাদের স.ম্রাজ্যের নান! দিক দিয়ে দ্রুত পরিবন ঘটে চলেছে।
তার সংগে মানিয়ে চলবার জন্য নৃতন দৃষ্টি আর নৃতন পদ্ধতির
প্রয়োজন । সে বিষে তুমি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছ ।
পদ্পনাভ যুক্তিতর্কের পাশ কাটিরে অন্য পস্থ! ধরলেন, সভার
প্রাচীন সদন 'অবিরথ এ ব্যাপারে সব দিক দিরেই আমার চেয়ে
যোগ্যতর ! এই পদে তাকেই নিয়োগ করুন না কেন?
বরাহস্বামী তার এই প্রস্তাবট! শুনে কিছুক্ষণ ভ্রকুঞ্চিত করে
কি ভাবলেন, শেষে বললেন, না না, সে হয় না।
কেন, হয় না কেন?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১১৪
কেন হয় না? সরল শিশুর মত এমন একটা প্রশ্ন তিনি পন্প-
নাভের কাছ থেকে আশা করেন নি।
একটু ঝাঝালো স্থুরে উত্তর দিলেন তিনি, না হয় না, তিনি যে
বৌদ্ধ।
পল্পনাভ এই উত্তর শুনে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে
রইলেন। এই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে বাকী রইল না বরাহস্বামীর। তার
নিবিকার কঠিন চিন্ত, কিন্ত এবার তার মধ্যেও একটু বিকারের লক্ষণ
দেখা গেল। সহজ সত্যটা সোজ! করে বলতে পারলেন না, একটু
ঘুরিয়ে বলতে হোল -_আদর্শ আর চিন্তার দিক দিয়ে ওদের সংগে
আমাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । প্রধান অমাত্য আর মহাসান্ধি-
বিগ্রহিকের চিন্তার মধ্যে বদি মূলগত অনৈক্য থাকে, তবে পদে পদে
বিরে।ব ঘটতে থাকবে, কাজ এণোবে না।
যে ভাবেই বলুন না কেন, তার কথার প্রকৃত মর্ম জলের মতই
প্রাজল। পদ্পনাভের মুখ থেকে ফস্ করে বেরিয়ে পড়ল--কিন্ত
আমাদের মহারাজ নিজেই তো! বৌদ্ধ সেজন্য কই, কাজের কোন
অস্থবিধা হচ্ছে না তো ।
বরাহস্বামী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, তার কথা স্বতন্ত্র।
কেন স্বতন্ত্র, কোন্ দিক দিয়ে স্বতন্ত্র, মে কথাটা কিন্ত অনুক্তই
থেকে গেল। বরাহস্বামী নেদিনকার মত ওইথানেই আলাপের
হেদ টেনে দিলেন ।
কিন্ত গুরুর কবল থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়ে
উঠল না। নিজের এই ছুর্লতা সম্পর্কে পদ্মনাভ অচেতন নন,
কিন্তু তবু তকে বার বার এই দুর্বলতার হাতেই আন্মসমর্পণ করতে
হয় ॥। এক দ্রিন বরাহস্বামী বলেছিলেন, বোগ্যত| অবোগ্যত। সম্পর্কে
বে সব প্রশ্ন তুমি তোল ওগুলো কোন কাজের কথা নয় । আসন কথা,
এ সব কাজে তোমার তেমন রুচি নেই। কিন্ত জাতির কল্যাণের
প্রশ্নে ব্যক্তি ।ত রুটি অরুচির কোন কথাই উঠতে পারে না ।
১১২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
জাতির কল্যাণ? এ জাতি কোন্ জাতি--চেদী, হিন্দু ন!
সাম্রাজ্যের সকল মানুষ? এই প্রশ্নটা নিতান্ত অস্পষ্ট আকারে
হলেও তার মনের মধ্যে একবার মাথা তুলে উঠেছিল, কিন্তু বরাহ-
স্বামীর কথার শোতে তা ভেসে গেল।
কিছু দ্রিন ধরে বরেন্দ্রী থেকে নান৷ রকম ছুঃসংবাদ আসছে ।
কোনটা সেখান থেকে প্রেরিত দূতের মুখে, কোন কোনটা! আবার
লোকের মুখে মুখে নানা ভাঁবে শাখাপত্রপল্লবিত হয়ে । সব কথা
বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু ব্যাপারটা থে ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে,
সেটা স্পষ্টই বোঝ! যায় ।
আমি নিঞ্জে এক বার গিয়ে দেখে আসি, পদ্মনাভ প্রস্তাব
করলেন।
না না, তোমার গিয়ে কাজ নেই, বরাহত্বামী দুঢ কথে আপনি
জানালেন। পরক্ষণেই পদ্ুনীভের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে
সামলে নিয়ে একটু নরম সুরে বললেন, সেটা নিগীপদ নয়। এই
গোলমেলে অবস্থায় তোমাকে সেখানে যেতে দিতে আমার সাহস
হয় না।
"নিরাপত্তার কথাটা আসল কথা নয়। এ অবস্থায় পদ্মনাভের
উপর তিনি নির্ভর করতে পারেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় পদ্মনাভ
অনেক ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্ত যে অবস্থায় কঠিন
হস্তে দমনই হচ্ছে একম।ত্র পথ, সেখানে পদ্মনাভ নরম নীতি
অনুসরণ করে চলবে, এ ভডয়ট! তার পুরো মাত্রায় আছে। ইতিপুবে
পদ্মনাভ তাকে সেই রকম পরামর্শ ই দিয়েছিলেন ।
পদ্মনাভ কিছু বলবার আগেই তিনি আবার বললেন, তা ছাড়া
এ সব ক্ষেত্রে মহাসান্ধিবিগ্রহিকের স্বয়ং ঘটনাস্থলে যাবার
কোন প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে যে সব রাজপুরুষের| ও সৈন্যেরা
নিয়োজিত আছে, এ অবস্থায় তারাই হচ্ছে সব চেয়ে উপযুক্ত
লোক।
বিদ্রোহী কৈবর্ত
১১৩
কিন্ত দেখেছেন তো, ওরা! অবিলম্বে এক দল অশ্বারোহী সৈন্ত
পাঠাবার জন্ত সংবাদ পাঠিয়েছে।
হ্যা দেখেছি । একটুতেই ভয় পেয়ে যায় ওরা । ওদের হাতে
সৈম্য তো বড় কম নেই। তবু আমি পদাতিক সৈন্য পাঠিয়ে দেবার
জন্য নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি । কিছু অশ্বীরোহী সৈন্তও ওদের কাছে
আছে। এই তো যথেষ্ট। এখান থেকে আর অশ্বারোহী সৈন্য
পাঠানো চলবে না। সেনাপতি এই অভিমত জানিয়ে দিয়েছেন।
ঠিকই বলেছেন তিনি। আমি এ বিষয়ে তার সংগে সম্পূর্ণ একমত।
বরেন্্ীতে এ রকম গোলযোগ মাঝে মাঝেই দেখা দেয়। একটু
ভাল হাতে মার খেলে ছু-দিন বাদে আপনি ঠা হয়ে যাবে।
কিন্ত আসল ভয় রাজধানীতে ।
পদ্মনাভ মুছ প্রতিবাদের স্্্রে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে,
আপনি ওখানকার ব্যাপারটাকে একটু ছোট করে দেখছেন। যে
সমস্ত খবর আসছে-_
হা! তাঁও শুনেছি, কিম্ত খবরগুলো বড বেশী অতিরঞ্জিত হয়ে
আসছে । সামন্তরীজ দিবেবোকের সংগে আমার সব সময় সরধসাঁর
যোগাঝোগ চলছে । আসল কথ কি জান, অজন্মা এবং আরও
নানা কারণে ওখানকার কয়েকট। অঞ্চলে খাগ্ভাভাব দেখ। দিয়েছে ।
তারই ফলে চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ চলছে । আর এই স্ত্রযোগে
যত সব বজ্জাতঃ বদমাস আর স্বভাব ছুবৃত্তেব দল ওদের সংগে
ভিড়ে গেছে । আগামী ফসলট। উঠলে অবস্থা এমনিতেই শাস্ত হয়ে
আসবে।
পদ্মনাভ কিন্তু কথাটা এত সহজে মেনে নিতে পারলেন না,
বললেন, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, বেছে বেছে বহিরাগতদের
উপরেই হামল! হচ্ছে । এর ভাৎপর্যটাই বা কি?
ওখানে বহিরাগতরাই যে সবচেয়ে সম্পন্ন লোক। তা ছাডা
গৌড়ীয় বণিকদের বিরাট বিরাট ধানের গোলাগুলো। ওদের লুব্ধ দৃষ্টি
১১৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আকর্ষণ করে। হামলা তাদের উপর হবে না তে। কার উপর
হবে।
কিন্ত ওরা ঘে আমাদের সৈন্দের ছুটে স্বন্ধাবার আগুন দিয়ে
পুড়িয়ে দিয়েছে, এ কথাটা তো! অতিরঞ্জিত নয়।
বরাহস্বামী বললেন, সৈন্যের সংগে ওদের সংঘর্ষ তো কিছুটা
বাধবেই। ইতিপূর্বে উপদ্রত অঞ্চলের কয়েকটা গ্রাম আগুন দিয়ে
পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। ওরাও সুযোগ পেয়েছে,
আর তার প্রতিশোধ নিয়েছে । আমার তো মনে হয় আমাদের
অপদার্থগলে! নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিল। তা না হলে এমন
কখনও হতে পারে! এই শিক্ষাটুকু পেয়ে ভালই হয়েছে । এর পর
থেকে সাবধান হয়ে চলবে।
সেই ভয়াবহ দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করে পদ্মলাভ শিউরে উঠে
বললেন, এ ভাবে শ্রামে« পর শ্রাম আগুন দিয়ে পুডিয়ে দেওয়া
এ কি আপনি সমর্থন করেন?
বরাহস্বামী শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, নিশ্চয় করি। এখান
থেকে সেই রকম নিদে'শই তো! ওরা পেয়েছিল ।
কিন্ত এর পরিণতি কোন্ দিকে চলেছে ?
নি:সন্দেহে শাস্তির দিকে, বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, শাস্তি ভংগ
করলে কঠোর হস্তে দমননীতি চালাতেই হবে। তা ন! হলে রাজা,
রাজপুরুষ আর সৈম্তদল থাকার সার্থকতাটা কি? তাদের দণ্ড
সক্রিয় আছে বলেই শান্তি বজায় আছে।
পদ্পনাভ নিঃশব্দ হয়ে রইলেন। বোধহয় গুরুর এই গুরুপাক
কথাগুলে হজম করবার চেষ্টা করছিলেন ।.বরাহস্বামী হেসে বললেন,
তুমি একটু বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছ। তার কারণ তুমি শুধু এক
ধরনের খবরই পেয়ে আসছ।
আমার তে? খুবই মনে হয় সেখানকার অযোগ্য রাজপুরুষেরা
নিজেদের অকর্মণ্যতাকে ঢাকা দেবার জন্য খবরগুলোকে অতিরঞ্জিত
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১১৫
করে পাঠাচ্ছে । দিব্বেকের কাছ থেকে আমি নিয়মিত ভাবে যে
সমস্ত সংবাদ পাচ্ছি, তাতে এমন আতংকিত হবার কোনই কারণ
নেই। এই অশান্তি সমস্ত বরেন্দ্রী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নি। যেখানে
যেখানে খাগ্ভ।ভাব বিশেষভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, এ সমস্ত হাংগামা
সেই সমস্ত অঞ্চলেই সামাবদ্ধ। কৈবর্তদের মধ্যে যে ক'জন ভূম্য-
ধিকারী বা সামন্ত আছে, তার! সবাই রাজার প্রতি আন্ুগত্যসম্পন্ন
এবং তার! নিজ নিজ অঞ্চলে শাস্তি রক্ষার কাজে আমাদের যথাসাধ্য
সাহায্য করে চলেছে'।
বরাহস্বামী সমস্ত ব্যাপারটাকে জলের মত সহজ করে দিতে,
চাইলেন। কিন্ত পদ্মনীভের মন এত সহঞ্জে তা মেনে নিতে
চাইছিল না। স্ভুনি বললেন, সামন্ত দিবেধোক যে সমস্ত সংবাদ
পাঠাচ্ছে, আপনি কি তার সবটাই নিঃসংশয়ে বিশ্বাস
করেন?
কেন করব না?
সামন্ত দিব্বোক যে ছদিকে ছু-রকম খেল! খেলছেন না, এমন
কথা কি নিশ্চিত ভাবে বলা চলে? কে জানে আমাদের দ্রিয়েও
তিনি হয়তো! খেলাচ্ছেন।
এ কথাটা তুমি আরও একদিন আমায় বলেছ। কিন্তু বর্বর
কৈবর্তের কাজ এতটা কুট বুদ্ধি আশা করা যায় না। ওটা তোমার
অতিরিক্ত কল্পন। ।
আপনি কি তাই মনে করেন? পদ্মনীভ বলে চললেন, দ্িবেবোক
সম্পর্কে আমার ধারণা কিন্ত আপনার সংগে মিলছে না। আমি
তার সংগে ঘণশিষ্ঠভাবে মিশেছি, তা থেকে আমার ধারণা হয়েছে,
তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান |
হ্যা, বুদ্ধিমান তিনি ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিমান হলেও সরল
প্রকৃতির লোক। এটা ওদের জাতের ধর্ম। ওদের বুদ্ধির একটা
স্বভাবজীত সীমাবদ্ধতা আছে।
১১৬ বিজ্রোহী কৈবর্ত
শুধু তাই নয়, আরও জানি গৌড়ের সআাটদের বিরুদ্ধে তীর
মনে বহু অভিযোগ সঞ্চিত হয়ে আছে।
সে কথা তুমি কেমন করে জানলে? বরাহস্বামী আশ্চর্য হয়ে
প্রশ্ধ করলেন ।
প্রথম বার যখন বরেন্দ্রীতে যাই, তার ওখানেই ছিলাম । তখন
তিনি আমাকে মন খুলে অনেকগুলো কথা বলেছিলেন । সে কথা”
গুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার । ভুখন দেখেছিলাম,
ওখানকার লোকদের কাছে কি আশ্চর্য রকম জনপ্রিয় তিনি ।
সে কথা সত্য, বরাহস্বামী স্বীকার করলেন ।, সেই জন্যই তো'
নিশ্চিন্ত আছি যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আমাদের পক্ষে আছেন, ববেন্দ্রী
সম্পর্কে আমাদের ভয় করবার মত কিছু নেই!
আর যদি পক্ষে না থাকেন? তা হলে?
না, সে রকম সন্দেহ করবার মত কোন কারণ আছে বলে মলে
হয় না । ওদের সম্পর্কে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা আছে আমার ।
পদ্দনাভ মৃছু হেসে বললেন, একটু আগেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যে
কথা আপনি বলছিলেন আমি সেই কথাটাই আপনাকে স্মরণ করিয়ে
দিতে চাই_:কোন কোন অভিজ্ঞ লোক অভ্যস্ত পথে চলতে চলতে
একটা নির্দিষ্ট খাতে এমন ভাবে আটকা পড়ে যায় যে, পরিবতিত
অবস্থায় প্রয়োজনীয় দ্রুততার সংগে তা থেকে বেরিয়ে আসতে
পারে না। এক যুগ আগে কৈবর্তরা যেমন ছিল, আজও কি তাই
আছে? পরিবর্তন সবারই আছে, শুধু কি কৈবর্তদেরই নেই ?
বরাহস্বামী উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠলেন, আমার অস্ত্রে আমাকেই
ঘায়েল করতে চাও + তোমার স্মৃতিশক্তির প্রশংস। করি । একেবারে
অক্ষরে অক্ষরে মনে করে রেখেছ । তোমার এই সন্দেহ তোমার
রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচায়ক । কিন্তু এই সন্দেহ প্রবৃত্তিটাকে
বল্গাহীন ভাবে ছেড়ে দিতে পার না, একট! জায়গ।য় গিয়ে
বিদ্রোহী ঠবর্ত ১১৭
তোমাকে থামতেই হবে। তবে একটা কথ। তোমাকে বলি, যদিও
আমি বিশ্বাস করি দ্িবেবোক সম্পর্কে আমার ধারণাটা সঠিক, তবু
সতর্কতা হিসাবে একটা ব্যবস্থা! রেখেছি আমি ।
ব্যবস্থা? কি ব্যবস্থা ?
তার নিজস্ব এলাকাতেই একটি সৈন্যের ঘখটি স্থাপিত আছে ।
সেখানকার ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষের উপর দিবেবাকের গতিবিধি ও
কাজকর্ম সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখবার জন্য নির্দেশ দেওয়। আছে ।
তার কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছি দিব্বোক সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ
পোষণ করবার কোনই কারণ নেই, তিনি আমাদেরই লোক । এবার
বুঝতে পারছ তো, বরেক্দ্রী সম্পর্কে আমি যে নিশ্চিন্ত হয়ে আছি,
তার সংগত কারণ আছে। কিন্তু আমার আশংকা এখানকার
অবস্থা নিয়ে ।
অবস্থাটা কি এতই আশংকাজনক বলে মনে করেন? পদ্মনা
উদ্বিগ্ন কে প্রশ্ন করলেন ।
মথনদেব বড় বেশী সক্ক্রিয় হয়ে উঠেছেন। স্বভাবতই তিনি
অত্যন্ত চাঁপা, সন্দেহ করবার স্তরযোগটুকু দিতে চান না। কিন্তু গ্রবার
তিনিও যেন আপনাকে চেপে রাখতে পারছেন না! আর ঠিক
এমনি সময়ে সভার বিশিষ্ট সদন অধিরথ রাজধানীতে অনুপস্থিত ।
কোথায় তিনি ?
খোজ নিয়ে জানা গেল, তিনি বৈষয়িক ব্যাপারে গ্রামাঞ্চলে
গিয়েছেন । এ সময়টা ফসল ওঠার সময় কি না, তাই। এট!
অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে সময়টা অস্বাভাবিক কিনা, তাই
সামান্য জিনিসকেও অসামান্য বলে মনে হয়।
মথনদেবের সংগে অধিরথের সম্বদ্ধটা কি? পদ্ননাভ আশ্চর্য
হয়ে প্রশ্ন করলেন ।
বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, সম্বন্ধ ছিল না জানি। কিন্তু হয়ে
যেতে কতক্ষণ? বিশেষ করে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র যখন প্রস্তত
১১৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আছে। পক্ষকাল পূর্বে সোমপুর বিহারে অন্তান্ত বিহারের অধ্যক্ষের!
একত্রে মিলিত হয়েছিলেন, এ খবরটাও শোনা গেছে। তারই ব৷
তাৎপর্য কি?
তাৎপর্য? এর আবার তাৎপর্ষ কি! এতো নতুন কথা নয়।
বিহারের পরিচালনা সম্পর্কে পরস্পর মতামত আদান প্রদানের জন্য
অধ্যক্ষের মাঝে মাঝে মিলিত হন। এই রীতি বহু কাল থেকেই
চলে আষমছে।
বরাহস্বামী চিন্তিত কণ্ে ধীরে ধীরে বললেন, হ্যা ঠিকই বলেছ
তুমি। এটা নতুন কিছু নয়, সেট। আমিও স্বীকার করি! কিন্তু
বহু দিন বাদে ওরা সেদিন মিলিত হয়েছিলেন, সেই কথাটাই
ভাবছি ।
বহু দিন ধরে মিলিত হন নি, সেই জন্যই হয় তো মেলাটা
প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছিল।
তাও বলতে পার, বরাহস্বামী হেসে বললেন । কিন্তু মনে যদি
একবার সন্দেহ জাগে, তখন সব কিছুই যেন বিশেষ বপ নিয়ে দেখা
দেয়, এমনিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখতে গেলে ঘটনাগুলোর মধ্যে
অস্বাভাবিকতা কিছুই নেই, কিন্তু একটা ছর্ষোগের মুখে এই ধরনের
কতগুলেো৷ ঘটনার সমাবেশ ঘটলে সন্দেহের স্থষ্টি করে তোলে ।
আচ্ছা, সে কথা থাক। এখন বল আমাদের পশ্চিমাঞ্চলের সামস্ত-
রাজদের মনোভাবট! কি? মথনদেবের দলবল যদি সত্যসত্যই
শক্তি পরীক্ষায় নামে, তা হলে এর! কোন্ পক্ষে যোগ দেবে?
পদ্গানাভ উত্তর দিলেন, সেটা! শ্থনিশ্চিত ভাবে বল! সম্ভব নয়।
এর! মুখে বলছে, রাজ্যের মধ্যে কোন রকম আভ্যন্তরীণ সংকট দেখা
দিলে বা বহিঃশক্র আক্রমণ করলে রাজার পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে।
কিন্ত আমার মনে হয়, এট তাদের মুখের কথা, মনের কথা নয়।
কোন কোন শ্রযোগসন্ধানী সামস্তরাজ এই স্থযোগে স্বাধীন হবার
স্ব দেখছে, এ কথাও শোনা যায়। তবে আমার ধারণা এদের
বিজ্ঞোহী কৈবর্ত ১১৯
মধ্যে অধিকাংশ প্রথম অবস্থায় নিরপেক্ষ হয়ে অবস্থার গতি
পর্যবেক্ষণ করবে। তার পর যে পক্ষের জয়ের সম্ভাবন1 দেখবে, সেই
দিকে যোগ দেবে।
বরাহস্বামী বললেন, হয়তে1 তোমার কথাই ঠিক । আবার এও
হতে পারে: এই শক্তি পরীক্ষায় চূড়ান্ত পরিণতি এদের দ্বারাই
নির্ধারিত হবে। শুনেছি, বেশ কিছু দ্রিন থেকে মথনদেবের চরেরা
এই সব সামন্তরাঁজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে । তবে তারা তাদের কাজে,
কতটা সাফল্য লাভ করেছে, এখনও তা৷ বলা সম্ভব নয়।
পদ্মনাভের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেন। বললেন, একটা
কথা বল! হয়নি আপনাকে । কয়েক দিন আগে একট খবর পেলাম।
এ খবরের কোন গুরুত্ব আছে কিন। আপনি ভেবে দেখুন ।
বরাহস্বামী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন ।
আমার পরিচিত এক বণিক তার মৃত পিতার পিওদান করতে গয়ায়
গিয়েছিল । ফেরার সময় পীঠিনগরের মহেশের মন্দিরে পূজো দিতে
গিয়েছিল। গীঠির রাজপথ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ তার দেখা
হয়ে গেল দিবেবাকের ভাই রূদোকের সংগে ।
রূদোককে কেমন করে চিনল ? বরাহস্বামী প্রশ্ন করলেন।
বণিক মধুদত্ত বাণিজ্যের উদ্দেস্টে কিছু কাল বরেক্দ্রীতে ছিল,
রুদোককে দে ভাল করেই চেনে ।
বেশ তো, রুদোককে যদি সে দেখেই থাকে, হয়েছে কি তাতে ?
গীঠিতে কিছু কিছু কৈবর্তের বসত্তি আছে । যেতেও পারে সেখানে ।
পদ্মনাভ বললেন, ত। পারে, মানলাম। কিন্তু কথা সেটা নয়।
রুদোক একজন স্থানীয় সন্ত্রান্ত লোকের সংগে কথা বলতে বলতে
যাচ্ছিল। হঠাৎ মধুদত্তের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সে কোন কথ! ন!
বলে রহম্তজনক ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল। বোধহয় 'সে মনে করেছিল
যে মধুদত্ত তাকে দেখতে পায় নি। মধুদত্ত দ্রুত পদে সেই ন্ুবেশ
সম্ভ্রান্ত লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা! করল, ভদ্র, আপনি আপনার
১২০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
যে সংগীটির সংগে কথা বলছিলেন, তিনি হঠাৎ কোথায় চলে
গেলেন ?
লোকটির স্বভাব অতান্ত রুক্ষ । সে দীত মুখ খিচিয়ে বলে উঠল,
তোমার চোখে কোন দোষ আছে নাকি হে?
মধুদত্ত হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, কই না তো,
আমার চোখে কোন দোষ নেই।
চোখে দোষ নেই* তবে বলছ কি এ সব? আমার সংগী আবার
কে, আমি তো! একাই বাচ্ছিলাম। কোন্ দেশের মানুষ তুমি ?
মধুদত্ত উত্তর দিল, আমি গৌড়ের অধিবাসী ।
হুঁ, যা ভেবেছি তাই। গৌড়ের প্রথম অক্ষরেই তোমার পরিচয় ।
বলেই সে হন হন করে চলে গেল । আর মধুদত্ত কিছুই বুঝতে না
পেরে হা করে পথের মাঝখানে দাড়িয়ে বইল |
বরাহস্বামী হেমে বললেন, আমার কি মনে হয় জান, কদৌকের
কাছে বণিক মধুদত্তের হয়তো! কিছু পাওন1 ছিল, তাকে দেখে ভয়
পেয়ে পাপিয়ে গেল। তা ছাড়া পে লোক রূদোক কিন! তাই বা কে
জানে | দেখামাত্রই মিলিয়ে গেল তো । আর আমাদের চোখে সব
কৈবর্তঠকই একই রকম মনে হয়। কিন্ত মে কথা থাক। এ নিয়ে
মধুদত্ত চিন্তা করে মরুক, কি ভুমি ভাবতে বসলে কেন, আর
আমাকেই বা এ নিয়ে ভাবতে বলছ কেন?
পদ্মনাভ বরাহস্বামীর ভাব দেখে মনের কথাটা খুলে বলতে একটু
দ্বিধা করছিলেন। একটু সময় ইতস্তত করে শেষে বললেন, 'আমি
ভাবছিলাম, পীঠিরাজ দেবরক্ষিত্ের সং দিবেবাকের কোন গোপন
যোগাযোগ চলছে না তে1? দেবরক্ষিত সম্পর্কে কিছু দিন থেকে
যে সব খবর আসছে, সেগুলো খুব ভাল নয়। তিনি নাক নিজেকে
স্বাধীন রাজ! বলে ঘোষণ। করবার চেষ্টায় আছেন। দেবরক্ষিতের
নামাংকিত মুদ্র৷ সম্প্রতি পীঠিরাজ্যে প্রচলিত হয়েছে। মধুদতত
স্বচক্ষে তা দেখেছে । রুদোকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটু
বিন্রোহী কৈবর্ত ১২১
অনুসন্ধান করেছিলাম । পীঁঠি থেকে মধুদত্তের পরিচিত এক বণিক
পণ্য ক্রয় করবার জন্য সম্প্রতি এখানে এসেছে । মধুদন্তকে দিয়ে
তাকে ডাকিয়ে এনেছিলাম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম
রূদোকের সেই রুক্ষভাষা সংগীটির সংগে পীহিরাজ্যের সেনাপতি
ভীমযশের আকৃতির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে । এর পরেও কি আপনি
বলতে চাইবেন যে রুদোকের এই ঘটনাটা সম্পর্কে আমাদের
চিস্তনীয় কিছুই নেই?
বরাহস্বামী অধৈর্ধের স্থরে বলে উঠলেন, বরেক্দ্রীর ভূত তোমার
কাধের উপর এমন শক্ত করে চেপে বসেছে যে তাকে নামানো বড়
কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে । আমরা এখানে এক বিরাট সংকটের মুখে,
যে কোন সময় অন্তধিপ্রব ফেটে পড়তে পারে, আর তুমি কিন? একট!
অবাস্তব কল্পনার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ। গৌড়ের বিরুদ্ধে দেবরক্ষিত
আর বরেন্দ্রীর কৈবর্তেবা সম্মিলিত হতে পারে, এ চিন্তা করা
বাতুলতা মাত্র। ববেন্দ্রীর ভাবনা! যারা ভাবছে তাবাই ভাবুক,
তোমার তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই, তুমি তোমার নিজের
কাজ করে যাও।
কথাগুলো! শ্রুতিম্থখকর নয়, কিন্তু পদ্মনাভ তবু ধের্য না হারিয়ে
শান্ত কেই বললেন, অন্তবিপ্লব যদি সত্যসত্যই দেখা দেয়, ওরা কি
সেই স্্যোগ নিয়ে বিদ্রোহ করতে পারে না?
করে করুক, সে জন্য ভাবি না, বরাহস্বামী অগ্রাহোর স্থরে
বললেন । অন্তবিপ্রবকে যদি দমন করতে পারি, তবে ওদের
বিদ্রোহকে দমন করতে সময় লাগবে না।
পঞ্মনীভ কঠিন বাক্যাঘাত খেয়েও পিছনে হটলেন না, বললেন,
আমরা ছুপক্ষ খন পরম্পর হানাহানি করে ক্ষত-বিক্ষত, অবসন্ন হয়ে
পড়ব সেই সময় স্থযোগ বুঝে ওর! যদি সদলবলে রাঙ্গধানীর বুকের
উপর এসে চড়াও হয়?
বরাহস্বামী উত্তর দিলেন, সে ছুঃসাহস ওদের হবে না। ওরা
১২২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বেশী ক্ষেপে ওঠে যদি, নিজের ভূমিতে দীড়িয়ে যুদ্ধ করবে, হয়তো
দলে দলে প্রাণও দেবে। কিন্তু গৌড়ে এসে হান! দেওয়া_সে
অসম্ভব । ধিস্কত তোমার আজ হয়েছে কি? এ সব অসম্ভব কল্পন!
তোমাকে পেয়ে বসেছে কেন?
এ কি একেবারেই অসম্ভব? পদ্মনাভ প্রশ্ন করলেন, আপনার
মুখেই তে শুনেছি, এক সময় বরেন্দ্রীর এই কৈবর্তেরাই গৌড় পর্যন্ত
এসে ধাওয়া! করেছিল। তাদেরই তো! বংশধর এরা | অভাবে
অনটনে এর! উন্মন্ত,প্রায় হয়ে উঠেছে। আবার কি সেই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি হতে পারে না?
না, অবস্থার অনেক রূপান্তর ঘটে গেছে । সে সময় বরেন্দ্র আর
গৌড়ের মধ্যবততী অঞ্চল ছিল বিশাল অরণ্য । সেই অরণ্য ছিল
ওদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, সুরক্ষিত ছুর্গ। সেই অনৃশ্য ছুর্গ থেকে নিশা-
চরের মত ওরা অতকিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আক্রমণের পূ
মুহুর্ত পর্ধস্ত আমরা ওদের চলাচল সম্পর্কে কোনই আভাস পেতাম
না। কিন্তু ওদের সেই স্রযোগ আজ আর নেই । দলের পর দল
কোচেরা এসে বন কেটে কেটে বসতি স্থাপন করেছে । গড়ের
সম্রাটরাও নান1 ভাবে তাদের উৎসাহ দিয়েছিলেন । এদের সংখ্যা
বড় কম নয়। কৈবর্তদের সংগে এদের সম্পর্ক বিশেষ ভাল নয়।
আর সেই সম্পর্ক যাতে ভাল না থাকে, সেদিকেও দৃষ্টি রাখছি
আমরা। ত। ছাড়া! সুশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংগঠিত
পদাতিক দল কি করতে পারে! কাজেই বৃথাই তুমি এ সব
কথা ভাবছ ।
পল্পনাভ এ কথার উত্তর দেবার সময় পেলেন না। শান্তিরক্ষা
বিভাগের একজন কর্মচারী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঘরে ঢুকল । তার
চোখ মুখের ভাব দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল, কোথাও একটা বিষম
অনর্থ ঘটেছে। সময়ট! ভাল নয়, মুহুর্তের মধ্যে কত কিছু
ঘটে যেতে পারে । সেকথা মনে করে বরাহম্বামী আর পল্পনীভ
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১২৩.
সচকিত হয়ে উঠে দাড়ালেন । কি, হয়েছে কি? প্রশ্ন করলেন
বরাহস্বামী ।
গুরুতর ব্যাপার ! মহাপ্রতীহার আপনাকে এখনই যেতে
বলেছেন।
আমাকে যেতে বলেছেন! কোথায় আছেন মহাপ্রতীহার ?
কি হয়েছে?
কর্মচারীটি প্রথমে প্রথম প্রশ্সের উত্তর দিল--মহাপ্রতীহার
রাজপ্রাসাদে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর
দেবার জন্য সময় ন1 দিয়েই বরাহস্বামী গর্জে উঠলেন, আঃ, হয়েছে
কি তাই বল না।
বেচার! বিন দোষে ধমক খেয়ে দ্রুত গড় গড় করে বলে গেল,
রাজবৈদ্য হরিগুপ্ত একটা গোপন লিপি শুদ্ধ ধরা পড়েছেন ।
কোথায় ধর পড়েছেন-__শংখদেবীর কক্ষে, তাই না?
হ্যাঁ হ্যা, সেখানেই । কর্মচারীটি আশ্চর্য হয়ে বরাহস্বামীর মুখের
দিকে তাকাল। যে কথা বাইরের কেউ এখন পর্যস্ত জানে না,
প্রধান অমাত্য কেমন করে তা জানলেন !
কারা ধরল?
প্রাসাদের নপুংসকেরা । চিঠিটা হাতে দিতে যাচ্ছিলেন, ঠিক
এমনি সময় একেবারে হাতে হাতে । আমরাও পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী
গুপ্তভাবে নীচে অপেক্ষা করছিলাম ।
মথনদেব কোথায়? তাঁর গৃহ অবরোধ করবার জন্য লোক
পাঠানে! হয়েছে?
জানি না।
রাজসভার সদম্য অধিরথ রাজধানীতে ফিরেছেন ?
জানি ন! তো।
তবে জান কি? মহারাজ কোথায় আছেন, সেই খবরট! জান
তো?
১২৭ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কর্নচারী উত্তর দিল, তিনি চোখ বুজে চুপ করে বসে আছেন,
একটা কথাও বলছেন না।
কথাট1 বলেই আবার দে মিনতির স্ত্ুরে বলল, আপনাকে এখুনি
যেতে বলেছেন ।
হ্যা হা, যাচ্ছি ।
পদ্পনাভ উদ্বেগপূর্ণ কণ্ে প্রশ্ন করলেন, রাজবৈদ্য হরিগ্রপ্তের কি
হয়েছে? আমি তো! কিছুই বুঝে উঠতে পারছি ন1।
তু কথায় বলছি, বিস্তারিত ভাবে পরে. শুনবে । হবরিগুপ্ত দীর্ঘ
দিন ধরে মথনদেবের সংগে সংশ্লিষ্ট হয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক। পালন
করে আসছিলেন : কিন্তু কেউ সন্দেহ করতে পারে নি. আমিও না।
তবে কিছু দিন থেকে শংখদেবী একটু ঘন ঘন অন্তুস্থ হয়ে পড়ছিলেন
বলে আমার মনে একটু খটক1 সেগেছিল। সেই জন্য রাজবৈদ্চ
যখন তার চিকিৎসার জন্য আসেন, তখন তার উপর সতর্ক দৃষ্টি
রাখবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম ! তাব ফলে চোর 'একেবারে হাতে
হাতে ধর! পড়ে গিয়েছে । এই লিপিব সাহায্যে ভেতরকার অনেক
রহস্যঈ হয়তো উদ্ঘাটিত হয়ে বাবে।
রাজবৈগ্থ হরিগুপ্ত-_-তিনি ওদের পক্ষে কাজ করছিলেন ?
হ্যা হ্যা, এখন আর কথ। বাড়িও না। পরে সবই বলব, এখন
আমি যাচ্ছি ওখানে ।
আমি কি মাপনাব সংগে যাব? পঞ্সনাভ প্রশ্ন করলেন ।
মা না, তোমার কাজ রয়েছে অন্যত্র ' আমার ধারণা নিবোধেরা
শিকার হাতে পেয়ে মথনদেব সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে । তুমি
সোজা তার গৃহের দিকে যাও। আমি এখনই এক দল শাস্তিরক্ষক
পাঠাবার ব্যবস্! করছি । তার! ছদ্মবেশে গৃহের বাইরে থেকে সতর্ক
ভাবে পাহারা দেবে, যাতে শ্তিনি কোন মতে পালাতে না পারেন।
এই লিপি পড়বার পর আর এক জন লোককে তোমার কাছে
পাঠাব। তার সংগে আমার লিখিত নির্দেশ থাকবে। বদি তাকে বন্দী
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১২৫
করবার জন্য নির্দেশ পাঠাই, তবে সোজা তার গৃহে প্রবেশ করে
তাকে আটক করবে। আর যদি ইতিমধ্যে টের পেয়ে পালিয়ে
গিয়ে থাকে, তবে তার স্ত্রী বা ছেলে মেয়ে যাকে যাকে পাও,
সবাইকে আটক করবে। সবাই যেন তৈরী হয়েই যায়। ধরতে
গেলে বাধা পেতে হতে পারে । খুব হুশিয়ার, সমস্ত ব্যাপারটার
পরিচালনার ভার কিন্ত ঘোমার উপর রইল ।
ওর] ভজন চলে যেতেই পদ্মনাভ মথনদেবের গৃহের দিকে দ্রুত
এগিয়ে চললেন ৷ পথে বেরিয়ে দেখলেন, রোজকার মতই স্বাভাবিক
জীবনযাত্রা । ইতিমধ্যে রাজপ্রাসাদে কি যে সব ঘটন। ঘটছে, তা
খবর এখনও কেউ রাখে না।
আশ্চর্য মানুষ রাজবৈদ্ঠ হরিগুপ্ত__কি করে এত দিন ধরে সকলের
চোখে ধুলে। দিয়ে এসেছেন। বরাহস্বীমীর কৃতিত্বও বড় কম নয়।
যাকে কোন দিন কেউ সন্দেহের চোখে দেখে নি, তাকেও শেষ পর্যন্ত
ধর! দ্রিতে হলো তার কাছে। এই সমস্ত নানা কথা ভাবতে ভাবতে
পদ্মনীভ যথাস্থানে গিয়ে পৌছলেন। একটু বাদেই ছদ্মাবেশী
শাস্তিরক্ষকের৷ যে যার জায়গামত ঘোরাঘুরি করতে লাগল।
তারও কিছুটা পরে একজন লোক নির্দেশপত্র নিয়ে এসে
পৌঁছল। নির্দেশ পেয়ে পদ্মনাভ আর কালবিলম্ব ন৷ করে সদলবলে
ঢুকে পড়লেন মথনদেবের বাড়ীর মধ্যে : বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কবে
দেখলেন, পাখী তার বাসা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে ।- শুধু মথনদেব
নয়, তার স্ত্রী পুত্র কন্ত। কাউকেই খুজে পাওয়৷ গেল ন।
সাত
দিব্বোকের স্ত্রী উনছলি ঘরের মধ্যে ঢুকেই চাপ! কান্নায় ভেংগে
পড়লেন। দিবেবাক অন্য দিকে মুখ করে বসে বসে কি ভাবছিলেন।
কান্নার শব্দ শুনেই মুখ ফিরিয়ে পেছন দিক তাকালেন, শেষে স্ত্রীর
মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
করলেন, কি হয়েছে?
আমি আর সইতে পারছি না, কান্ন॥। ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন
উনছলি। দিনের পর দিন এ রকম অপমান আর লাঞ্থনা আর কত
সহ করা যায়। একদিন যারা আমার মুখের দিকে চেয়ে কথা
বলতে পারত না, আজ কিনা তার আমায় দেখে মুখ ফিরিয়ে থুথু
ফেলে। আমার মরণই ভাল, আমার বেঁচে থাকার আর সাধ নেই।
সে তো! জানি, কিন্তু সম্প্রতি কি হয়েছে ?
দ্রিববোকের নিখিকার কণ্ঠস্বরে উনছলির ছুঃখ দ্বিগুণ বেড়ে গেল,
চাপা কান্নাটা এবার বাধভাংগ! জলআ্োতের মত হু হু করে বেরিয়ে
এল। দিব্বোক কোন কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে
তাকিয়ে অটল ধৈধের সংগে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে
লাগলেন ॥
স্বামীর এই মূত্তি উনছলির কাছে অপরিচিত নয়। এতদিন ধরে
এই মামুষটার সংগে ঘর করে আপছেন, কিন্ত আজও তার তল
খুঁজে পেলেন ন। এমনিতে মানুষটার মন বড় নরম, আর সবার
জন্য কি মায়া! মমতা । কিন্ত মাঝে মাঝে যখন কঠিন হয়ে ওঠে,
বিষম কঠিন, ঘা মেরে কেউ তাকে ভাংগতে পারে না, চোখের জল
ঢেলে গলাতে পারে না। দিব্বোকের ভাবলেশহীন চোখের দিকে
“বিদ্রোহী কৈবর্ত ১২৭
তাকিয়ে বুঝলেন, কেঁদে কোন ফল হবে না, কান্না থামালেন
উনছলি । ভিজে গলায় বললেন, উলান ঠাকুরের মেলায়
গিয়েছিলাম । কত মানুষ, কিন্তকি মেয়ে কি পুরুষ কেউ আমার
সংগে একটা কথা কইল না । ডেকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে
মুখ ফিরিয়ে চলে যায় । আবার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে নিজেরা
নিজেরা কত কি যে বলে।
কি বলে ওরা?
মুখপোড়ারা কত কিছুই তো বলে, তা শুনে তুমি করবে কি?
আর যে মানুষ তুমি, কোন কিছুই কি তোমার গ।য়ে বেঁধে?
দ্রিবেব'কের স্থির কঠিন মুখ এবার নির্নল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে
উঠল। সেই হাসির আলোয় দেখা গেল সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ ।
হাসতে হাসতে বললেন, এতক্ষণে সার কথাট! বুঝেছ তুমি, সত্যি,
এ সব কোন কথাই গায়ে বেধে না আমার । এ চামড়া যে গণ্ডারের
চামড়া ।
হাসবে না, হাসবে না৷ তুমি এমন করে, হাসবে ন] বলছি, দস্ভরমত
ক্ষেপে উঠলেন উনছলি। দিব্বোক তাকে কাছে টেনে এনে আদর
করে গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, আহা বল না, কি
বলছিল ওর]
উনছলি মুখে যাই বলুন, মানুষটার কাছে শেষ পর্যন্ত কোন কথাই
চেপে রাখতে পারেন না। আশ্চর্য এই মানুষ, কি যে মন্ত্র জানে,
কেমন করে একটু একটু করে সব কথাই আদায় করে নেয়।
আজও তাই ঘটল। উনছলিকে বলজেই হলো সমস্ত
কথা। ওরা বলছিল, গৌড়ের পাত-চাটা কুকুর, কৈবর্ত জাতের
কলংক।
একদিন সারা রাজ্যের মানুষ ওকে মাথায় করে রেখেছিল।
ওর আদেশে সমস্ত মানুষ ওঠ! বসা করত, ওর এক কথায় আমরা
প্রাণ দিতে পারতাম। একদিন কি চোখ নিয়ে আমরা ওকে
১২৮ বিশ্রোহী কৈবর্ত
দেখেছি। কিন্তু এত দিনে ওর আসল রূপট! বেরিয়ে পড়েছে । আগে
কি এমন কথা ভাবতে পেরেছে কেউ ? দেখ না, গৌড়ের সৈন্যদের
এনে বসিয়েছে এখানে _ আমাদেরই বুকের উপর। ওরা আমাদেরট!
লুটে পুটে খাচ্ছে, আর আমাদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
সারাট। রাজ্য একেবারে ছারখার করে দ্রিল। কত গ্রাম পুড়িয়ে
ছাই করল, কত সংসার উচ্ছন্ন করল, কত মানুষ মারল, সে হিসাব
কে রাখে । আর ওদেরই সংগে দিবেবোকের ষত দহ্ম মহরম, ওরাই
তার সব চেয়ে আপণার লোক ।
একট। ছোকরা পেছন থেকে ফস্ করে বলে উঠেছিল, এমন দিন
থাকবে না। আসবে, আমাদের দিনও আসবে । আর সেদিন সব-
চেয়ে প্রথমে ওই ব্যাটাকে গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে এসে
ওলান ঠাকুরের কছে বলি দেব!
কাকে রে? প্রশ্ন করল একজন ।
আবার কাকে * ওই কুত্তার বাচ্চ। দিবেবোককে ।
ছি ছি, এমন কথ। বলিস নাবে । এই দিব্বোক আদ্গ থাই করুক
না কেন, একদিন আমাদের এ কৈবত-সমাজের জন্য যা করেছে
সে, তোরা সেদিনের ছেলে, তোবা কেমন করে তা জানাব । সে
আমরা জানি ।
কিন্ত সেই ছোকরার সমর্থকের অভাব ছিল না। একজন বলল,
সেকোন্ আমলের কথা, জানি না আমরা, জানতেও চাই না|
চোখের উপর ঘা দেখছি, তাই যথেষ্ট। জয়দ্দথ ঠিক কথাই বলেছে।
আমাদেরও সেই কথা । লোকে ক্ষেপে গিয়ে যদি কুকুরের মত ওকে
ঠেংগিয়ে না মেরে ফেলে, তবে নির্থাত ওকে বলি দেব, ওল।নঠাকুর
সাঙ্গী থেকো । আর এর উপর ঘদি কেউ ভাল মান্ুবা কোন কথা
বলতে আসে; তা হলে তাকে শুদ্ধ
উনছনি বলছিলেন) আমি একপাশে দাড়িয়ে এই সব কথা!
শুনছিলাম । একট! মেয়ে আমাকে দেখে চিনল। এক ছ্রোড়াকে
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১২৯
ডেকে আমার দিকে ইসারা করে বলল, ওই দেখ, দেখ, হারামজাদী
মাগী কেমন করে চোরের মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে টোক নিচ্ছে।
কেরে, কে ওটা?
আর কে, রাজ! দিব্বোকের রাণী গো ।
এখানে কেন, পাঠিয়ে দিক গৌড়ে রাজা মহীপালের কাছে,
পাটরানী করে নেবে।
যার যা খুশী তাই বলতে লাগল, আমি চলে এলাম। আসতে
আসতে শুনলাম, বলছে, আবাগী বাজী, এই পাপেই তো ওর পেট
ভর্তি পাথর, সেখানে কিছুই গজাতে পাত্রে না । তা নইলে
বছরবিয়ানী--কৈবর্তের মেয়ে-_
বলতে বলতে আবার কেদে ফেললেন উনছলি। দিবেবাক
সহানুভূতি ভর! দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কি দরকার ছিল মেলায়
যাবার? ন! গেলেই পারতে ॥ আমি তো মান1 করেছিলাম, শুনলে
না তুমি ।
বা রে, ওলান ঠাকুরের মেলায় যাব না? সারা বছরে এই একটা
দিন, এই দিনে কেউ ন৷ গিয়ে পারে !
কেন, আমি তো যাই নি, চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছ ।
তুমি? তুমি তো রাজ্যছাড়া মানুষ, তে'মার সংগে কার কথা !
তবে শুনতেই হবে '৭ সমস্ত কথা । ওরা তো। বলবেই।
বলবেই ? কেন বলবে? উনছলি ঝংকার দিয়ে উঠলেন।
সারা রাজ্যের মানুষ বলছে, আমরা এমন করে পড়ে পড়ে মার
খেতে পারব না। আমাদের পূর্বপুরুষরা চিরদিন ওদের সংগে লড়াই
চালিয়ে এসেছে । যেমন মরেছে, মেরেছেও তেমনি । আজও
পরভুদের দল আমাদের জন্যই এখানে ওখানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে,
আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে আছি, এ কেমন কথা ! আর আমরা,
তাঁদের দললপতির! তাদের ঠেকিয়ে রাখতে চাইছি। আরও সবাই
দেখছে, আমরা। রাজপুরুষদের কাছে যাই, আসি, তাদের সংগে ভাব
কি
১৩০ বিল্লোহী কৈবর্ত
রেখে চলি, এ ভাবে ও ভাবে তাদের সাহাধ্য করি, মানুষ তো!
ক্ষেপে উঠবেই ।
উনছলি অস্বীকার করতে পারলেন না কথাটা । সত্যি তো,
ওরা ক্ষেপে উঠবে না! কেন? মাঝে মাঝে তার নিজের মনই ষে
,ক্ষপে উঠতে চায় । বললেন, তাই যদি বোঝ, তবে এমন করছ
কেন তোমরা? সবাই চাইছে যুদ্ধ করতে, তোমরাই বা বাধা
দাও কেন?
দিবেবোক নিঃশব্দে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কতক্ষণ,
শেষে বললেন, তোমাকে তো বলেছি এক দিন ।
ভূল, ভূল, ভূল করছ তোমরা । সব জিনিমেরই একটা সময়
সময় আছে । আজ ঘখন সমস্ত মানুষ যুদ্ধ চাইছে, তোমর! চাইছ
তাঁদের ঠাণ্ডা করে রাখতে । এর পর সময় হারিয়ে তোমরা বখন
ডাক দেবে, তখন সে ড'ক কেউ হয়তো সাড়াই দেবে না|
দিব্বোক এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। এ তো শুধু
উনছলির কথাই নয়, তার নিতান্ত অন্তরংগ দলপতিরাও বার বার
এই প্রশ্ন তুলছে । তীরা তাদের নিজেদের লোকদের সামলে রাখতে
পারছেন না। নিজেরাও অধৈর্য হয়ে উঠছেন। কেউ কেউ এই
বলে শাসিয়েছে, এ ভাবে আর বেশী দিন অপেক্ষা করে থাকতে
পারবে না তারা । দিব্বোক বদি সম্মতি না দেন, তা হলে তারা
নিজেরা ঘা ভাল মনে বরে তাই করবে।
সন্ধ্যা অনেকক্ষণ পার হোয়ে গেছে । অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে,
আর তারই পটভূমিকায় লক্ষ নক্ষত্রের আলোকসজ্জায় সারা আকাশ
ঝলমল করছে । অপূর্ব দৃশ্য ! কিন্তু যতই হ্ুন্দর হোক না! কেন,
সেই দৃশ্য দেখে যুদ্ধ হস্সে শাঁকাবার মনত মনের অবস্থা নয় এখন।
নাথার উপর বিরাট “*'রত্বের ভার। উনছলি বলছে, আরও
অনেকেই বলেছে, সময় হারালে সময় আর ফিরে আসে না। তবু
[তনি তার নিজের সিদ্ধান্ত আকড়ে ধরে বসে আছেন ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৩১
যদি তার এই সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রতিপন্ন হয়ে যায়, তখন
ভবিষ্যতের কাছে চিরদিনের জন্য দায়ী হয়ে থাকতে হবে তাকে ।
আর নিজের মনকেই বা কি বলে বুঝ দেবেন? এর চেয়ে অনেক
সহজ দশের মতে মত দিয়ে চলা । কিন্তু সহজ বলেই কি তা
করণীয়? যতই দিন যাচ্ছে, স্থযোগ আর সম্ভাবনার মাত্রা বেড়ে
চলেছে । গৌড় থেকে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, ওদের নিজেদের
ভিতরকার দলাদলিট। বেশ দানা বেঁধে উঠেছে । কিন্তু অবস্থাটা
আরও একটু পেকে উঠৃক--তারপর , কিন্তু সেইটাই তো যথেষ্ট
নয়। কৈবর্তেরা দুর্ধ্ব যোদ্ধা সন্দেহ নাই । কিন্তু ওদের অশ্বারোহী
সৈন্যের বিরুদ্ধে পায়ে হাটা সেম্ত কি কখনও যুঝতে পারে?
এ প্রশ্নের সমাধান না হওয়া পধন্ত প্রকাশ্য যুদ্ধে নামতে গেলে জয়ের
আশা কমই আছে। কিন্তু অভাবে, অনাহারে, আর দ্রিনের পর
দিন রাজপুরুষদের অত্যাচারে ওদের ধের্ধ আর বাধ মানছে না ।
আর ক'দিন ওদের ঠেকিয়ে রাখ! যাবে !
ছদিকেই সমস্যা । কোন্ পথে প1 বাড়াবেন? সময় হারিয়ে
ডাক দিলে সে ডাকে সাড়া পাওয়। যায় না, কথাটা তো মিথ্যা নয়।
দিবেবোক এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে নিজের মধ্যেই নিজে ডুবে
গেলেন।
উনছলি বুঝলেন, এখন আর কথ! বলে সাড়া পাওয়া যাবে না।
কথা বলে লাভ নাই ! মানুষটাকে চিনতে তো৷ আর.-তীার বাকী নাই।
দূর থেকে মেলার কোলাহল মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল । রাত
দুপুর পর্স্ত এই মেল! চলবে। এই উপলক্ষে বহু দূর দূর থেকে লোক
আমে । এ শঞ্চলে এত বড় মেলা আর কোথাও হয় না। রাত্রিবেলা
এই মেলা আরও জমে ওঠে । ছেলের] মেয়ের! মেলায় দল বেঁধে নাচে,
গান করে৷ সারা বছরের মধ্যে এই দিনটা? একট দিনের মত দিন ।
রাঁত বেড়ে চলল। দিবেবাক বললেন, যাও, রাত হয়েছে, তুমি
ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো । আর বাইরের দরজাটি। খুলে রেখো ।
১৩২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কেন, বাইরের দরজ খুলে রাখব কেন?
দরকার আছে, দিব্বোক সংক্ষেপে উত্তর দিলেন। এক এক সময়
দিবেবাকের ক্টত্বর এই রকম অতিরিক্ত ভারী ভারী বলে মনে হয়।
তখন তার সংগে বেশী কথা বলতে ভরস! পাওয়া যায় না।
আমাকে অন্য ঘরে যেতে বলছ কেন?
হ্যা, তাই যাও। গিয়ে শুয়ে পড়।
আর তুমি কি.করবে?
আমার কাজ আছে।
অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আর কাটখোটা! উত্তর । যেন এড়িয়ে যেতে চায়।
শুনলে পরে গ! জ্বালা করে । উনছলি রাগ দেখিয়ে ফড় ফড় করে
ঘর থেকে বাইরে চলে যান। মনের মধ্যে কেমন একট খটকা! লাগে"
তার, এমন তো৷ কোন দ্রিন হয় না । এর পর শুয়ে পড়লেও ঘুম আসে
ন। চোখে । শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবেন। ভাবনার কি শেষ
আছে! কিছুক্ষণ বাদে শুনতে পেলেন তার ঘরের সামনা "দিয়ে
পায়ের শব্দ সামনের দিকে মিলিয়ে গেল। এই পায়ের শব্দ কার,
সে.বিষয়ে ভুল করবার যো নাই। নিঃসন্দেহে দিব্বোকের পায়ের
শব্দ। কিন্তু এমন সময় কোথায় চলেছে দিব্বোক ? কোন বিপদের
মুখে গিয়ে পড়বে না৷ তো? সময়ট। খুবই খারাপ । আপন লোকের
মধ্যেই শত্রর অভাব নাই। মেলার সেই ছোকরাটার কথা মনে্
পড়ে গেল। এখনও সময় আছে, ছুটে গিয়ে নিষেধ করবেন. যেতে
কিন্তু কিছু ফল হবে না! বড় শক্ত মানুষ, যা করবে বলে স্থির করে
তা থেকে কিছুতেই সরিয়ে আনবার উপায় নাই । কেউ পারে না,
--উনছলি অনেক দেখেছেন !
না, সেই পায়ের শব্দ আবার ফিরে আসছে, উনছলি একটু
আশ্বস্ত হলেন । পায়ের শব্ধ দিবে্বোকের ঘরের দিকে এসে মিলিয়ে
গেল। উনছলি মনে মনে অনুমান করলেন, দেখতে গিয়েছিল
বাইরের দরজাটা! সত্যসত্যই খোলা আছে কি না। কিন্ত কেন?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৩৩
এর তো! একটি মাত্র মানে হয়--বাইরে থেকে কেউ আসবে । কিন্ত
কে আসবে? কে আসতে পারে এমন সময় চোরের মত 1 এমন
কোন্ লোক যার জন্য উনছলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়? কোন
মেয়েমান্ুষ নয় তো।? ছিঃ, এমন কথা ভাবা উচিত নয় তীর।
দিবেবাকের চরিত্রে কোন দিন কোন দাগ পড়ে নি। তা ছাড়া সে
বয়স কি আর আছে এখন? নিজের মনের এই গোপন সন্দেহটার
দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলেন উনছলি।
কিন্তু ব্যাপারটা! কি? কোন বিপদ আপদ ঘটবে না তো?
রহস্তটা প্রকাশ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঘুম আসবে না চোখে। না,
ঘুমোলে চলবে না। শুয়ে ছিলেন, উঠে বসলেন ।
দিবেবাক তার চিরদিনের যা অভ্যাস, ছ'হাত পিছন দিকে জড়
করে ঘরের মধ্যে পায়চারী করে বেড়াচ্ছিলেন। তার অন্তরংগ যারা
তারা জানে, কোন কঠিন সমস্তার সম্মুীন হলে এই ভাবেই তাঁকে
পায়চারী করে বেড়াতে হয়। কতক্ষণ বাদে পায়চারী বন্ধ করে
দিবেবাক মুক্ত গবাক্ষের সামনে দাড়িয়ে আকাশের বুকে নক্ষত্রের
অবস্থান পধবেক্ষণ করে দেখতে লাগলেন। এখানকার লোকৈরা
রাত্রিবেলা এই ভাবেই সময় নির্ণয় করে থাকে।
হ্যা, এইবার সময় হয়ে এসেছে । তার মুখ থেকে এই অর্ধস্ফুট
স্বগতোক্তি বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই যেন তার এই কথাকে
সমর্থন করবার জন্যই এক দল শিয়াল হুয়৷ হুয়া করে ডেকে উঠল।
তার অর্থ রাত এক প্রহর হয়ে গেছে। পায়চারী বন্ধ করে দিব্বোক
তার আসনে গয়ে বসলেন ।
হঠাৎ মনে গড়ে গেল একটা কথা-_কুকুরটা বাইরে আছে।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে আটকে রেখে ফিরে এলেন
নিজের ঘরে। একটু বাদেই পায়ের শব শোনা গেল-ছু
জোড়া পায়ের শব্দ। কারা যেন সাবধানে পা টিপে টিপে
আসছে।
১৩৪ বিজ্রোহী কৈবর্ত
খোল! দরজ। দিয়ে হুজন এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল । একজন এ
বাড়ীর বৃদ্ধ ভৃত্য হারুক। তার পিছনে কালো পাথরের মতই কুচ
কুচে কালো এক জওয়ান । তার মাথায় বাবড়ী চুল। গলায় দুলছে
লাল নীল সবুজ পাথরের মালা । বাতির আলো পড়ে সেগুলি চিক
মিক করে উঠল । . এ সব মাল! মেলায় কিনতে পাওয়! যায় । মনে
হয় মেলার জায়গা থেকেই এসেছে 1 দ্বিবেবাকের হাতের ইংগিতে
হারুক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। জওয়ান লোকটি উপুড় হয়ে
দিবেবাকের পায়ের উপর মাথ। ছু*ইয়ে প্রণাম করল ।
দিবেবোক সামনের কাষ্ঠাসনটাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বোসো।
কিন্ত তার সামনে উচ্চাসনে বসতে ইতস্তত করছিল সে।
দিব্বোক তাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন ।
বল, এবার শুনি অবস্থাটা কি?
খুব ভাল, আবার খারাপও ।
খুব ভাল, আবার খারাপও-_তার মানে কি পরভু ?
পরভূ বলল, সমস্ত মানুষ আমাদের পক্ষে । শুধু মুখের কথায় নয়,
তার প্রাণ দিতেও প্রস্তত। কবে আমরা তাদের ডাক দেব, সেই
আশায় তারা বসে আছে। তারা বলছে, এ ভাবে চোর ডাকাতের
মত লুকোচুরি করে আর কত দিন চলবে, এবার সামনাসামনি একট!
বোঝাপড়া হয়ে যাক।
হু, সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করলেন দিব্বোক।
গ্রামের জওয়ান ছেলেরা ঘর বাড়ী ছেড়ে বনে এসে আমাদের
গে যোগ দিচ্ছে । এত লোককে জায়গ। দিতে পারছি না! আমরা]।
খাবেকি? তা ছাড়া বেশী লোক একত্র হলে দ্রুত চলাফেরা
অস্তরবিধা হয়, খবরট1 সহজেই ছড়িয়ে পড়ে, আর আমাদের ঘেরাও
হয়ে পড়বার ভয়ট] বেড়ে যায়। কিন্ত যাকে ফিরিয়ে দিতে যাই,
সেই মুখ কালো করে। কি আশ্চর্য, আগে সবাই যাদের ভীতু বলে
জানত, তাঁরাও এখন হুর্জয় সাহসী হয়ে উঠেছে । মাত্র একটা বছরের
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৩৫
মধ্যে কি মানুষ কি হয়ে গেছে ! তাদের মুখের দিকে তাকালে মনে
হয়, আমাদের অসাধ্য কিছুই নাই।
যা বলছ, সবই তে। ভাল খবর পরভূ, তবে খারাপটা কি?
খারাপ? হ্থ্যা খারাপ খবরও আছে । মোড়লদের উপর, বিশেষ
করে- বিশেষ করে আমার উপর, তাই না?
পরভূ উত্তর দিল, হ্যা, তাই, মানুষ ভীষণ ক্ষেপে উঠেছে । অনেকে
এমন কথাও বলছে, আগে ওদের শেব কর, ঘরের শক্রকে বাঁচিয়ে
রেখে বাইরের শক্রর সংগে লড়াই করা চলে না। আবার এ কথাও
তো! সত্যি, মোড়লদের মধ্যে কেউ কেউ শঞ্রু পক্ষের সংগে হাত
মিলিয়েছে। তারা যা বলছে তা তো অন্যায় কিছু বলছে না।
মোড়লদের মধ্যে কে আমার্দের আপন আর কে পর, সে কথা আমর
জানি, কিন্ত এরা কেমন করে জানবে? আপনি আমাদের মুখ বন্ধ
করে রেখেছেন, কোন কথা বলতে দিচ্ছেন না। কিন্ত আপনার
বিরুদ্ধে এ সমস্ত কথা যখন বলতে শুনি, তখন অসহা মনে হয়। তা
ছাড়া আপনার উপর আক্রমণ হবার আশংক1 দিন দিন বেড়ে
চলেছে । আমাদের নিজেদের লোকদেরই এই নিয়ে বলাবলি করতে
শুনি । তাদের সামলে রাখতে চাই, কিন্তু কি বলে বোঝাব তাদের ?
অন্তত এই অনুমতিট1 দিন, আমরা আভাসে ইংগিতে ভিতরকার
কথাট। যেন কিছুটা প্রকাশ করতে পারি। অবস্থা সবই আমাদের
পক্ষে, কিন্ত ওলান ঠাকুর না করুন, কোন অঘটন যদি ঘটে যায়,
তখন ? সে কথ! আমি ভাবতে পারি ন1।
দিবেবানু তার কাধের উপর একটা হাত রেখে আশ্বাসের সুরে
বললেন, তোমাদের অবস্থাট। বুঝতে পারছি, কিন্তু আর ক'টা দিন
অপেক্ষা কর পর্ভূ, রুদোক গীঠি থেকে ফিরে আন্মুক। তারপর সমস্ত
রহস্ প্রকাশ হয়ে যাবে। মামুষ নিজের চৌখের সামনেই সব কিছু
দেখতে পাবে, আমাদের সম্পর্কে তাদের মনে যত বিরূপ ধারণাই
থাক না কেন, মিটে যেতে সময় লাগবে না।
১৩৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কিন্তু গীঠির সাহায্য ছাড়া আমরা কি নিজেদের শক্তির উপ
নির্ভর করতে পারি না? কৈবর্তেরা কত কাল ধরে ওদের সংগে যুদ্ধ
করে আসছে, কিন্ত সেজন্য কারু প্রত্যাশায় বসে থাকে নি, একি
সত্যি নয়?
হ্যা, সত্যি বই কি, দিক্বোক উত্তর দিলেন, কিস্তু তখনকার যুদ্ধ
আর আজকার যুদ্ধ এক নয়। আজ আমরা গৌড় অধিকার করতে
চলেছি। অশ্বারোহী সৈম্ত ছাড়া সে কাজ সম্ভব নয়। সেই জন্যই
গীঠির উপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।
ওদের উপর বিশ্বাস কি? ওরা সাদা মানুষ হয়ে সাদা মানুষের
বিরুদ্ধে কালো মানুষকে সাহায্য করবে, এ কথ৷ বিশ্বা করতে ভরস!
পাচ্ছি না। এমন কি কোন দিন হয়েছে?
না, হয় নি। কিন্তু যা! হয় নি, এমন অনেক কিছুই হয়, আর যা
হবার যার যার প্রয়োজন অনুসারেই হয়। ওরা আমাদের
অনুগ্রহ করতে আসছে না, ওদের নিজেদের স্বার্থ রয়েছে যে।
ওরা এই ম্থযোগে গৌড়ের সাম্াজ্যবন্ধন থেকে বেবিয়
বেতে,চায়।
পরুতু প্রশ্ন তুলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা যদি বিশ্বাস ভংগ ক'ব?
এই স্যোগে নিঙ্জেরাই যদি গৌড় দখল করে বসে?? সাদা মানুষদের
কথায় বিশ্বাস আছে?
দিবেঝক প্রতিবাদ করে বললেন, না না, তা হতে পারে না।
গীঠিরাজ তেমন লোক নন, তাকে আমি বনু দিন আগে থেক্ই
জানি। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা ছাড়া সেই অসৎ উদেশ্য
যদ্দি থেকেও থাকে তবে তা কিছুতেই সফল হতে পারবে না ।
ওখান থেকে মাত্র কয়েকশো! অন্বারোহী সৈম্ত আসবে । একবার
যদ্দি আমরা গৌড় অধিকার করে বসতে পারি, কি করবে তারা ?
পীঠি এখান থেকে বহু দূরে, আর তাদের পক্ষ হয়ে সাহায্য করবার
মত কেউ এখানে নাই। কিন্ত ও কথা থাক এখন, এত দিনই
বিপ্রোহী কৈবর্ত হি
যখন অপেক্ষা করতে পেরেছ, আর 'কণ্টা দিন অপেক্ষা কর।
এখন আজকার যা কাজ, তাই নিয়েই কথা হোক ।
বলুন ।
তোমাদের লোকজন কোথায় ?
তার! মেলায় বসে বিকি-কিনি করছে ।
সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরী হয়ে এসেছে তো?
হেসে উঠল পরভু, তবে কি খালি হাতে আসবে নাকি? কোন
চিন্তা করবেন না । আজকার শিকার বড় শিকার, সে জন্য আমরা
ভালমত তৈরী হয়েই এসেছি । আর যে দলট। নিয়ে এসেছি, এট!
'আমাদের সেরা দল। এরা এ পরধন্ত যে সব কাজে গেছে,
কোনটাতেই বিফল হয়ে ফিরে আসে নি।
লাকুটিয়া এখান থেকে ক্রোশখানেক দূরে, চেনো৷ তো? দিবেবাক
প্রশ্ন করলেন।
হ্যা, হ্যা খুব চিনি, এ অঞ্চলে আমার অচেনা কোন জায়গ৷ নাই।
সব কিছু আমার চোখের সামনে ভাসছে । আপনি বলুন ।
দিন ছুই হয় গৌড় থেকে লাকুটিয়ার ঘণাটিতে প্রচুর অস্ত্র এস্ছে।
খুবই গোপনে নিয়ে আসা হয়েছে, বাইরের লোকে এ খবর জানে
না। কয়েকদিন বাদেই ওদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে এই অস্ত্রথলি বিলি
হবে। একসংগে এত অস্্র আর কোন দিন ওরা আনে নি। আমার
এই সংবাদ নিভূল, এটা ধরে নিতে পারো।
উল্লাসে পরভূর চোখ ছুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল । সে বলল, আপনার
কাছ থেকে এ পর্যস্ত অনেক সংবাদই আমরা পেয়েছি, কিন্ত তার
কোনটাই ভূল হয় নি। ওদের সৈম্তসংখ্য! বিশজন, তাই না?
হ্যা, এ পর্যন্ত এ অঞ্চলে ওদের উপর কোন আক্রমণ হয় নি।
ওদের ধারণা আমার এলাকায় এ সমস্ত ঘটতে পারে ন।। তাই ওরা
খুবই অসতর্ক। পাহারার ব্যবস্থা একেবারেই টিলেঢালা । পাহারা
থাকলেও একজনের বেশী নয়। গিয়ে প্রথমেই তাকে কাবু করে
১৩৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
ফেলবে। তারপর সৈন্যদের ঘরের দরজাগুলি বাইরে থেকে চটপট
বেঁধে ফেলবে, যাতে একজনও বেরোতে ন। পারে।
ওদের থাকবার ঘরের পিছনে ছাংগা-চোৌরা ঘর। বাইরে
থেকে দেখে সন্দেহ হয় না, এর মধ্যে কোন মূল্যবান জিনিস থাকতে
পারে। সেই ঘরের মেজের তলায় শুদুঢ গোপন কক্ষ আছে। সেই
কক্ষে অস্ত্র মজুত রয়েছে । ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে সেই গোপন কক্ষের
দরজা । তালা ভেংগে ভিতরে ঢুকে পড়বে!
বাস, আর কিছু বলতে হবে না। আমি চলি । পরতু দাড়িয়ে
পড়ল । দিবেবাক হেসে বললেন, বোসৌ, বোসো. আর একটা কথা
শুনে বাও। সংঘধ হত দূর সম্ভব এড়িয়ে চলবে । নেহাৎ আত্ম-
রক্ষার জন্য না হলে কাউকে প্রাণে মারবে না ।
কেন? পরভূ তীত্র ভাবে আপত্তি জানাল? আমি তো! ভেবেছি,
যদ্দি সম্ভব হয়, জুব ব্যাটাকে নিকেশ করে আসব । আগুন দিয়ে
জ্বালিয়ে ওদের ওই ঘাটি নিশ্চিহ্ন করে দেব। ওরা আমাদের সংগে
যেমন করে, আমরাও ওদের সংগে তেমনি করে থাকি ।
«“দ্রিবেবোক বললেন. আগে যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু এখন সেটা
বাদ দিতে হবে! শুধু এখানে নয়, সব জায়গার কথাই বলছি।
যতটা সম্ভব ওদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখবে । পরভু বিস্মিতকণ্ে প্রশ্ন
করল, কেন, ওরা কি আমাদের আদরের কুটুম নাকি?
দিব্বোক হেসে উত্তর দিলেন, ওদের দিয়ে প্রয়োজন আছে
আমাদের । ছুদিন আগেই হোক আর পরেই হোক যেদিন আমর!
প্রকাশ্টযে যুদ্ধ ঘোষণ। করর সেদিন প্রথমেই ওদের সবাইকে জীবিত
অবস্থায় বন্দী করতে হবে। একটাও যেন পালাতে না পারে । যদি
প্রয়োজন হয়, গৌড়ের ধানুকীদের তীরবর্ধণের সামনে এদের স্থাপিত
করে আমরা পিছনে দাড়িয়ে যুদ্ধ করব। বুঝতে পেরেছ তো?
হ্যা, এবার বুঝতে পেরেছি, পর্ভূর সহীন্ত মুখে সাদা ঝকঝকে
টাতগুলি বাতির আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠল ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৩৯
কিন্তু হুর্দিন আগে বা! পরে, কবে, আসবে সেদিন?
বেশী দেরী নেই তার, সময় হয়ে এসেছে ।
পরত আবার উপুড় হয়ে প্রণাম করল, তারপর দ্রুত ঘর থেকে
বেরিয়ে গেল। সংগে সংগেই ভেজানো দরজাট। ঠেলে দমকা
হাওয়ার মত উনছলি ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে পড়লেন, তারপর
দিব্বোককে কোন কিছু ভাববার বা কোন কিছু বলবার স্যোগ না
দিয়ে ছু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে । ওর এলে! চুলের ঝাপটা
খেয়ে বাতিটা নিভে গেছে । অন্ধকার হয়ে গেছ ঘরট]।
একি, এ আবার কি, চমকে উঠলেন দ্রিবেধোক। কিন্তু ততক্ষণে
উনছলি দিব্বোকের মাথাটা তার বুকের উপর চেপে ধরে বলছেন,
আমার রাজা, আমার রাজা, আমার রাজা! আমার মণি, আমার মণিঃ
আমার মণি! এখন যে যাই বলে বলুক, যে যত পারে গাল দিক. কোন
কিছু আমার গাঁয়ে লাগবে না। আমি সব কিছু হাসিমুখে সইব। তুমি
আমার বুক ভরে দিয়েছে। আমার রাজা, আমার রাজা, আমার রাজা!
দিব্বোক এবার বুঝলেন। ও, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে সব কথা
শুনছিলে ! কেন? কেন? তার কথস্বরে তিরস্কারের শর ফুটে উঠল।
কিন্তু উনছলি বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না। তিনি দিব্বোকের কানের
কাছে মুখ রেখে গুঞ্জন করে চলেছেন, আমার মণি, আমার মণি,
আমার মণি ! আমার রাজা, আমার রাজা, আমার রাজ! !
পর দিন ভোর হতে না হতেই লাকুটিয়া থেকে খবর এসে পৌঁছল,
লাকুটিয়ার ঘাটি আক্রান্ত ও লুন্তিত হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ
দিবেবাককে অবিলম্ে সেখানে যাবার জন্য নির্দেশ পাঠিয়েছেন
জনকয়েক অন্ুচর সংগে নিয়ে দ্িবেবোক তখনই লাকুটয়ায় গেলেন।
গিয়ে দেখলেন, যে ভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি স্ুশংখল
ভাবেই কাজ কর! হয়েছে। এক জনও হতাহত হয় নি, সবাই স্ুস্থ-
শরীরে আছে, শুধু যাঁবার সময় ওর! ওদের মনের ঝালটা মিটাবার
জন্য অন্ত্রের ঘরট1 আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দ্রিয়ে গেছে । যেখানে অস্ত্র
১৪০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মজুত কর! ছিল সেই ভূগর্ভকক্ষ কুড়িয়ে কাচিয়ে সাফ করে.নিয়ে
গিয়েছে, কিছুই অবশিষ্ট রেখে যায় নি। আস্তাবলে তিনটা ঘোড়া!
ছিল, একটাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা সম্ভবত অস্ত্রের বোঝ
সেই ঘোড়াগুলির পিঠে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছে ।
ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ আর সৈন্যেরা মাথায় হাত দিয়ে বসেছে ।
কি সাংঘাতিক কথা! একট! লোকের গায়েও একটু জচড় পড়ল
না, অথচ সমস্ত অস্ত্র লুটেপুটে নিয়ে চলে গেল। এ খবর যখন
রাজধানীতে গিয়ে পৌছবে কি হবে তখন অবস্থাটণ !
সব চেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এমর্ন সংগোপনে অস্ত্র্ুলো
আনাবার ব্যবস্থা করা হোল, এমন ম্বরক্ষিতভাবে রাখা হোল, কিন্ত
কেমন করে মেই খবর গিয়ে পৌছল ওদের কাছে। কার! এরা ?
নিশ্চয়ই স্থানীয় লোক আছে, শুধু বাইরের লোকের পক্ষে এ কাক্ত
সম্ভব নয়। খবর পাঠিয়ে অন্ঠান্ত অঞ্চল থেকে সৈম্তদের আনানে।
হয়েছে । পাশাপাশি গ্রামগুলিতে টহল দিয়ে ফিরতে লাগল তারা।
পার্থববর্তী বন অঞ্চল তন্নতন্ন করে খু'জল | কিন্তু লু্টনকারীদের বা
লুষ্টিত'দ্রব্যের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।
উপর থেকে নির্দেশ আছে, সামন্ত দ্রিবক্বোকের সংগে যেন সব
বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চল হয়, তিনি আমাদের নিজস্ব
লোক। এত দিন পর্যন্ত তার এলাকায় কোন রকম অশান্তি ঘটে নি।
শেষ পর্যন্ত এই খানেই এমন একট! দুর্ঘটনা! ঘটল! দিবেবাক
রাজপুরুষের সংগে গোপনে আলাপ করলেন । এ অবস্থায় কি করা
উচিত, তাই নিয়ে পরামর্শ চলল। ভরস্রা দিলেন এ বিষয়ে সাহাযা
করবার ব্যাপারে তার পক্ষে বঘতট1 সম্ভব, তাতে কোনই ক্রটি হবে
না। অনুসন্ধানকারীদের সংগে এখানে ওখানে ঘুরে ফিরে দেখলেন ।
সমস্ত গ্রামবাসীরা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে
দেখতে লাগল ।
প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পন্ন করে দ্দিব্বোক নিজের গ্রামে ফিরে
বিদ্রোহী কৈবর্ত' ১৪:
চললেন। সংগে সেই ক'জন অনুচর, যারা তার সংগে এসেছিল ।
যেখানে যান, তারা তার সংগে সংগে থাকে । লোকে বলাবলি করে,
এক দিন যাকে সমস্ত কৈবর্তেরা দেবতার মত দেখত, আজ তিনি
দেহরক্ষী ছাড়া কোথাও যেতে ভরসা পান ন1। মানুষ কি থেকে
কি হয়ে যায়!
পথটা যেখানে এসে তীর গ্রামের দিকে মোড় নিয়েছে, ভার
এক দিকে প্রান্তর । কথা বলতে বলতে অন্তমনে পথ চলছিলেন
তারা । হঠাৎ বনের মধ্যে একট পাখী ভয়ার্ত স্থুরে ডেকে উঠল,
ঠিক সেই সময় শী করে একট তীর এসে দ্িবেবোকের কাধের উপর
বিধে বসল। “উঃ বলে তিনি মুখ ফিরিয়ে দ্ীড়ালেন। সংগে সংগে
আরও ছুটো তীর তীর কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। তীরগুলি
তাকে উদ্দেশ্খ করে ছোড়া হয়েছিল, সে বিষয়ে কারু মনেই কোন
সন্দেহ ছিল না! । ছুটতে ছুটতে তাঁর! বনের সীমান। ছেড়ে কিছুট!
নিরাপদ জায়গায় এসে হাফ ছেড়ে দাড়ালেন। তীরট। অনেকটা
বিধে বসেছিল । দিব্বোক এক টানে তীরট] খুলে ফেললেন। সংগে
সংগে ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল, সার৷ গা কাপড়
চোপড় লাল হয়ে গেল । তার অনুচরেরা তাকে ধরাধরি করে নিয়ে
ধাড়ীতে এল ।
উন্ছলি স্বামীকে কক্তীক্ত অবস্থায় দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে
উঠলেন । দিবেবাক সন্সেহে ধমক দিয়ে বললেন, থাম, আর কাদতে
হবে না । আমি এখনই মরতে বসি নি, একটু আচড় লেগেছে মাত্র ।
কাল না বঞ্জেছিলে_সে যাই বলুক, আর যে ঘাই করুক, কিছুই
তোমার গায়ে লাগবে না। এরই মধ্যে উলটে গেল সেই কথা !
খবর পেয়ে অনেকেই দেখতে £এএল। যারা এসেছিল, তারা
নিজেদের মধ্যেই কানাকানি করছিল, এমন যে একট! কাণ্ড ঘটবে,
আমরা আগেই জানতাম । তবু তো অল্পের উপর দিয়ে গেছে।
আর এক জন বলল, কিন্তু এতেই কি শেষ হয়ে যাবে ভাবছ ?
১৪২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
অল্প বয়সী ছড়ার! যা গরম হয়ে উঠেছে, ওদের সামলে রাখ বড়
কঠিন হয়ে দীড়িয়েছে। যার যার নিজের ঘরের কথা ভেবে দেখে ন।।
কথাগুলি আস্তে বললেও উনছলির কানে এসে ঢুকল । তার ভয়
হোল, পাছে দ্রবেবোক এ সমস্ত কথা শুনতে পান। তাই এ কথ
ও কথা বলে তার মনটাকে অন্ত দ্দিকে সরিয়ে রাখতে চাইলেন ।
রক্তত্রাব কিছুক্ষণ হয় বন্ধ হয়েছে । দ্বিব্বোক একটু নিশ্তেজ হয়ে
চোখ বুজে পড়েছিলেন। উনছলি মাথার কাছে বসে হাওয়৷
করছিলেন । খবর পেয়ে এ শ্রাম ও গ্রাম থেকে লোক আসছে । ঘরের
মধ্যে লোকের ভীড় জমে গেছে । ঘরের এক কোণায় কয়েক জন
লোক খুবই উত্তেজিত হয়ে কি নিয়ে যেন আলাপ করছে । তাদের
টুকরো টুকরো কথা দিবেবাকের কানে এসে ঢুকছিল। ওরা বার বার
ভীমের নাম বলছে । মনে হচ্ছে যেন তাকে নিয়েই ওদের আলাপ
চলছে। কি হয়েছে ভীমের! দিবেধোকের মন আশংকায় পূর্ণ
হয়ে উঠল। ভীম তার ছোট ভাই রুদোকের ছেলে, এ
বংশের একমাত্র সন্ভান। নিজের সন্তানের মতই তিনি তাকে
ভালবাসেন ।
চোখ মেলে উনছলির মুখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ে প্র
করলেন, ভীম কোথায়? কই, সে তো একবার আমায় দেখক্তে
এল ন1।
উনছলি যেন তার কথা শুনেও শুনতে পেলেন ন।। দিব্বোক
আবার প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে ভীমের? কোথায় সে?
উনছলি এবার আর কথার উত্তর না দিয়ে পারলেন না । বললেন,
ও কথা এখন থাক, পরে হবে।
উনছলির কথায় তার উদ্বেগ আরও বেড়ে উঠল। বুঝলেন,
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গুরুতর, সেই জন্যই উনছলি কথাটা চাপা
দিতে চাইছে।
ন্িনি বিরক্তি মিড কঠিন কগে বলে উঠলেন, উনছলি, কথা
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৪৩
চাপা দিও না। কি হয়েছে খুলে বল, আমি সব কথা শ্রনৃতে চাই।
বল, ভীম কোথায় 1
উনছলি এই কণ্ঠস্বরকে ভয় করেন, বলতেই হোল তাকে। ভীম
আজই বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে । যাবার সময় বলে গেছে, আমাদের
লোকদের সংগে যোগ দিতে চলল মে। এ বাড়ীর সংগে তার সম্পর্ক
শেষ, চিরদিনের জন্য শেষ। আর কোন দিন সে ফিরে আবে না।
ও, এই ব্যাপার। দ্বিব্বোক কোন কথা না বলে আবার চোখ
বুজলেন, তার ওষ প্রান্তে মূদু হাঁসির রেখা ফুটে উঠল ।
উনছলি অবাক হয়ে গেলেন, এটা কি একট' হাসবার মত কথা
হোল!
আট
আজও সেই মেলার রাত্রির মতই ঘন অন্ধকার রাত্রি। দিবেবোক
আর উনছলি তাদের ঘরে বসে কথা বলছিলেন । রাত্রি অনেক হয়ে
গেছে, কিন্তু কথায় কথায় সে খেয়াল ছিল ন!। হঠাৎ বাইরের
দরজায় কার করাঘাতের শব্ধ শোনা গেল৷ সংগে সংগে কুকুরটা
ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল।
ওরা ছুজনেই চমকে উঠলেন । এত রাতে এমন সময় দরজায় ঘা
মারে কে? উঠে দাড়ালেন দিব্বোক ! কিন্ত সামনে ছু পা বাড়াতেই
হাত বাড়িয়ে পথ আগলে দীড়ালেন উনছলি। বললেন, না তুমি
না, আগে আমি গিয়ে দেখে আমি। তাঁর মনে অশুভ আশংকা
দেখ! দিয়েছে। চিরদিনের আপন জন যারা, ভাগের কি খেলা,
তাঙাই আজ পরম শক্র হয়ে দাড়িয়েছে । এক কালে ধার কথায়
তারা সবাই উঠত বসত, আজ তাকেই হত্যা করবার জন্য পদে পদে
সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন অসময়ে কে আসতে পারে! সন্দেহ
আর শংক। তো! জীগবারই কথা।
আঃ পথ ছাড়, এত ভয় করে বেঁচে থাকা চলে না। ঠেলে
এগিয়ে বেতে চাইলেন দিবেবাক। কিন্তু উনছলি কিছুতেই পিছু
হুটলেন না, বললেন, তুমি থাকো, আমি যাই । এমন অসময়ে এ
ভাবে কোন ভাল মানুষ আসে! আমার যেন ভাল ঠেকছে না।
দিব্বোক হেসে বললেন; এমন সময় পড়ছে, যখন ভাল মানুষ
ঘাঁরা তাদের এই ভাবেই পরস্পরের সংগে দেখা শোনা করতে হয়।
আমার মনে হচ্ছে কেউ কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছে । পথ
ছাড়।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৪৫
কিন্ত উনছলি ততক্ষণে দরজার কাছে গিয়ে পৌছেচেন।
দিবেবাক সামনে ঝুঁকে পড়ে হাত ধরে টেনে আনলেন তাকে।
ওরা যদি কোন খারাপ উদ্দেস্ট নিয়েই এসে থাকে, তুমি গিয়ে
ঠেকিয়ে রাখতে পারবে ওদের ?
উনছলি উত্তর দিলেন, তা পারব না। কিস্তু আমার গলার জোর.
আছে, ট্যাচাতে পারব তো । আমার ট্যাচামেচি শুনলেই তুমি সরে
পড়তে পারবে ।
এত সব বুদ্ধি পরামর্শ কোন কাজেই লাগল না। ওরা ঢুকে
পড়েছে, এগিয়ে আসছে, ওদের পায়ের শব্দে সে কথা বোঝা গেল।
কেমন করে ঢুকল এরা! উনছলি ঘর থেকে বাতিটা নিয়ে দ্রুত
এগিয়ে গেলেন সামনে ।
বাতির আলোয় দেখলেন সবার সামনে হারুক -তাদের বৃদ্ধ
ভৃত্য হারুক। সে-ই তা হলে দরজাট! খুলে দিয়েছে । এতক্ষণ তার
কথা ওদের মনেই ছিল না। ওদের আসার ভংগি দেখে মনে হোল,
কোন অসং উদ্দেশ্ট নিয়ে আসেনি ওরা । হারুকের পিছনে পর পর
ছুজন লোক । দ্বিতীয় লোকটির মাথার বাবড়ী দেখেই উনছলি
চিনতে পারলেন, এ আর কেউ নয়, সেই পরভূ। সংগে সংগে তার
বুকের কীপুনিট! থেমে গেল। তৃতীয় লোকটি কে, দেখবার জন্য না
দাঁড়িয়েই ছুটে ফিরে গেলেন ঘরে, চঞ্চল বালিকার মত উত্তেজিত ও
ও উচ্ছুসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, পরভূ গো পরভু, আমাদের পরভূ।
ইতিমধ্যে ওর তিন জন ঘরের মধ্যে এসে দাড়িয়েছে । হারুক
নতুন লোক নয়, সে জানে এ সময় এখানে তার উপস্থিতিটা প্রয়ো-
জনীয় নয়, স-ঞনীয়ও নয়। এদের রেখে সে আস্তে করে সরে পড়ল।
পর্ভূ আর তার সংগী দিব্বোক ও উনছলি ছুজনের পায়েই প্রণাম
জানাল। উনছলির মুখে গৰ ও আত্মতৃপ্তির হাসির রেখা । এত দিন
সবার কাছ থেকে যে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা পেয়ে আসছেন, সে ছুঃখ
আর রইল্প না। সমাজের মাথার মণি, সকলের আদরের পরভু
১০--
১৪৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তাকে রাণীর মর্যাদা দিয়েছে। সে পরম সমাদরে ওদের হুজনকে
বসাল।
জীবনের এই রকম একট! উজ্জল মুহুর্তে দিব্বোক যে হাতের
ইংগিত করে তাকে ঘর থেকে সরে যেতে বলতে পারে, এমন একটা
কথ! তিনি ভাবতেও পারেননি । কিন্তু ইংগিত অত্যন্ত স্থম্পষ্ট, ভূল
করবার কারণ নেই। তবু কুন্ঠিত অংগভংগির সাহায্যে তিনি তার
মুহু প্রতিবাদ ও ব্যগ্র আবেদন জানালেন। কিন্ত দিব্বোকের চোখ
পড়তেই বুঝলেন, এ ক্ষেত্রে আবেদন নিম্ষল। অগত্যা মনংক্ষুপ্ন হয়ে
পা টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
পরতু উঠে দাড়িয়ে বলল দেখি কোন্ জায়গাটায়?
কি দেখবে? দিবেবোক আশ্চর্য হয়ে বললেন, কি দেখতে চাও ?
তীরটা কোথায় বিধেছিল ? উঃ খবরটা! শোনার পর কি অবস্থায়
যে আমাদের দিন কেটেছে ।
ওঃ সেই কথা! দিবেবাক তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ও সামান্ত
একটা খোচা সে তো কবেই সেরে গেছে।
কিন্ত সে কথায় পরভূর মনের উদ্বেগ মিটল না। সে স্বচক্ষে
দেখে নিয়ে বলল, কোথায় সেরে গেছে, এখনও ঘ! রয়েছে যে । কিন্তু
কি ভাগ্য আমাদের, একটুকুর জন্য কি না হয়ে যেতে পারত !
কিন্ত তোমার এ ভাবে আসাটা ঠিক হয় নি পরভূ। লাকুটিয়ার
ঘটনার আগে আমাদের এ অঞ্চল সম্পর্কে ওরা একেবারে নিশ্িস্ত
ছিল। কিন্তু তার পর থেকে বিশেষ করে আমার উপর আক্রমণ
হবার ফলে ওদের টনক নড়েছে। আর এমন নড়াই নড়ছে যে
এখানকার লোকদের প্রাণান্ত হয়ে দাড়িয়েছে।
সৈম্তদের কাছে ওরা যে বর্ণনা পেয়েছে তাতে ওরা নিশ্চিত
ভাবেই বুঝতে পেরেছে সে দিন তুমি সেই দলের সংগে ছিলে । ওদের
সন্দেহ, এখন তুমি এই অঞ্চলেরই কোথাও আছ। সেই জন্যই ওর!
দিন নাই, রাত নাই, আজ এখানে কাল ওখানে হামলা করে ফিরছে।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৪৭
যখন খুশী ধরে নিয়ে আটক করছে, ভিতরকার কথা জানবার জন্য
মারপিট করছে ।
ওদের ভয় পাছে আমার উপর আবার আক্রমণ হয়। সেই জন্য
ওর! অতি সতর্ক ভাবে আমাকে পাহারা দিয়ে চলেছে। ওদের
ধারণা এ দেশে আমিই ওদের প্রধান নির্ভর। যেকোন ভাবেই
হোক আমাকে বাচিয়ে রাখতেই হবে। এ অবস্থায় এখানকার খোঁজ
খবর না নিয়ে তোমার এখানে আসাটা একেবারেই ঠিক হয় নি।
আপনিই ওদের প্রধান নির্ভর? হেসে উঠল পরতু।
হ্যা, ওরা এখনও মনে প্রাণে তাই বিশ্বাস করে। আগে যদি
বা কিছু সন্দেহ থাকত, এই আক্রমণের ফলে তাও কেটে গেছে।
কিন্ত পরভূ, তুমি তে। তোমার সংগীর পরিচয়টা এখনও দাও নি।
পরভূ বলল, এ আমাদেরই একজন: আমার ছোটবেলাকার বন্ধু ।
এর নাম ভাহ। এর সামনে সব কথাই বল! চলে । আমার কাছে
যে কথা বলতে পারেন, সে কথা ওর কাছেও বলতে পারেন ।
তা হোক, কিন্ত আমি যে কথা বলতে চাই শুধু তোমার কাছেই
বলতে চাই। পরভু, তোমার বন্ধুকে বল একটু বাইরে বসে অপেক্ষা
করুক ।
কথাটা ভাছুর কানে গিয়েছিল। পরভূর আর বলবার দরকার
হোল না। দে নিজেই উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল। পরভু একটু
অস্বস্তির সংগে বন্ধুর গতিশীল মৃত্তিটির দিকে তাকিয়ে রইল।
এবার বল, কি জন্ত এসেছ? যে জন্যই এসে থাক, ঠিক
প্রয়োজনীয় সময়টিতেই এসেছ । তোমাকে দেবার মত জরুরী
ংবাদ আছে । আমি নিজেই তোমার সংগে দেখা করবার জন্য
ব্যবস্থা করছিলাম । এখন আগে তোমার কথা শুনি।
পরতু বলল, আপনার উপর আক্রমণের খবর শুনে আমরা অস্থির
হয়ে উঠেছিলাম । কি ছূর্ভাবনায় যে আমাদের দিন কেটেছে ! কিছু
দিন থেকে এই ভয়ই তো! করছিলাম আমরা । অবশেষে সত্যসত্যই
১৪৮ বিপ্রোহী কৈবর্ত
তাই ঘটল! খবরটা আমার কাছে গিয়ে পৌঁছতে দেরী হয়েছে, তা!
না হলে সংগে সংগেই চলে আসতাম আমি ।
কেন,কি করতে এসে তুমি? দিব্বোকের চোখ ছুটি ভ্রকুটি
কুটিল হয়ে উঠল। ধর, যর্দি আমার প্রাণ সংশয়ই হোত, কি সাহাধ্য
করতে পারতে তুমি আমার? তুমি কি বৈদ্য না গুণীন লোক?
না না পরভু, এ সব ভাল কথা নয়, এর কোন মানে হয় না। তুমি
জান, অনেক কিছুই নির্ভর করছে তোমার উপর, আর তুমি
অকারণে এ রকম বিপদের ঝুকি নেবে, এ কেমন কথা !
দিবেবাকের কথায় স্ু্পষ্ট তিরস্কারের মন্থর | কিন্ত পরভূ তা গায়ে
মাখল না হেসে বলল, এক পরভু যাবে, কত পরভু আসবে। কিন্ত
ওলান ঠাকুর ন] করুক, আপনার যদি কোন কিছু ঘটে সে জায়গ!
পূর্ণ করবে কে? সেই জন্যই তো ছুটে আসতে হয়েছে আমাকে ।
আর এমনিতেই আসিনি, আজ একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ফিরব।
তার মানে? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন দিবেবাক, কি যে বলছ,
কিছুই বুঝতে পারছি না। হেস্তনেস্ত? কিসের হেস্তনেস্ত ?
পরভু তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর ন। দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
আচ্ছা আমর। এ পর্যন্ত আপনার কোন কথা অমান্য করেছি ?
তা করনি ।
আর আমাদের একটি মাত্র কথা, সে কথাটা আপনি রাখেন না
কেন?
পরভূ এমন করে কোন দিন তার সংগে কথা বলেনি, দিবে্বোকের
বিস্ময়ের সীম! রইল না, প্রশ্ন করলেন, কি তোমাদের কথা? কোন্
কথা৷ রাখিনি ?
আমরা কি বলিনি, আপনি সোজাসুজি আমাদের মধ্যে চলে
আন্মন ?
দিবেবীক হেসে বললেন, দেই কথা! আমার কি তাতে বড়
অসাধ? যারা আমার সব চেয়ে আপন, তাদের চোখে আমি শত্রু
বিস্কোহী কৈবর্ত ১৪৯
হয়ে আছি, এ কি আমার বড় সুখের কথা? কিন্ত কি করব, তবুও
আমাকে ছন্মবেশ নিয়ে চলতে হচ্ছে। এর ফল ভাল হয়েছে না
খারাপ হয়েছে, তুমিই বল।
পরভূ উত্তর দিল, ভালই হয়েছে মানি। কিন্তু আর বেশী
ভালোর কাজ নাই আমাদের । আপনাকে এ ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর
মুখে ফেলে রেখে আর এক পাও এগোতে রাজী নই আমরা।
সেদিন মৃত্যু আপনার কানের পাশ ঘেষে চলে গেছে । যা ভাবতে
পারি না! তাই যদি ঘটত, কি হোত তবে? পরভুর কথ্স্বর ভারী
হলে এল ।
তার কম্বরের এই পরিবর্তন দ্িব্বোকের কার্ম এড়াল না।
তিনি প্রতিবাদ করে বললেন, না না, নিশ্চিত মৃত্যু বলছ কেন?
আচ্ছা বেশ। এখন থেকে না হয় আর একটু বেশী সতর্ক হয়ে চলব ।
পর্ভু অধৈর্ষের সংগে তার বাবড়ী চুলে ঝাড় মেরে বলল, রাখুন
আপনার সতর্কতা! যাদের মধ্যে আছেন, তারাই যদি এভাবে
ক্ষেপে উঠতে থাকে, কি সতর্ক হবেন আপনি! এখানকার পলাজ-
পুরুষের! পাহার! দিয়ে রক্ষা করবে? ওরা যত বেশী সাহায্য করতে
চাইবে আপনাকে, আপনার বিপদ তত বেশী বাড়বে । এখন কত
শক্তি আমাদের, ছু চার ঘ্বর ধনী আর তাদের সংগোপাংগরা ছাড়া
বরেন্দ্রীর সমস্ত মানুষ মনে মনে আমাদের সংগে । অথচ আপনাব
নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারি, সে শক্তি আমাদের নেই। সেই
জন্যই আমরা মিলিত হয়ে স্থির করেছি-_
আমর? আমরা কারা? দিবেবাক প্রশ্ব করলেন ।
“আমরা” মানে যারা আপনাকে সঠিক ভাবে চিনি, যাদের সংগে
আপনি মন খুলে কথা বলেন তারা।
কি স্থির করেছ তোমরা ?
স্থির করেছি, আপনি ঘর্দি আমাদের কথা না মানেন, তবে
আমরাও মানব না আপনার কথা।
১৫৭ বিদ্রোহী কৈবর্ত
দিবেবোক হেসে বললেন, বেশ তো, নাই মানলে আমার কথ|।
আচ্ছা ধর, তোমাদের কথায় ষদি আমি নাই রাজী হই,কি করবে
তবে?
কিকরব? আমাদের যা খুশী তাই করব। পরভু ছেলেমান্ুষের
মত বলে চলল, আসবার সময় আমি বলে এসেছি, যদি রাজী ন'
হন, হত্যা দিয়ে পরনে থাকব ওখানে, একদিন, ছু দিন, তিন দিন,
যত দিন লাগে। সে খবর বদি প্রকাশ হয়ে যায়, আর সে জন্ত ধর!
পড়তে হয়, তবে সে দায় দায়িত্ব তার। আমি কিছু জানি না। সত্যি
বলছি আপনাকে, আমি ছোট বেলা থেকে ভীষণ জেদী, যা একবার
ধরি তা ছাড়ি না। আপনি যদি কথা না দেন, আমি এ জায়গ।
ছেড়ে এক পা নড়ব না। তাতে যা হবার হবে।
দিবে্বোকের বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল । এ এক অপূর্ব
অনুভূতি । শান্ত সংযত এবং শক্ত মানুষ বলেই তিনি সকলের কাছে
পরিচিত। এমন অভিভ্ঞরতা তার কোন দিনই হয় নি। একি
হলো্তীর, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে যে। পরভুর
একটা হাত ছ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, একটু সবুর
ভাই, আর কট] দ্রিন। তোমাদের কথা শুনব না তো কার কথ
শুনব! তবে আর একটু অপেক্ষা কর, স্থখবর আছে। রুদোকের
কাছ থেকে খবর নিয়ে লোক এসেছে, ওরা আসছে।
আসছে! উত্তেজনায় দাড়িয়ে পড়ল পরভূ, কবে? কবে
আসবে ?
আর দু'মাস বাদে।
আরও ছু'মাস! পরভুর উৎসাহ যেন নিভে ছাই হয়ে গেল।
আরও ছ'মাস আমাদের অপেক্ষা করতে বলছেন ! তারপর আপনি
নিজেকে প্রকাশ করবেন? আর এই ছ'মাসে কত কিছু ঘটে যেতে
পারে ভেবে দেখেছেন? আমাদের বহু ভাগ্য এবার একটুর জন্য
আপনাকে হারাতে হয় নি। কিন্ত আর আমর এই ঝুঁকি নিতে
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৫১
পারব না। এ ভাবে আপনার এখানে থাকা আর চলবে না। আমরা
সবাই একমত হয়ে ঠিক করেছি । আমাদের এ কথ! আপনি কিছুতেই
ফেলতে পারবেন না।
পর্ভুর কথার মধ্যে দিয়ে এমন গভীর আস্তরিকতার ম্থুর ফুটে
উঠেছিল বে তার সামনে কিযে বলা যায়, দিব্বোক কথা খুঁজে
পেলেন না।
সার! দেশের মানুষ আপনার নামে যে সব কথা বলছে, তার
কতটুকু আপনার কানে আসে? সেজানি আমরা । আর যারা
আমাদের দলের মানুষ, তাদের রাগ আরও বেশী । কি না বলছে
তারা! কিন্তু আপনি আমাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছেন, সত্য কথা
প্রকাশ করতে দিচ্ছেন না। আমাদের বুক ফেটে যায়, কিন্তু মুখ
বুজে সব কিছু হজম করে যেতে হয়। এ কিকম কষ্ট? আর
দিনের পর দিন এ সব কথা শুনে শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে
বায়, কাজে আর উৎসাহ পাই না।
বলুক না ওরা । ওদের দোষ কি, ওর! তো বলবেই।
ওদের দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু আপনাকে আমাদের মধে না
পাওয়া পর্যস্ত আমর1 নিশ্চিত মনে কাজ করতে পারছি না। তা
ছাড়া গীঠি থেকে অশ্বারোহী সৈন্তরা এত দূর দেশে আমাদের সাহায্য
করতে আসবে, এ আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি
যদি আসার ইচ্ছা থাকত, তা হলে এত দেরী করবে কেন? অথচ
সময় বয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি কি আসবে ওর|? আমার তো
মনে হয়, ও' দর সব কিছুই ফাকি। আসার হলে আগেই আসত ।
দিবেবাক বললেন, না, এবার ঠিকই আসবে। রুদোক জানিয়েছে,
এতদিন ব্যাপারটা নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে একটা গরমিল
চলছিল। গীঠিরাজ দেবরক্ষিত এই বিষয়ে আমার কাছে প্রতি-
শ্রুতিতে আবদ্ধ। তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবার জন্ত সব
সময়ই তৈরী আছেন। কিন্তু তার সেনাপতি ভীমযশ এত দিন
১৫২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। তাঁর সেই আপত্তি নাকি সম্প্রতি
কেটে গেছে। কিছু ভয় কোরো৷ না। ওরা আসবেই।
পরভু অবহেলার সুরে বলল, ভয় ! ভয় করব কেন? আমার
নিজের কথা বলছি, গীঠির ঘোড়সওয়ার সৈম্তরা আম্মক আর নাই
আন্ক, সেজন্য আমার কোন ভরসাও নেই, ভয়ও নেই। আমি তো!
মনে করি, আমরা নিজেরাই যথেষ্ট, কার সাহায্যের প্রয়োজন নেই
আমাদের। শুধু আপনার নির্দেশ, সেই জন্যই পীঠির ঘোড়মওয়ারদের
জন্য পথের দিকে তাকিয়ে আছি ।
দিবেবোক একটু অধৈর্ধের সরে বলে উঠলেন, এ কথাটা আমি
তোমাকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছি না যে, যে যুদ্ধ আমাদের
সামনে, তা এতদ্দিনকার এই বন-জংগলের যুদ্ধ নয়। রাজধানী
দখলের এই যুদ্ধের ধরন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ যুদ্ধ হবে মুক্ত রণক্ষেত্রে,
আর নগরের রাজপথে । এ যুদ্ধ ওরা চিরকাল করে এসেছে, তাই
এ ব্যাপারে ওরা দক্ষ। কিন্তু কৈবর্তের যত যুদ্ধই করে আম্মক
না কেন, এ ধরনের যুদ্ধ তাদের কোন দিনই করতে হয় নি। আর
ঘোড়গওয়াররা যদি আমাদের বাহিনীর সামনে না থাকে, তবে এ
যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হবে না॥ আমরা যুদ্ধ করতে চসছি শুধু প্রাণ
দেওয়া-নেওয়ার খেল! খেলতে নয়, আমরা জয়লাভ করতে চাই।
পরভূ দিবেবাকের হরে সুর মিলিয়ে বলল, হ্থ্যা আমরা জয়লাভ
করতে চাই। কিন্তু আমি আপনার এই কথাট! কোনদিনই পুরো-
পুরি স্বীকার করে নিতে পারি নি। আগেও না, এখনও না। কিন্তু
স্বীকার করি আর না করি, আমরা তো! আপনার কথ! মেনে নিয়ে
অপেক্ষা করেই আছি। কাজেই ও কথা থাক। আমি তো তা
নিয়ে কোন কথ বলতে আসি নি। আমি যে কথা নিয়ে এসেছি,
সে কথাটা আপনাকে মানতেই হবে। এটা শুধু আমার নিজের
কথা নয়, এ আমাদের সকলের কথা ।
দিব্বোক কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিস্ত বলতে পারলেন না।
বিক্রোহী কৈবর্ত ১৫৩
প্রভু তাকে বলবার গ্ুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে চলল, কিন্ত
শুধু আপনার প্রাণের আশংকা আছে বলেই যে বলছি, তা নয়, এর
মধ্যে আরও কথ! আছে। যে মুহূর্তে আপনি আমাদের 'মাবখানে
এসে দাঁড়াবেন, তখন তা মস্তরের মতই কাজ করবে। আমরা যখন
এতদ্দিনকার এই চাপ! দেওয়! কথাট। সবার কাছে প্রকাশ করে দেব,
আর সবাই যখন দেখবে আপনি আমাদের মধ্যে নেমে এসে
ঈাড়িয়েছেন, তখন অবস্থাটা কি হবে ভাবতে 'পারেন? আপনি
পারবেন না, আমরা পারি। উত্তরের পাহাড় থেকে পাগলী দিস্তাং
নদীর ঢল যেমন করে নেমে আসে, সারা ববেন্দ্রীর মানুষের মনে
তেমনি করে উৎসাহের ঢল নেমে আসবে । আমাদের মধ্যেই এমন
মান্য আছে, যারা বলে এই কৈবর্ত জাতের কোন আশ! নেই |
আমাদের রাজ! দ্রিব্বোক যার সংগে কারু তুলনা হয় না, সেই যদি
এমন করতে পারল, তবে আর কার উপর ভরসা করতে পারি
আমরা! অনেকের মনেই এই কথাটা জমে আছে। তাই তারা
নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে । যদি দেখতে পায় আপনি তাদের মানুষ,
তাদেরই আছেন, তবে এই আধমর! মানুষগুলো লাফিয়ে উঠবে।
অন্যের কথা কি বলব, আপনাকে ঘযদ্দি সামনে পাই, এই ষে পরভু
দেখছেন, তারও বুকের জোর দশগুণ বেড়ে যাবে ।
এগুলে৷ আপনি ভেবে দেখছেন না, আপনার দৃষ্টি রয়েছে শুধু
পীঠির ঘোড়-সওয়ারদের দিকে । আমরা যদি আমাদের নিজেদের
শক্তিকে জমায়েত করতে না পারি, ওরা কি করবে? বেগতিক
বুঝলে ওরা যে যার প্রাণ নিয়ে পালাবে । আমাদের কালো
মীঙ্গুষদের জন্য ওদের কি এত দরদ !
পরতু যেন এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথ! বলে থামল। পরতু শুধু
যুদ্ধ করতেই পারে না, কথ! বলতেও জানে । আর তার কথার পিছনে
সুসংগঠিত চিস্তাও আছে। দিবেবোক এত দিন বাদে আজ তাকে নতুন
দৃষ্টি নিয়ে দেখলেন। পরভু আজ তাকে নতুন ভাবনায় ভাবিয়ে
১৫৪ বিজ্রোহী কৈবর্ড
তুলেছে । সত্য কথাই বলেছে পরতু, দেশের মানুষের মনের কথা
এরাই তো! জানে, তিনি আর কতটুকু জানেন?
দিবেবককে নিরুগ্তর দেখে পরভুর মনে আশার আলো দেখা
দিল। একটু অপেক্ষা করে কোন উত্তর না পেয়ে সে প্রশ্ন করল, কই
কিছুই বলছেন না ষে?
দাড়াও, একটু ভাবতে দীও। কিন্তু একট! দরকারী কথা জিজ্ঞাসা
করা হয়নি। কোচদের সংগে যে কথাবার্তা চালাতে বলেছিলাম,
সেটা কি কিছুটা এগিয়েছে ?
হ্যা, আমর! আলাপ করেছি ওদের সংগে । আমি নিজে যেতে
পারি নি। বে যারা গিয়েছিল, তাদের সংগে আমাদের এই ভাছও
ছিল। ওদের ছুজন মোড়লের সংগে ভাছুর পরিচয় আছে । বিশেষ
করে সেই জন্যই তাকে পাঠানে। হয়েছিল। আপনি ভাছর মুখ
থেকেই সব কথ। শুনুন । বেচারা! বাইরে একা এক মনমর] হয়ে বসে
আছে।
দিবেধাক তার মনের ভাবটা বুঝতে পেরে বললেন, কিন্ত কি করা
যাবে! এ সব বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে চল! প্রয়োজন | সময় সময়
একটু রূঢ় বলে মনে হতে পারে । কিন্তু উপায় নেই।
ভাছ্ সত্য সত্যই মনমরা হয়ে বসেছিল। দিবেবকের সংগে
মুখোমুখি কথা বলবার এমন একটা! ম্থযোগ একেবারে হাতের কাছে
এসেও এমন করে ফস্কে গেল, ছুঃখ হবার তে। কথাই।
ডাক পড়তেই শশব্যস্ত হয়ে উঠে এল সে। যেটুকু মনঃক্ষোভ
জমে উঠেছিল, তা গলে একেবারে জল হয়ে গেল।
ভাহ সমস্ত কথা খুলে বলল। মোড়লেরা স্পষ্টভাবেই তাদের কথা
জানিয়ে দিয়েছে--গৌড়ের রাজার বিরুদ্ধে ওর! কিছু করতে পারবে
না। গৌড়ের রাজারাই তাদের ডেকে এনে জায়গা দিয়েছিল ॥
একদিন তাদের অনুগ্রহে তারা এখানেই ঠাই পেয়েছে, এ কথ! তারা
অস্বীকার করতে পারে না। মোড়লরা তাদের বাপদাদাদের মুখে
বিজ্বোহী কৈবর্ত ১৫৫
শুনেছে, তাদের পূর্বপুরুষরা বখন প্রথমে এখানে এসে বসেছিল,
তখন তাদের কোন রকম কর-্টর দিতে হতো! না । অগাধ বন, যে
যতটা পেরেছে, জংগল কেটে জমি আবাদ করেছে । এখন অবশ্য
সবারই কিছু কিছু কর দিতে হয়। কিন্ত তা তেমন গায়ে লাগে না।
এ ছাড়া আর কোন রকম আদায় নেই। তাদের মাথার ওপর রাজ!
আছে বটে, কিন্ত তাদের নিজেদের নিয়মে তাদের সমাজ চলে ।
রাজা তার ওপরে কোন হাত দেন না । তারা বেশ শাস্তিতেই
আছে। রাজ] তাদের বিরুদ্ধে কোন কিছুই করে না । তারাই বাঁ
করতে যাবে কেন?
ভাছু বলে চলল, আমরা আমাদের ছুরবস্থার কথা সবই খুলে
বললাম। ওর! বলল, হ্যা হ্যা, এসব কথা শুনেছি বটে ।
শুনেছেন? একি শুধু শোনা কথাই? আজকাল এত
জুলুম চলছে আমাদের ওপর, একি আপনারা চোখে
দেখেন না?
মোড়লের! এ ওর মুখের দিকে চেয়ে একটু গা মোচড়ামুচড়ি দ্রিয়ে
শেষে বলল, আরে ভাই, চোখেও দেখি, কানেও শুনি, কিন্ত
এ ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি ?
আমাদের মধ্যে একজন বলল, আপনারা আমাদের গা-ঘে যা
প্রতিবেশী । আমরা চাঁধী, আপনারাও চাষী । আমাদের নখে
আপনাদের স্থখ, আমাদের দুঃখে আপনাদের ছুঃখ। আমাদের কথাটা
আপনাদের কি একটু চিন্তা করা উচিত নয়?
ওরা তখন এই নিয়ে আলাদ! হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে
নিল। শেষে বলল, না বাপু* আমরা ওসব পারব-টারব নী । গোৌড়ের
রাজা! আমাদের তো কোন ক্ষতি করে নি, আমরাই ব! তাদের ক্ষতি
করতে যাব কেন?
আমরা বললাম, আজ না হয় ওরা আপনাদের সংগে ভাল
ব্যবহারই করছে। কিস্ত এআর ক'দিন ! এক সময় তো আমাদের
১৫৬ বিজ্রোহী কৈবর্ত
সংগেও ভাল ব্যবহার করত। কিছুদিন যাক নী,. তারপর দেখবেন,
আপনাদেরও ওরা ছেড়ে কথা কইবে না।
এক বুড়ো বলে উঠল, যখন করে তখন দেখ! যাবে, তাই বলে
আমরা আগ বাড়িয়ে দোষী হতে যাব কেন?
এই নিয়ে সারা রাত ধরে আলাপ আলোচনা চলল । শেষকালে
রাত্রি যখন শেষ হয় হয় তখন ওরা! মাঝামাঝি একট! প্রস্তাব দিল।
বলল, আর বেশী কথায় কাজ নেই ভাই, আমরা! আমাদের শেষ কথা
বলে দিচ্ছি, আমরা এ পক্ষেও নেই, ও পক্ষেও নেই। তবে
তোমাদের এই ছুঃসময়ে তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করব না।
কিন্ত রাজার বিরুদ্ধে যদি তোমাদের সাহায্য করতে বল, তাও
আমরা পারব না।
এর বেশী আর এগোতে পারলাম না । যেটুকু পেলাম তাই
নিয়েই ফিরে এলাম আমরা ।
কথা শেষ করে ভাছ দিব্বোকের মনৌভাবট1 বোঝবার জন্য তার
মুখ্রে দিকে তাকাল। দিবেবাক খুশী হয়ে অনুমোদনের দ্থুরে বললেন,
বেশ, বেশ, ওরা যে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এটা খুবই আনন্দের
কথা। আমাদের এই সংকটের সময় এট] বড় কম সাহায্য নয়।
কিন্ত আমি ভাবছি কোচরা শেষ পর্ষস্ত তাদের এই মুখের কথা রক্ষা
করে চলবে তো?
পরতু উত্তর দিল, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি।
কোচদের কথার কক্ষনে। নড়চড় হয় না। তারা যেটুকু বলে, তা
অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আচ্ছা, ওকথ। তো! গেল, এখন আমার
কথাটার উত্তর দিন। এটা! মনে রাখবেন, আপনার এই উত্তরের
ওপর আমাদের অনেক কিছু নির্ভর করছে।
দিবেধোক বললেন, তোমার কথাটা আমি ভেবে দেখছি পরভূ।
তোমাদের কথা ঘদ্দি মেনে নিই তাহলে আমার সমস্ত পরিকল্পনা
আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। সেই জন্যই আমি কথাটা!
বিভ্োহী কৈবর্ড
আরও ভাল করে ভেবে দেখতে চাই। কাল বাদে পরশু--হ্যা,
পরশ্ুই আমি তোমাকে আমার চূড়ান্ত মতামতট! লোক মারফৎ
জানাব। তুমি তোমার নিজের জায়গায় থেকো । আর এক কথা,
তোমাকে বার বার করে সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি নিজে কক্ষনে!
এখানে আসবে না, আপাতত কোন লোক পাঠাবারও দরকার নেই।
যা করবার আমিই করব।
পরভু হেসে বলল, আমি ধরে নিচ্ছি আপনি আমার কথায় রাজী
হয়ে গিয়েছেন । আর যদি তার বিপরীত ঘটে তা হলে আসতেই
হবে আমাকে এখানে । আমি আপনার সব কথাই মেনে চলি, কিন্তু
এ কথা কিছুতেই মানতে পারব ন।। এ আপনাকে আগেই জানিয়ে
রাখছি।
এর দিন সাতেক বাদেই এ অঞ্চলের লোক অবাক হয়ে শুনল,
দিব্বোক তীর স্ত্রী আর তার ভাই রূদোকের স্ত্রীকে নিয়ে তীর্থবাত্রায়
চলেছেন। তীর্থযাত্রাট। অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সময়টা! এমন
যে অন্ত সময়ে যা স্বাভাবিক এখন তা সন্দেহজনক হয়ে দাড়াল।
তীর্ঘযাত্রার কথাট। কেউ বিশ্বাস করল ন।। অনেকেই বলল, প্রাণ
বাচাবার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন লোক্রের।
আফসোস করে বলল, এমন একটা মানুষ, শেষকালে এই হলো তার
গতি | তরুণরা! বলল, গেছে, আপদ গেছে । তবে আরও কিছুদিন
আগে গেলে আরও ভাল হতো ।
রাজপুরুষরা নাকি 'এ সময়ে না 'যাওয়ার জন্য খুবই গীড়াগীড়ি
করেছিল। কিন্তু কিছুতেই তাকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না। তবে
যাবার সময় সবাইকে বলে গেছেন, অতি শীত্রই ফিরে আসবেন
আবার। কিন্ত খুব কম লৌকই সে কথ বিশ্বাস করেছে ।
১৫৭
নয়
মধুবনবিহারের এক গোপন কক্ষে তারা পাঁচজন বসে মন্ত্রণা
করছিলেন ।
বিহারের অধ্যক্ষ স্ুভদ্র বললেন, আপনাদের সংগে আমাদের
প্রথমও প্রধান শর্ত ছিল যে, রাজ! মহীপাঁলের পতন ঘটলে আমাদের
মধ্য থেকে প্রধান অমাত্য গ্রহণ করতে হবে। বলুন এ কথাটি
কি ঠিক নয়?
মথনদেব উত্তর দিলেন, ঠিক বই কি।
তাই যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে হিন্দুদের মধ্যে এই বিপরীত
প্রচার চলছে কেন?
বিপরীত প্রচার? সেকি!
« হ্যা, আমাদের পক্ষপাতী হিন্দু যাঁরী, শুনছি তারা নাকি বলাবলি
করছে, এই রাজত্বের পতন ঘটলে বরাহম্বামীর পরিবর্তে অন্য একজন
হিন্দুকে প্রধান অমাত্য নিয়োগ করা! হবে। এ সব কথার মানে কি?
এ কথা কেন উঠছে ?
উঠছে নাকি! মথনদেব একটু অগ্রাহ করবার ভংগিতে বললেন,
যার মন ষে রকম চায় মে সেই রকম কল্পনা করবে, তাতে আর
বিচিত্র কি !
এটা কি শুধু তাদেরই কল্পনা? এর পিছনে আঁর কিছু নেই ?
বর্তমান কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছিল । আলোচনাটা কিছু
দুর এগোতেই শুঁভন্র হঠাঁং এমন একটা জায়গায় ধোঁচা মেরে বসলেন
যে সমস্ত আবহাওয়াটা ঘুলিয়ে উঠল ॥ এর জন্ত কেউ প্রস্তুত ছিল
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৫৯
না। এটা ন্ুভদ্রের নিজত্ব বৈশিষ্ট্য | যেটাকে সে সত্য মনে করে সে
সম্পর্কে স্প্টোক্তি করতে তার কখনও বাধে ন1।
প্রবীণ ও বিচক্ষণ মথনদেব প্রথমে কথাটা গায়ে মাখতে
চাইছিলেন না, কিন্ত এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন ন!।
এই অর্বাচীন তরুণের দিকে জ্রকুঞ্চিত করে তাকিয়ে বললেন, আপনি
কিসের ইংগিত করছেন ? কি বলতে চান স্পষ্ট করেই বলুন ।
আমার কথাট। কি যথেষ্ট স্পষ্ট হয় নি? প্রশ্নাকারে উত্তর দ্রিলেন
স্থভদ্র ।
মথনদেব এ কথার কোন উত্তর ন! দিয়ে অধিরথের মুখের দিকে
তাকালেন। সেই দৃষ্টির তাৎপর্-আপনাদেরও কি এই একই বক্তব্য
অধিরথ অস্বস্তির সংগে নড়েচড়ে বসলেন ।
উপগ্প্ত বাধ! দিয়ে বললেন, এসব কি বলছ স্থভদ্র। কে কোথায়
কি বলেছে না৷ বলেছে, সেটা! আমাদের আলোচ্য নয়। এসব সামান্য
কথ! ছেড়ে দিয়ে মূল আলোচনার দিকে এসো ।
কিন্তু এত সহজে হ্ুভদ্রকে থামানে। গেল না, তিনি বলে উঠলেন
'সামান্ত ? এটাকে সামান্ত বলছেন 'আপনি! আজ যেটা ছোট,
তাকে প্রশ্রয় দ্রিলে কাল তা বড় হয়ে উঠবে। আমাদের সমাজে এই
দুর্গতি এই ভাবেই তো হয়েছে । সে জন্য গোড়। থেকেই পরিষ্কার হয়ে
নেওয়া ভাল।
মথনদেব এবার একটু মন্তব্য না করে পারলেন না, গোঁড়াট।
মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল, আপনিই অপরিষ্কার করে তুলছেন।
অধিরথ নুভদ্রকে লক্ষ্য করে দৃঢ়কঠে বললেন,ও সমস্ত অপ্রাসংগিক
কথা এর মধ্যে টেনে আনবেন না । বে কাজের কথা হচ্ছিল, সেই
কথাই ব্লুন। আমাদের মাথার ওপর কত বড় দায়িত্ব সে কথাট!
একবার ভেনে দেখুন | অবস্থাটা সব দিক দিয়েই আমাদের অম্কুল
ছিল,কিস্ত সেই চিঠিট1 ধর! পড়বার পর থেকে হুর্যোগ নেমে এসেছে
"আমাদের ওপর । আমাদের কিছু লোক ধরা পড়েছে, কিছু লোক
3১৬৩ বিদ্রোহী বৈবর্ত
ওদের সন্দেহের পাত্র হয়েছে, আমাদের ভিতরকার কোন কোন কথা
ওদের কাছে ফীসও হয়ে গেছে । এই হ্থযোগটা পেয়ে বরাহস্বামী
তার জাল ছড়িয়ে ফেলছেন । এট! মনে রাখতে হবে, আমরা খুবই
সংকটের মধ্যে আছি।
এ ভাবে বাঁধা পেয়ে সুভদ্রের মেজাজট! তিরিক্ষি হয়ে উঠেছিল ।
তিনি মনের ঝালটা মিটাবার জন্য বলে উঠলেন, এ সংকট তো সাধ
করে ডেকে আনা হয়েছে ।
তার মানে 1? সবাই সপ্রশ্র দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন।
সাধ করে না তে। কি? কোন প্রয়োজন ছিল কি শংখদেবীকে
এই চিঠি পাঠাবার ? তিনি একে মেয়ে মানুষ. তার উপর প্রাসাদের
মধ্যে প্রায় বন্দিনীর অবস্থায় অছেন। এত বড় বিপদের ঝুঁকি
নিয়ে তীর সংগে মতামত বিনিময়ের কি যে সার্থকতা থাকত পারে
এ আমার বুদ্ধির অগম্য। আর তাঁর ফলটাও হাতে হাতেই পাওয়।!
গেল। সংকট আপনি আসে নি।
এই কথার মধ্য দিয়ে সোজান্থজি মথনদেবকে আক্রমণ করা
হয়েছে । কিন্ত তিনি এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। তার পক্ষ
হয়ে, উত্তর দিলেন অধিরথ। তিনি বললেন, এখানকার অবস্থা
সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা নেই। সেই কারণেই শংখদেবীর সংগে
মতামত বিনিময়ের সার্থকতা বুঝে ওঠা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই আপনি এমন কথা বলছেন। কিন্ত এ সব কথা এখন থাক ।
আপনি সম্প্রতি সব কটি বিহার পরিভ্রমণ করে সেখানকার অধ্যক্ষ ও
ভিক্ষুদের মতামত জেনে এসেছেন। তীদের মতামতের যথেষ্ট
গুরুত্ব আছে, কেননা কি এহিক কি পারত্রিক সকল বিষয়েই বহু
লোক তাদের নির্দেশ মেনে চলে । - আমরা আপনাদের কাছ
থেকে তাদের মত্তামতট1 জানতে চাই।
স্ুদ্র বুঝলেন প্রধান অমাত্যের নিয়োগের প্রশ্নটাকে গোড়।
থেকেই আরও বেশী পরিষ্কার করে নেওয়া আপাতত সম্ভব নয়। এ
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৬১
বিষয়ে এখানে সবাই তার বিরোধী । অগত্যা! সেই চেষ্টাটা ছেড়ে
দিয়ে তিনি অধিরথের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, বিহারগুলির অর্ধেকেরও
বেশী আমাদের সংগে আছে। বাকী সবাই বলছে, রাজা মহীপাল-
দেব যাই করুন না কেন তিনি আমাদের সমধর্মী, আমরা তার
বিরুদ্ধে যেতে পারব না। তা ছাড়া বদল হলেই যে আমাদের
অবস্থার উন্নতি হবে, এমন কথাই বা কে বলতে পারে। অবস্থা
যা আছে তার চেয়ে খারাপও তো হতে পারে ।
উপঞ্প্ত চিন্তিত কে বললেন, হ্যা, হিন্দুদের মধ্যে ছুঃভাগ,
বৌদ্ধদের মধ্যেও তাই । লক্ষণট1 আমার কাছে ভাল লাগছে না।
একটা বড় রকমের রক্তারক্তি ঘটবার আশংকা আছে। সৈন্তদের
মধ্যে আমাদের সমর্থকদের সংখ্যা কেমন ?
মথনদেব উত্তর দিলেন, সে কথ চূড়াস্ত ভাবে বল কঠিন ।
কেনন। ঘন ঘন অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে । তবে মনে হয় আনুমানিক
এক তৃতীয়াংশ আমাদের সংগে থাকতে পারে ।
মাত্র এক তৃতীয়াংশ ? তবে কিসের উপর আমরা নির্ভব করছি?
উশগ্প্ত প্রন্ন করলেন আপনারা কি মনে করেন প্রজাদের মধ্যে
অধিকাংশ আমাদের সমর্থক?
অধিরথ মাথা! নেডে বললেন, না, এমন কথা বলা যায় না।
বরং এর বিপরীতট। হবারই সম্ভাবনা । এখানকার প্রজাদের
রাজভক্তি রাজার পক্ষে একট বিপুল শক্তি ।
তবে?
মথনদেব বললেন, আমাদের প্রধান ভরসা সামস্তরাজেরা।
আপনারা কাহ,রের মুখেই সেখানকার অবস্থা শুনুন ॥
মথনদেবের পুত্র কাহ্,রদেব এতক্ষণ নিঃশব্দে সবার কথা
শুনছিলেন। পিতার ইংগিত পেয়ে তিনি বলে চললেন, আমি
গত এক বছর প্বরে বাণিজ্যের উপলক্ষ নিয়ে কোটাটবী, বালবলভী,
অপরমন্নার, কুজবটী, তৈলকম্প, উচ্ছাল, চেন্বরীয়, কযংগল মণ্ডল,
১১.
১৬২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
নিন্রাবল, পছুবন্বা ও কৌশাম্বী ছোট বড় এই এগাঁরোটি সামস্তরাজ্য
পরিভ্রমণ করেছি। সাহায্যের প্রশ্ন নিয়ে আমি এদের সবার সংগেই
আলাপ করেছি। এদের কথা-বার্তা শুনে আমার মনে হয়, যদি
রামপালদেব ব৷ শুরপালদেব বাইরে থাকতেন, তা হলে এরা সবাই
আমাদের সংগে যোগ দিতেন! এদের মধ্যে অপরমন্দার, তৈলকম্প,
উচ্ছাল ও নিব্রাবল ন্ুস্পষ্টভীবে আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে। অবশ্য তারা তাদের নিজেদের স্বার্থটাকেই বড় করে
দেখছে। এই যুদ্ধ উপলক্ষে তাদের নিজ নিজ রাজ্যের সীমান।
প্রসারিত করে নেওয়াটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য !
আর বাকী ছয়টা! রাজ্য? অধিরথ প্রশ্ন করলেন ।
তারা দোছ্ল্যমান অবস্থায় আছে। ছু'পক্ষের সংগেই কথা চালিয়ে
যাচ্ছে ওরা । তবে এ কথা আমি ভাল ভাবেই জানতে পেরেছি,
বরাহস্বামীর লোকেরা ওদের কাছ থেকে এখন পর্ধস্ত সুস্পষ্ট ভাবে
কোন কথা আদায় করতে পারেনি । আসল কথা, ওরা একটু
আলগা হয়ে বসে শক্তি পরীক্ষার প্রথম পর্যায়টা দেখে নিতে চায়।
শেষ যে দিকে জোর দেখবে বেশী, সেই দিকেই ঝুকে পড়বে।
নৃভদ্র প্রশ্ন তুললেন, যে পাঁচট1 রাজ্যের কথা বললেন. তাদের
প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করা যায় তো ?
কাহ,রদেব উত্তর দিলেন, আমি যতদুর বুঝতে পেরেছি তাতে
মনে হয় এদের কথায় নির্ভর করা চলে। আর এরা যদি সাহায্য
করে তবে পূর্ণ শক্তি নিয়েই সাহায্য করবে। কেননা! তারা জানে
যে তারা আমাদের সংগে যোগ দেবার পরেও আমরা যর্দি জয়ী হতে
না পারি, তবে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ।
অধিরথ বললেন, আমাদের অনুকূলে আরও একট। ঘটন। ঘটছে,
আমাদের এই শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাকেও আমরা তুচ্ছ করতে
পারি না।
কি ঘটনা? উপঞ্প্ত প্রশ্ব করলেন ।
বিজ্বোহী কৈবর্ত ১৬৩
বরেন্দ্রীতে অনেক দিন থেকেই কৈবর্তদের মধ্যে বিক্ষোভ চলে
আসছে। তার গুরুত্বের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে । ফলে
সেখানকার বিক্ষোভ দমন করবার জন্য রাজধানীর বেশ কিছু সৈন্য
সেখানে আটকে পড়ে আছে। আমাদের পক্ষে এ একটা ভাল
স্বযোগ।
সবাই বলল, তা ঠিক ।
আর ওদের বিক্ষোভের মাত্রা বত বেশী বেড়ে চলবে, আমাদের
তত বেশী ন্ৃবিধ।
সবাই বলল, তা৷ ঠিক, তা ঠিক।
কাহু,রদেব এই প্রসংগে একটা নতুন প্রস্তাব তুললেন-_-এই যখন
অবস্থা, তখন উভয় পক্ষের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখে আমরা কি
কৈবর্তদের সংগে কোন রকম পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে
পারি না?
না না, তা হতে পারে না, মথনদেব প্রবল ভাবে আপত্তি
জানালেন, কৈবর্তদের সংগে কোন রকম চুক্তিতে আবদ্ধ হতে
আমাদের মর্যাদায় বাধে । তা ছাড়া আরও বড় কথা, এর ভিত
কখনোই ভাল হতে পারে না। এই বিক্ষোভের ইতিহাসটা আমার
ভাল করেই জানা আছে। অভাবের তাড়না এবং গোৌড়ের
রাজপুরুষ ও বণিকদের বিরুদ্ধে কতগুলি অভিযোগ নিয়ে এক দিন
এই বিক্ষোভের সৃচন। হয়েছিল । কিন্ত এখন বিক্ষোভ আর সেই
পর্যায়ে নেই। তারা এখন গৌড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপনাদের
স্বাধীন বলে ঘোষণা করতে চাইছে । আজ যদি আমরা পারস্প্ররিক
সাহীষ্যের চুক্তিতে আবদ্ধ হই, তা হলে তা তাদের এই উদ্দেশ্য
সিদ্ধির পক্ষে সহায়ক হবে। আর এ ভাবে তারা বদি আমাদের
হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ! কি দাড়াবে? এ
কথা৷ কে ন! জানে যে, বরেজ্জ্রীর শহ্যাসম্পর্দের উপর গৌড়ের সমৃদ্ধি
নির্ভর করে। সেই জন্তই আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত যে ওখানকার
১৬৪ বিজ্রোহী কৈবর্ত
বিক্ষোভ চলতে থাক, কিন্ত তা যেন একটা বিশেষ নির্দিষ্ট মাত্রার
মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে । অগ্নিতে ঘৃতান্ছতি দিয়ে আমরা কখনোই
তাকে বাড়িয়ে তুলব না। আমরা সমস্ত রকম ন্থুযৌগের সদ্যবহার
করব সে কথা ঠিক, কিন্তু তাই বলে আমর! অপরিণামদর্শী হতে
পারি না।
ঠিক এমনি সময় সমস্ত বিহার জুড়ে হঠাৎ একট কোলাহল জেগে
উঠল। শিক্ষার্থী ভিক্ষুরা সবাই সমস্বরে উত্তেজিত রুটে কথ! বলে
চলেছে। কি ব্যাপার! গোপন কক্ষে মন্ত্রণীরত নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তিরা চমকে উঠলেন ।
কোন বিপদ আপদ ঘটেনি তো? উপগুপ্ত উদ্বিগ্ন কে প্রশ্র
করলেন।
অধিরথ বললেন, না, না, বিপদ নয়। শুনছেন না, ওরা উল্লাস
ধ্বনি করছে ॥
ভালই হোক আর মন্দই হোক, ব্যাপারট1 যে গুরুত্বপূর্ণ সে
বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। যাও দেখে এসো তো স্থভদ্র, ঘটনাটা
কি? উপগ্প্ত ডেকে বললেন।
ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন শ্ুভদ্র, একটু পরেই হাঁপাতে
হাপাতে ফিরে এলেন । কিন্তু এবার তার চেহারাটা! একেবারেই
বদলে গেছে । ঘরে ঢোকা পর্যন্ত সইল না, বাইরে থেকেই বিহারের
অধ্যক্ষ হ্ুপণ্ডিত স্ুভদ্র, আর সমস্ত শিক্ষার্থীদের স্বরে সুর মিলিয়ে
চেঁচিয়ে উঠলেন- হয়ে গেছে ! হয়ে গেছে !
কি? কি? কি হয়েছে? এক সংগে বলে উঠলেন সবাই।
বিদ্রোহীরা রাজধানী দখল করে নিয়েছে! রাজ! মহীপালদেব
যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত ।
এক মুহুর্তের জন্য নিঃশব্দ হয়ে গেলেন সবাই । পরক্ষণেই সবাই
এক সংগে কথা বলে উঠলেন । মথনদেব প্রশ্ন করলেন, এই সংবাদ
সত্য তো?
বিজ্বোহী কৈবর্ত ১৬৫
এ কি সত্য না হয়েপারে। গুঁভত্র উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
সমস্ত লোক এই নিয়েই বলাবলি করছে, পথের মোড়ে মোড়ে
লোকের ভিড় জমে গেছে।
খবরটা প্রথম নিয়ে এল কে, তার খোজ করুন ।
তার খোজ? তার খোজ পাওয়া সহজ নয় এখন। সেই প্রথম
সংবাদ বাহকটির কথা আমিও ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ।
ওরাও কেউ ঠিকমত বলতে পারল না। কিন্তু এ খবর কখনোই
মিথ্যা হতে পারে নী। আমরা রাজধানী থেকে অনেকট। দূরে ।
এখানকার লোক যে যার সাংসারিক ধান্ধ। নিয়ে ব্যস্ত। তারা এ
সব খবরাখবর রাখে না, আর এ সব নিয়ে মাথাও ঘামায় না। কিছু
বদি নাই হবে, তবে এমন একটা কথ এ ভাবে ছড়িয়ে পড়বে কেন?
মথনদেব বললেন, ঠিক কথাই। শুধু শুধু এমন একটা কথা
ছড়িয়ে পড়তে পারে না। কিন্তু ওরা কি বলছিল? বিদ্রোহীরা
রাজধানী অধিকার করে নিয়েছে? এই বিদ্রোহীরা কারা সে সম্বন্ধে
কেউ কোন কথা বলছে না?
বিদ্রোহীরা কারা, এ প্রশ্ন বাহুল্য মাত্র। আমর! ছাড়া আপনি
আর কারু কথা ভাবতে পারেন ? ন্ুভদ্র প্রশ্ন করলেন।
না, তা পারি না! আমি ভাবছি কিন্তু আমাদের সংগে কোন
রকম পরামর্শ না করেই-__
কাহু,রদেব বললেন, হয় তো! এমন কোন জরুরী পরিস্থিতির
উদ্ভব হয়েছিল ষার জন্য পরামর্শ করবার মত সময় ছিল না ।
অধিরথ বললেন, আমার কিন্ত একট! কথ মনে হচ্ছে। বন্দী
রাজকুমাররা হয় তো যে কোন ভাবেই হোক কারাগার থেকে বাইরে
বেরিয়ে এসেছেন। আর তাদের সামনে নিয়ে বিদ্রোহীরা আক্রমণ
করেছে। এমন এক একট! চূড়ান্ত মুহূর্ত আছে যা মানুষের ভয়,
ভাবনা, দ্বিধা» হিতাহিত বিবেচনা সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে
যেতে পারে।
১৬৬ বিজ্রোহী কৈবর্ত
খুবই সম্ভব। তা না হলে এমন হঠাং--উপগুপ্ত এই পর্যন্ত
বলেই থামলেন ।
স্ুভদ্র বললেন, আমার বিবেচনায় আমাদের এই মুহুর্তেই রাজ-
ধানীতে চলে যাওয়া,উচিত। রাজধানী অধিকার করাই আমাদের
একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমাদের এতদিনকার অভিযোগগুলি যাতে
মিটতে পারে, এবার সেই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
মথনদেব হেসে ৰললেন, হ্যা, এই মুহুর্তেই আমাদের চলে যাওয়া
উচিত। কিন্তু আমরা বড় জোর এই মুহুর্তে যাত্রা করতে পারি
মাত্র। খুব দ্রুত হেঁটে গেলেও গিয়ে পৌছতে অন্তত ছুটো দিন তো
লাগবেই । কিন্তু আমার মনে হয়, তার আগে খবরটা আমাদের
ভাল করে জেনে নেওয়৷ দরকার ।
অধিরথ সমর্থন করে বললেন, ঠিক কথাই বলেছেন আপনি ।
এখান থেকে স্থানীয় রাজপুরুষদের আস্তানা কত দূর ?
হু ক্রোশের কিছু বেশী হবে, সুভদ্র বললেন ।
একজন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে সঠিক খবরটা
আনিয়ে নেওয়। যায় না ?'
স্ভদ্র একটু ভেবে নিয়ে ৰললেন, হ্যা, তা পারা যায়।
তবে তাই করুন ।
বিহারের নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে একট ঘোড়া আছে। ঘোড়াটা
বুড়ো হয়ে এসেছে । তার উপর তার একটা পা একটু খোঁড়া । তা
হলেও ঘোড়া! তো।। একজন পরিচারক তামাটি গ্রামের উদ্দোশ্যে
ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এই তামাটিতেই রাজপুরুষদের আস্তানা ।
সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে তার ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে
লাগল । সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময় সেই লোক ফিরল। খবর
শুনবার জন্য কৌতৃহলী হয়ে সবাই তাকে ঘিরে দাড়াল ।
রাজপুরুষেরা কেউ সেখানে নাই, সব ভেগে গেছে।
বল কি, এই অবস্থা ! তা হলে কোন খবরই আনতে পার নি?
বিক্কোহী কৈবর্ত *৬৭
হু, আমি তেমনি কাচা ছেলে কিনা, খালি হাতেই ফিরে আসব।
আমি তখন তামাটি গ্রামের লোকদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
হ্যা গো, সঠিক খবর তোমর! বলতে পার? তারা বলল, আমরা
তামাটি গ্রামের লোক, সঠিক খবর আমরা বলতে পারব. না, কে
পারবে ! কিস্তু তার আগে বল, তুমি কে, কোথা থেকে আসছ?
আমি বললাম, আমি মধুপুর বিহার থেকে আসছি। শুনে সবাই
গড় হয়ে আমাকে প্রণাম করল, তারপর সঠিক খবর বলল। আমি
বললাম, একটা! কথা বললেই তো হোল না, এই খবরটা কেমন করে
পেয়েছ, কার কাছ থেকে পেয়েছ, সেই সব বৃত্তান্ত বল শুনি । আমি
'ফিরে গেলে .এই সব কথা আমাকে আবার জিজ্ঞেস করবে তো ।
শ্রোতারা অধৈর্য হয়ে উঠেছিল । একজন চেঁচিয়ে উঠল, আহা,
সঠিক খবরটা কি সেইটা! আগে বল না।
কিন্তু বক্তা সে কথায় কান দিল না, তার নিজস্ব পদ্ধতি অনুসারেই
সে বলে চলল ঃ ওরা বলল, আমাদের কাছে কোন বাজে খবর
পাবেন না। আমরা তামাটি গ্রামের মাস্ুষ, বাজে কথার ধার ধারি
না। আমরা রাজপুরুষদের মুখেই শুনেছি। যাবার আগে তারাই
আমাদের এই কথাগুলো বলে গেল কিনা । ওরা বিষম ভয়
পেয়েছিল।
স্ভদ্র এবার একটা কড়! ধমক দিয়ে বললেন, আগে তোমার
খবরটা বলে নাও, আর বাদ বাকী যত কথা পরে বলবে ।
হুভদ্বের ব্যবহারে মনংক্ষুঞ্ণ হয়ে সে বলল, খবরটাই তো! বলতে
যাচ্ছিলাম, কিন্তু এমন করলে কোন কথা বলা যায়!
অবশেষে যেই সঠিক খবরটা সে নিবেদন করল, তা শুনে সবাই
স্তস্ভতিত হয়ে গেল--এ বলে কি ! বরেকন্দ্রীর কৈবর্তেরা নাকি রাজধানী
গৌড় অধিকার করে নিয়েছে । রাজা মহীপালদেব যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত
হয়েছেন, এ খবরটা ঠিকই ।
শ্রোতাদের কয়েক জন বলে উঠল, তুমি ভুল শুনেছ, এ হতেই
১৬৮ বিদ্রোহী বৈবর্ত
পারে না। বরেক্দ্রীর কৈবর্তেরা এসে গোঁড় অধিকার করে নিয়েছে,
এ কি একটা কথা নাকি? এতই সাহস আর এতই শক্তি তাদের !
বৃদ্ধ পরিচারক তার কথার উপর এমন অনাস্থার ভাব দেখে দস্তর-
মত চটে উঠল । আমি যা বললাম এইটাই সঠিক খবর । এখন
তোমরা বিশ্বাস কর কি না কর, সে তোমাদের খুশী ।
খবরটা শোনার সংগে সংগেই মথনদেবের মুখ কালো হয়ে
গিয়েছিল। আর সবার মত কথাটা! তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন
না। আজই তাদের আলোচনার সময় এই আশংকাট। একবারের
জন্য তার মনের মধ্যে উকি মেরেছিল। কিন্তু এ অসম্ভব, এই কথ
বলে জোর করে তিনি তাকে চাঁপ1 দ্রিয়েছিলেন। অবশেষে সেই
আশংকাই কি সত্য হোল?
তিনি একটু ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, যেই কৈবর্তেরা
গৌড় অধিকার করল, তাদের নেতার নাম কি? কেতাদের চালনা
করে নিয়ে এসেছিল ?
হ্যা, ওরা বলেছিল বটে তার নামটা । আঃ কিছুতেই মনে করতে
পারছি না-_একটা বিতিকিচ্ছি নাম-্থ্যা, হ্যা, এইবার মনে পড়ছে,
তারণনাম দিব্বোক।
আর সন্দেহ রইল না । মথনদেব কপালে করাঘাত করে বললেন,
সর্বনাশ হয়েছে । এ যা বলেছে, সত্য কথাই বলেছে । অন্তত
আমার মনে তে৷ কোন সন্দেহ নাই। শেষ কালে আমাদের সোনার
গৌড় এই বর্ধরদের হাতে গিয়ে পড়ল ! হা অদৃষ্ট |
মথনদেবের কথা শুনে শ্রোতাদের মধ্যে উদ্বেগের গুঞ্নধবনি
উঠল । মথনদেবের আশংকাটণ যে অহেতুক নয়, তার চোখ মুখের
ভাব দেখে তা বুঝতে কারু বাকী ছিল না। এত কাল যেই
কৈবর্তের তাদের পায়ের লায় ছিল, এখন তারাই এসে তাদের
উপর শাসন চালাবে !
মথনদেব আবার প্রশ্ন করলেন, রাজা মহীপাল দেবের ভাই
'বিজোহী কৈবর্ত ১৬৪
শ্বরপাল দেব আর রামপাল দেব তীর্দের কোন খবর জান তুমি ?
তার! বেঁচে আছেন তো?
সে উত্তর দিল, না, তাদের কথা কেউ আমাকে বলে নি।
ওরা আক্রমণ করেছে কবে? কবে ওরা রাজধানী দখল করে
নিয়েছে?
কবে? আজ থেকে ঠিক তিন দিন আগে ।
মথনদেব অধিরথের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর আজ
তিনদিন বাদে সেই খবর আমাদের কাছে এসে পৌছল। দেখুন,
ভাগ্যের কি পরিহাস। তিন দিন আগে রাজ! মহীপালদেব নিহত
হয়েছেন, তার রাজধানী গৌড় পরহস্তগত হয়েছে, আর আমরা
আজ তার পতন ঘটানোর জন্ত কত আলোচনাই না করলাম !
কারাগারের নির্জন কক্ষের শয্যাহীন কঠিন মেঝের উপর শুয়ে
শুয়ে হরিগুপ্ত তার জীবনের ছিন্র-বিচ্ছিন্ন স্মৃতির কুহ্ুম নিয়ে মালা
রচনা করে চলেছিলেন। এবার মৃত্যু অবধারিত, পরিত্রাণের কোন
পথ নাই। কিন্ত কই, মনের মধ্যে সেজন্ত তেমন কোন উত্দগ
নেই তো।
মৃত্যু যখন দূরে ছিল, তার সম্পর্কে মনে মনে কি ভয় আর
উৎকণ্ঠীই না ছিল ! কিন্তু এখন নিশ্চিত মৃতার সামনে দীড়িয়েও সেই
মন আজ শান্ত হয়ে এসেছে । কোন তাড়া নেই, ছটফটানি নেই,
শুয়ে বসে নিজের মনে চিন্তার জাল বুনে চলেছেন । এ অভিজ্ঞতা
জীবনে কোন দিন হয়নি, এখানে না! এলে কোন দিন হোতও না।
সংসারে আপন বলতে কেউ নেই তার! বাপ মা মারা গেছেন
বহুদিন আগে । ভাই বোন কোন দিনই ছিল না। বিয়ে করেন
নি, সংসারে নিতান্তই একা | সংগীর মধ্যে স্ত,গীকৃত চিকিৎসাশাস্ত্রের
গ্রন্থ আর তার রোগী ও রোগিণীরা। এর মধ্যে কেমন করে জড়িয়ে
পড়লেন রাজনৈতিক আবর্তে । আর তারই ফলে গোৌঁড়ের ন্ুবিখ্যাত
নি বিজবোহী কৈবর্ত
রাজবৈদ্ত হরিগুপ্ত আজ কারাগারে নির্জন বন্দী, আর মৃত্যু পায়ে
পায়ে এগিয়ে আসছে তার সামনে ।
বিম ঝিম ঝিমস্্ঘুম নেমে আসছে চোখে । ঘুমের কোমল,
মন্থণ পথে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছিলেন । কিন্তু হঠাৎ যেন একটা ঘা
খেয়ে সচকিত হয়ে উঠে বসলেন। সমস্ত কারাগার জুড়ে কিসের
একটা দাপাদাপি আর মাতামাতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্যাপার কি,
এমন গোলমাল কিসের? গোলমালটা! যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে ।
কতগুলো পায়ের শব্দ তার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। হ্থ্যা, তারই
ঘরের দিকে । এবার কি তবে সত্যসত্যই ডাক পড়েছে তার?
পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হবে? সংগে সংগে মনের আকাশে
একটি মুক্তি স্বর্ণ রেখায় ফুটে উঠল। এমনি করেই দিবসে নিশীথে সে
বার বার তার কাছে আসে- আসে যায়, যায় আসে--তার নির্জন
মুহূর্তগুলিকে আনন্দে বেদনায় অভিষিক্ত করে দেয়। কিন্তু যাবার
সময় যদি হয়েই থাকে, তবে আর কৈন ? রূপৈশ্বর্ষময়ী এই পৃথিবীর
মতই সেও মিলিয়ে যাক। যাঁক সব যাক । শুধু একটি মাত্র কামনা,
বার্ঝর সময় যেন সহজ্জ ভাবে চলে যেতে পারেন। ছিচ কীছনে
শিশুর মত জীবন নিয়ে বায়না ধরা, এ বড় লজ্জার কথা, বড়
অমর্যাদার কথা ।
তালাচাবির ঝন্ ঝন্ শব্খ, তার পর ঘরের দরজাট! খুলে গেল ।
হরিঞ্চপ্ত অবাক হয়ে দেখলেন রামপাল দেব, শুরপাল দেব এবং
আরও কয়েক জন সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, আর তাকে ডেকে
বলেছেন, আস্মুন, বাইরে বেরিয়ে আন্মুন। আমরা মুক্ত । আমরা
মুক্ত ।
তার অর্থ? কি বলছে সব এরা? হরিগুপ্ত অভিভূতের মত
বাইরে বেরিয়ে এলেন।
আমরা মুক্ত, ওরা আবার বলে উঠলেন।
শুধু মুক্তিই নয়, তার চেয়েও বিস্ময়কর ও রোমাঞ্চকর কতগুলি
বিজ্বোহী বৈবর্ত ১৭১
সংবাদ তার জন্ত অপেক্ষা করছিল। বরেন্্ী থেকে কেবর্তের!
রাজধানী আক্রমণ করেছে । নগর থেকে এক ক্রোশ দূরে ছ পক্ষে
সংঘর্ষ হয়েছিল, গৌড়ের সৈম্তেরা পরাজিত হয়েছে। রাজ
মহীপাঁলদেব যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছেন । বিজয়ী কৈবর্তেরা
নগরের দিকে ছুটে আসছে, এখনই এসে পড়বে । ওদিকে আর
এক সংবাদ ! আর এক দল কৈবর্ত এই স্থযৌগে নগরের উত্তরাংশে
ঢুকে পড়েছে । তাদের সংগে নগরবাসীদের হাতাহাতি লড়াই
চলেছে। কিন্তু বুথ, এখন আর তাদের কে ঠেকিয়ে রাখবে !
এক সংগে এতগুলো সংবাদ হজম করতে হোল । সময় নেই, ওরা
এসে পড়েছে, বা কিছু করবার এই মুহূর্তে করতে হবে। পাঁচজন
সশস্ত্র ঘোড়মওয়ার প্রহরী রাজকুমারদের নিয়ে নগর ত্যাগ করবার
জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। রাজকুমারদের জন্য ছুটে! ঘোড়া দাড়িয়ে
আছে । ওরা বার বার মাটিতে খুর ঘর্ষণ করে নিজেদের অধৈর্য
প্রকাশ করে চলেছে! আসন্ন বিপদের আভাসটা ওরাও যেন টের
পেয়ে গেছে । রাজভক্ত নগরবাসীর! দল বেঁধে দাড়িয়ে আছে।
তারাই কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্ত করে দিয়েছে। হরিগুপ্ত মার
অন্তান্ত বন্দীদের সংগে নিয়ে তারা নগর ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে
চলে যাবে। তাদের সবার হাতেই অস্ত্রশস্ত্র । প্রয়োজন হলে যুদ্ধ
করতে করতে শক্রদের ঝেষ্টনী ভেংগে বেরিয়ে যাবে ।
যাত্রার পূ মুহুর্তে রাজপ্রাসাদের কথা উঠল। রামপালদেব
আর শুরপাল দেবের স্ত্রীদের অনেকদিন আগেই তাদের পিত্রালয়ে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের জন্য চিস্তা নাই। কিন্তু মা?
রামপালদেব ইতস্তত করছিলেন। একজন নগরবাসী বলে উঠল,
শুনেছি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সবাই চলে গেছে । তিনিও নিশ্চয় সেই
সংগে গিয়েছেন। তার জন্য ভাববেন না। ভাববার সময়ই বা
কোথায়! আক্রমণরকারীদের বিকট উল্লাস ধ্বনি ভেমে আসছে ।'
সেই ধ্বনি কারাগারের প্রাচীরে প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে আরও ভয়া-
১৭২ বিক্বোহী কৈবর্ত
বহ রূপ ধারণ করল। ওরা এসে পড়েছে । রাজকুমাররা ঘোড়ার
উপর লাফিয়ে উঠলেন। তারপর সেই ক্ষুত্র অশ্বারোহীদল ঘোড়ার
খুরে আগুনের ফিন্কি ছুটিয়ে বিদ্যৎবেগে অপৃশ্য হয়ে গেল।
তাদের পিছন পিছন ছুটল বাকী লোকেরা । হরিগুপ্ড তাদের
সংগ্েই চললেন । চারদিককার এত ব্যস্ততা, ছুটাছুটি, হাঁকাহাকি,
ডাকাডাকি, এর মাঝখানে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতই হয়ে গিয়েছিলেন ।
নিজের শক্তিতে পথ চলছিলেন না, জনপ্রবাহ তাকে টেনে নিয়ে
চলেছিল। যেতে যেতে রাজপ্রাসাদের উঁচু চুড়াটা চোখে পড়তেই
তিনি থমকে দাড়িয়ে পড়লেন। আক্রমণকারীদের বিকট চীৎকারে
সারা নগর তখন কেঁপে কেপে উঠছে । ভয়ার্ত জনত৷ প্রাণ বাচাবার
ব্যাকুল আগ্রহে উ্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে । তার মধ্যে কে গেল আর
কে রইল, সে খবর কে নেয়!
হরিগুপ্ত চারিদিকে দেখলেন, সমস্ত পথ শুন্য, কোথাও একটা
লোক দেখা যায় না । সেই সীমাহীন শুন্ততার মাঝখানে তিনি একা
দাড়িয়ে আছেন । রাজপ্রাসাদের স্বর্ণ-বর্ণ উন্নত চুড়াটা আবার তার
চেমশখ পড়ল । কি দূনিবার তার আকর্ষণ ! মুহুর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির
করে নিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদ লক্ষ্য করে ছুটলেন।
নগরের রাজপথের মতই সমস্ত রাজপ্রাসাদ জনশূন্য । রাজবৈদ)
তিনি, এই রাজপ্রাসাদে কতবার তাকে আসতে হয়েছে, কিন্তু এমন
শূন্যতার দৃশ্য কোন দিনই তার চোখে পড়েনি। সিড়ি বেয়ে তর
তর করে উপরে উঠলেন, কিন্তু কোথাও কেউ নেই। রাজপ্রাসাদ
পরিত্যক্ত, এ খবর তো! আগেই পেয়েছিলেন, কিন্ত তবু এমন একটা
দষ্ট তিনি কল্পনা! করতে পারেননি । তবে কি বৃথাই তিনি এসেছেন ?
ছুটতে ছুটতে রাজপ্রাসাদের উত্তর প্রান্তের সেই অতি পরিচিত
আর অতিপ্রিয় কক্ষটির কাছে আসতেই তাঁর পা ছুটে! অচল হয়ে
গেল। দরজার উপর একট! তাল। ঝুলছে । বাইরে তাল! বন্ধ
আর ভিতরে মানুষ থাকবে, এ কি কখনও হয়! তাও হয় বই
বিভ্বোহী কৈবর্ত ১৭৩
কি। কারাগারে এই অবস্থাতেই তো তাদের থাকতে হোত ।
আর সব ঘরের দরজাগলো হা করে আছে, এই একট! ঘরেই ব।
তাল! ঝুলছে কেন? হরিগুপ্ত এবার দ্রুত পদে সামনে এগিয়ে গিয়ে
বন্ধ দরজাটার উপর ঘন ঘন করাঘাত করে চললেন।
কে? কে? ভিতর থেকে অতি পরিচিত কণ্ঠের প্রশ্ন শোন। গেল ?
হরিগুপ্ত রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন, তবে তাঁর আসাটা ব্যর্থ হয় নি।
পায়ের শব এগিয়ে আসতে আসতে দরজার কাছে এসে থেমে
গেল। দরজার ফীক দিয়ে ছু জনই ছু জনকে দেখতে পেলেন ।
ংখ দেবী বিস্মিত কণে প্রশ্ন করলেন, আপনি ? এমন সময়
আপনি এখানে কেন?
দাড়ান, পরে কথা হবে। হরিগুপ্ত দরজ1 ছেড়ে বিপরীত দিকে
ছুটে গেলেন। তারপর ধোঁজাধুজি করে একট! লোহার ভা নিয়ে
ফিরে এলেন । ছুটে। ঘ। মারতেই দরজার তালাট। ভেংগে খসে
পড়ল। বাইরে বেরিয়ে এলেন শংখ দেবী ।
আপনাকে এ ভাবে তালা বন্ধ করে রাখল কে?
শংখ দেবী হেসে বললেন, চিঠিটা ধরা পড়বার পর থেকে এ
অবস্থাতেই থাকতে হচ্ছে।
আর সবাই প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্ত
আপনাকে ফেলেই চলে গেল !
যেযার প্রাণ নিয়ে পালাবার জন্য অস্থির, এ সময় আমার কথা
কার মনে পড়বে!
কিন্ত সে কথা যাক, আপনি মুক্ত হয়েছেন দেখতে পাচ্ছি।
রামপালের খবর বলুন।
হরিগুপ্ত উত্তর দিলেন, রামপাল দেব, শুরপাল দেব এবং অন্যান্য
বন্দীরা নিরাপদে নগর ত্যাগ করে চলে গেছেন ।
লুসংবাদ । কিন্তু ওরা সবাই নগর ত্যাগ করে গেল, আর এ
সময় আপনি এখানে কেন?
৪১৭৪ বিভ্রোহী কৈবর্ত
শংখ দেবী উদ্বিগ্ন কণে প্রশ্ন করলেন, ওদের চীৎকার শুনে মনে
হচ্ছিল, ওর। নগরের খুব কাছে এসে পড়েছে !
হরিগুপ্ত শান্ত কে বললেন, ওরা কতক্ষণ হয় নগরের মধ্যে
প্রবেশ করেছে |
সে কথা জানবার পরেও আপনি এখানে এলেন কেন ? শংখ
দেবীর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কেপে উঠল ।
আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য | .আমার ভয় ছিল্--এখন দেখছি
ভয়টা মিথ্যা নয় ।
আবার ওদের চীৎকার শোনা! গেল। এবার রাজপ্রাসাদে
একেবারে কাছে।
ওরা যে এসে পড়েছে । শংখ দেবী বলে উঠলেন।
হ্যা ওই যে ওদের দেখা যাচ্ছে । মনেহচ্ছে ওরা এদিক লক্ষ্য
করেই ছুটে আসছে।
কি করবেন, কোথায় যাবেন, চলুন ।
হরিগুপ্ত সামনে এগিয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চারদিকটা দেখে
নি ফিরে এসে বললেন, আর কিছুই করবার নাই, ওরা প্রাসাদ
ঘিরে ফেলেছে?
এখন ?
এখন ? এখন মরবার জন্য প্রস্তত হতে হবে।
শংখ দেবী উত্তর দিলেন, মরবার জন্য কোন বিশেষ প্রস্তুতির
প্রয়োজন করে না। কিন্ত আপনি জেনে শুনে এই আগুনে ঝাপ
দিয়ে পড়লেন কেন? মেয়ে মানুষ বলে আমাকে হয়তো ওরা
কিছু বলবে না, কিন্ত আপনাকে তো! ছাড়বে না। বলুন, কেন
এলেন ?
হরিগচপ্ত কোন উত্তর দিলেন না।
বলুন, আমার কথার উত্তর দিন। বলুন, কেন এলেন ? হরিপ্রপ্তের
চোখের উপর চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শংখ দেবী ।
বিক্োহী কৈবর্ত টার
আমি জানি না হরিগুপ্ত স্মলিত কষ্টে উত্তর দিলেন, কিন্ত শংখ
(দেবীর দৃষ্টি থেকে তার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন ।
হরিগ্যপ্তের এই সংকোচটুকু শংখদেবীর দৃষ্টি এড়াল ন1। ছুর্ষোগের
ঘনঘটার মধ্যে বিছ্যুৎ ক্ষুরণের মত যৃছ হাসি তাঁর ঠোটে খেল! করে
গেল। আর কোন কথা না বলে শংখদেবী ঘরের মধ্যে প্রবেশ
করলেন । কিছুক্ষণ পরেই একটা! পুটলী হাঁতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন
তিনি। হরিগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে তার কার্ধকলাপ লক্ষ্য করছিলেন ।
এটা আবার কি? এ দিয়ে কি হবে?
এর মধ্যে আমার সঞ্চিত মণি-মাণিক্য রয়েছে। এ আমার
ভবিষ্যতের সমন্ঘল।
ভবিষ্যৎ?
হ্যা, যতক্ষণ আমি আছি, আমার ভবিষ্যংও আছে । এই বলে
পু'টলীটা হরিগুপ্তের হাতে দিয়ে বললেন, এই নিন ধরুন। হ্যা
এবার চলুন ।
কোথায় যাবেন? হরিগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ওরা যে
"আমাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে আর ক্রমেই কাছে এগিয়ে
আসছে । এর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব । আপনি নিজেই
দেখুন না। হরিগুপ্ত হাত তুলে সামনের দিকে দেখালেন ।
কোন কথা বলবেন না, আপনি আমার পিছন পিছন চলে
আন্মন ৷ শংখ দেবী সামনে এগিয়ে গেলেন। হরিগুপ্ত হতবুদ্ধির মত
তার অনুসরণ করে চললেন ।
উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন হুজন। প্রাসাদের
পশ্চিমাংশে একটি স্ষুদ্রাকৃতি কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে শংখ দেবী
ভিতর থেকে দরজাটা! বন্ধ করে দিলেন । অন্ধকার হয়ে গেল ঘরটা।
ও আপনি এখানে আত্মগৌপন করে থাকতে চান? কিন্তু সে চেষ্টা
বৃথা। ওরা! ধনরত্বের আশায় সমস্ত প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খু'জে দেখবে।
'তা ছাড়া ওরা! তে। এই প্রাসাদে বসবাস করবে। এখানে হইছুরের মত
১৭৬ বিজ্রোহী কৈবর্ড
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে, সে আমার সইবে না। প্রকাশ্ডে
দিবালোকে মরতে চাই। চলুন, বাইরে চলুন ।
মরতে চাইলেই মরা যায় না, বলে শংখ 'দেবী হরিগুপ্তের হাতের
পুটলীট৷ থেকে একটা বাতি আর চকমকি পাথর বার করে বাতিটা
ধরালেন। উজ্জল হয়ে উঠল ঘরটা।
ঘরের কোণায় একট! প্রশস্ত লোহার পাত পড়ে আছে । সেটার
দিকে অংগুলি করে শংখ দেবী বললেন, নিন, ওটাকে টেনে সরিয়ে
নিয়ে আন্ুন এদিকে ।
কেন?
আঃ আবার প্রশ্ন! কোন কথা নয়, যা বলছি করুন।
হরিগ্প্ত আর কোন কথা না বলে লোহার পাতট। টেনে নিয়ে
এলেন। সংগে সংগে একটা গোপন পথ উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল।
সিঁড়ির পর সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গিয়েছে । এতক্ষণে রহস্থাটা
পরিক্ষার হয়ে গেল, হরিগপ্তের হতাশ মনে আশার আলে দেখা
দিল। তিনি বললেন, বাতিট! আমার হাতে দিন। আমিই আগে
নাগি।
উদ আপনি পারবেন না, এ পথ বড় জটিল, আপনাকে পায়ে
পায়ে ছু'চোট খেয়ে মরতে হবে। এ পথের সংগে আমার ঘনিষ্ঠ
পরিচয় আছে। আমি আপনাকে ঠিক ভাবেই নিয়ে যেতে পারব।
আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু এখন থেকে
আপনার পরিচালনার ভার আমিই নিয়ে নিলাম।
দশ
পদ্পনাভ ঘটনার ছু দিন আগে তীর গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন।
তীর সংসারের লৌকজন সবাই সেখানে থাকে । নগর থেকে তার
গ্রাম প্রায় তিন ক্রোশের ব্যবধান । ঘটনার দিন তার নগরে ফিরে
আসার কথ ছিল, কিন্তু বিশেষ কাজে আটকা পড়ে যাওয়ায় ফিরতে
পারেননি । অথচ ফিরে আসাটা খুবই প্রয়োজন ছিল। সেই জন্য
সেদিন রাত্রি থাকতেই যাঁত্র। করেছিলেন, যাতে সকাল বেলাই
নগরে গিয়ে পৌছতে পারেন ।
এ পথে লোকের বনতি খুবই কম। মাঠের পর মাঠ। বেশীর
ভাগ মাঠই পতিত পড়ে আছে। ছুপাশে ঝোপ ঝাড়, জংগল
আর জল ভূমি । তার মধ্য দ্রিয়ে পথ। নগরের কাছাকাছি
বখন এসে পৌছলেন তখন সূর্য কিছুটা উপরে উঠেছে ।
পল্মনাভ স্বভাবতই একটু অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক। বিশেষ
করে পথ চলবার সময় তার স্বভাবট1? আরও বেশী করে প্রকট হয়ে
ওঠে। তা না হলে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটা বিশেষত্ব তার দৃষ্টি
এড়াতে পারত না। এ সময় রাখালের দল বেঁধে এখানে গরু,
মোষ ইত্যাদি চরাতে আসে । কিন্ত আজ যে দিকেই তাকানে।
যাক না৷ কেন, একটা গরু নেই, একট মানুষ নেই, চার দিক খা খা
করছে। কিন্তু তীর নিজের মনট! পূর্ণ ছিল বলেই হয়তো মাঠের
এই শুন্যতা তার নজরে পড়ল না ।
মাঠের পর মাঠ ভেংগে অবশেষে নগরের উপকণ্ে এসে
পেঁছলেন। রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সচেতন হয়ে
উঠলেন তিনি। ব্যাপার কি? অন্য দিন এ সময় এখানে ওখানে
১২
১৭৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
লোকের ভীড় জমে উঠতে থাকে । কিস্ত আজ একটা লোকেরও
দেখা নেই, এরা সব গেল কোথায়? বেশ বড় একখান! বাড়ী, তার
সামনের দরজাটা ভাংগা। উঁকি মেরে দেখলেন, ভিতরে কোন
লোক আছে বলে মনে হোল না। অথচ বেশ মনে পড়ছে, সেদিন
যখন এই বাঁড়ীটার পাশ দিয়ে গেছেন তখন বাড়ীটা লোকজনে
জমজমাট ছিল। এরই মধ্যে কি হোল আবার 1
উপর দিকে তাকাতেই একট! জিনিস বিশেষ ভাবে তার দৃষ্টি
আকর্ষণ করল । নগরের মাথার উপর বনু শকুন উড়ছে । শুধু উড়ছে
নয়, ওরা ঘুরে ঘুরে নগর লক্ষ্য করে নীচের দিকে নেমে আসছে ।
এমন তো কোনদিন দেখেন নি । এসব কিসের ছুল ক্ষণ ? পথের একট!
মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল তার সামনে একেবারে পথের উপরেই
একদল শকুন গোল হয়ে ভোজের উৎসবে মেতেছে । কুকুর বা অন্য
কোন পশুর মৃতদেহ হবে। সামনে যেতেই শকুনগুলি সসম্ভ্রমে তার
জন্য পথ করে দিয়ে সরে টাড়াল। কিন্ত এ কি দৃশ্ট ! শিউরে উঠলেন
পল্পনাভ। এ যে মানুষের মৃতদেহ ! চুল দাড়ি দেখে বোঝা গেল
লোকটি বৃদ্ধ। ওর! তীর পেটের নাড়িভু'ড়ি ছিড়ে ছি'ড়ে খাচ্ছিল ।
নগর নয়, নগরের উপকণ্, তা হলেও রাজধানীর উপকণ্ঠের পথের
উপর মামুষের মৃতদেহ নিয়ে শকুনে ছেঁড়াছিড়ি করে খাবে এটা
কল্পনাতীত। আকাশে এত শকুনের সমাগমের কারণটা এবার বোঝা
গেল। কিস্ত শকুনগুলে৷ নগরের বিভিন্ন অংশে নামছে বলেই যেন
মনে হচ্ছে । তার মানে কি? নগরের নানা জায়গায় কি তবে মানুষের
মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে আছে? তবে কি নগরে কোন মহামারী দেখ
দিয়েছে? কিন্ত মাত্র তিন দিন হয় তিনি নগর ত্যাগ করে বাইরে
গিয়েছিলেন, তখন তেমন কোন ব্যাধির প্রকোপ ছিল না, আর এরই
মধ্যে এমন ব্যাপক মহামারী দেখা দিল, তাই বা কেমন করে সম্ভব !
কিছু সাংঘাতিক কোন একটা ছুর্ঘটন! ঘটে গেছে, সে বিষয়ে কোনই
সন্দেহ নেই। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে একটা লোককেও তো!
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৭৯
দেখা যাচ্ছে না, কোথায় গেল তারা? সবাই কি পালিয়ে গেছে?
কিন্ত কেন? পথের মাঝখানে হতবৃদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইলেন তিনি ।
হঠাৎ একট। কোলাহলের শব্দে তার ধ্যান ভেংগে গেল। পিছন
ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, কয়েকজন কৈবর্ত হল্লা করতে করতে ছুটে
আসছে। একট! নতুন দৃশ্য বটে । আজকাল বরেন্দ্রীর কৈবর্তদের
রাজধানীর বুকের উপর খুব কমই দেখা যায়। যাঁক ভালোই হয়েছে,
আম্মক ওরা, ওদের মুখে হয়তে। নগরের খবর পাওয়। যেতে পারে।
কিন্তু ওর! এমন করে ট্যাচাতে চ্যাচীতে ছুটে আসছে কেন? ওর।
যখন দলবেঁধে শিকারের পিছন তারা করে, তখন এমনি করে ওর!
ছোটে । প্রশ্নটার উত্তর পেতে দেরী হোল না। দেখতে দেখতে ওর!
যখন তাকে এসে ঘিরে ধরল তখন ওদের চোখমুখের ভাব দেখে
বুঝতে বাকি রইল না যে ওর! শিকারের সন্ধানেই এসেছে, আর
তিনিই এখন ওদের শিকার । ওদের সকলের হাতেই কোন না কোন
রকম অস্ত্র ।
বরেন্দ্রীর কৈবর্তদের সঙ্গে একদিন যথেষ্ট পরিচয় ছিল তার। কি
স্ন্দর ওদের ব্যবহার ! কত দিন কত জনার কাছে ওদের কথা বুলাতে
বলতে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছেন তিনি । কিন্তু এ মানুষগুলে! যেন সে
মানুষ নয়। ওদের চোখে কি হিং দৃষ্টি! ওরা তাকে শিবিক। থেকে
টেনে নামিয়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল । এদিকে শিবিকাবাহীরা
শিবিক। ফেলে উধ্বশ্বাসে ছুটছে । আত্মরক্ষার সহজাত সংস্কীরের
বশে পদ্মনাভ এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বললেন, কি
চাস্ তোরা ?
সংগে সংগে পিছন থেকে তার পিঠের উপর একটা মুগ্চরের প্রচও
ঘা পড়ল। চোখে অন্ধকার দেখলেন পদ্মনাভ। দাড়িয়ে থাকার
শক্তি ছিল না, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যেতেন, কিন্তু ওর! তাকে পড়তে
দিল না, হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল।
পল্পনাভ চেতন আর অচেতনের প্রত্যন্ত সীমায় অবস্থান
১৮৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
করছিলেন ! ওরা তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে, কোন্ দিকে চলেছে,
কি তীর পরিণতি সে কথা বুঝবার মত শক্তি তীর ছিল না। কি
আশ্চর্য, সেই অবস্থাতেই মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় গল্প শুনে-
ছিলেন মৃত্যুর পর নরকের যমদূতের! পাপীদের এমনি করেই নাকি
টেনে নিয়ে যায়। চোখের সামনে ঝাপসা! অন্ধকার, তবে তার মাঝে
ছুটো একটা ছবি বিহ্যনত্ের মতই ভেসে উঠছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল।
একবার পায়ের তলায় নরম কি 'একটা ঠেকল। চেয়ে দ্রেখলেন-_-
ভগবান এ কি দেখালে তুমি--একটি শিশুর মৃতদেহ । আবার সেই
মৃতদেহ! তবে কি সারা নগরের রাজপথই মুতদেহে বিকীর্ণ হয়ে
আছে! একবার সন্দেহ হোল, তিনি জীবিত আছেন তো? তার
দেহটা সংগেই আছে, না রাজপথে কোথাও পড়ে আছে, তাই নিয়ে
শকুনীদের উৎসব চলেছে ? না, শরীরটা তার সঙ্গেই আছে, মাথার
উপর একটা আঘাত পড়তেই সে কথা উপলব্ধি করতে পারলেন ।
যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করে পদ্মনাভ জ্ঞানহারা হয়ে পড়লেন ।
বখন জ্ঞান ফিরে এল, পদ্মনীভ দেখলেন, বড় একটা ঘরের
শৃন্ত মেঝের উপর তিনি পড়ে আছেন। তিনি একা নন, আরও
অনেক লৌক সেই ঘরের মধ্যে ঠাসাঠাসি হয়ে পড়ে আছে। তার
জ্ঞান হতে দেখে অনেকগুলি দিশাহারা ভয়ার্ত মুখ তার সামনে এসে
ঝ একে পড়ল ।
এরা তাকে সবাই চেনে । রাজ্যের মহা সান্ধিবিগ্রহিক, তাকে না
চিনবে কে? পগ্পনাভ নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার
উত্তরীয় বাস নেই, পরণের ছেঁড়া কাপড়টা কোনমতে লজ্জা নিবারণ
করছে। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত, এখানে ওখানে দল। দলা রূক্ত
জমে আছে। সমন্ত শরীর জুড়ে হাড় পর্যস্ত অসহা বেদনা । কিন্তু
সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠল কৌতৃহল । একটু একটু করে সমস্ত
বৃত্তান্ত তিনি শুনলেন ।
এট কারাগার-গৃহ। এ ঘরে যারা, তার! সবাই তারই মত
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১০৪
বন্দী। এদের মধ্যে রাজপুরুষ আছে, সৈন্য আছে, সাধারণ নাগরিকও
আছে। এরাই সব নয়, অন্যান্য ঘরে নাকি আরও বন্দী আছে।
কিন্ত রাজপথে যাদের মৃতদেহ পড়ে আছে তাদের সংখ্যা এর চেয়ে
বহু গুণ বেশী । সবাই সেই কথাই বলছে।
এমন অবিশ্বাস্ত ব্যাপার কেমন করে ঘটল 1 ওদের অশিক্ষিত
পদাতিক বাহিনী গৌড়ের শ্ৃশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনীকে কেমন
করে পরাজিত করল? পদ্মনাভ প্রশ্ন করলেন !
একজন উত্তর দিল, ওদের সংগেও অশ্বারোহী সৈন্ত ছিল।
অশ্বারোহী কৈবর্ত সৈম্ত ? বলছ কি ভে'মরা ?
ন। না কৈব্র্ত নয় তার1। শুনেছি গীঠি-রাজ দেবরক্ষিত কৈবর্ত-
দের সাহায্য করবার জন্য তার অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়েছিলেন ।
বণিক মধূদত্ত গীঞ্চিরাজ্য থেকে ফিরে এসে রূদোক সম্পর্কে যে
সংবাদট1 দিয়েছিলেন, পদ্পনাভের সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
ঘটনাচক্রে সেই সংবাদটা তার কাছে এসে পৌছেছিল। তার যে
কতট। গুরুত্ব ছিল, তা এখন পরিঞ্ষার বোঝ! যাচ্ছে। পল্পনাভ এ
নিয়ে বরাহস্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি এটাকে
একেবারে হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বরাহস্বামী তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন
সন্দেহ নাই, কিন্তু কৈবর্তদের ব্যাপারটাকে সব সময়ই তিনি লঘু
দৃষ্টিতে দেখে এসেছেন । সব সময়ই বলে এসেছেন, এরা বর্বর । এদের
জন্য অতিরিক্ত ছুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোন কারণ নাই। তার মনে যে
ধারণ! একবার বদ্ধমূল হয়ে বসে, তা থেকে তাকে বিচলিত করা!
কারু পক্ষেই সম্ভব হয় না।
ব্রাহস্বামীর কথাটা! মনে পড়তেই পদ্মনাভ প্রশ্ন করলেন, বরাহ-
স্বামী নিরাপদে আছেন তো ?
ওর! কয়েকজন এক সংগে বলে উঠল, বরাহস্বামী ? তিনি বেঁচে
নেই। কৈবতেরা তাদের দলটাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল।
বরাহস্বামী যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছেন। পদ্মনাভ স্তব্ধ
১৮২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
হয়ে গেলেন। কতক্ষণ পর্যস্ত তার মুখ দিয়ে কোন কথ!
ফুটল ন1।
বন্দীদের মধ্যে নানা! জনের নান। অবস্থা ৷ গুরুতর আহত যারা,
তারা শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। কেউ কেউ শিশুর মত কান্নাকাটি
করছে, কেউ বা পাথরের মৃত্তির মত নিশ্চল হয়ে বসে আছে।
অনেকেই এসে ঘিরে ধরেছে পদ্মানাভকে | এখানে তিনিই সব চেয়ে
বিশিষ্ট ও বিচক্ষণ লোক । সবাই তার কাছ থেকে কিছু কিছু আশার
বাণী শুনতে চাইছে।
একজন বলছিল, ওর! কি আমাদের হত্যা করবে ? আপনি কি
তাই মনে করেন? কেন, আমরা কি করেছি ?
পদ্মনাভের এত ছুঃখের মধ্যেও হাসি পায়। হত্যার জন্ত কি
কোন অপরাধ করার প্রয়োজন আছে? যাঁরা নিহত হয়, তাদের
মধ্যে ক'জন আর দোষী 1?
সেই স্রকোমলদেহ শিশুটি, যার স্পর্শ এখনও তার গায়ের সংগে
লেগে আছে, এ সংসারে কার কাছে কি দোষ সে করেছিল ?
“কি বলবেন পল্পনাভ ? ওদের হতাশ করতে মনে ব্যথ! লাগে ।
কিন্তু মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বুঝেও
আশার কথ! শোনানো, তার মধ্যেও যেন একটা নিষ্ঠুরতা আছে।
বন্ধ দরজাট। খুলে ক'জন কৈবর্ত ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল । সবার
আগে যে, পোশাকে আর চাল চলনে তাকে একটা নেতা গোছের
লোক বলেই মনে হয়। কুচ. কুচে কালো রং এমন কালো
কৈবর্তদের মধ্যেও সুলভ নয়। তার বাবড়ী চুলের বাহারট1 বিশেষ
করে লক্ষ্য করবার মত। ওরা ঘরে ঢুকতেই যারা পল্পনাভকে ঘিরে
ধরেছিল, তার1 চোখের পলকে ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ
অক্ষট কবলে উঠল “পরভু? ।
এই তবে সেই পরভু, সেই বিখ্যাত দন্থ্যু, যার নাম গৌড়বাসীদের
কাছে হ্ুপরিচিত। তার ছুঃসাহসের কাহিনী লোকের ঘরে ঘরে, মুখে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৮৩
মুখে ছড়িয়ে আছে। পন্সনাভ তাকে ভাল করে দেখবার জন্য
বিস্কারিত দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন।
পদ্মনীভের দিকে অংগলি নির্দেশ করে ওরা! নিজেদের মধ্যে কি
যেন বলাবলি করছিল। একটু বাদেই পরতু গট গটু করে এগিয়ে
এল! তার দলবল তার পিছনে চলল । বন্দীরা ত্রস্ত ও সংকুচিত
হয়ে অরে গিয়ে তাদের পথ করে দিল। পদ্মনাভের সামনে এসে
দাড়িয়ে পড়ল পরতু, তারপর তার আপাদ মস্তক পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন
করল, তুমি এ রাজ্যের মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক ছিলে?
পদ্মনাভ বিশ্মিত হলেন, এরা কেমন করে এ কথাট। জানল ?
পরক্ষণেই মনে হোল বন্দীদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছে, তা
নইলে আর কেমন করে জানবে! তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যা ।
পরভূ আর কোন কথা না বলেই চলে গেল । পদ্মনাভ লক্ষ্য করলেন,
সে যাওয়ার আগে তাকে দেখিয়ে প্রহরীদের কাছে কি যেন বলল।
কি বলছে পরত? পন্মনাভ মনে মনে ভাবলেন ।
তার এই কৌতুহল মিটতে দেরী হোল না। পরভু চলে যাবার
ংগে সংগেই ছু জন কৈবর্ত প্রহরী এসে তাকে এ ঘর থেকে বাঞকরে
নিয়ে গেল। ঘরটা ছেড়ে আসবার সময় সমস্ত বন্দীরা এমন কাতর
ভাবে তীর মুখের দিকে তাকাল যে তার মনে হোল এবার তার ডাক
এসে গেছে, এ ভাক আর ফিরানো৷ যাবে না। কিন্তু না, যা!
ভেবেছিলেন, তা নয় ওরা তাকে নিয়ে কিছু দুরে আর একট। ছোট্ট
কুঠরীর মধ্যে পুরল | কুঠরীট। অন্ধকার, তার উপর বাতাস খুব কমই
ঢুকতে পারে। বড় ক্লান্ত লাগছিল, পদ্মনাভ ভিজে সীৎসেঁতে মেঝের
উপর আচ্ছন্নের মত পড়ে রইলেন।
কিন্তুংবেলা যতই বেড়ে চলল, ক্ষুধা তৃষ্ণাও প্রবল হয়ে উঠতে
লাগল। মনের কোণায় ক্ষীণ একটু আশ! ছিল, কিন্তু বৃথা, কেউ
কোন আহার্য বা পানীয় নিয়ে এল না। নিজের দিকে তাকিয়ে
নিজেই হাসলেন পন্মনাভ। মনে পড়ল অনেক দিন আগেকার
১৮৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
একটা! কথা । দেবীর মন্দিরে পূজো দেখতে গিয়েছিলেন, তখন তার
বয়স আর কত? কিন্তু সেই ছবিটা এখনও যেন স্পষ্ট তার চোখের
সামনে ভাসছে । একটু বাদেই বলি হবে। বলির ছাগশিশুটি
যুপকাষ্ঠের সংগে বাধা রয়েছে । কে যেন একটা কাঠালের ঘনপত্র
ডাল ওর সামনে এনে দিয়ে গেছে। ও মহ! আনন্দে সেই পাতা
চিবিয়ে চলেছে। ওর চোখে মুখে সেকি তৃপ্তি! সেদ্দিন ওর দিকে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার চোখ ছুটি জলে ভরে গিয়েছিল। বলির
বাজন। বাজাবার জন্য ঢাকী যখন তার প্রকাণ্ড ঢাকটা নিয়ে এসে
দাড়াল, তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন মন্দির ছেড়ে । সেদিন তার
আর পুজো৷ দেখা হোল না। আজ নিজেকে সেই নির্বোধ
ছাগশিশুটার মতই মনে হচ্ছে ।
কত দিনের কত কথাই যে মনে পড়ছে! ক্রমে বেল গড়িয়ে গেল.
ক্ষুধার তীব্রতাট! আগেকার চেয়ে কমে এল বটে, কিন্তু পিপাসা!
ক্রমেই বেড়ে চলল। শরীরের উপর দিয়ে আজ যে ধকলটা গেছে,
হয়তো! শরীরটা সেই জন্যই এত বেশী করে জল চাইছে ।
£বিকেল ছাড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্য! ছড়িয়ে রাত্রি নেমে এল । গলা শুকিয়ে
কাঠ হয়ে আসছিল। শরীরেকু মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে । তখন
কত রাত্রি কে জানে, নিজের অজান্তেই “জল? বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
কতক্ষণ বাদে বাইরে থেকে কে যেন ভাকল, এই যে, ও মানুষ
শোন, জল খাবে তো! সামনে এসো ।
কে, কে তাকে ডাকছে জল খেতে । এখানে, এমন সময়, এমন
বন্ধুকে তার আছে। বোধ হয় স্বপ্ন দেখছেন । হোক স্বপ্ন, তাও
ভাল। চুম্বকের টানে লোহা যেমন করে ছোটে, তেমনি করে তিনি
কুঠরীর দরজাটা দিকে ছুটে যেতে চাইলেন। গায়ের বেদনাট।
আরও বেড়েছে, জ্বরের দাহে সার! গ1 পুড়ে যাচ্ছে । উঠে দাড়াতে
পারলেন না, পশুর মত হাতে পায়ে ভর করে এগিয়ে গেলেন ।
দরজার বাইরে কৈবর্ত প্রহরী হাতে জলের পাত্র নিয়ে সামনের,
ধব্জ্রোহী কৈকর্ত ১৮৫
দিকে ঝ,কে দাড়িয়ে আছে। সামনেই ওর বাতিট! জ্বলছে, সেই
আলোতেই তিনি তাকে দেখতে পেলেন ।
এই যে আমি দরজার ফাক দিয়ে জল ঢেলে দিচ্ছি, তুমি হাত
পেতে নাও।
আঃ কি আরাম। অগ্রলি অঞ্জলি জল পান করে পল্মনাভের
প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ ক্ষিদের কথাট! মনেই ছিল না, এখন
তার খোচানি শুরু হয়ে গেল।
ঠিক তখনই প্রহরী প্রশ্ন করল, আজ তোমাকে কি দিয়েছে
খেতে?
পদ্পনাভ এ কথার কোন উত্তর দিলেন না।
ও, কিছুই দেয়নি বুঝি? আহা, সারাটা দ্িন। আচ্ছা, তুমি
তোমার জায়গায় গিয়ে বৌসো৷ আমি দেখছি ।
এই কথা৷ বলেই প্রহরী অদৃশ্য হয়ে গেল ।
দরজার সামনে বাতিট। উজ্জল শিখায় জ্বলতে লাগল । পদ্মনাভ
প্রহরীর কথার তাৎপর্ট। ধরতে পারেননি । আর ভিতরে যেতে
ইচ্ছা হোল না, দরজার কাছেই পড়ে রইলেন ।
একটু বাদেই সে ফিরে এসে ডাকাডাকি শুরু করল ওগো, ওঠো,
ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? পদ্লপনাভ ঘুমোননি, সাড়া দিলেন, কেন?
সময় হয়েছে? বাহারে যেতে হবে নাকি ?
বাইরে । বাইরে কোথায় যাবে?
আমাদের হত্যার সময় হয়নি এখনও ? কাজট! তাড়াতাড়ি শেষ
করলেই তো৷ চুকে যায়। আহা, আমি কি সেই কথা বলছি নাকি?
আমি তোমার জন্য খুঁজে পেতে কিছু খাবার এনেছি। নাও,
ওঠে! ।
পদ্মনাীভ ততক্ষণে উঠে বসেছেন । দেখছেন, সত্যিই তো?
একটা পাতায় করে কি যেন খাবার নিয়ে এসেছে । তিনি অবাক
হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ কি উল্টো পাল্টা
১৮৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
সব ব্যাপার । শক্রু পক্ষের লোক যার সংগে এখন শুধু প্রাণ দেওয়া
নেওয়ার সম্পর্ক সে তার জন্য এত করছে কেন? বাতির আলোয়
যতটুকু দেখা গেল, তাতে দেখতে পেলেন সেই বর্বর কৈবর্তের চোখ
ছটি থেকে স্সিগ্ধ সমবেদনা ঝরে পড়ছে ।
লোকটির বয়স হয়েছে, মাথার চুল কালোর চেয়ে সাদাই বেশী।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে পদ্মনাভের মনটা আবেগে ভারী হয়ে
উঠল ।
নাও, ধর, অমন করে চেয়ে রইলে কেন?
পদ্মনাভ প্রশ্ন করলেন, তোমার নামটি কি ভাই ?
এই দেখ, এখন নামের কোন্ দরকারট। পড়ল ? আমার নাম
অভিমন্ন। হোল তো, নাও।
পদ্মনাভ দরজার ফীক দিয়ে খাবারগুলে। নিয়ে খেতে লাগলেন ।
নিতান্ত সাধারণ খাস্ভ, কিন্তু অমৃতের মতই মনে হচ্ছে। একি শুধু
ক্ষিদের জন্তই, না অভিমন্র হাতের গুণ ?
খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে
গেস ওদের কথা যারা ওই ঝড় ঘরটায় আটক আছে। ওদের তো
কাল থেকে এ পর্ধস্ত কিছুই পেটে পড়ে নি, জলটুকু পর্যন্ত না । অমৃতে
আর রুচি রইল না, হাত তুলে বসে রইলেন ।
অভিমন্ন আপত্তি জানিয়ে বলল, ওটুকু আবার ফেলে রাখলে
কেন?
আর পারছি না, পদ্মনাভ আবার একটু জল চেয়ে নিয়ে থেলেন।
কতক্ষণ চুপচাপ কাটল। পদ্পনাভই প্রথম কথা বললেন,
আমাদের সবাইকেই হত্যা করা হবে, তাই না?
তাই তো শুনছি, অভিমন্ন সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
কেন?
এই “কেন'র উত্তরে কি যে বলা যায়, অভিমন্ন সম্ভবত তখনই
সেই কথাট! খুঁজে পেল ন1। একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, আমাদের
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৮৭
রাজা দিবেবোক এ সব বেশী পছন্দ করেন না! তার প্রথম থেকেই
আদেশ দেওয়া আছে, মেয়েদের আর বাচ্চাদের গায়ে হাত দিতে
পারবে না, কারু ঘরে আগুন দিতে পারবে না। যে এই নিষেধ
মানবে না তার কঠিন শাস্তি হবে। কিন্ত পরভু যে ক্ষেপে একেবারে
আগুন হয়ে আছে! এ আঞ্চন সহজে শান্ত হবার নয়। আর রাজা
দিব্বোক তাঁর কথ! একেবারে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন না।
কেন, পরভূ এমন আগুন হয়ে আছে কেন?
অভিমন্ন উত্তর দিল, হবে না! মানুষের চামড়া যার গায়ে আছে,
সে কখনও এ সব চুপ করে সয়ে যেতে পারে ? যে মেয়েটার সংগে
ওর ভাব হয়েছিল, এমন কি বিয়ের দিন পর্যস্ত ঠিক হয়ে গিয়েছিল,
তাকেই কিনা ওরা চুরি করে নিয়ে গেল। সেই ষে গেল তো! গেল,
আজ পর্যন্ত তার কোন খবর নেই । সে বেঁচে আছে, ন। মরে গেছে
তাও কেউ বলতে পারে না।
কারা চুরি করে নিয়ে গেছে? পদ্মনাভ প্রশ্ন করলেন ।
যার! চুরি করে নিয়ে গেছে, তারা তো৷ আর তাদের নাম লিখে
রেখে যায় নি। তবে এ কথা কারু অজান নেই, হয় রাজপুরুধ
নয় তো গৌড়ের বণিক, এ তাদেরই কাজ। তারা ছাড়া আর
কেই-বা করবে! কৈবর্তদের সমাজে এই রীতি কোন দিনই ছিল
না, আজও নেই। একটি ছুটি মেয়ে নয়, এ ভাবে কত মেয়ে যে
উধাও হয়ে গেছে, তার সীমাসংখ্যা আছে? মেয়েটাকে হারিয়ে
পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল পরভু। তার পরই তো৷ সে এই পথে
নামল।
এই তো একমাত্র কথা নয়, আরও অনেক কথা আছে। পরভুর
বাড়ী শিয়ালমারি গ্রামে । পরভুর গ্রাম বলে তোমাদের সৈম্েরা
সেই গ্রামের সমস্ত ঘর বাড়ী পুড়িয়ে ছাই করে দিল। সেই একটা
গ্রামে দেড় কুড়ি পুরুষ মেয়ে আর বাচ্চাকে ওর! ঘরের মধ্যে আটকে
রেখে সেই ঘরে আগুন দিয়ে তাদের পুরিয়ে মেরেছে । এই ভাবে
১৮৮ বিজ্বোহী কৈবর্ত
গ্রামের পর গ্রাম ওর! উচ্ছন্ন করেছে । বছরের পর বছর ধরে কি যে
অত্যাচার চালিয়ে এসেছে ওরা, সে সব কথা কি আর আমরা ভূলে
যেতে পারি! শুধু পরভুই তো! নয়, বরেন্দ্রীর সমস্ত মানুষ, কি
পুরুষ, কি মেয়ে, সবাই আগুন হয়েছিল। এই আমার কথাই ধর
না, এ সব মারামারি কাটাকাটি কোন দিনই আমার ভাল লাগত
না। কিন্ত এ সব দেখে শুনে-_ বিশেষ করে আমার বড় আদরের
ছোট ভাইটাকে মেরে ফেলবার পর আমি কি মানুষ হয়ে গেলাম !
রাত দিন শুধু এই কথাই বলতাম, ওলান ঠাকুর, ওলান ঠাকুর,
তোমার ইচ্ছায় সব চলে। তুমি তো যা খুশী তাই করতে পার।
তোমার কাছে আর কিছু চাই না, শুধু এইটুকুই চাই, আমাকে
আরও কিছু দিন বাঁচিয়ে রেখো । আর হাতের এই বলটুকু রেখো,
যেন তোমার আদেশে ওদের যখন নিপাত ঘটবে, তখন আমার এই
দ্টো৷ হাত দিয়ে আমি অন্তত ওদের একশোটাকে যেন মারতে
পারি। আমার গোষ্টির মানুষ, যাদের ওরা মেরে ফেলেছে, তাদের
আত্মা এতে শাস্তি পাবে। আমিও তাতে শাস্তি পাব। তার পর
দিনই যদি আমাকে মরতে হয় আমি কোন কথা বলব না, হাসিমুখে
মরে যাব।
পদ্মনাভ স্তম্ভিত হয়ে তার কথ শুনছিলেন। অভিমন্ন একটান।
এতগুলি কথ! বলে নিয়ে একটু থামতেই তিনি প্রশ্ন করলেন,
ক'জনকে মারতে পেরেছ এ পর্ষস্ত ?
ও কথা আর বোলো না। এই ছুটো দিন আমার চোখের
সামনে যা! দেখলাম 'আমি ক'জনকে মেরেছি সে কথা আমি নিজেই
জানি না। যখন আমরা নগরে এসে ঢুকলাম তখন প্রায় সবাই
নগর ছেড়ে চলে গিয়েছে । এখানে ওখানে কিছু কিছু বাকী ছিল।
আমাদের লোকের! ঘরে ঘরে ঢুকে তাদের শিকার খুজে ফিরছিল।
হঠাৎ কোথা থেকে তাড়া খেয়ে একট! লোক আমার পাশ দিয়ে
ছুটে চলে গেল। আমিও আমার তরোয়ালট! বাগিয়ে ধরে পিছন
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৮৯
পিছন ছুটলাম। বেশী দূর যেতে পারল না, কয়েক কদম ছুটে
গিয়ে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরলাম। ও ভয়ে থর থর কাপতে
লাগল, একট! কথাও বলতে পারল না, কিন্ত এমন করে আমার
মুখের দিকে তাকাল যে আমি পারলাম না, চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে
বললাম, যা চলে যা। ও তখনও ঠিক বুঝতে পারে নি, ঠিক
তেমনি ভাবে হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি
তাড়া দিয়ে বললাম, পালা! মরবি নাকি, পালা! ও তখন যে
দিকে চোখ যায়, উর্দশ্বাসে ছুটল । কিন্ত মরণ ওকে ছাড়ল না।
উল্টে দিক থেকে আমাদের ক'জন লোক আসছিল, পড়বি তো
পড়, সে ওদের মাঝখানেই গিয়ে পড়ল। আর কি কথা আছে ।
ওরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, আর দেখতে দেখতে রক্তের নদী বয়ে
গেল। ওর কাটা ধড়টা! এক বার লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল।
আমাদের লোকেরা হল! করতে করতে চলে গেল। আমার
কি মনে হোল, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সামনে । ওর কাট!
মাথাটা একটু দূরে ছিটকে এসে পড়েছে । ওর চোখ ছুটে! বুজে
গেছে, মুখের ভাব শান্ত, ভয়ের চিহ্নটুকু মিলিয়ে গেছে । কিন্তু ওর
দিকে তাকাতেই আমি শিউরে উঠে ছ্ হাত দিয়ে আমার চোখ
ঢেকে বসে পড়লাম । এ যে অবিকল আমার ছোট ভাইটার মত।
ওরা ভার মাথাটাকেও কেটে এমনি করে পথের উপর ফেলে
রেখেছিল, যাতে লোবে দেখে ভয় পায়।
তোমার ভাই কেমন করে মারা পড়ল? পদ্মনাভ জিজ্ঞাসা
করলেন।
অভিমও উত্তর দিল, আর কেমন করে ! যেমন করে আমাদের
ঘরে ঘরে ছেলের! মার! গেছে তেমনি করেই । উপমন্ন পরভুর দলে
যোগ দিয়েছিল । একদিন তোমাদের সৈম্তদের কাছে হাতে-হাতে
ধরা পড়ে গেল। রাজপুরুষেরা প্রথমেই ওকে মারল না, নানা
ভাবে অত্যাচার করে ওর কাছ থেকে পরভুর দলের ভিতরের কথা
১৯৯ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বার করে নেবার জন্য চেষ্টা করতে লাগল । পাঁচ দিন পর্যস্ত তার!
ওকে কিছুই খেতে দেয় নি, জলটুকু পর্যন্ত না । শুনেছি, ও যখন জল
জল করে ট্যাচাত, তখন তারা জোর করে ওর মুখে প্রস্রাব ঢেলে
দিত। ওদের এই অত্যাচারের ফলে উপমন্ন মারা গেল। সে
আজ থেকে এক বছর আগেকার কথা । ওরা তার মাথাটা কেটে
রাস্তার উপর ফেলে রেখেছিল। আমি নিজে চোখে দেখেছি, তা
কি কোনদিন ভুলতে পারব!
পল্পনাভের মনে হচ্ছিল, তিনিই যেন মূল অপরাধী । তাঁকে
বিচার সভায় এনে টাড় করানে! হয়েছে । আর বরেন্দ্রীর সমস্ত
কৈবর্তদের মুখপাত্র হয়ে অভিমন্ন তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থিত
করছে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করবার মত একটি কথাও তার
বলবার নেই। টুপ করে রইলেন তিনি। অভিমন্্র মুখেও কোন
কথা নেই।
কিন্ত অভিমন্নই প্রথম কথা বলল। বলল, তুমি তখন “জল”
“জল” বলে টেঁচিয়ে উঠেছিলে। শুনেই আমার মনে পড়ে গেল
উপমন্নর কথা । আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, ছুটে গিয়ে
জল নিয়ে এলাম। আর যখন তোমাকে খাওয়াচ্ছিলাম, আমার
মনে কি হচ্ছিল জান ? মনে হচ্ছিল যেন আমার ভাই উপমন্নকেই
খাওয়াচ্ছি। বিশ্বাস করবে তুমি আমার কথা?
পল্পনাভ গভীর স্বরে উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি যা যা বলেছ আমি
তাঁর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকুই বিশ্বাস করি। আমার কি ভাগ্য
পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় নেবার আগে তোমার মত একজন মানুষের
ংগে আমার দেখা হয়ে গেল। মরবার পর যদ্দি ভগবানের সংগে
দেখা হয় তবে আমি তাকে তোমার কথ| বলব। বলব প্রতু, তোমার
টিতে বড় অবিচার, বড় অত্যাচার আর বড় নিষ্ঠুরতা । কিন্তু তার
মাঝখানে এমন নুন্দর 'একটি মানুষ তুমি স্থ্টি করেছ, সেজন্য
তোমাকে ধন্যবাদ ।
বিজ্ঞোহী কৈবর্ত ১৯১
আবেগের প্রাবল্যে পল্পনাভের কণ্ঠস্বর নীচু খাদে নেমে এসেছিল
তার শেষের কথা কয়টা অভিমন্ন ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু তার
.কণ্ঠম্বরে যে গভীর আস্তরিকতা ফুটে উঠেছিল, তা! তার মনের তন্ত্রীতে
গিয়ে ঘা মারল । দরজার ফাক দিয়ে হাতটা! গলিয়ে দিয়ে পদ্পনীভের
একট! হাত সে চেপে ধরে বলল, এ কথ! কাউকে বলিনি, বলবও
না, শুধু তোমাকেই বলেছি। কাল এই নগরে পা দেবার পর থেকে
কম মানুষ মরতে দেখলাম না। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে যার মুখের
দিকে তাকাই, আমার মনে হয় আমার ভাই উপমন্নকেই যেন
দেখছি । মনে হয় ওরা বার বার করে তাকে আমার সামনে মারছে ।
এ আমার কি হোল, আমি কালো আর সাদা, কৈবর্ত আর গৌড়-
বাসী, আপন আর পর কিছুই ভেদ করতে পারছি না। আমার
চোখে সবই যেন কেমন এলোমেলো! হয়ে যাচ্ছে । আমার মনে হয়
আমার এই কথ। আর কেউ বুঝতে পারবে না, হয়তো! তুমিই শুধু
পারবে, সেই জন্য তোমাকে বলেছি।
পল্পনীভ বললেন, আমি তোমার সব কথাই বুঝতে পারছি,
তোমাকে চিনতে আমার আর বাকী নেই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অভিমন্ন কিছুটা নিজের মনে, কিছুটা
পল্পনাভকে উদ্দেশ করে বলল, যদি আমার হাতে ক্ষমতা থাকত,
আমি এখানকার রাজা, তার হষ্ট মন্ত্রীরা ৰারা তাকে কুপরামর্শ
দিয়েছে, আর যে সমস্ত রাজপুরুষেরা আমাদের উপর অত্যাচার
করেছে, তার ছাড়। আর কাউকে কিছু বলতাম না। আর কেউ
তো কোন দৌষ করেনি।
পল্পনাভ বুঝলেন, অভিমন্ন এখন আর অভিযোগকারী নয়, সে
ন্তায় বিচারের আসনে অধিষ্টিত। তার বিচারে তিনি দোষীদের
মধ্যে অন্যতম বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন । এই বিচার তিনি মাথা পেতে
নিলেন। মনে মনে বললেন, সত্য সত্যই আমি দোষী, আমার দণ্ড
পাওয়াই উচিত।
১৯২ বিদ্রোহী কৈবর্ড,
পদ্পনীভ কতক্ষণ ধরে একটা কথা বলি-বলি করছিলেন । কোমরে
একটি সোনার কবচ ছিল, সেটা খুলে অভিমন্নের হাতে দিয়ে
বললেন, আমার সংগে আর তো৷ কিছুই নাই, এই একটা জিনিস
মাত্র আছে, এটা! তোমাকে উপহার দিচ্ছি, তুমি নাও।
কেন, এ দিয়ে কি করব আমি ? অভিমন্ন আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল ॥
কি করবে? পদ্সনাভ হেসে বললেন, এ খুব ভাল সোন।।
ওজনেও ভারী আছে। সোন। কার না'কাজে লাগে!
অভিমন্ন কবচট! নিয়ে বাতির সামনে ধরে দেখল। সত্যই তো
সোনা । গরীব মানুষ অভিমন্ন, তার চোখ ছুটি মুহুর্তের জন্য উজ্জ্বল
হয়ে উঠল। কিন্ত পরক্ষণেই তার মুখের ভাব কেমন যেন ম্লান হয়ে
এল ।
তুমি কি ভাবছ এই জন্যই তোমাকে আমিনা ন1 না, তোমার
জিনিস তুমি ফিরিয়ে নাও ।
ছি ছি, একি কথ! বলছ? পদ্মনীভ বাধ! দিয়ে বললেন, আমি
তোমাকে চিনেছি, ভাল করেই চিনেছি, কিন্তু তুমি এখনও আমাকে
চিনতে পারছ না। আমি তোমাকে ভালবেসে দিয়ে দিচ্ছি।
আজকের দিনে তোমার মত আপনার মানুষ আর আমার কে আছে!
আর এ তে। আমার কোন কাজেই লাগবে না । চলে যাবার সময়
সব কিছু ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে। তখন যে পাবে, সেই
নিয়ে নেবে। তার চেয়ে তুমি যদি নাও আমি বড় আনন্দ পাব।
এ তুমি ফিরিয়ে দিও না ।
পদ্মনীভ অনুভব করলেন, তার হাতের মধ্যে ওর হাতটা কেঁপে
কেপে উঠছে।
অভিমন্ন মৃহ কণ্ঠে বলল, তোমার জন্য আমি কি কিছু করতে
পারি?
পন্মনাভ হেসে উঠলেন, আমার জন্য 1 আমার জন্য আর কি
করবার আছে?
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৯৩
কিছুই নাই? অভিমন্স হতাশ শ্ুরে প্রশ্ন করল।
হঠাৎ একট। কথা মনে 'পড়ে গেল পদ্মনাভের। সংশয়ভরা কণে
বললেন কিন্ত তুমি কি সে কাজ করতে পারবে ?
পারব, নিশ্চয় পারব, তুমি বল।
আমি একখানা পিপি পাঠাতে চাই একজনের কাছে।
খুব পারব। কেসে বল। কোথায় থাকে? কোথায় পাব
তাকে?
তোমাদের রাজ| দিবেবাক, তার কাছেই পাঠাতে চাই।
আমাদের রাজা দিব্বোক-তাকে চেন তুমি? অভিমন্ন আশ্চর্য
হয়ে প্রশ্ন করল।
হ্যা চিনি, খুব ভাল করেই চিনি ।
যেই প্রশ্নটা অনেক আগেই করার কথা, সেই প্রশ্নটা! এখন
অভিমন্নর মূনে পড়ে গেল, সে আগ্রহের সংগে বলে উঠল, তুমি
কে? তোমীর নাম কি?
আমার নাম? আমার নাম পল্সনাভ।
অভিমন্ন তার আসল প্রশ্নটার উত্তর পায়নি, সে কথা সে মু
ফুটে না! বললেও পদ্মনাভের তা বুঝতে বাকী ছিল না। কিন্তু
আত্মপরিচয় দিতে সংকোচ হচ্ছিল মনে । নিজের এই ছুবলতা৷ টের
পেয়ে নিজের উপর কঠিন হয়ে উঠে মনে মনে বললেন, হায় রে,
মরতে বসেও ছলনা । তার পরিচয় পাওয়ার সংগে সংগেই অভিমন্নর
মন তার প্রতি বিরূপ হয়ে যাবে, সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল
না। চরম সংকটের মধ্যেই যে সুন্দর পরিবেশটি গড়ে উঠেছে, তা৷
মুহুর্তের মধ্যে আবিল হয়ে উঠবে, এ কথা৷ ভেবে ব্যথায় ভরে উঠছিল
মন, কিন্ত না, তবু তিনি আত্মগোপন করবেন না । বললেন, আমি
গৌড়ের মহাসান্িবিগ্রহিক ছিলাম । আমার নাম পল্মনাভ।
মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক ! পরম বিস্ময়ের সংগে এই কথাটি উচ্চারণ
করেই অভিমন্স চুপ করে রইল।
১৩-
১৪৪ বিভ্রোহী কৈবর্ত
পল্পনাভ তার মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন
ও, সেই জন্য আপনাকে ওদের কাছ থেকে আলাদা করে
রেখেছে ?
আপনাকে! পদ্মনাভের কানে কঠিন আঘাতের মতই এসে
বাজল। এ যে হবে, এ তো! জানা! কথাই। কতক্ষণ চুপ করে কি
চিন্তা করল অভিমন্্, তার পর হঠাৎ উচ্ছুসিত হয়ে উঠল, কিন্তু তুমি
যাই হও না কেন, তুমি কখনোই খারাপ লোক হতে পার নানা
না, কিছুতেই ন1।
পদ্মনীভ হেসে উঠলেন । সে হাসিতে একটু ব্যংগের স্থুর কিন্ত
তার সঙ্গে একটু আনন্দও মিলে আছে। বললেন, নিঠ্র মাংসাশী
বাঘ বিপদে পড়লে ভেড়া বনে যেতে পারে, কিন্তু তা হলেও বাঘ
বাঘই।
উঃ আমাকে ও সব কথা বলে ভুল বোঝাতে পারবে না,
অভিমন্্ প্রতিবাদ করে বলল। আমি শিক্ষিত লোক নই, সোজা!
বুদ্ধির মানুষ, কিন্তু তাহলেও আমি মামুষ চিনি । দীও, তোমার
ঞিপি দাও। যেমন করেই পারি, তোমার এই লিপি আমি জায়গামত
পৌঁছে দেব। এই বলে অভিমন্ন নেবার জন্য হাত বাড়াল।
হাঁয় ঈশ্বর। কোথায় পাব লিপি। তুমি যদি লেখার উপকরণ
এনে দাঁও, তবেই লিখতে পারি। তা নইলে কেমন করে লিখব!
কিন্ত তা কি যোগাড় করে এনে দিতে পারবে তুমি ?
ও, তাই তো, অভিমন্্র চুপ করে একটু করে ভাবল, শেষে বলল,
আচ্ছা) দাড়াও, আমি দেখে আসি।
পদ্পনাভের মনে আশ খুব কমই ছিল, কিন্তু দণ্ডখানেক পরে
অভিমন্ত্র সত্যসত্যই লেখার সরঞ্জাম নিয়ে ফিরে এল।
পঞ্পনাভ দিব্বোককে উদ্দেশ করে লিখলেন £
আমার কথা সম্ভবত আপন" মনে আছে । দুজনে বসে এক
দিন কত কল্পনাই না করেছিপাম । আমাদের ছ জনের মনের গতি
বিজ্রোহী কৈবর্ত ১৯৫
ছিল একই দিকে কিন্ত কি বিচিত্র মানুষের জীবন, ঘটনার প্রবাহ
আমাকে বিপরীত দিকে, টেনে নিয়ে গেল। তাই আজ আমি
আপনাদের শক্রপক্ষ। জীবন ভিক্ষ! চাইছিনা, সত্য করেই বলছি,
জীবনের সাধ আমার মিটে গেছে । তবে মরবার আগে আপনার
সংগে একবার সাক্ষাৎ করতে পারলে বড় সুধী হোতাম। কিন্তু তা
কি আপনার পক্ষে সম্ভব হবে?
আপনার কাছে একট। শেষ প্রার্থনা আছে । আপনার মনের
সংগে পরিচয় আছে বলেই কথাট। বলতে ভরসা পাচ্ছি। রাজার
পক্ষ থেকে আপনাদের উপর যে সমস্ত অবিচার, অত্যাচার, করা
হয়েছে, পদাধিকারস্থত্রে আমিও তার সংগে জড়িত হয়ে আছি। সে
কথা আমি অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু আর যে সমস্ত বন্দী
এখানে মৃত্যুর অপেক্ষায় মুহূর্ত গুণে চলেছে, তার! সম্পূর্ণ নির্দোষ ।
কোন দণ্ডই এদের উপর প্রযোজ্য হতে পারে না। আমার কথা
বিশ্বাস করুন, এদের মুক্তি দিন। ভগবান আপনাদের মংগল
করুন।
অভিমন্নর মনের কথা যা-ই থাক, চিঠিটার মর্ম সে শুনতে চাঁয়
নি। পদ্মনাভ নিজেই উদ্ভোগী হয়ে চিঠিট। তাকে পড়ে শোনালেন ।
পাঠ শেষ হবার পর অভিমন্ন বলল, নিজের কথাটা অমন করে বাদ
দিয়ে গেলে কেন? তুমি নিজে কোন দোষে দোষী নও সে কথাটাও
স্পষ্ট করে লিখে দাও। আমি তোমার মুখ দেখেই বলে দিতে পারি
তুমি কার উপর কোন অন্যায় করতে পার না।
পদ্পনাভ আর একটি কথাও লিখতে রাজী হলেন না। পরম
তৃপ্তির হাসি হেসে চিঠিখানা হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে বললেন, তুমি
কি সত্যসত্যই তাই মনে কর? আর মনে মনে বললেন, যাবার
থে পুগিবীর কাছ থেকে এই শেষ উপহারটুকু নিয়ে গেলাম ।
অভিমন্নর পাহারার পালা শেষ হয়ে গেছে সে চলে গেল।
যাবার সময় বলে গেল পদ্মনাভের জন্য সে ওলাশ ঠাকুরের কাছে
১৯৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মানত করবে। ওলান ঠাকুর বদি প্রসন্ন হন, তবে অসাধ্য সাধন
হয়ে যেতে পারে।
পদ্মনাভ শুয়ে শুয়ে পুরানে। দিনের কথা ভাবতে লাগলেন ।
বরেক্্রীতে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি একবার এই দিব্বোকের .গৃহে
তিন দিন অতিথি হয়ে ছিলেন । তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষ,
তখনও মহাসান্ধিবিগ্রহিকের পদে নিযুক্ত হন নি। কি আনন্দময় ছিল
সেই দিনগুলি ! আজ অভিমন্ন তার সম্পর্কে যে কথা বলছে, এক
দিন সবাই তাই বলত। বলত, এ মানুষ কোন দিন কারু উপর
কোন অন্যায় করতে পারে না।
বরেন্দ্রীর এই কৈবর্তদের সেদিন তার কি ভালই না লেগেছিল ।
আর তাদের রাজ। দিবেবাকের চরিত্র আর কার্ধকলাপ দেখে মুগ্ধ
হয়ে গিয়েছিলেন । গৌডের রাজা মহীপাল তার রাজ্যের, আর এই
দিবেবোক বরেন্দ্রীর সমস্ত কৈবততদের হৃদয়রাজ্যের রাজা । একটা
মান্ুধ যে নিজের চিন্তাকে সমীজের সমস্ত মানুষের চিন্তার সংগে
এমন করে মিলিয়ে দিতে পারে, এ কথা তার ভাবনার অভাত
ছিল।
গৌড়ের মানুষ যে কথা ভাবতে পারে না, বরেক্দ্রীতে গিয়ে তাই
তিনি দেখেছিলেন । আর গৌড়ের লোকের! কিন! এদের বর্র বলে
আখ্যা দেয়। ক'টি দিনের মধ্যেই তার! পরস্পর অন্তরংগ হয়ে
উঠেছিলেন । দিব্বোকের কাছে কথ! দিয়েছিলেন, তিনি বরেক্দ্রীতে
গিয়ে তার ঘর বাঁধবেন, আর কৈবর্তদের মধ্যে শিক্ষা দান করে তার
জীবনপাত করবেন । এই হবে তার জীবনের ত্রত। সেদিন তার
এই কথার মধ্যে কোন ফাকি ছিল না, পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়েই এ
কথা বলেছিলেন। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। গুরু বরাহ-
স্বামীর অদ্ভুত প্রভাব তার উপর। যেন জোর করে তাকে মহাসান্ধি-
বিগ্রহিকের পদে বসিয়ে দ্রিলেন। সে শুধু, তার যোগ্যতার জন্য
নয়, তিনি তাকে নিজের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন, এই
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৯৭
আশা নিয়েই তাঁকে এই পদের জন্য মনোনীত করেছিলেন, এ কথা
আজ আর তাঁর কাছে অস্পষ্ট ন়। অনেক আপত্তি করেছিলেন
তিনি, শেষ পর্যন্ত গুরুর প্রবলতর ইচ্ছাশক্তিই জয়ী হোল । তারপর।
তারপর যারা শোষণকারী, যারা অত্যাচারী, সব কিছু জেনে শুনেও
তাদের সংগে যোগ দিলেন, ক্রমে ক্রমে তাদের সংগে মিশে যেন
এক হয়ে গেলেন । মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করতে চেয়েছেন, কিন্তু
স্থদক্ষ সাপুড়ের মত মন্ত্র পড়ে তাকে বশ করেছেন। সেমন্ত্রজাতির
কল্যাণের মন্ত্র । এর নাম জাতির কল্যাণ?
কৈবর্তদের উপর যে অত্যাচার চলছিল, সে কথা তাঁর অজান।
ছিল না। কিন্তু তা দূরের জিনিস, তাই তার জাচটা তার
মনের উপর তেমন করে এসে পড়েনি। কিন্তু অভিমন্ন তারই
ছবিটা তার চোখের সামনে এনে ধরেছে ।) নগরের বুকে এই ব্যাপক
হত্যাকাণ্ডের পটভূমিকায় সেই ছবিটা যেন আরও স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ
হয়ে উঠেছে । বরেন্দ্রী আর গৌড়ের নির্দোষ মানুষগুলির উপর যে
লাঞ্থনা আর মৃত্যুর অভিশাপ নেমে এল তার জন্য দায়ী গৌড়ের
রাজশক্তি। তিনিও তো সেই স্বার্থধ্ধ আর হিংস্র রাজশত্তিল্সই
একটি অংশ । মনকে যত করেই বোঝানো যাক না কেন, এই
সত্যটাকে কিছুতেই মুছে ফেল! যাবে ন1।
একটু আগেই অভিমন্ন তাকে বলেছিল যে তিনি কখনও কারু
উপর কোন অন্যায় করতে পারেন না। ওর মুখের এই কথাটা
তখন বড় ভাল লেগেছিল তার। কিন্ত না, এ কথ! যথার্থ নয়, তিনি
ওর সরল আর বিশ্বামভর। চোখ ছটিকে প্রতারিত করেছেন। ভিজে
স্যাত সেঁতে মেঝেটা তেতে যেন আগুন হয়ে উঠেছে । এ আগুন
মনের আগুন । সেই আগুনের জ্বালায় ছট ফট করতে করতে পল্মনাভ
মনে মনে বলছিলেন, আসম্থক মৃত্যু-সবচিস্তাহর, সর্হঃখহর পরম-
শাস্তির নিদান পরম দয়াল মৃত্যু ৷
চিঠিটা যখন এ হাত ও হাত ঘুরতে দ্বুরতে দিব্বোকের কাছে
১৯৮ বিদ্রোহী কৈব্্ত
গিয়ে পৌছল তখন বেশ বেল! হয়ে গেছে। চিঠিটা! পড়েই দিবেবাক
একটুও দেরী না করে ঘোড়া! ছুটিয়ে চলে এলেন বধ্যভূমিতে ।
ঘাতকের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেক লোক এই দৃশ্য
দেখবার জন্য সেখানে জড় হয়ে ছিল। সবার সামনে উচ্চীসনে
বসে পরভু এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। এমন সময় রাজা আসছেন
"রাজা আসছেন” ,বলে একটা শব্দ উঠল। দর্শকেরা সসম্্রমে ছু
ভাগ হয়ে মাঝখানে একট প্রশস্ত পথ তৈরী করে দিল! দিব্বোকের
ঘোড়াট। পরভুর কাছে এসে স্থির হয়ে দাড়িয়ে পড়ল। সংগে সংগেই
দিবেবাক লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়লেন । তার মুখে গভীর দুশ্চিন্তা
ও উদ্বেগের চিহ্ন । সবাই তা লক্ষ্য করল ।
পরভু শশব্যস্ত হয়ে তার আসন থেকে নেমে এসে উপুড় হয়ে
তাকে প্রণাম করল। দ্িব্বোকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়
ও উতকণ্ঠার সংগে প্রশ্ন করল কি হয়েছে ?
একটা বিরাট লোহার খাচাঁ। তার মধ্যে এক দল বন্দীকে বন্যা
পশুর মত আটকে রাখা হয়েছে। খাঁচাট। বধ্যমঞ্চের গা ঘেষে
আছে। একজন একজন করে নিয়ে আসা হচ্ছে, আর ঘাতকের
রক্তাক্ত খড়গ বিছুৎ বেগে নামছে । দিববোককে আসতে দেখে
ঘাতক তার উদ্যত খড়গ নামিয়ে রাখল। বধ্যমঞ্চের উপর বলির
পশুর মত একজন বন্দী থর থর করে কাপছে ।
পদ্মনীভ, পদ্পনাভ কোথায়? দিব্বোক হাঁপাতে হাপতে
বললেন।
পন্মনাভ ? গৌড়ের মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক পদ্মনাভের কথা বলছেন?
পরভু প্রশ্ন করল।
মহাসাদ্ধিবিগ্রহিক ? তিনি কি মহাসাদ্ষিবিগ্রহিক ? আচ্ছা,
দেখি নিয়ে এসো তকে আমার সামনে ।
তাকে? তাকে তো সবার আগেই-_-
দিব্বোকের কথাটা ঘাতকের কানে গিয়েছিল। সে একটা
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১৪৯
রক্তমাখা «কাটা মাথা নিয়ে ছুটে সামনে এসে বলল, এই যে তার
মাথা । মরবার আগে ছুটো অনুরোধ করেছিল । বলেছিল, সবার
আগে আমাকে কাটো, আর আমি মরলে পর আমার মৃতদেহ
রাজাকে দেখিও। সেই জন্যই আমি আপনাকে দেখাবার জন্য
পৃথক করে রেখেছিলাম ।
দিবেবাক পন্মনাভের কাটা মাথাটার দিকে একবার তাকিয়েই
ছু হাতে মুখ ঢাঁকলেন, তার পর আর্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, নিয়ে যাও,
সরিয়ে নিয়ে যাও ।
ঘাতক হতভম্ব হয়ে ভাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়ল ।
দিব্বোক এবার পরভুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কত জন
বন্দী? পরভূ উত্তর দিল, সবশুদ্ধ একশো! তিন জন ছিল । তাদের মধ্যে
গাচ জনকে হত্য করা হয়েছে, আর আটানববই জন বাকী আছে।
হত্যা বন্ধকর। সব বন্দীদের ছেড়ে দাও।
পরভু, আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল, ছেড়ে দেব? কেন?
এর! নির্দোষ। সেই জন্যই এদের আমি মুক্তি দিলাম ।
নির্দোষ? কেমন করে জানলেন এরা নির্দোষ? গৌড়ে নির্ণিষ
বলতে কোন লোক আছে নাকি ?
হ্যা, এরা নির্দোষ । মৃত্যুর আগে পন্পনাভ আমাকে লিখে
জানিয়ে গিয়েছেন, এদের কারু কোন দোষ নাই।
দিবেবীকের কথ৷ শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। পরভু বলে
উঠল, তার কথায় বিশ্বাস কি?
দিবেবাক দৃঢ় স্বরে বললেন, আমি তীর কোন কথাই অবিশ্বাস
করতে পারি.না। পন্মনাভ কখনও মিছে কথ! বলতেন না।
কিন্তু পরভূ এই আদেশ মেনে নিতে চাইল না, সেও জোরের
সংগে বলে উঠল, হোক নির্দোষ, তবু এদের মরতে হবে। ওর!
আমাদের যে সমস্ত ভাইবোনদের মেরেছে তারা কি দোষ করেছিল?
এদের রক্তপাত না| করলে তাদের আত্ম! তৃপ্ত হবে না। আপনি
ইড৩ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আপনার এই আদেশ ফিরিয়ে নিন। এ আদেশ আমর! মানতে
পারব না। নানা, এ হতে পারে না।
দিবেবাক পরভূর উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির সংয'্ত
কণ্ে বললেন, পরতু, এ রাজ্যের রাজা কে?
পরভু মাথ। নত করে বলল, আপনি । কিন্ত এ প্রশ্ন কেন করছেন!
দিবেবোক বললেন, কিন্তু আমার তো তা মনে হচ্ছে না। আম
যদি সত্য সত্যই রাজা হতেম আমার আদেশ অবশ্যই প্রতিপালিত
হোত। আমি নই, তোমরা তোমাদের বাহুবলে এই রাজা জয়
করেছ। তার মধ্যে তোমার কৃতিত্ব সব চেয়ে বেশী, এ কথা সবাই
জানে। এই রাজ্য শাসনের ভার তোমার উপরে থাকাই ভাল।
তাই থাকুক। এক রাজ্যে ছু জন রাঞ্জা থাকতে পারে না। আমি
বরেন্দ্রীতেই ফিরে যেতে চাই ।
যারা কাছাকাছি দীাড়িয়েছিল: শুনে স্তস্তিত হয়ে গেল--এ সব
বলছে কি রাজা! পাথরের মত কঠিন প্রাণ পরভুর। কিন্তু সেই
পাথরও এবার গলে গেল। দিব্বকের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে
স্কাদ কাদ কে বলল, আপনি এমন একট কথা বলতে পারলেন?
আপনি কি জানেন না কত ছু:খ আমাদের বুকে জমে আছে, কত
ছুঃখে এ সব কথা বেরিয়ে আসে? কিন্তু তাই বলে এমন কথা
আপনি বলবেন! আপনার যা ইচ্ছা, তাই করুন, আমি আর কোন
কথা বলব নখ।
দিবেবোক তাকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, পরভু
বুঝি, সবই বুঝি। এ ছুঃখ যে আমাদের সকলের। এ ছঃখ কি
আমার মনে নেই? এর জন্ত যার! দায়ী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ
প্রাণ দিয়েছে, বাকী যারা! তারা আমাদের হাতের নাগালের বাইরে
কিন্ত এই নির্দোষ অসহায় মামুষগুলিকে হত্যা করে কি তার কোন
প্রতিকার হবে? ওরা অমানুষ বলে আমরা তো অমানুষ হতে
পারি না।
এগারো!
এখানে ওখানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে। কোথাও যুদ্ধ কোথাও বা
একতরফা লুটতরাজ আর হত্যা । নগরের বিভীষিকা অবশেষে
গোৌড়ের গ্রামাঞ্চলে এসে হান। দিয়েছে।
সংশক গ্রামবাসীদের মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই।
যথেচ্ছাচারী, যথেচ্ছাভোজী, পৃথিবীর অপবিত্র সম্তান এই কৃষ্ণকায়
ববরের! হিংস্র পশুর মতই কখন এসে ঝাপিয়ে পড়বে, কে বলতে
পারে! নানা জায়গা থেকে নানা রকম অশুভ জনরব উড়ে উড়ে
এসে পড়েছে, তার সব কিছু সত্য হতে না পারে, কিন্ত সবটাই তো
মিথ্যা নয়।
যারা এতকাল পায়ের তলায় ছিল, তার! উপরে উঠে এসেছে ।
ভগবানের বিধানে যাদের স্থান ছিল সবার উপরে আর এত কাল
ভগবানের একান্ত প্রিয়পাত্ত বলে যারা গণ্য ছিল, তারা আজ হস্তে
হয়ে মাথা গু'জবার জন্য আশ্রয় খুঁজে ফিরছে । গৌড়ের প্রাক্তন
রাজপুরুষেরা, সৈন্যাধ্যক্ষেরা, সৈন্যেরাঃ যে যার আপন'আপন প্রাণ
বাঁচাবার জন্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । বিজয়ীরা “'আগ্চনের শেষ
রাখতে নাই” এই নীতি অন্ুদরণ করে তাদের পিছন পিছন তাড়া
করে ফিরছে।
তারই ফলে অত্যাচার, লুষ্টন আর আতঙ্ক মানুষের প্রাত্যহিক
জীবনকে ছুঃসহ করে তুলেছে। রণক্ষেত্র আর রাজধানীর বুকে যে
রক্তের নদী প্রবাহিত হয়েছিল, ত। শাখা প্রশাখার রূপ নিয়ে নিম্ন-
ভূমিতে নেমে আসছে। বাতাসে রক্তের গন্ধ । পশুর মতই মাম্ুষের
স্রাণশক্তিও প্রখর হয়ে উঠেছে ।
২২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আর এই ঘোর ছূর্যোগের মধ্যেও গৌড়ের বুকে নেমে এসেছে
বসস্তভ। সেই অপরূপ বসন্ত য৷ চিরদিন মানুষের মনকে দোল। দিয়ে
*এসেছে। প্রকৃতি প্রতিবার যেমন মোহিনী মূন্তি নিয়ে দেখা দেয়,
এবারও তেমনি করেই এসেছে । এখানকার মানুষের জীবনে একটা
বিকট ছন্দভংগ ঘটেছে, কিন্ত প্রকৃতির ছন্দধারা অব্যাহত গতিতে
প্রবহমান । নান! দেশ থেকে পাখীর। নানা দেশের বার্ত৷ নিয়ে চলে
এসেছে । তাদের উচ্ছৃসিত কল-কাকলিতে বনভূমি মুখর । তরু
লতার অন্তরে অন্তরে যে সৌন্দর্য বন্দী হয়েছিল, বসন্তের উন্মাদ
আহ্বানে তা আবরণ ভেদ করে ফুল হয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছে ।
মন উতলা কর! দক্ষিণের বাতাস তেমনি করেই বয়ে চলেছে, প্রতি
বসন্তে যেমন করে বয়। পশুপাখী, কীটপতংগ থেকে তরুলতা পর্যন্ত
তারই ডাকে সমভাবে সাড়া দিয়েছে । শুধু আত্মঘাতী হতভাগ্য
মান্য আপনাকে আপনি বঞ্চিত করছে, নিজের হাতে গড়ে তোল।॥
সমস্তায় নিজেই জীর্ণ হয়ে চলেছে। কিন্তু সে জন্য গ্রকৃতির গতি
থেমে থাকে না।
পলাশের বনে যেন আগুন লেগেছে । আর কোন গাছ নয় শুধু,
পলাশ আর পলাশ । আর কোন রঙ নয়, শুধু এই আগুনী রঙ |
যতদূর চোখ যায়, একই দৃশ্ঠ, একই রঙের খেল1। কোথায় গিয়ে
এর শেষ হয়েছে কে জানে !
কাছে ভিতে কোথাও জন-বসতি নাই । উঁচু নীচু বন্ধুর ভূমি,
কোন দিন কোন চাষীর লাঙ্গলের ছোয়। পায়নি । এখানকার মাটি
কোন দিন শস্য ফলিয়ে দেখেনি । এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুবই কম, মাঁটি
রোদে পুড়ে পুড়ে বামার মত হয়ে উঠেছে । কিন্ত সেই কঠিনের বুক
নিংড়ে কেমন করে রস রক্ত টেনে দিতে হয় পলাশ তা জানে । তাই
এই মাটির মধ্যেও তার এতই বাড় বাড়ন্ত। পলাশ প্রতি বসন্তে
অজত্র বীজ ছড়িয়ে দেয়, মাটির গর্ভ থেকে নব নব অঙ্কুর উদগত হয়ে
ওঠে । পলাশ বন বেড়েই চলে, বেড়েই চলে।
বিজ্রোহী কৈবর্ত ২০৩.
জনবসতি থেকে বহু দূরে বলে কাঠ্রেরা! এখানে এসে হামল!
করে না, পলাশের অতি-প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করার কোন ব্যবস্থাই নেই।
যে মানুষ তার ক্ষতি করতে পারে, এখানে সেই মানুষের অনধিকার
প্রবেশ নেই, আবার যে মানুষ মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করবে, সে মানুষও
এখানে নেই ।
কিন্ত আজ তার ব্যতিক্রম । বনে ঢুকবার কিছুটা আগেই
কাছিমের পিঠের মত উচু একটা টিবি । একজন প্রৌঢ় আর এক-
জন প্রৌঢ় তার উপর বসে সেই দক্ষিণ থেকে উত্তরগামী পুষ্পিত
পলাশ বনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরস্পর কথা বলছিলেন ।
প্রো বললেন, সত্য কথাই। জীবনের শেষ পাদে এসে পা
দিয়েছি কিন্ত এমন দৃশ্য দেখবার সুযোগ আর কোন দিন পাইনি।
আমাদের নগরের বাইরের দিকে কয়েকটা পলাশ গাছ ছিল, যেতে
আসতে অনেক সময় চোখে পড়েছে, কিন্তু তারা কোন দিন মনকে
এমন করে দৌল! দিতে পারেনি । আজ ওদের দিকে তাকিয়ে
শুধু এই কথাই মনে হচ্ছে।
ওর! সারাটা বছর ধরে এই আগুন কেমন করে লুকিয়ে রাখে 5
বাঃ বাঃ, প্রৌটা চঞ্চলা কিশোরীর মত হাত তালি দিয়ে বলে
উঠলেন।
স্বল্পভাষী রাজবৈদ্ঠ হরিগুপ্তের মুখ দিব্যি খুলে গেছে দেখতে
পাচ্ছি।
কিন্ত আমি ভাবছি, এ কি বসন্ত খতু, না তার এই প্রগলভ!
ংগিনী, কার মন্ত্রণে এই অসাধ্য সাধন ঘটল? কি বলছিলে শেষ
কথাটা আবার বল তে শুনি ?
হরিগুপ্ত লজ্জা! পেয়ে চুপ করে গেলেন।
উত্তর না পেয়ে শংখদেবী এবার নিজেই তার কথার পুনরাবৃত্তি
করে বললেন, ওরা সারা বছর ধরে এই আগ্ন কেমন করে লুকিয়ে
রাখে এইটাই তোমার কাছে সব চেয়ে বড় বি্মত্ব, তাই না?
২৫৪ রিস্রোহী কৈবর্ত
আর আমরা যে সারা জীবন ধরে এই আগুন লুকিয়ে রাখলাম,
আর তার দাহে দগ্ধে দগ্ধে মরলাম, সে কথাটা তোমার মনেই
পড়ল না, না?
হরিগুপ্ত অশ্বস্তির সংগে নড়ে চড়ে বসলেন, শেষে বললেন,
রাজমাতা, আমরা কয় দিন ধরে রাজধানী ত্যাগ করে এসেছি, মনে
আছে আপনার ? আমার কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
ংখদেবী ওষ্ঠ দংশন করে বললেন, আমি জানি, ভাল করেই
জানি এ সব ছোট খাট বিষয়ে তোমার কোন দিনই ভূল হয় না।
তোমার ভুল মূলে । সেই তুলেই তো! আমাদের জীবন এমন করে
মিথ্যা হয়ে গেল। কিন্তু তুমি কি আমাকে শিশু পেয়েছে! ?
এমনি করে একটা বাজে কথা তুলে দিয়ে আসল কথাটা এড়িয়ে
যাবে। তোমরা সবাই তো বল, আমার মত বৃদ্ধিমতী হয় না,
তবে আর এই মিথ্যা চেষ্টা কেন? তোমার ওই ম্থসংযত, ন্ৃচিস্তিত
ও পরিচিত কথা অনেক শুনেছি । রাঁজপ্রাসাদের কৃত্রিম পরিবেশেই
তাকে মানায়, কিন্ত এখানে একেবারেই বে-মানান। আজ এই
উদার আকাশের নীচে মুক্ত, প্রাস্তরের মাঝখানে বসে, এই মাধূর্ধে
ভর! পরম মুহুর্তে তোমার ত্বভাব-কার্পণ্য বর্জন করে সহজ হয়ে একটু
মন খুলে কথা বল হরিগপ্ত।
আবেগের এই ঝাপটাটা! সামলে নিয়ে হরিগুপ্ত ধীরে ধীরে
বললেন, রাজমাতা, ও প্রসংগ রাখুন । মানুষ যা মনে মনে ভাবে,
তার সব কথা বল! যায় না। সেটা শোৌভনও নয়, সংগতও নয়।
শংখদেবী অধৈর্ধের সংগে বলে উঠলেন, কোথায় রাজমাতা ?
রাজপ্রাসাদ ধ্বংস হয়েছে, সেই সংগে রাজমাতারও মৃত্যু ঘটেছে ।
তুমি কেন বৃথা তার সেই কংকালটাকে জকড়ে ধরে রাখতে চাইছ ?
আজ রাঁজমাতাও নাই, রাজবৈদ্চও নাই, আছে শুধু শংখ আর
হরিগুপ্ত।
রাজপ্রাসাদ যেতে পারে কিন্তু রাজ্য আছে, রাজ! আছেন,
বিশ্রোহী কৈবর্ত ২০৫
রাজমাতাও আছেন । রাজমাতাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্ধাদা
দিতেই হবে, আর তিনিও সে মর্ষাদ। থেকে আর্ট হতে পারেন ন1।
কিন্ত তার সেই গান্তীর্ষে ভর! গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি কোন কাজেই
এল..না |! খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন শংখদেবী । হরিগুপ্তের সর্বাংগে
শিহরণ খেলা করে গেল । এমন করে হাসতে পারেন শংখদেবী ?
এতদিনের সেই জানা মানুষটা হঠাৎ যেন নতুন হয়ে ফুটে উঠছে
যেমন করে রিক্ত পলাশ বলস্তের ছোয়া পেয়ে ফুলসজ্জায় সেজে
ওঠে।
হাসি থামিয়ে আপনাকে সামলে নিয়ে শংখদেবী স্থির দৃষ্টিতে
হরিগ্ূপ্তের মুখের দিকে তাকালেন, শেষে বললেন, তুমি চির দিন
আপনাকে বঞ্চনা করে এলে, বঞ্চিত করেছ আমাকেও, তাই বলে
আমার চোখে ধুলে। দেবে সে শক্তি তোমার নেই । তুমি আপনাঁকে
যতই ঢাকা দিতে চাও না! কেন, চাপ] দিয়ে রাখতে পার না, পদে
পদে ধরা পড়ে যাও।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
না, বুঝতে পারছ না, কথাট। ঠিক নয়, বুঝতে চাইছ না। কিন্ত
আজ আর এড়িয়ে যাবার উপায় নেই হরিগুপ্ত। আমার একটা
কথার উত্তর দাও। সেদিন শক্রসৈম্ত যখন নগরে এসে প্রবেশ
করল, তখন নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে রাজপ্রামাদের দিকে অমন
উম্মতের মত ছুটে গিয়েছিলে কেন ?
কর্তব্য বোধে, হরিগুপ্ত মৃুন্বরে উত্তর দিলেন ।
কর্তব্য বোধে ! মধুর হাসি হাসলেন শংখদেবী। 'হরিগুপ্ত চোখ
ফিরাতে পারলেন না। এই রহস্তময় হাসি কি যে মধুর আমন্ত্রণ
বহন করে নিয়ে আসে ! তখন বড় কঠিন হয় আপনাকে সংযত করে
রাখা । যৌবনের প্রথম দিনগুলিতে যেমন ছিল, জীবনের প্রত্যন্ত
সীমায় এসেও ঠিক যেন তেমনি আছে। এ কেমন করে হয়?
বার্ধক্যের ারদেশে এসেও কি প্রবৃত্তি নিবাণ লাভ করে না?
২০৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
শংখদেবী আবার বিজ্রপ মাখা গ্থুরে উচ্চারণ করলেন, কর্তব্য
বোধে! তার পর মু কে বললেন, গত রাত্রির কথ! স্মরণ কর
হরিগুপ্ত।
হরিগুপ্ত চমকে উঠলেন, কি? কিসের কথ! বললেন?
সে চমক এতই হ্ম্পষ্ট যে তা ধরা পড়বেই। শংখদেবী হেসে
বললেন, আমরা নৌকা করে যে বিলটা! পার হলাম তার নাম যেন
কী!
কংকন বিল।
হ্যা, কংকন বিল। মাঝিরা সারারাত নৌকো বেয়ে চলেছিল,
তাই না?
হ্যা।
পথশ্রম আর নৌকার দৌলানিতে শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে-
ছিলাম । কত রাত্রি তখন জানিনা, হঠাৎ জেগে উঠলাম । জেগে
উঠে কি দেখলাম জান-_না না দেখলাম নয়, নৌকার ভিতর
অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না, অনুভব করলাম, কে যেন আমার
পাশ ঘে'ষে ঘন হয়ে বসে আছে। আমার একট! হাত তার হাতের
মুঠোর মধ্যে আবদ্ধ। সে যে কে, বুঝতে বাকী রইল না। কত
রাত্রি ও দিনের স্থৃপ্ত আর জাগ্রত স্বপ্নের মধ্য দিয়ে এই স্পর্শ যেন
আমার কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু কোন দিন পেয়েও পাইনি ।
বড় লোভী হয়ে উঠলাম। মুখ ফিরিয়ে শুলাম, আমার আর একটা!
হাত তোমার কোলের উপর তুলে দিলাম । তুমি ভাবলে ঘুমের
ঘোরে, কিন্তু তা নয়, আমার হাত যেন আপনি চলে গেল। আর
ংগে সংগেই তুমি আমার মাথাটা--ও কি, ও কি অমন করে মুখ
ফিরিয়ে নিলে কেন? কোন লজ্জার কথা নেই এতে । -_আর
সংগে সংগেই তুমি আমার মাথাটা তোমার কোলের উপর তুলে
নিলে। এ আমার আশার অতীত -আমি আনন্দে যেন মৃছ্ছিত
হয়ে পড়ে রইলাম।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ১
হরিগুপ্ত অন্য দ্রিকে তাকিয়ে ছিলেন । শংখ দেবী জোর করে
তাঁর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
আমি ফে জেগে আছি, তার বিন্দুমাত্র আভাস দিলাম না।
আমি জানতাম তুমি টের পেলে অমনি জমে গিয়ে পাথর হয়ে যাঁবে।
কতটুকু সময় এই ভাবেই কাটল। তার পর তুমি আমার মাথাট?
আস্তে করে নামিয়ে রেখে নৌকার সামনের দিকে চলে গেলে ।
বাকী রাতটা আর ঘুম এলে! না। আমারও না, তোমারও না।
থামলেন শংখদেবী। একটু পরেই আবার বললেন, আমি যা
বললাম তা৷ কি ভূল বলেছি?
হরিগুপ্ত ভাংগা গলায় বলে উঠলেন, নার্জনা- মার্জনা ভিক্ষা
করছি। মাম্ুষ বড় ছ্র্বল, বড় অসহায়। কি থেকে কি হয়ে যেতে
পারে, মানুষ পূ্মুহূর্তেও তা জানে না। তা না হলে এত বড় পাপ
আমি কেমন করে করলাম ।
মার্জনা ? কে কাকে মার্জনা করবে হরিগুপ্ত? যদি পাপ হয়ে
থাকে ্ুজনেরই পাপ। আর মনে মনে এই পাপ আমরা তো কত
কতকাল থেকেই করে আসছি । নতুন কিছু নয়। পাপের নিব্স
মনে, দেহে নয়। কিন্তু এ যে পাপ এ কথা মানিনা আমি।
কিছুতেই মানব না।
বলতে বলতে শংখদেবী তাঁর ছুটি হাত হরিগুপ্তের কীধের উপর
রাখলেন। হরিগুপ্ত যেমন ছিলেন, তেমনি- বসে রইলেন । তার
হৃদয়ের কোন গ্রভীর তলদেশ থেকে কম্পিত কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এল,
বলছ কি শংখ, এ পাপ নয়?
না, পাপ নয়। আমি বলছি, এ পাপ নয়।
না, পাপ নয়? তুমি বিবাহিতা । তুমি পরের। তুমি সন্তানের
মাতা । তুমি রাজরানী। তুমি রাজমাতা। তবু তু'ন বলছ, এ
পাপ নয়?
হ্যা, তবু আমি বলছি, এ পাপ নয় শংখদেবী দৃঢ়ত্বরে উত্তর
২০৮ বিক্রোহী কৈবর্ত,
দিলেন। শোন হরিগুণ্ত, বে কথ! কোন দিন তোমাকে বলবার
হ্ুযোগ পাইনি, আজ তা বলব। যাঁকে তোমরা! বল সুদিন, আমার
জীবনে তা পরম ছুর্দিন হয়ে ছিল। আর তোমাদের এই ছূর্দিন
আমার কাছে পরম হৃদিন হয়ে এসেছে । তাই তো প্রাসাদের
অবরোধ থেকে মুক্ত হয়ে এমন একাস্ত ভাবে তোমাকে আমার কাছে
পেয়েছি। এত কাল য! স্বপ্ন ছিল, আজ তা সত্য হয়ে উঠেছে ।
আগে আমার কথ! কয়টা! মন খুলে বলতে দাও। তারপর পাপ
পুণ্যের হিসাব করে দেখা যাবে। কি? বলব?
বল।
রাজরানী আর রাজমাতা, যে যাই বলুক না কেন, সেট। আমার
সত্যিকারের পরিচয় নয়। এ আমার বাইরের আচ্ছাদন মাত্র ।
ন৷ না, আচ্ছাদন নয়, বন্ধন ।
হরিগুপ্ত বললেন, তুমি তো শুধু রাজরানী আর রাজমাতাই নও,
তুমি তে রাজকন্তাও বটে। তোমার দেহে রাজরক্ত বইছে। তুমি
অস্বীকার করলেই তো তা৷ মিথ্য। হয়ে যাবে না।
শংখদেবী হেসে উত্তর দিলেন, হ্যা, আমি রাজবংশের কন্যা ।
আমার থেকে তিন পুরুষ আগে এ বংশের লোক রাজত্ব করত।
কিন্ত রাজত্বহারা রাজরক্ত ক'পুরুষ পর্যন্ত টিকে থাকে বলতে পার ?
আমাদের আধিক সংগতি ছিল না, কিন্তু বংশের মর্যাদা ছিল ।
আমার পিতাকে খুশী করবার জন্য অনেকেই মহারাজ বলে সম্বোধন
করত।
আমি কিন্ত মনে প্রাণে নিতান্ত সাধারণ একটি মেয়ে ছিলাম।
আর দশটা মেয়ের মত আমার দেহেও এক দিন বয়সের ছোঁয়।
লাগল, আর দশটা মেয়ের মত আমার মনেও রঙ দেখা দিল ।
আমার বয়সী মেয়েদের মুখে নানা কথ! শুনতে শুনতে আমার মনও
জেগে উঠল। আমি চাইলাম, রাজা নয়, রাজপুত্র নয়, এমন
একজন মানুষ, যাকে ভালবেসে আমি সার্থক হয়ে উঠতে পারব।
বিদ্রোহী কৈবর্
কেমন মানুষ সে, কত রকম করে মনের চিত্রপটে তার ছবি এঁকে
তুলতে চাইতাম ! কিন্তু সে ছবিতে ধরা দিত না। এমনি করেই
কাটছিল আমার অধীর প্রতীক্ষার দিনগুলি । এমন সময় হঠাৎ
এক দ্রিন শুনলাম গৌড়ের সম্রাট বিগ্রহপালের সংগে আমার বিয়ের
সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেছে। বৃদ্ধ সম্রাট বিগ্রহপাল, আর সকল
রাজাদের মত তার আরও কয়েকটি রানী আছে । আমি হব
তাদের অন্ততমা। আমি কিন্তু চেয়েছিলাম এমন একটি মানুষ
যাকে, আমি ভালবাসতে পারব আর যে হবে একাস্ত ভাবে
আমার ।
সবাই বলল, আমার নাকি সৌভাগ্যের অন্ত নাই, রাজরাণী হয়ে
পরম হ্ুখে দিন কাটাতে পারব। আর এই বিয়ের মধ্য দিয়ে
আমাদের বংশের মর্ধাদা আরও বেড়ে যাবে। পরে বুঝলাম, তার
চেয়েও বড় কথা, এর মধ্য দিয়ে আমাদের বংশের আর আমাদের
সমাজের লোকেরা গৌড়ের রাজসিংহাসনের চারদিকে বিশিষ্ট
স্থানগুলি অধিকার করে বসবার স্থবোগ পাবে।
এ সম্বন্ধে আমার মতামত কেউ এক বারের জন্যও জিজ্ঞাস!
করে দেখেনি । বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের মতামতের কোন স্থান
নেই। আমি কিস্তু কিছুতেই এটাকে মেনে নিতে চাইনিঃ শেষ
পর্ষস্ত বাধ! দ্রিয়ে চলেছিলাম। কিন্ত সকলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা
মেয়ে কিই বা করতে পারে! ওরা জোর করে আমার বিয়ে দ্িল।
পুরাকালে রাক্ষস বিবাহের প্রচলন ছিল বলে শুনেছি, এ কি তার
চেয়ে কোন অংশে কম? বল হরিগ্প্ত, এট। কিবিয়ে? তুমিকি
এটা সমর্থন করতে পার ?
হরিগুপ্ত আমতা আমতা করে কি যেন বললেন ।
এ বিয়েকে সেদিন আমি স্বীকার করে নেইনি, আজও করি না।
এ বিয়ের দায়-দায়িত্ব মেনে চলতে আমি বাধ্য নই।
চমকে উঠলেন হরিগুপ্ত, এ তুমি কি বলছ! অগ্নিসাক্ষী করে
১৪-.
২৩৪
২১০ বিস্রোহী কৈবর্ত
এই যে পবিত্র বিবাহ অনুষ্ঠান তাকে কি অস্বীকার করে উড়িয়ে
দেওয়! যায়? আর তাও এত কাল পরে?
হ্যা, অস্বীকার করেছি, প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছি
আমি। ওর! যে মন্ত্র পড়িয়েছে, সে মন্ত্র আমি পড়িনি । আমি
অগ্নিকে স্মরণ করে মনে মনে বলেছি, হে অগ্নিদেব, তুমি সবজ্ঞ,
তোমার অগোচর কিছু নেই। তুমি সাক্ষী থেকো, আমি এ বিবাহে
সম্মত নই। এ বিবাহ সিদ্ধ নয়। এ বিবাহ মিথ্যা।
হরিগুপ্ত স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে কতক্ষণ চেয়ে রইলেন,
শেষে বললেন, আশ্চর্য, অদ্ভুত মানুষ তুমি! এমন কথা কোন দিন
কারু মুখে শুনিনি ।
শংখদেবী হেসে বললেন, ক"টা মেয়ের মনের কথা শুনেছ তুমি ?
আর আমি ছাড়া এমন কথা কেই বা! তোমাকে এমন করে বলতে
যাবে? তার পর শোন। বিগ্রুহপালের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণার
ভাব নিয়ে এখানে এসেছিলাম । পরে সেই বিতৃষ্ণ ঘৃণায় পরিণত
হয়ে গেল।
স্বর্গগত স্বামীর সম্পর্কে এ ভাবে কথা বলতে একটুও বাধে না
তোমার ?
না, একটুও না। তোমর! তাকে শুধু বাইরে থেকেই দেখেছ,
তাতে আর কতটুকু দেখা যায়! তাঁর চরিত-কথা রাজপ্রাসাদের
অন্তঃপুরিকারাই সব চেয়ে ভাল করে জানে ।
হরিগুপ্ত বললেন, কিন্তু এ কথা তো৷ সব্জনবিদিত যে শেষ বয়সে
তিনি তোমার কথায়ই উঠতেন, বসতেন ।
হ্যা, সে কথাও মিথ্য। নয়, শংখদেবী উত্তর দিলেন, কিন্ত সেটাই
কি বড় প্রশংসার কথা? কিন্ত ও কথা থাক, আমি বলতে
যাচ্ছিলাম তোমার আর আমার কথা । বিগ্রহপাল বার বার তার
মাঝখানে পড়ে বাধার স্থষ্টি করছে কেন? যেদিন তোমার সংগে
প্রথম দেখ! হয় মনে আছে সেদিনের কথা ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২১১
আছে।
তোমাকে দেখা মাত্রই কিন্তু চিনে নিতে পেরেছিলাম । আমার
মন আমাকে ডাক দিয়ে বলে উঠল, এই যে--এই মানুষটির জন্যই
তুমি এত দিন অপেক্ষা করে বসে ছিলে । তোমার উদ্দেশ্টে মনে মনে
প্রশ্ন করলাম, যদি এলেই তবে এত দেরী করে এলে কেন? কিন্তু
এখন আমার যে চারদিকেই কীটা, আমি কোন পথ দিয়ে তোমার
সামনে গিয়ে দাড়াব! সেই দিন থেকেই তুমি আমার দিন রাত্রির
চিন্তা হয়ে দাড়ালে।
পরপুরুষ হয়েও কেমন করে তুমি এমন আপন হয়ে গেলে!
কিন্ত সেজন্য একটি দিনের জন্যও আমাকে অনুশোচনা করতে হয়
নি। আজও অনুশোচনা করি না। এই গেল আমার পক্ষের কথা,
এবার তোমার পক্ষের কথ শুনি |... সেদিন আমাকে দেখে কি মনে
হয়েছিল তোমার ?
কি মনে হয়েছিল? মনে হয়েছিল, আমাদের মহারাজ
ন্ত্রী-ভাগ্যে ভাগ্যবান ।
শুধু এইটুকুই ? এর বেশী আর কিছুই মনে হয় নি?
না, তার বেশী আর কিছু. ভাববার মত ধৃষ্টতা আমার ছিল না।
সত্য কথাই বলেছ । কিন্তু সেই ধৃষ্টতার জন্ম হোল কবে সেই
কথাটাই শুনতে চাই ।
এরই মধ্যে কখন শংখদেবীর হাত হরিগুপ্তের হাতের মধ্যে বাধা
পড়ে গেছে। একটু আগেকার সেই সংকোচ ও অন্থুশোচনার
ভাবটা! কখন খশে পড়ে গেছে।
শংখদেবীর হাতের উপর একটু মৃছ চাপ দিয়ে হরিগুপ্ত বললেন,
এত কথা জান তুমি, শুধু এই কথাটাই জান না?
শংখদেবী আড় নয়নে নিজের বন্দী হাতটার দিকে এক বার
"তাকিয়ে নিয়ে ঠোটের কোণায় কুটিল হাসি হেসে বললেন, স্থ্যা,
জানি। কিন্তু তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলাম । নিজেকে
(৭4৬1 ৬ তব স্
নে উঠতে বু দিন লেগেছিল তোমার। এত লোকের
গ-লক্ষণ বিচার করে বেড়াও, আর নিজের বেলায়
[ন ভূল?
হরিগুপ্ত হেসে বললেন, সেই জন্যই তো! বৈদ্েরা কখনও
জেদের চিকিৎসা নিজেরা করে না।
আমার সেই গুরুতর ব্যাধির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার ।
| সময় প্রতি দিন তোমাকে আসতে হোত। প্রয়োজনে তো
সতেই, প্রয়োজন ছাড়াও আসতে । সে কত দ্দিনের কথা, কিন্ত
খনও স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। তোমার চোখের দৃষ্টি বদলে
য়েছিল। অভিজ্ঞ বৈগ্ধের দৃষ্টিতে অমন ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে না।
নই সময়ই তোমার নিজের দিকে তোমার দৃষ্টি পড়ল। বল, ঠিক
লছি কি না।
হরিগুপ্ত স্বীকারোক্তি দিলেন, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
তার পর আমার সেই চিঠি। যখন বুঝলাম, তুমি নিজের
চাছে ধর! পড়ে গেছ, তখনই লিখেছিলাম চিঠি, তার আগে নয়।
কন্ত তার যে এমন পরিণতি হবে, তা কেমন করে জানব! ক'বছর
দরশত্যাগী হয়ে রইলে। কিন্তু কেন, সে কথাট1 একবারও জিজ্ঞাস
কর! হয়নি । আজ বল শুনি। পরনারীর এই ছুষ্প্রবৃত্তি দেখে ঘৃণা
জেগেছিল মনে 1
হরিগুপ্ত উত্তর দিলেন, না, তা নয়। আমার মনে হয়েছিল
এজন্য মূলত আমিই অপরাধী । তা ছাড়! নিজের মনের গতি দেখে
ভয়ও. পেয়ে গিয়েছিলাম । মনের বোঝাটা হালক৷ করবার জন্য
তীর্থে তীর্ঘে ঘুরে বেড়ালাম ! কিন্ত মন কিছুতেই মানতে চাইছিল
না। দেশে ফেরার জন্য উতল! হয়ে উঠলাম । ফিরে এলাম দেশে ।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম এ টান দেশের টান নয়__
'এ টান সেই হশ্চরিত্রা বিদেশিনী মেয়েটার টান, তাই না
হরিগুগ্ড? তোমার এই সত্য কথাটির জন্য ধন্যবাদ। কিন্ত এত
বিক্বোহী কৈবর্ত ২১৩
দিন বাদে সেই সত্য কথাটা আজ তুমি প্রথম শোনালে ! বড় কৃপণ,
বড় কপণ তুমি হরিগুপ্ত।
আমি কি বলব বলে বলছি? তুমি কেমন করে আমার মুখ থেকে
কথাগুলে! জোর করে টেনে বার করে নিচ্ছ।
না, আমি নই। আমি তো আগেও ছিলাম, কিন্তু এক দিনও
তোমার মুখ থেকে এই মধুর স্বীকারোক্তির একটি কথাও বার করতে
পারিনি। আজ লোকসমীজে আর লোকলজ্জার গণ্তী ছাড়িয়ে বন্ছ
দূরে চলে এসেছি আমরা তাই বুঝি এমন অঘটন ঘটল।
কিন্ত শংখ, আমার কোন কথা তোমার অজান! ছিল ?
ছিল না, স্বীকার করি। কিন্তু সেই জানা কথাটাই যখন
প্রিয়জনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তখন তা" নতুন রূপ রঙ আর
রসে পূর্ণ হয়ে ওঠে! এটুকু না হলে মানুষের চলে না।
কিস্ত মনের গভীরে যে কথাগুলি জমে ওঠে, মানুষ কি তা!
প্রকাশ করে বলতে পারে?
পারে না। কিন্তু তার প্রকাশের এই অক্ষম আকুতির মধ্য দিয়ে
অনুস্ত কথার যে আভাসটুকু ঝিলমিলিয়ে ওঠে, তাঁর তুলনা নেই ;
আমি অবাক হয়ে যাই শংখ, এমন ভাষা তুমি কোথায় খু'জে
পাও? "আর আমার মন যত বেশী পূর্ণ হয়ে ওঠে আমি ততই
নিঃশব' হয়ে যাই।
শংখদেবী মৃদু গুপ্রনের সুরে বলে উঠলেন, বর্ষণহীন মেঘ, পৃথিবীর
তৃষা কি তাতে মেটে ?
হরিগুপ্ত নিঃশব্দ হয়ে মাথা নত করে রইলেন ।
না, না, ভূল বলেছি, ভুল বলেছি আমি, শংখদেবী নিজেই নিজের
কথার প্রতিবাদ করে বললেন, কি জান, হয় তো! তুমি তোমার ওই
না-বল! কথার মধ্য দিয়েই আমাকে আরও বেশী করে কাছে
টেনেছিলে সেদিন। ওগো! বর্ষণহীন ঘন মেঘ, দূর আকাশে তোমার
ওই অস্পষ্ট গুরু গুরু শব্দে আমার বুক সেদিন দুরু দূরু করে কেঁপে
২১৪ বিভ্রোহী কৈবর্ত
উঠেছিল। প্রথম যৌবনে আমার যে ন্থকোমল রক্ত রঙিন কামনা!
বিগ্রহপালের স্ুল অগুচি হস্তাবলেপে লাঞ্ছিত, ক্ষতবিক্ষত ও মুছিত
হয়ে পড়েছিল, তুমি তার মধ্যে চেতনার সঞ্চার করে তুললে।
ওগে। মেঘ, আমি তোমার সেই গভীর নিঃশব্দতার বিছ্যৎ-স্পদনে,
স্পন্দিত হতে লাগলাম । তোমার প্রত্যাশায় আমার কামনা কলাগীর
মত কলাপ বিস্তার করে উঠল। ওগে! দূর আকাশের মেঘ, তুমি
তার কতটুকু সন্ধান পেয়েছিলে।
শংখদেবীর মুদ্রিত চোখ বেয়ে ছুই বিন্দু জল গড়িয়ে নেমে এল।
সচেতন হয়ে দেখলেন কখন, অজান্তে হরিগুপ্তের দক্ষিণ বাহু তাঁকে
নিবিড় বেষ্টনে জড়িয়ে ধরেছে। সামনে ওই আকাশের বুকে গুচ্ছ
গুচ্ছ রক্তপলাশ তাদের দিকে তাকিয়ে নিলজ্জ হাসি হাসছে।
আবার চোখ ছুটি বুজে নিজেকে ছেড়ে দিলেন শংখদেবী ।
বারো
লাঞ্থিতা, ধর্ষিতা নগরী আবার নতুন রূপসজ্জায় সেজে উঠেছে ।
রাজধানী গোৌড়ে বিজয়ী কৈবর্তদের বিজয়োৎসব। বরেন্দ্রী থেকে
কালো মানুষের ঢল নেমে এসেছে । নাচে গানে হাসিতে আনন্দে
কোলাহলে ওরা আকাশ বাতাসকে চঞ্চল আর মুখর করে তুলেছে ।
ঢোল বাজছে, মাদল বাজছে, বাজছে কত রকমের বাশী। সেই স্থুরে
স্তরে আর সেই তালে তালে, নাচছে মেয়েরা নাচছে ছেলেরা,
কোথাও মগণ্ডলীবন্ধ হয়ে, কোথাও সারি বেঁধে, কোথাও যেমন খুশী
তেমন ।
এই অভিজাত নগরীর বুকে এমন ঘটন? আর কখনও ঘটেনি ।
নগরী যেন স্তস্তিত হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে,
এ সব কি ব্যাপার, এই বর্রেরা পেয়েছে কি। এই স্বষ্টিছাড়া নবাগত
কৃষ্ণকায় মানুষগচলির সংগে সে যেন তার কোন সামপ্রস্যই খুজে
পাচ্ছে না।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সবাই যখন নাচগান থামাল; তখন এল
পানাহারের পাল । আজকের জন্য সমস্ত মানুষ এক পরিবার হয়ে
গেছে। গৌড়ের রাজকীয় পশুশালায় পশুর অভাব নাই। সারি
সারি চুল্লী, হাড়ীর পর হাড়ী মাংস উঠছে, নামছে। মাংসের হ্থগন্ধে
বাতাস মহ-মহ করছে। মাটির উপর চাটাই পেতে ভাতের উঁচু
স্তপ করা হয়েছে। রাজ্যের মাছি এসে পড়েছে তার উপর । ক্ষুধার
ছেলেগুলি যেতে আসতে খাবল! খাবল। তুলে খাচ্ছে। বড়দের
চোখে পড়লে ' ধমক ধামক দিচ্ছে। কিস্ত আজ উৎসবের দিন,
এ সব শাসন কেই বা মানে! আজ নিয়ম টিয়ম উঠে গেছে।
২১৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
হ্যা, রোজকার নিয়ম আজ অচল। আজ অবাধ আনন্দের
দিন। শুধু বিজয় উৎসব নয়, আজ ষে ক্ষেত্র বুড়ীর পরব। ক্ষেতর
বুড়ী-_যার দয়ায় জমিতে ফসল ফলে আর মেয়েদের পেটে বাচ্চা
আসে। জওয়ান ছেলেরা আর মেয়েরা আজ একটু বে-চাঁল চালে
চলবে। সেজন্য কেউকিছু.মনে করে না। সমাজে চিরকালই
এই রীতি চলে আসছে। আজকার দিনে ও ধরতে নাই। গ্রামাঞ্চলে
স্ববিধা-অনেক ।॥ আড়াল-আবভাল পাওয়া! যায়, যাকে যার মনে ধরল
তাকে সংগে নিয়ে চলে গেল । কিন্তু এখানে সবই বড় বেশী খোলা
মেলা । কিস্তুকি কর! যাবে, স্বয়ং ক্ষেত্তর বুড়ীর বিধান-এ বিধান
মেনে চলতে হয়। আজ এই বছরকাঁর দিনে জওয়ান ছেলে আর
মেয়েদের মধ্যে একটু মাখামাখি, একটু পুটোপুটি, একটু দেওয়!
নেওয়া হবেই। এ যদি কারু চোখে পড়ে, তাড়াতাড়ি অন্ত দিকে
চোখ ফিরিয়ে চলে যেতে হয়। এও ক্ষেত্তর বুড়ীরই বিধান, এই
বিধান ভংগ করার ফলে কারু কারু চোখ কাণ! হয়ে গেছে, এমন
কথাও শোনা যায়।
খাবার সময় সবাই সারি বেঁধে খেতে বসে গেছে। ছোট
বড়,” মেয়ে পুরুষ, যে যেখানে জায়গা পেয়েছে, বসে পড়েছে।
বিশেষ বিশেষ পরবের দিনে সারা গাঁয়ের লোক এমনি করেই এক
সংগে বসে খায়। কিন্ত আজ তো৷ শুধু এক গাঁয়ের লোক নয়,
বরেন্দ্রীর কত গায়ের কত লোক এখানে এসে জমেছে, যেন এক
রাজ্যের মানুষ একত্র হয়েছে । সারির পর সারি মানুষ, এক দল
উঠছে, এক দল বসছে। উঠছে বসছে, আসছে যাচ্ছে, দিচ্ছে
খাচ্ছে _চেচ। মেচি হে-হুল্লেড়ে সারাটা! নগর সরগরম | হ্যা এর
নাম পরব।
এমন জমজমাট পরব কেউ কোন দিন দেখেনি । কেউ কেউ
বলছিল সারাটা! বছর যদ্দি এই ভাবেই চলত মন্দ ছিল কি! বড়
ছোট সবাই মিলে এক সংগে কাজ করতাম, এমগি করে এক
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২১৭
পরিবার হয়ে মিলে মিশে ওঠা বসা, খাওয়া দাওয়া করতাম ।
তাঁ হলে তুমি খেতে পাও, আমি খেতে পাই না, এ ছুঃখ কারু
থাকত না।
শণের মত পাকা চুল অথর্ব মত এক বুড়ো মাথ! দোলাতে
দোলাতে বলল, বাঁপ দাদাদের মুখে শুনেছি, আগেকার দিনে সেই
নিয়মই নাকি ছিল। তখন সব মাম্ুষ ছিল ভাই-ভাই, সবাই এক
সংগে মিলে-মিশে থাকত। পরে আমাদের মধ্যে পাপ দেখা দিল,
আমরা! লোভী হয়ে উঠলাম, জমি-জম! বিষয়-আশয় নিয়ে “আমার
আমার' বলে টানাটানি ছেঁড়াছি ডি শুরু হয়ে গেল। আর তার ফল
এখন দেখ, প্রথমে ঘর ভাংগাভাংগি, তার পর মন ভাংগাভাংগি ।
সেই জনই তো আজ আমাদের দুর্দশা ।
আবার কি সেই দিন ফিরিয়ে আনা যায় না? একজন প্রশ্ন
করল ।
বুড়ো হতাশ ভাবে মাথ। নেড়ে বলল, যা! যায়, একেবারেই যায়,
আর তা ফিরে আসে না। এই আমার জীবনেই কত কিছু
দেখেছি। যা চলে গেছে, আর কি তা! ফিরে আসবে ? এই বলে বুড়ে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
কিন্ত উৎসবের চঞ্চল হাওয়ায় সেই দীর্ঘশ্বাস কোথায় উড়ে চলে
যায়। বুড়ো তার জীবনে কি পেয়েছিল এক দিন, আর কিই বা
হারিয়েছে, তাই নিয়ে প্রশ্ন করবার বা সমবেদনা জানাবার মত
অবকাশ কোথায়! শুধু মুহূর্তের স্মৃতি-দংশন, পরক্ষণে বুড়ে। নিজেই
তুলে গেছে সে কথা । এমনি সময় একটা ছেলে আর একটা
মেয়ে হীপাতে হাঁপাতে বুড়োর পাশে এসে বসে পড়ল। চারি দিকে
সমস্তগুলি মুখ নড়ছে, খাওয়। শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ।
ওদের আসতে একটু দেরী হয়ে গেছে।
কাছাকাছি যতগুলি মানুষ সবার চোখ ওদের দিকে নিবন্ধ।
এতগুলি উৎমথক দৃষ্টির লক্ষ্য স্থল হয়ে ওর! একটু সংকুচিত হয়ে রইল।
২১৮ বিদ্রোহী কৈবর্ড
বুড়ে। ওদের ভাল করেই চেনে । সে মেয়েটার খোঁপাটা ধরে'
একটু নেড়ে দিয়ে বলল,
কি লো, এত দেরী করলি যে?
পরক্ষণেই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অর্থপূর্ণ হাসি
হেসে বলল, হু” দেরী তো হবেই । দেরী করবার মত বয়সই তো
তোদের । আমরা বুড়ো মানুষেরা সেই কখন থেকে বসে আছি ।
এক খাওয়া ছাড়! আর কিই বা আছে আমাদের ! বেশ, বেশ,,
বেশ।
চার দিকে একটা হাসির ঢেউ বয়ে গেল। সেই হাসির তোড়ে
সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওরা ছুজনেও হেসে উঠল।
খাঁওয়! শেষ হলে পানীয় এল । এ রাজ-ভাগারের সংরক্ষিত
মদ নয়। এ কৈবর্তদের নিজেদের চোলাই করা ঝাঝের উগ্রগন্ধী
ধেনো মদ।
রাজধানীতে যে গোঁড়ী সুরার প্রচলন আছে, তা স্থত্বাছু,
ন্ববাসিত, কিন্ত কৈবর্তের! নাক সিঁটকে বলে, বড় নরম, এতে নেশা
ধরে না। ধেনোর মত জিনিস কি আর সংসারে আছে ! ভাড়ের
পর ভখড় আসছে, আর দেখতে দেখতে নিঃশেষ । আজ এমনিতেই
পরবের দিন, ভার উপরে বিজয় উৎসব 1? যে যত পার খাও, কোন
বাধা বরাদ্দ নেই, অঢেল ব্যবস্থা । তার ফলে কিছুক্ষণ বাদে দেখা
গেল কেউ আর বসে নাই, উপুড় হয়ে, চিৎ হয়ে যার খুশী পড়ে
আছে। চেতন আর অচেতনের সংগম স্থলে এই যে হাবুডুবু খাওয়া»
এর মধ্যেই তো! চরম স্ুখ। একমাত্র তুরীয় অবস্থার সংগেই এর
উপমা! দেওয়া! চলতে পারে। দেহ বোধ বলতে ওদের প্রায় কিছুই
অবশিষ্ট নাই, আছে শুধু একটু অতি সুষম অনুভূতি । কয়েকজন
উলংগ হয়ে পড়ে আছে । ওরা দেহের বদ্ধন থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত।
দিবেবোক তার দলবল সহ নগর পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ।
ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে এমনি একটি দৃশ্টের সামনে এসে থমকে
বিজ্রোহী কৈবর্ত ২১৯
দাড়ালেন। ধরাশীয়ীদের মধ্যে যে ক'জন পরিমাণে একটু কম টেনে
ছিল তারা টের পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। আর সবাই যেমন
ছিল, তেমনি পড়ে রইল।
নিজের সমাজের এই অতি-পরিচিত ছবিটির দিকে তাকিয়ে
দিবেবাক স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলেন । ছোট বেল থেকে এই দৃষ্
দেখে দেখে তিনি অভ্যস্ত । কোন দিন এনিয়ে তীর মনে কোন
প্রশ্ন জাগে নি। কিন্তু আজ অসীম বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন ।
উৎসব রাত্রির শেষে ঘুমন্ত নটাদের বিকৃত মুখভংগি ও বিশ্রস্ত বেশ
বাসের দিকে ভাকিয়ে একদিন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বুঝি এমনি বিতৃষ্ণায়
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তীর সামনেই একটা লোক হড় হড় করে
বমি করে ভাসিয়ে দ্িল। দিব্বোক ত্রস্ত ভাবে কয়েক পা পিছনে
হটে এলেন। তার চোখে মুখে বিরক্তি ও ঘৃণার ভাব ফুটে উঠল ।
হো! হো করে হেসে উঠল তীর দলের লোকেরা । তাদের কাছে এ
একট! মজার ব্যাপার। একজন মন্তব্য করলঃ পরবের দিনে একটু
মাত্রা রেখে সামলে চলতে পারলে এমন মজার ছবি অনেক দেখা
যায়।
এই দৃশ্য দিব্বোককে ক্ষ আর ক্রুদ্ধ করে তুলল। তিনি
উত্তেজিত কণ্ে বলে উঠলেন, না না, এ কিছুতেই চলতে পারে না।
কথাট। স্বগতোক্তি। কিন্তু সেই স্বগতোক্তি এমন জোরের সংগে
বেরিয়ে এল যে, তা কারু শুনতে বাকি রইল না। তার এই
কথার তাৎপর্য কেউ বুঝতে পারল না । , দিবেবাক চিরদিনই শাস্ত ও
সংযত স্বভাবেব লোক। তার কথার স্তরে স্পষ্ট বোঝ! গেল, কারু
বিরুদ্ধে যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন! কিন্তু কার বিরুদ্ধে?
কে সে?
পরভূ পিছনে ছিল, সামনে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, কি হয়েছে ?
কি হয়েছে? দেখতে পাচ্ছ না? দিব্বোক আংগুল তুলে
ওদের দিকে দেখালেন ।
২২০ বিজ্রোহী কৈবর্
ওঃ হো, হেসে উঠল পরভু। একি আপনি নতুন দেখছেন
নাকি? পরবের দিনে এ তো হবেই। আর একটু আমোদ-ফুক্তিই
যদি না করল, তবে আর কিসের পরব !
দিবেবাক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমর1 এখন বরেন্দ্রীতে নিজেদের
ঘরে বসে নেই যে যা খুশী করতে পারি। বাইরের লোক যদি এ সব
দেখে, কৈবর্তদের সম্বন্ধে কি বলবে তারা?
কথা শুনে পর্ভুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে বললে, কে
আবার কি-বলবে ! বরেন্দ্রীই হোক আর গৌড়ই হোক, আমরা
যেখানে বাস করি সেইটাই আমাদের ঘর। এখানে বাইরের
লোকটা কে? আর থাকেও যদ্দি থাক না, কার কি বলবার আছে
এতে?
কে কি বলবে, এই ভয়ে আমাদের রীত্ আমরা রক্ষা করে
চলব না?
পরভূ উলটো! ঘেন তাঁকেই চেপে ধরেছে। দ্িবেবাক একটু থতমত
খেয়ে গেলেন । শেষে গলার হ্থরট1 নীচু করে বললেন, আঃ তোমার
কি চোখ নেই, ওই মেয়েটার দিকে চেয়ে দেখ না একবার ।
পর্ভূ যেমন বলছিল সেই ভাবেই বলে চলল, তাতে হয়েছে
কি? মদ খেলে অমন একটু বে-সামাল হয়েই থাকে । আজ এমন
একট! পরবের দিনে তাই বলে মদ খাবে না, এর ওর সংগে একটু
রং ঢং করবে না? চেতন হলে পর ওর! নিজেরাই নিজেদের সামলে
নেবে। সেজন্য কাউকে কিছু বলতে হবে না। আর এর জন্য
ওদের গায়ে কোন দোষও লেগে থাকবে না।
এর উত্তরে কি বলবেন, দিবেবাক কথ! খুঁজে পেলেন না। ত্বিনি
নিজেও কৈবর্তের ঘরের সম্তান। কিন্তু ত1 হলেও দেশ বিদেশে
ঘুরেছেন, নান! জায়গার লোকের সংগে মিশেছেন। তা ছাড়!
তিনি লেখাপড়া করবার সুযোগ কিছুটা! পেয়েছিলেন । জভ্য
সমাজের রীতি-নীতি আচার ব্যবহার জানা আছে তার।
বিত্বোহী কৈবর্ত ২২৬
সেই কথাটাই আবার একটু ঘুরিয়ে বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্ত
ধরা পড়ে গেলেন পরভুর কাছে। পরভু দস্তর মত চটে উঠল।
বলল, ও আপনি গৌড়ের ওই শয়তানগুলির কথা বলছেন? ওদের
কথা বাদ দ্িন। ওদের মধ্যে যা কিছু আছে সবই খারাপ, ভাল
বলতে কিচ্ছ,নেই। ওদের যেমন স্বভাব তেমনি আচার বিচার।
ওদের ছোঁয়া পেয়ে আমরা পর্যন্ত খারাপ হয়ে উঠছিলাম । ওদের
ওই সভ্যতা দিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই। ওদের সভ্যতা নিয়ে
ওর! ডুবে মরুক।
দিবেবোক আর সবার মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টভাবেই বুঝতে
পারলেন এ বিষয়ে তার। সবাই পরভূর সংগে একমত । তার পক্ষে
কেউ নেই। নানা কারণে তার চোখের দৃষ্টি বদলে গেছে, তাই এই
মদ খেয়ে এ ভাবে পথের ধারে বেহু*শ হয়ে পড়ে থাকাট! তাঁর কাছে
দৃষ্টিকটু বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এদের কাছে এট! এতই সহজ ও
স্বাভাবিক যে এর মধ্যে দোষণীয় কিছু থাকতে পারে এরা তা
ভাবতেই পারে না।
তিনি কথাটার মোড় একটু ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, সারা রাজ্যের
মানুষ ঘর্দি এমনি করে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে, তবে তো শত্রুদের
পক্ষে মস্ত বড় স্থযোগ ! ওর! যদ্দি এই দিনটা বেছে নিয়ে আক্রমণ
করত, আমাদের অবস্থাট। হোত কি বল দেখি? এরা করত যুদ্ধ?
এবার কিন্ত পরভু কথাটা তেমন করে উড়িয়ে দিতে পারল ন1।
কিন্তু মেনেও নিল না। বলল, আমাদের এখানকার এ সব কথা
ওর কেমন করে জানবে?
কেন, সেটা! জান। কি এতই কঠিন? আমাদের কৈবর্তদের
মধ্যেই যে ওদের কাছে খবরাখবর দেবার মত লোক আছে, সে
কথাট। কি তোমাকেও মনে করিয়ে দিতে হবে?
পরভূকে এবার নিরুত্তর হতে হোল। এ কথাটা কেমন করে
অস্বীকার করবে?
২২২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মধুমত্তদের পিছনে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে চলল! তার!
কথায় কথায় বিষয়াস্তরে এসে গেল ।
পরভু বলছিল, আমরা ওদের পিছন পিছন ভাড়। করেছিলাম,
আপনি কেন যে আমাদের ফিরিয়ে আনলেন ! ওদের যদি একদম
শেষ করে দিয়ে আসতে পারতাম, তবে আর ওদের জন্য ভাবতে
হোত না।
দিবেবাক বললেন, শেষ করে দিয়ে আসতে পারলে ভালই হোত,
সে বিষয়ে সন্দেহ কি? কিন্তু সে শক্তি তোমাদের ছিল না।
আপাতত ওদের দুল বলে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু সাত্রাজ্যের নান!
জায়গায় ওদের শক্তি ছড়িয়ে আছে । তোমরা যত বেশী এগোতে
তত বেশী করে শক্রদলের ভিতরে গিয়ে পড়তে । তা ছাড়া পীঠির
ঘোড়-সওয়াররা আর কত দিন তোমাদের সংগে থাকত ! সে রকম
কথাও ছিল না তাদের সংগে ।
পরভুর এবার মনে পড়ল, গীঠির ঘোড়-সওয়াররা তাঁদের নিজেদের
দেশে ফিরে যাবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল বটে। যদি চলে যেত
ধ্ করতে পারত তারা ? পরভূ মনে মনে নিজেকে শতবার ধিকার
দিল, নাঃ ভার বুদ্ধির কানাকড়ি মূল্য নাই। তাদের নাকের ডগায়
যা ঘটছিল, তার গুরুত্ব তলিয়ে দেখবার মত বুদ্ধি ছিল না তাদের,
আর দিবেবাক দূরে বসেও তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন ।
পরভূকে নিরুত্র দেখে দ্িবেবাক বলে চললেন, ওদের নিজেদের
মধ্যে যথেষ্ট দলাদলি ছিল, এখনও হয়তো। আছে । কিন্ত তুদিন আগেই
হোক আর পরেই হোক, কৈবর্তদের হটাবার জন্য ওরা যে কোন
রকমেই হোক নিজেদের ভিতরকার গোলমালটা মিটিয়ে ফেলবে । তখন
শুরু হবে আল যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধ যে কতদিন চলবে তার কিছুই
ঠিক নেই। ওদের এত দিনের গৌড় ওর! কি এত সহজেই ছেড়ে দেবে
ভাবছ? কাল যি ওরা আক্রমণ করে বসে, কেমন করে ঠেকিয়ে
রাখবে ওদের? গীঠির ঘোঁড়-সওয়াররা গীঠিতে চলে গেছে, আমাদের
'বিস্বোহী কৈবর্ত ২২৩
নিজেদের হাতে মাত্র পঞ্চাশ জন ঘোড় সওয়ার, তাও সবাই নতুন,
এখনও ভাল করে শিক্ষিত হয়ে উঠেনি।
পরতু এবার চিন্তিত হয়ে বলল, তাই তো৷ কি হবে তবে?
সেই জন্যই তো৷ বলছিলাম, এখন কি পরব আর বিজয়োৎসব
নিয়ে মেতে থাকবার সময়? এখন প্রতিটি দিন মুহূর্ত আমাদের
কাছে মহা মূল্যবান ওরা আক্রমণ করতে যতটা] দেরী করে,
আমাদের 'তত লাভ। এর মধ্যেই আমাদের প্ররস্তত হয়ে নিতে
হবে। সেই জন্যই তোমাদের ফিরে আসবার জন্য খবর পাঠিয়ে-
ছিলাম। আবার বলছি, প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহুর্ত আমাদের
কাছে মহা! মূল্যবান । তোমরা তোমাদের বা যা করণীয় কাজ করে
চলেছ তো?
পরভূ উত্তর দিল, সে দিকে কোন ক্রটিই হচ্ছে না। প্রতি দিন
দলে দলে লোক সৈন্য দলে নাম লেখাচ্ছে। ঘরে ঘরে হাতিয়ার
তৈরী হচ্ছে । কি পুরুষ কি মেয়ে কেউ বসে নেই।
কোচরা কি করবে ?
তারা এবার সবাই আমাদের পক্ষে আছে। গৌড় দখল করবা
সময় ওদের মধ্য থেকে শখানেক লোক আমাদের সংগে যোগ
দিয়েছিল। আর এবার কথ! দিয়েছে, যুদ্ধ বদি আবার বেঁধেই যায়,
'তবে প্রতি ঘর থেকে এক জন করে লোক দেবে।
বেশ বেশ বেশ, খুব ভাল কথা দিবেবাক খুশী হয়ে বললেন।
কিন্ত পরভূ এই সাফল্যেও খুশী হয়ে উঠতে পারল না। সে তার
মনের উদ্বেগট। প্রকাশ করেই ফেলল, কিন্তু ঘোড়া? ঘোড়া
আমরা কোথায় পাব? কেমন করেই বা পাব? আপনি
“ঠিকই বলেছিলেন শুধু পায়ে হাটা সৈন্ত দিয়ে ঘোড়-সওয়ার
বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখ! সম্ভব নয়। কিন্তু ঘোড়া আমরা পাচ্ছি
কোথায় ?
দিব্বোক আশ্বীস দিয়ে বললেন, এক মাস বাদে হুশে! ঘোড়া
২২৪ বিস্বোহী কৈবর্
আসছে বাইরে থেকে। মেই ব্যবস্থা কর! হয়ে গেছে। এখন তুমি
ঘোড়-সওয়ার বাছাই কর পরতু।
খবরটা শুনে লাফিয়ে উঠল পর্তু, বটে, ছুশে! ঘোড়া? তবে
আর ভাবনা কি! বলতে বলতে পরভু আনন্দের আতিশয্যে
দিব্বোকের গায়ের উপর মাথ! ঠকতে লাগল।
আঃ কি কর, কি কর, দিবেবাক বাঁধ দিতে চেষ্টা করলেন।
কিন্ত পরভূর মন যখন নেচে ওঠে, তখন তাকে ঠেকিয়ে রাখ!
বড় শক্ত।
তেরে
ওর! গ্রামাঞ্চলের পথ ধরে যাচ্ছিলেন। এক হাতে দণ্ড অপর
হাতে ভিক্ষা পাত্র, কীধে ঝুলি, .পরনে গীত বসন- সৌম্যমৃত্তি,
উজ্জ্লশ্রী ছুই ভিক্ষু আর ভিক্ষুণী। পথের মানুষ ভক্তিভরে লুটিয়ে
প্রণাম করছে, করজোড়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করছে, আর তারা
আশীবাদ বর্ষণ করে চলেছেন ।
ভিক্ষু বলছিলেন, আমাদের বয়স কম হয়নি, এই তো প্ররব্রজ্য।
গ্রহণের স্রময়। আর এই সময় আমরা--
হ্যা, এই সময় আমরা আমাদের এই নূতন সংসারে পা দিলাম ।
ভিচ্ষুণী ভিক্ষুর অপূর্ণ কথাটাকে পূর্ণ করে দিলেন ।
ংসার? এর নাম সংসার?
কেন হরিগুপ্ত, আমাদের এট! সংসার নয়? সংকীর্ণ গৃহকোণে
সীমাবদ্ধ নয় বলে? মানব না তোমার কথা । আমাদের প্রেম আর
আমাদের এই সংসার বহতা! নদীর মত সামনের দিকে বয়ে চলেছে ।
রাজপ্রাসাদের অগ্ধকার, গুপ্ত শ্ুড়গ পথ বেয়ে তোমার হাত ধরে
যেই মুহুর্তে বাইরে মুক্ত আলোকে বেরিয়ে এলাম, সেই তখনই,
তুমি বুঝতে পার নি, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের
সংসার যাত্র! শুরু হয়ে গেল।
আর তার শেষ-শেষ কোথায়?
শেষ কোথায়, কে বলবে? সে কথা কি কেউ বলতে পারে?
বদি তাই পারত, সেটা হোতো৷ পরম হুভরণগ্যের কথা । জীবন তার
রোমাঞ্চকতা৷ হারিয়ে ফেলে বিস্বাদ হয়ে যেত। তখন কি আর
১৫---
২২৬ বিদ্রোহী বৈবর্ত
অভাবনীয়ের প্রত্যাশায়, আর অজানার উম্মাদনায় এমন করে ছুটতে
পারত মানুষ!
হরিগুপ্ত একটু ইতস্তত করে বললেন, কিন্ত শংখ, এ যে যৌবনের
ধর্ম, আমরা ছজনেই পরিণত বয়স্ক আমরা কি পর-ধর্ম আচরণ
করছি না? মাঝে মাঝে কি মনে হয় জান? মনে হয়, বয়সের
জীর্ণ আবরণ আর ভিঙ্ষুর কাষায় বসনের আচ্ছাদনে নিজেদের
ত্বরূপকে ঢেকে রেখে সবাইকে প্রতারিত করে চলেছি। , এটা কি
ভাল?
শংখ দেবী হেসে বললেন, আচ্ছাদনের অন্তরালে নিজের স্বরূপ-
টাকে অনুভব করতে পারছ তো? তবে আর পর-ধর্ম বলছ কেন?
সেই পলাশ বনের কথা! ম্মরণ কর। আমিই তো তোমাকে দেখিয়ে-
ছিলাম সব চেয়ে বুড়ো! সেই গাছটাকে যার মধ্যে সব চেয়ে বেশী
ফুল ধরেছিল । ফুল ফোটাবার শক্তি যার আছে, সে ফুল ফোটাবেই।
বয়সের কথা মনে করে মেকি আপনাকে সামলে রাখতে পারে।
ছলনা? হ্থ্যা, একটু ছলনা করতে হয়। আড়াল? হ্যা একটু
আড়াল রাখতেই হয়। কৌতুহলী দর্শকের কৌতুহল মিটাবার জন্য
কোন্ মিথুন ভাদের গোপন মিলন কক্ষের দ্বার উত্মুক্ত করে রাখে?
তোমার আর আমার এই গোপন লীলা, লোকচক্ষের অন্তরালেই
তার বসতি, অন্তঃসলিল! নদীর মতই তা৷ অশ্রুতম্থরে কল্লোলিত হয়ে
চলবে। এর নাম প্রতারণ! নয়।
হরিগুপ্ত একটু সময় চুপ করে থেকে শেষে বললেন, তুমি এমন
করে কথা! বল, শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে পড়ি। তখন কথার কোন
উত্তর খু'জে পাই না। কিন্তু একটা কথা সত্যি করে বল, মানুষের
যা সহজ সংস্কার তুমি কি তার সব কিছু থেকেই মুক্ত? ভয় বলতে
কিছুই কি তোমার নেই?
অমন কথা কি বলতে পারি! তবে ভয়টা চির দিনই আমার
একটু কম। আর লোকে যে সকল কথা বেদবাক্যের মত নিঃসংশয়ে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২২৭
মেনে নেয়, আমি তার সব কথা! মেনে নিতে পারি না। এ জিনিসটা
'আমি আমার এক পিতৃব্যের কাছ থেকে পেয়েছিলাম । তার মনে
স্বাধীন জিজ্ঞাসা ছিল। কোন কণ। বহু কাল ধরে চলে আসছে
বা বু লোক তাকে সত্য বলে মেনে আসছে, একমাত্র এই কারণেই
তিনি তাকে সংশয়াতীত সত্য বলে মেনে নিতে চাইতেন না।
এই সব নিয়ে কতদ্দিন কত লোকের সংগেই যে তার মতইৈধ ও
মনান্তর ঘটেছে । সে জন্য তাকে ছুঃখও বড় কম পেতে হয়নি।
কিন্ত কোন দিন এই হুঃখকে এড়াবার জন্য তার নিজের পথ থেকে
তাঁকে ভঙ্ট হতে দেখিনি । তার সেই অটল সত্যনিষ্ঠা আর একান্ত
নির্ভয়তাকে আমি চির দিন প্রণাম জানিয়ে এসেছি । আমি যেটুকু
শিক্ষা পেয়েছি, তার কাছেই পেয়েছি । আর তারই মধ্যে দিয়ে
তার সেই স্বভাবের একটুখানি যেন আমার মধ্যেও এসে গেছে ।
সেজন্য অনেক নিন্দীও শুনতে হয়েছে আমাকে ! কিন্তু আমি
ভাবছি হরিঞগুপ্ত, আমার বেখাপ্পা ত্বভাবটা তোমার আর আমার
মাঝখানে ব্যবধানের স্থর্টি করে তুলছে না তো?
হরিগুপ্ত উত্তর দিলেন, ঠিক তার বিপরীত। তুমি জান গা,
এর জোরেই তুমি যেন আমাকে আরও বেশী করে তোমার কাছে
টানো। এযেকি রহস্ত আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু আবারও
তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এই যে আমরা ভিক্ষু-ভিক্ষুণী না! হয়েও
তাদের ছদ্মবেশ ধরে লোকের শ্রদ্ধা, ভক্তি আর আতিথ্য কুড়িয়ে
বেড়াচ্ছি, এর মধ্যে কোন পাপ নেই ?
পাপ? এর মধ্যে পাপের কি আছে? শংখদেবী আশ্চর্য
হয়ে প্রশ্ন করলেন, আনরা! তো কারু কোন ক্ষতি করিনি, কাউকে
ভাল কথা ছাড়া মন্দ কথ! বপিনি। বিপদে আপর্দে লোকের
যতট। পেরেছি সাহাধ্য করেছি। মনে আছে, সেই যে চক্রশীলা
গ্রামে দারুণ মহামারী লাগল, তুমি তোমার প্রাণের মায়া
তুচ্ছ করে চিকিৎসা করে কত লোকের প্রাণ বাচালে, আর
২২৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আমি আমার যেটুকু শক্তি আছে তাই দিয়ে তার্দের সেব!
করলাম--
হরিগুপ্ত বলে উঠলেন, হ্যা: সেদিন তোমাকে দেখে অবাক হয়ে
গিয়েছিলাম । তুমি রাজরাণী, রাঁজমাতাঃ চিরদিন পরের সেবা!
পেয়ে এসেছ, এমন সেবা তুমি কেমন করে শিখলে? ক্লান্তি, ঘৃণ!
আর ভয় বলতে কিছুই যেন তোমার ছিল না। সেদিন তোমাকে
আমি নুতন করে দেখলাম, আর নূতন করে ভালবাসলাম।
শংখদেবীর চোখের সামনে সেই ছবি ভাসছিল। তিনি যেন
নিজের মনেই বলে চললেন, কি বিচিত্র আর কি বিস্ময়কর সেই
দিনগুলি! আমার জীবনে এমন দিন যে আসতে পারে, সেকি
আমি কখনও ভাবতে পেরেছি! ওরা আমাদের ডাকত বাবা আর
মা, তাই না? আহা কি মিষ্টি সেই ডাক! আজ যখন সেই
পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির দ্রিকে তাকাই, তখন অবাক হয়ে
ভাবি, আমি কি ছিলাম, আর কি হয়েছি! এমন ঘ্খ আমি আমার
জীবনে আর কখনও পাইনি । ধন্ত হয়েছি আমি। তুমি কি বলতে
5বও এই সবই আমাদের পাপের ফল? পাপের ফল যদি এই
ভাবেই ফলে, তবে পাপই আমার ভাল, পাপই আমার মাথার মণি।
হরিগুপ্ত, সেই পাপের কথা মনে করে এখনও কি তুমি অনুশোচনা
কর?
হরিঞুপ্ত ঠিক বুঝতে পারলেন না, বললেন, কোন পাপের কথা
বলছ?
আমি পরক্ত্রী, সন্তানের মাতা- আর সেই জন্যই তো! এ ভাবে
আত্মগোপন করে ফিরতে হচ্ছে । যদি কার কানে এ কথা যায়,
কেউ ক্ষমা! করবে না, সবাই ঘ্বণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর
পরকালে অনস্ত নরক, শাস্ত্রীয় পণ্ডিতেরা আমাদের জন্য এই
ভবিষ্যাৎবাণীই করবেন। এ সব কথা মনে করে তোমার ভয় হয়
হরিগুপ্ত ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ব্ঈ:
ভয়? না, ভয় ঠিক নয়। আর পরকালের কথাটা মনেই হয়
নি। কিন্ত বিরাট একটা ধিক্কার এসেছিল মনে । অন্ুশোচনার
আগুনে তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে চলেছিলাম। কিন্তু মনের সেই
আগুন নিভে গিয়ে এখন নেমে এসেছে বিমল শান্তি! তোমার কথা
শুনতে শুনতে তোমার সংগে কথা বলতে বলতে আর তোমার
সংগে পথ চলতে চলতে সেই অন্থুশৌচনা! কখন, কোথায়, কেমন
করে খসে পড়ে গেল, নিজেই তা বুঝতে পারিনি । কিন্ত এবার
তোমাকে পালটা প্রশ্ন করি। করব?
কেন করবে না? কিন্ত প্রশ্ন অনাবশ্তক । আমি নিজে থেকেই
তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছি। আমার মনেও কোন অনুশোচনা
জেগেছিল কি না? না, এক বিন্দ্ুও না। আমার কথ৷ বিশ্বাদ কর,
এক দিনের জন্যও না, এক মুহূর্তের জন্যও না। আমি জানি এ
পাপ নয়। পাপ কাকে বলে, মর্মে মর্মে জেনেছি আমি। কত
দিন পাপের পংকে আকণ্ঠ ডুবে ছিলাম, তুমি এসে আমায় উদ্ধার
করলে। আর সেই তোমাকে ভালবাসা পাপ।
আমি তোমায় পাপের পংক থেকে উদ্ধার করেছি, এ বলছ কি
তুমি শখ ? অযথা এ সব কথা বলে তুমি আমাকে সান্তনা দিতে
চেষ্টা কোরো না।
শংখদেবী হেসে বললেন, না, এ ভাবে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
আমার যা বলবার আছে তা আমি বলবই । ও চলবে না, তোমাকে
শুনতেই হবে।
না] শুনতে চাইলেও জোর করে শোনাবে ?
হ্যা তাই শোনাব।
তবে আর কি করব, বল।
বাঃ এই তো! ভাল ছেলে । কিন্তু এ ভাবে চলতে চলতে নয়।
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়েছি, অনেক দূর থেকে এ বটগাছটা৷ দেখতে
দেখতে আসছি । অনেক খানি ছায়া ফেলে দাড়িয়ে আছে, যেন
৩৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। ওর তলায় বসে একটু
জিরিয়ে নেব, আর সেই সময় তৃমি যে কথাগুলো! শুনতে চাইছ না,
সেগুলো বলব।
সত্যিই ভারী সুন্দর গাছটি। এখনও বিরাট বনস্পতি হয়ে
উঠেনি, তবু প্রচুর ছায়। ছড়িয়ে আছে । যে আসে সামনে, তাকেই
বসবার জন্য সাদর আহ্বান জানায়। এই ছায়াশীতল আমন্ত্রণ
এড়িয়ে যাওয়া বড় কঠিন।
আঃ, বলে হরিগুপ্ত একটুও দেরী না করেই ঘাসের উপর সোজা
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। শংখদেবীও বসলেন । বসে বললেন,
এখন দেখছি, আমার চেয়েও তোমার বিশ্রামেরই দরকার ছিল
বেশী।
হ্যা, মিছে বলনি, বলে হরিগপ্ত কাঁত হয়ে শুলেম। চিৎ হয়ে
শুয়ে শংখদেবীর মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন ন৷ !
নিজের মানুষ এত কাছে থাকতে উপাধানহীন হয়ে অমন করে
মাটিতে গড়াগড়ি আর কেন? শংখদেবী আমন্ত্রণ জানালেন । কিন্তু
হরিগুপ্ত বুঝতে পেরেও সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন না, যেমন
ছিলেন তেমনি পড়ে রইলেন । শংখদেবী এবার একটু কাছে সরে
বসে তার মাথাট।? কোলের উপর টেনে নিয়ে বললেন, আমার যেটুকু
পাওনা সবই কি এমনি করে জোর করে কেড়ে নিতে হবে?
সাহস পাই না ফে।
সাহস পাও না? কিন্ত সেই কৃষ্ণ! চতুর্দশীর রাত্রিতে, কংকন
বিলের বুকে, নৌকার উপরে--সেদিন তো সাহসের অভাব হয় নি?
সে সাহস চোরের সাহস, উত্তর দিলেন হরিগুপ্ত।
শংখদেবী কলকঠে হেসে উঠলেন ।
চুপ চুপ, কেউ যদি শুনতে পায়। ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীকে এ
'অবস্থায় দেখলে কি বলবে!
কে আছে এখানে, কে দেখবে ?
বিজ্বোহী কৈবর্ত ২৩১
স্থির, শান্ত প্রকৃতি । মাঝে মাঝে এক একটা দমকা বাতাস
এসে সেই স্থির সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের দৌল! জাগিয়ে তুলছিল।
বটের পল্লবঞচলি মাতামাতি শুর করে দিয়েছে।
উপর দ্বিকে চেয়ে দেখ শংখ, বটের পাতাগুলি ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীর
দিকে তাকিয়ে কেমন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
হাসছে ওরা? হান্নক। হাস্থক আকাশ, হাস্থক বাতাস, হাস্থক
দশদিক, হাস্রক নিখিল প্রকৃতি । আর ওদের হাসি আশীর্বাদের মত
আমাদের উপর ঝরে ঝরে পড়ুক। সত্যি করে বল তো হরিগুপ্ত,
বয়সের বোঝাটা1 আপনা থেকেই খসে পড়ে যাচ্ছে না?
হরিগপ্ত প্রতিবাদ করলেন, আপন। থেকে ? না আপনা থেকে
নয়। এ তোমার হাতের যাছ। তোমার স্পর্শে আমার বয়সের
জমা বরফগুলি গলে গলে ঝরে পড়ছে । মনে হচ্ছে, আমি আমার
হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যকে আবার ফিরে পেয়েছি।
আর আমার মনে পড়ছে সেই দিনের কথা যখন আমার জেগে-
ওঠা কুমারী মন তোমাকে চোখে দেখার আগেই তোমার স্বপ্ন
দেখছিল ।
হরিগ্প্ত হেসে বললেন, এও আবার হয় নাকি ?
ই্যাহয়। তা না হলে তোমাকে দেখা মাত্রই আমি কেমন করে
চিনে ফেললাম? কিন্তুসে অনেক পরের কথা । তার আগেকার
কাহিনী বড় মর্মান্তিক । আমার স্বপ্ন ভেংগে দিয়ে এক দিন বৃদ্ধ
বিগ্রহপালের দীর্ঘ লোলুপ হস্ত আমাকে ছে মেরে নিয়ে গেল তার
কদর্ধ কামনার অন্ধকৃপে ।
রাজপ্রাদাদকে তুমি বাইরের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছ, তার ভিতরকার
আসল রূপটার পরিচয় পাওনি কোন দিন। তার কানায় কানায়
বিলাস, ব্যভ্যিচার আর বিকৃত কামনার হুর্গদ্ধ পংক। প্রথম প্রথম
ঘৃণায় আমার মুখ ফিরে আসত । দেখতাম ভোগের বলি হিসাবে
নিত্য নতুন মেয়ে আসে, কিছুদিন বাদেই রাজ-উচ্ছিষ্ট হয়ে তাঁরা
২৩২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
কোথায় অদৃশ্ঠ হয়ে যায়। চোখের সামনে দেখতাম, কিছুই করার
উপায় ছিল না, মনের বিক্ষোভ মনেই চাপা দিতে হোত। কিন্তু
তাতেও বিগ্রহছপালের কামনার নিবৃত্তি ছিল না। তার হাত থেকে
আত্মরক্ষা করবার জন্য কত ভাবেই ন! চেষ্টা করেছি,কিস্ত আমার সমস্ত
চেষ্টা ব্যর্থ হোত। আমার সপত্বী ছিল আদর্শ পতিব্রতা । আমাকে
সাজিয়ে গুজিয়ে স্বামীর কাছে নিয়ে উপহার দিত। আর আম'র
মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত, কিছুতেই সাড়া দিতে চাইত না, কিন্দ,
সে তার দৈহিক বল প্রয়োগ করে আমাকে তার আয়ত্তে আন”
সময় সময় আমাকে কৌশলে মদ খাইয়ে মাতাল করে আমাৰ
শরীরটাকে নিয়ে সে তার কামনা চরিতার্থ করত।
আঃ থাম, থাম শংখ, বাধা দিলেন হরিগুপ্ত।
কিন্তু শংখদেবীর কানে সে কথা গেল না। তিনি বলে চললেন,
এই হল আমার রাজরাণী জীবনের প্রথম অধ্যায় । আমার পিতৃগুহের
স্বজন যারা, তারা বলেছিলেন, আমি পরুম ভাগ্যবতী । মৌন্াগা
না থাকলে রাজরাণী হওয়। যায় ! কিন্ত সেই সৌভাগ্যের রূসটা কি
এবার তা প্রত্যক্ষ করলাম, আর মর্মে মরে অনুভব করলাম । এ
এমন এক হন্ত্রণ যা মুখ ফুটে প্রকাশ করা যায় না, যার ফলে সমস্ত
বিষ অন্তরাত্মাকে বিষাক্ত করে তোলে ।
কিন্তু ক্রমে স্বই বুঝি গা! সওয়' হয়ে যায়। একটু একটু করে
আমার মধ্যে পরিবর্তন আসজে লাগল । আমি ক্রমে ধাপের পর
ধাপে নেমে আদতে লাগলাম । মোটামুটি একট! রফা৷ করে বসলাম
সেই জীবনের সংগে । এত দিন বিগ্রহপাল তার গায়ের পাক
আমার গাষে মাখিয়ে এসেছে,' আর আমি এখন নিজেই সাধ করে
নিজের গায়ে পাক মাপতে শুক করলাম। রক্ষী বেষ্টিত রাজ
অন্তঃপুরের গোপনকক্ষে কত কিছু ঘঈতে পারে, তোমরা বাইরের
জগতের মানুষ, সে ধাবণা কোমাদের নেই। মনে আছে সেদিন
তুমি বলে ছলে, আমি দেবী। শুধু তুমি নও, এমন অনেকের মুখেই
বিদ্বোহী কৈবর্ত ২৩৩
আমি একথা শুনেছি। শুনেছি, আর মনে মনে ব্যংগ ভরে হেসেছি।
কিন্ত সেদিন তোমার এই কথা শুনে হাসতে গিয়েও হাসতে পারলাম
ন1। অসহা যন্ত্রণায় ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে সব কথা
তোমার কাছে খুলে না বলা পর্যন্ত এই যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই আমার
মুক্তি নেই। আজ যখন বলবার স্থযোগ পেয়েছি, সব কিছু বলব,
কোন কথাই গোপন রাখব না, তোমার চোখের সামনে তোমার
এই দেবীর স্বরূপটা নগ্ন করে খুলে দেখাব।
আমাকে দয়া কর, দয়া কর শংখ, আমি আর কোন কথা শুনতে
চাই না।
হরিগুপ্তের ব্যথাদীর্ণ আর্ত ক শুনে চমকে উঠলেন শংখদেবী,
তারপর পরম স্নেহভরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সব
কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছে তোমার ? থাক তবে, বলব না। কিন্তু যে
কথা খুলে বল! হোল না, সে কথাগুলি তূমি বুঝে নিও। এত দিন
সবাইকে ফীকি দিয়ে শ্রদ্ধা সম্মান আর শ্রীতির অর্থ্য পেয়ে অসছি।
কিন্ত তোমার কাছে ফাকি দেওয়া আমার সইবে না। সেই জঙ্যই
তো! বলবার জন্য এমন ব্যাকুল আর উন্মুখ হয়ে উঠেছিলাম ।
হরিগুপ্ত এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। শংখদেবীও আর
কোন কথা বললেন না।
সময় নিঃশব্দে বয়ে যেতে লাগল ।
হঠাৎ শংখদেবী চমকে উঠে বললেন, নাও, এবার ওঠ, উঠে
বসো।
কিন্তু হরিগুপ্তের উঠবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না! তিনি
যেমন চৌখ বুজে পড়ে ছিলেন, তেমনি রইলেন। বায়না ধর! শিশুর
মতই বলে উঠলেন, উঠতে বলছ কেন? যেমন আছি, থাকি না।
এমন লগ্ন জীবনে আর ক'বার আসবে !
ংখদেবীর মনের আকাশে যে মেঘটা এসে জমেছিল, মুহ্তেঁ
তা কেটে গিয়ে সারা আকাশ আলোয় ঝলমল করে উঠল । তিনি
২৩৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
লঘু কণ্ঠে হেসে বললেন, ওরে লুব্ধ, এত দিন এই লোভ কোথায়
ছিল? কিন্ত উঠে বসতেই হবে। লগ্রটা ভাল ছিল সন্দেহ নাই,
কিন্ত সম্প্রতি তার উপর তুষ্টগ্রহের ছায়াপাত হয়েছে ।
তার মানে? হরিগুপ্তের ভ্র কুঞ্চিত হয়ে উঠল।
আহা, শুনতে পাচ্ছ না, এক দল মেয়ে কথা বলতে বলতে এদিকে
এগিয়ে আসছে । ওই ঝোপটার আড়াল পড়েছে বলে ওদের দেখা
যাচ্ছে না। এই এখনই বেরিয়ে আসবে।
ব্যাস, আর বেশী বলতে হোল না। তিক্ষুণীর কোলের মায়া!
ছেড়ে ভিক্ষু ধড়ফড় করে উঠে বসলেন । "তার এই সন্ত্রস্ততা দেখে
হেসে উঠলেন শংখদেবী।
চুপ, চুপ, কোন ভিক্ষুণী কোন দিন এমন চপল কে হাসে না ।
হাসতে নাই।
শংখদেবী ঠিকই বলেছিলেন । একটু বাদেই দেখা গেল কয়েকটি
নারীমূক্তি ৰৌপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ওদের সবার মাথার
উপরে একট। যেন কি। আর একটু কাছে এলে পর হরিগপ্ত
বলেন, ওরা গোয়ালিনী, দই বিক্রি করতে বেরিয়েছে ।
ওর] কলকল করে কথা বলতে বলতে আসছিল। প্রথমে লক্ষ্য
করেনি, পরে তাদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই ওর! দাড়িয়ে পড়ল, শেষে
মাথার ভখড় মাটিতে নামিয়ে রেখে একে একে সবাই সাষ্টাংগে
প্রণিপাত করল।
কোথেকে এলে গো তোমরা ? প্রশ্ন করলেন শংখদেবী ।
দই নিয়ে হাটে গিয়েছিলাম মা।
এখনই ফিরে এলে ? যেতে যেতেই সব দই বিক্রি হয়ে গেল
বুঝি? কোথায় আর বিক্রী, এক ফৌটাও না । আজ কি দেখেই
যাত্রা করেছিলাম ! মিতারার হাট এত বড় হাট, কিন্তু সেই হাট
আজ বসলই না মোটে । এত বয়স হোল, চির কাল এই হাট করে৷
এলাম, কিন্ত জম্মে এমন কখনও দেখিনি !
বিজ্রোহী কৈবর্ত ২৩৫
কেন গো, হাট বসল না কেন ?
মুখপোড়া সৈন্যের নাকি আসছে। এলে পর হাটের উপর
এসে হামলা! করবেই । ওর! দাম দেয় না, ওদের মনের মত যা কিছু
পায়, সবাই লুটে পুটে নিয়ে নেয়। এটাই নাকি ওদের রীত.। এই
কথাই বলাবলি করছে সবাই। এ সব কথা শোনার পর আমরা
আর এক দও দীড়াতে সাহস করলাম না। বয়সের মেয়ে রয়েছে
সংগে। সৈন্যদের বিশ্বীস আছে!
হরিগুপ্ত জিজ্ঞীসা৷ করলেন, কাদের সৈন্য--আমাদের না ওদের ?
সে কথা জানি না বাবা । আর কি-ই বা হবে সে কথা জেনে !
সৈম্ত--সব সৈন্তই সমান, এর আর আমাদের আর ওদের কি!
যে আসবে সেই লুটপাট করে নেবে, আর ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে
আমাদের ক্ষেতের ফসল খাওয়াবে। তাইনিয়ে কি কথা বলার
উপায় আছে? বাড়ীতে ভাকাত পড়লে মানুষ ম্থযোগ পেলে দল
বেঁধে রুখে দীড়ায়, কিন্তু ওদের বেল! চুপ করে দাড়িয়ে দীড়িয়ে
দেখতে হয়। আর সব চেয়ে ভয় এই বয়সের মেয়েগুলিকে নিয়ে ।
দলের মধ্যে ছুটি বয়সের মেয়ে, ওরা এসব কথা শুনে কেমন
জড়সড় হয়ে আছে।
যেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি ওদের মুখপাত্র হয়ে কথা বলছিল, হরিগুপ্ত
তাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন, কি গো মা, তোমাদের এখানে রাজ!
কে এখন? আমরা তীর্থ করতে গিয়েছিলাম বিদেশে, বহু বছর
বাদে ফিরছি, সেই জন্তই জিজ্ঞাসা করছি।
রাজা? রাজার কথা বলছ ? রাজ! তে। মহারাজ মহীপাল।
আর একটি মেয়ে সংগে সংগেই তাকে সংশোধন করে দিয়ে,
বললঃ আহা-হা কেমন কথা বলে শোন, মহারাজ মহীপাল ন৷ মার!
গেলেন সেদিন কৈবর্তদের সংগে যুদ্ধ করতে গিয়ে ?
তা বটে, তা বটে, বৃদ্ধা নিজের ভুলটা স্বীকার করে নিয়ে বলল,
বুড়ো হয়ে গিয়েছি, অত মনে-টনে থাকে না।
২৩৬ বিক্রোহী কৈবর্ত
হরিগুপ্ত এবার অন্ত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
তা হলে এখানকার রাজা এখন কে?
মেয়েটি উত্তর দিল, সঠিক করে বলতে পারব না বাবা । মিতারার
হাটে নান! জায়গা থেকে লোক জন ' আসে, তাদের কাছেই
আমরা খবরাখবর পাই । শুনেছিলাম কৈবর্তের! রাজ্য দখল করে
নিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানকার রাজা কে, সে কথা জিজ্ঞাস!
করল্লে এক এক জন এক এক রকম কথা বলে। কেউ বলে,
মহারাজ মহীপালের দ্বিতীয় ভাই শুরপাল, আবার কেউ বলে, ন!
শুরপান নয়, তার পরের ভাই রামপাল । জানিনা কার কথা ঠিক,
আমরা যেমন শুনেছি তেমনি বললাম । আবার একজন বলছিল,
দেশ এখন অরাঁজক--আমাদের মাথার উপর কোন রাজা নাই।
আমি বললাম, এ তুমি কি বলছ ? প্রজা থাকবে অথচ রাজ! থাকবে
না, একি কখনও হয় নাকি? কোন শাস্ত্রে এমন কথা লেখেনি!
রাজ ন। থাকলে আমরা আছি কেমন করে ?
তার কথার ভুল ধরে আর তাকে ডিংগিয়ে আর একজন এতগুলি
কথা বলে যাবে, প্রথমা স্ত্রীলোকটির এটা একেবারেই মনঃপুত
হয়নি। সে ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, আহা! লো,কত বড় পণ্ডিতানী
আমার, ঝড় শান্তর কথ! শোনাতে এসেছেন-_রাজা। না থাকলে
আমরা আছি কি করে? রাজা আমাদের কোন্ কাজে লাগে শুনি?
দেশে অনাবৃষ্টি-সজন্মা লেগেই আছে, চোর ডাকাতের উপব্রবে
মানুষ অস্থির, অস্রধ-বিহ্খ ঘর থেকে নামতে চায় না, অভাবে-
অনটনে মরে গেল মানুষ, কিন্তু রাজা কোন দিন দেখতে এসেছে ?
ডেকে একটা মুখের কথা জিজ্ঞাস। করেছে -ওগো। তোমরা কেমন
আছ? রাজ। জানে শুধু তার লম্বা! হাতটা বাড়িয়ে দিতে । জমির
কর দাও, হাটের কর দাও, ব্যবসা বাণিজ্যের কর দাও শুধু
দাও, দাও, শব । এমন রাজা থাকার চেয়ে না থাকা অনেক
ভাল।
পর্বিস্রোহী কৈবর্ত ২৩৭
আহা! কি যে কথ বল মাসী, একজন বলে উঠল, এমন কথা
বলতে নেই গো। রাজা আর দেবতায় কি কোন তফাৎ আছে?
বৃদ্ধা উত্তর দিল, সে যেদিন ছিল, সেদিন ছিল। সেই দিনও
নেই, সেই রাজাও নেই। এখনকার রাজারা নিজের পেট ভরতেই
ব্স্ত। সেই যে সেবার আকাল লাগল, সারা. দেশ ছারখার হয়ে
গেল, মহারাজ বিগ্রহপাল তখন দেশের রাজা, কি করল সে?
তাঁরই চোখের সামনে মানুষগ্চলো পট পট করে মরছে, কিন্তু সে
তখন তার পাওনা গণ্ডা আদায় করেই চলেছে । আমি তখন নৃতন
বউ, কোলে এক বছরের ছেলেট1। না খেয়ে না খেয়ে হাডিড সার
হয়ে গেলাম, বুকের ছুধ শুকিয়ে গেল। শেব কালে বুকের ছুধটুকুও
না পেয়ে সোনার বাছা আমার ছটফটিয়ে মরে গেল ।
বহু দিনের পুরানো! সেই ছুঃখ আবার যেন নূতন হয়ে উথলে
উঠল। চোখে আচল তুলে দিল সে। সবাই অনেক করে সাম্তবন!
দিয়ে তাকে থামাল।
এদের মধ্যে সব চেয়ে ছোট যে সে বলল, সে কোন যুগের কথা
মাসী, এখন সেই সব কথা তুলছ।
কোন ধুগের কথা কি লো! এযে সেদিনকার কথা । আমি
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু এখন ওদের ঘরে ফেরার তাড়া, দাড়িয়ে কথা বলার সময়
নাই। মাসীকে কোন মতে সামলে নিয়ে তাঁদের মধ্যে একজন
বলল, যাই গে মা, যাই গে! বাবা ॥ মিতারায় সৈম্তদের কথা শুনে
এলাম, গায়ের লোকদের খবর দিতে হবে তে ।
তোমাদের গ্রাম কতদূর এখান থেকে? শংখদেবী প্রশ্ন
করলেন ।
আমাদের গাঁ? ন!, দূর আর কোথায়? সামনে ওই যে
মাথাভাংগ! তালগাছটা দেখছ না, ওই গায়ের নাম সিদ্ধল। তার
পরেই আমাদের শিমুলতলী ।
২৩৮ বিভ্রোহী কৈবর্ত
যাবার আগে ওরা আর একবার প্রণাম করে নিয়ে বলল,
(তোমরাও আর এখানে বসে থেকো! না । সময়টা ভাল নয়।
মাসী প্রস্তাব দিল, তোমরাও চল না! আমাদের সংগে । আমাদের
গায়ের লোক তোমাদের মত পৃণ্যবান লোক পেলে বড় খুশী হবে।
অনেক ভাল কথা শুনতে পাব তোমাদের মুখ থেকে।
শংখ দেবী মিষ্টি হাসি হেসে বিদায় দিলেন, না গো! না, তোমর!
তোমাদের ঘরে বাও। আমরা অন্য লোকের জন্য অপেক্ষা করছি
এখানে । আর সৈন্যরা? না, ওরা আমাদের কিছু বলবে না।
আমাদের কি আছে, কিইব! নেবে !
ওরা! চলে গেল। সবার মাথায় দৈয়ের ভণড়, কিন্তু সেজন্য
দৃূকপাঁত নাই। স্বচ্ছন্দে গল্প করতে করতে. এগিয়ে চলেছে।
বাতাসে দূর থেকে ভেসে আগছে ওদের কলকলানি । মনে হচ্ছে
যেন সবাই মিলে একই সংগে কথা বলে চলেছে ।
ওরা চলে গেল। ছুজনেই নিঃশব্দ হয়ে রইলেন। প্রথমে কথা
বললেন শংখদেবী, হরিগুপ্ত, তুমি আমাকে এক নৃতন জগতে নিয়ে
৪এসেছ, আর সাথে সাথে নৃতন মানুষ হয়ে উঠছি আমি । এই যে
গ্রামের মাম্ুষগ্জলি যাদের চিনতাম না, জানতাম না, যাদের কথা
ভূলেও মনে করিনি কোন দিন, কি আশ্চর্য দেখ, আজ মনে হচ্ছে
এরাই আমার আপন মানুষ, আর মনে মনে কামনা করছি, এদের
মাঝধানেই যেন আমার বাকী জীবন্টা কাটিয়ে দিতে পারি এই যে
ওদের মাসী, রাজাদের সম্পর্কে মন খুলে কত কথা বলে গেল,
আমার মনে হয় এতটুকুও বাড়িয়ে বলেনি সে। কিন্তু যদি জানত
আমি কে, কার সংগে সে কথা বলছে, তা হলে কি এমন করে বলতে
পারত? সেই জন্যই যে নিষ্ঠুর নির্মম পাষাণপুরীর অবরোধ ভেংগে
বেরিয়ে এসেছি, আর দেখানে ফিরে যেতে চাই না। আমি এদের
সংগে মিশে যেতে চাই, যেমন করে জল জলের সংগে মিশে যায়।
রাজপ্রাসাদ আমার কাছে অতীত দিনের ভয়াবহ ছুংস্বপ্ন । তার
'বিভ্রোহী কৈবর্ত ২৩৯
মাঝখানে আবার যেন আমাকে ফিরে যেতে না হয়। তুমি আমাকে
বাঁচাও হরিগুপ্ত। একমান্র তুমি ছাড়! কেউ আমাকে বাচাতে
পারবে না।
হরিগুপ্ত য় উত্তরে বললেন, একটা! অপ্রিয় কথা বলব? কিছু
মনে করবে না তো!
শংখদেবী হেসে বললেন, এক দিন অনেক প্রিয় কথা শুনেছি
তোমার কাছে, আজ ন! হয় একটা! অপ্রিয় কথাই শুনলাম, বল তুমি।
নির্ভয়ে বল।
আমার ভয় হয়, এখন তুমি যা বলছ, তার অনেকটাই তোমার
স্বপ্ন দেখা । চারি দিককার ঘাতপ্রতিঘাতের প্রতিক্রিয়া আর
সাময়িক ভাবাবেগ তোমাকে তোমার নিজের মাটি থেকে উন্মুলিত
করে তুলতে চাইছে। কিন্তু ছু'দিন বাদে এই স্বপ্রের বুদ্ধ যখন
(কেটে যাবে_
কেন, এ কথা বলছ কেন? আমার কাজের মধ্য দিয়ে কোন দিন
কি তুমি অতিরিক্ত ভাবালুতার পরিচয় পেয়েছ?
না, পাইনি। কিন্তু আজ তুমি যা বলছ আর যা করছ, এ
“তামার স্বধর্ম নয়।
কি আমার স্বধর্ম বলতে পার?
অভয় দিয়েছ যখন একটু মন খুলেই বলি। তুমি যাই বল ন'
কেন, রাজপ্রাসাদ তোমার পক্ষে একটা দৈব ঘটন। মাত্র নয়। ভগবান
তোমাকে একান্ত ভাবে রাজপ্রাসাদের যোগ্য করেই গড়ে তুলে-
ছিলেন। তোমার তীক্ষপ্রৃতিভা, কুটবুদ্ধি আর স্থুচতুর কর্ম-কৌশল
তোমার স্বপক্ষ আর প্রতিপক্ষ সকলেরই বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে,
সে কথ! ভোমার অজানা নয়।
হ্যা, জানি আমি।
আর মেই একই কারণে আমি মনে মনে তোমাকে ভয় করে
এসেছি, সে কথা হয় তো তোমার জান! নেই।
২৪০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তয়?
হ্যা, ভয়ই তে।। ভয় ছাড়া আর কি নাম দেব তার? কুট
রাজনীতি আর জটিল চক্রান্ত, এদের সম্পর্কে আমার ভয়ও আছে,
বিতৃষ্ণাও আছে । আমি আমার ভাগ্যগচণেই হোক বা ভাগ্যদোষেই
হোক, প্রথম জীবন থেকে রাজপ্রাসাদের সংগে সংশ্লিষ্ট, কিন্ত তা
হলেও আমি যতদূর সম্ভব এ সব এড়িয়ে আসছিলাম ।
শংখ দেবীর মুখের ভাব বদলে এল, বললেন, তা হলে আমার
সম্পর্কে শুধু ভয়ই নয়, বিতৃষ্ণাও ছিল!
হরিগুপ্ত হো৷ হো করে সশব্দে হেসে উঠলেন । একট! কাক নীচু
একটা ডালে বসে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে ওদের
পর্যবেক্ষণ. করছিল। হঠাৎ এই হাসির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে ঝটপট
করে উড়ে চলে গেল ।
শংখ দেবী ভ্রকুঞ্চিত করে একটু কঠিন স্তরে বললেন, অমন করে
হাসছ কেন ?
শংখ দেবীর ভ্রভংগিতে হরিগুপ্তের কিন্ত ভয়ের কোনই লক্ষণ দেখা
প্রেল না। 'তিনি হাসি মুখে বললেন, তোমাদের কথ শুনে না! হেসে
থাকতে পারা যায়! এত দিন বাদে এমন একটা কথা তুমি বললে!
বিতৃষ্ণাই যদি থাকত, তবে তো৷ রক্ষা পেয়ে যেতাম । তা হলে কি
আর ভাল মন্দ বোধ বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে মধুমত্ত ভূংগের মত
তোমাকে ঘিরে এমন করে ঘুরে ঘুরে মরতাম !
শংখ দেবীর মুখের ভাব সহজ হয়ে এল । বললেন, কয়েক দিন
থেকে অ-বাকপটু হরিগুপ্তের আশাতীত উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সেও তোমারই গুণে । কিন্ত শংখ, বিতৃষ্ণার কথাটা তুমি কেমন
করে বললে, সেই কথাটা এখনও আমি ভাবছি। শেষ পর্যস্ত
তোমাদের এই সব কাজের মধ্যে এ হেন আমাকেও তো তুমি
পেয়েছিলে। সে কথা তোমার মনে নেই? তোমাদের ওই
সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি, হানাহানি আর দলাদলির রাজনীতি
বিশ্রোহী কৈবর্ত ২৪১ '
আমার কাছে বড় অরুচিকর লাগত । কিন্তু তবু আমি তোমার কথা
এড়াতে পারিনি । যেটকু করেছি, একমান্রর তোমার মুখের দিকে
চেয়েই করেছি।
ংখ দেবী মাথ! নীচু করে রইলেন। এর উত্তরে স্বপক্ষে বলার
মত কোন কথাই খুঁজে পেলেন না। হরিঞ্প্ত তার মনের ভাব
কিছুটা অনুধাবন করতে পেরে অন্য প্রসংগ টেনে নিয়ে এলেন।
কিন্তু শংখ দেবা সে কথায় যোগ দিলেন না।
হঠাৎ হরিগুপ্তকে চমকে দিয়ে তার একটা হাত দুহাত দিয়ে
জড়িয়ে ধরে তিনি অভিভূত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ক্ষমা কর, আমায়
ক্ষমা! কর হরিগুপ্ত। ভালবাসার স্থযোগ নিয়ে তোমার মত বিশুদ্ধ
ও পবিত্র হৃদয়কে আমাদের এই সংকীর্ণ স্বার্থচক্রের মধ্যে টেনে নিয়ে
এসেছিলাম, সে জন্য আমি এখন অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে মরছি।
বিশ্বাস কর আমার এই কথ|।
এ কি, শংখ, এ সব কি বলছ তুমি ?
হ্যা, সত্য কথাই বলছি। এছুঃখ আমার কোন দিন যাবে
না। আমি এবিষয়ে অপরাধী, শত বার স্বীকার করি। কিন্তু
তবু একটা কথা বলি, তুমি যাকে বলছ আমার স্বধর্ম, তা
ঠিক নয়। তোমার এই কথা মানব না, আমি কিছুতেই
মানব না।
হরিঞ্প্ত গ্রবোধ দেওয়ার শ্থুরে বললেন, বেশ তো, সত্যি যদি ন!
হয়, কেন মানবে? আমি বললাম বলেই বে কথাটা সত্যি হয়ে
গেল, তা তো নয়।
তার এই কথাটাকে একেবারেই গায়ে না মেখে শংখ দেবী প্রশ্ন
করলেন, তুমি আমাকে ভালবাস, কিন্তু কেন ভালবাস বলতে পার
হরিগুপ্ত ?
প্রশ্ন শুনে হরিগুপ্ত তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন ।
আমার যৌবনে আমি হ্বন্দরী বলে খ্যাত ছিলাম । কিন্তু সেই
১৬ --
২৪২ বিস্রোহী কৈবর্ত
সৌন্দর্যের চিহুমাত্র অবশিষ্ট নেই আজ । এতএব রূপের জাল
দিয়ে তোমাকে জড়িয়ে রেখেছি এ কথা সত্যি নয়।
না, সত্যি নয়, হরিগুপ্ত প্রতিধ্বনির মতই বললেন ।
আমার স্বধর্ম বা প্রকৃতি সম্পর্কে তোমার ঘোর বিতৃষ্ণা। তুমি
নিজেই প্রকারাস্তরে এ কথা বলেছ। এখন আমার মুখের দিকে
চেয়ে এ কথার প্রতিবাদ করতে যেও না।
হরিগুপ্ত কোন কথা বললেন না।
তাই যদি সত্য হয়, তা হলে আমার মধ্যে এমনকি আছে
তুমি ভালবাস? চুপ করে থেকে৷ না, কথাটার উত্তর দাঁও।
আমি জানি ন', উত্তর দিলেন হররগুপ্ত।
জান না? সত্যি কথাই বলেছ। কিন্তু আমি জানি। তুমি
বোঝ আর নাই বোঝ, আমার মধ্যে যাকে তুমি ভালবেমে এসেছ,
সেইটাই আমার সত্যিকারের নিজস্ব প্রকৃতি । তুমি তো জান না,
প্রতি মুহূর্তে আমার মধ্যে কি যে সংঘর্ষ চলে এসেছে । আম্মি
একটি সুন্দর, সুকুমার, শুজ মন নিয়ে তোমাদের এখানে এসেছিলেম,
কিন্ত রাজপ্রাসাদের কুৎসিং পরিবেশ আর জীবন-ধারা! আমার সেই
মনকে অশুচি ও বিকৃত করে তুলল। কিন্তু তা আমাকে একেবারে
মেরে ফেলতে পারেনি । যে ভাবেই হোক তোমার অন্তরের গভীরে
আমার সেই রূপের ছায়। প্রতিফলিত হয়েছিল। তাই যদি না
হবে তা হলে তোমার মত মানুষকে আমি কেমন করে আমার এত
কাছে টেনে নিয়ে এলাম? এ তো ক্ষণিকের মোহ নয়। আমাদের
দীর্ঘ আর সংকটমংকুল জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়ে সে কথা স্প্রমাণিত
হয়েছে ।
হরিগুপ্ত চিন্তিত ক্ঠে বললেন, তুমি আমাকে নৃতন করে ভাবিয়ে
তুললে। এ কথাটা! এমন করে আর কখনোই ভেবে দেখিনি ।
এখন মনে হচ্ছে, তোমার কথাই হয়তো সত্য । কিন্তু তবু ভয় হয়,
কি জানি যদি--
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৪৩
যদি আবার সেই বিকৃতির মধ্যে ফিরে যাই, সেই কথাটাই বলতে
ভাইছ তো? না, এখন আমি আমার পরম নির্ভর খুঁজে পেয়েছি,
'আর আমার ভয় নাই। একটা কথ! তুমি জান না, আমার অতীত
দিনের এই ছুর্গীতির জন্য তুমিও কম দায়ী নও ।
আমি! আমাকে দায়ী করছ! কিন্ত কেন? হরিগুপ্ত আশ্চর্য
হয়ে প্রশ্ন করলেন।
ই, তুমিই সব চেয়ে বেশী দায়ী । শংখ দেবীর কত্বর অভিমানে
ভারী হয়ে এল। আমার প্রতি কি তোমার কোন দায়িত্বই ছিল
না? আমার জীবনের সেই পরম ছর্দিনে, আমার জীবনের সেই
পরম আনন্দময় লগ্নে এক লিপির মধ্যে দিয়ে তোমাকে জানালাম,
বন্ধু, এই রাজপ্রাসাদ আমার আত্মাকে তিলে তিলে হত্যা করে
চলেছে । তুমি আমাকে বাঁচাও, আমাকে মুক্ত করে তোমার ওই
আনন্দময় জগতে নিয়ে যাও। মনে পড়ে সে কথা?
হরিগুপ্ত মাথ। নেড়ে বললেন, হ্যা, পড়ে।
আর তুমি কি করনে তখন? কাউকে কোন কথা না বলে
অদৃশ্য হয়ে গেলে । সবাই বলল, ধন্য, ধন্য হরিগুপ্ত, এই বয়সেই
ভগবানকে লাভ করার জন্য সংসার ত্যাগ করে চলে গেল। সারা
সংসারে এক মাত্র আমিই জানলাম-সে পালিয়েছে। আর তার
ফলে কি ঘটল জান?
কি? শু কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন হরিগুপ্ত।
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম তোমার উপর, আমার নিজের উপর আর
সমস্ত সংসারের উপর। বললাম, আর আমার কোন দায় দায়িত
নেই, আমি যে পথ পাব, সেই পথেই ভেসে চলব। ভেবে দেখ,
তুমি চলে যাওয়ার পর কি আমার রইল? অমন শুম্তার বোঝ!
বয়ে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? তখন ঝাঁপিয়ে পড়লাম কুট
রাজনীতির আবর্তে, মেতে গেলাম স্বার্থের নির্মম হানাহানির খেলায়,
যে খেলায় নীতি আর বিবেকের কোনই স্থান নেই।
২৪৭ বিদ্রোহী কৈবর্ত
তারপর এক দিন তুমি ফিরে এলে । তোমার চোখে দেখলাম
গভীর মমতার ছবি, বুঝলাম, আমার তুমি আমারই আছ। এত
লাঞ্ছনার মধ্যেও আমার সেই মনটা একেবারে মরে যায় নি । তোমার
দৃষ্টিপাতে মরা গংগায় বান জাগল। মনে হোল, যেন আমি কানায়
কানায় ভরে উঠলাম। কিন্ত তখন আমি কুট চক্রান্তের সহত্রজালে
জড়িয়ে পড়েছি। তার মধ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আসি
সে শক্তি আমার নেই। বুঝি বা ইচ্ছাও নেই। শক্তির খেলায়
তখন আমি প্রমন্ত হয়ে উঠেছি। সামনে একটি মাত্র পথ, সেই
কুটিল পথ, এ ছাড়া আর কোন পথ আমার চোখে পড়ল ন।। আর
সেই পথ দিয়ে তোমাকেও টেনে নিয়ে চললাম । আরও শুনতে চাও ?
না, আর দরকার নাই।
এবার বুঝতে পারছ, শুধু আমি নই, আমার জন্তে তুমিও দায়ী ?
না, আমি তা মানি না। তুমি মুক্তি চেয়েছিলে, কিন্তু তা তো
মুক্তির পথ নয়। যে আমার প্রিয়তমা, তাকে কি আমি এমন করে
সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র করে কলংকের পথে টেনে নিয়ে যেতে পারি?
আবেগে হরিগুপ্তের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
শংখ দেবী কতক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে হরিগুপ্তের এই মধুর শ্বীকারোক্তি-
টুকু গভীরভাবে উপভোগ করলেন, তার পর বললেন, আর আজ ?
আজকার কথা স্বতন্ত্র। ভাগ্যের শ্রোতে আজ আমরা ভেসে
চলেছি। আর লোক সমাজের মাঝে থেকেও এক দিক দিয়ে
আমরা লোকচক্ষুর অন্তরালে আছি।
একটু থেমে হরিগুপ্ত আবার বললেন, কিন্তু এ ভাবে কত দিন
আর ভেসে চলবে শংখ ? কুলে তো৷ এক দিন ভিড়তেই হবে।
শংখ দেবীর চোখে শংকার ছায়৷ ভেসে উঠল। হরিগ্প্তের একটা
হাত চেপে ধরে অনুনয়ের স্থরে বললেন, কুলের কথা আর তুলো ন৷
হরিগুপ্ত। জীবনের কতই বা বাকী! এই বাকী ক'টা দিন আমি
এমনি করে অকুলেই ভেসে বেড়াতে চাই।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৪৫
কিন্ত রামপাল! তুমি যে তার মা। তাকে ছেড়ে তুমি কেমন
করে থাকবে?
রামপাল? সেতো ওই রাজপ্রাসাদেরই অংশ । তাকে পেতে
হলে রাজপ্রাসাদেই ফিরে যেতে হবে। হরিগুপ্ত, আর কত হুঃখ
দেবে আমাকে, আবারও কি আমাকে সেই চক্রান্তের জালের মধ্যেই
ফেলে দিতে চাও?
হরিগুপ্ত আশ্বাস দিয়ে বললেন, আবার কিসের চক্রান্ত ?
চক্রান্তের মূল তো ছি“ডেই গেছে।
ভুল, ভুল বলছ তুমি, ওর মূল ছিড়বার নয়। রাজপ্রাসাদ
থাকবে, আর চক্রান্ত থাকবে না, এ কি কখনও হতে পারে ? আমি
পরিক্ষার চৌখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এবার শক্তির সংঘর্ষ বেধে
উঠছে শুরপাল আর রামপালের মধ্যে । ওর মধ্যে আমি আর গিয়ে
পড়তে চাই না ।
এ তোমার মিথ্যা! সন্দেহ, হরিগুপ্ত প্রতিবাদ করলেন, এ কখনও
হতে পারে না। রাজধানী গৌড় কৈবর্তদের অধিকারে চলে গেছে।
এই চরম ছুঃসময়ে এরা কখনই আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে নী ।
শংখ দেবী হেসে বললেন, রাজবৈগ্, মনুষ্যাদেহ বা দেহগত ব্যাধি
সম্পর্কে তুমি যি কোন অভিমত প্রকাশ করতে, আমি এক কথায়
তা মেনে নিতাম। আর রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে আমার মতামতগুলো।
তুমিও তেমনি করে মেনে নিও । যতই ছুঃসময় হোক ন1 কেন, এই
সংঘর্ষ চলছেই, আমার একথাট1 তুমি শুনে রাখো । কেনই বা
চলবে না? এত দিন ধরে আমরা তো তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে
এসেছি । আমি জানি কনিষ্ঠ হলেও রামপালের মনে বাজ্যলিগ্লার
শিখা লেলিহান হয়ে উঠেছে, আর সেই আগুন আমরাই নিজ হাতে
জ্বালিয়ে তুলেছি। তা ছাড়া যত দিন আমার ভাই মথনদেব জীবিত
আছেন, তত দিন এই ছুই ভাইয়ের মধ্যে কোনমতেই শাস্তি স্থাপিত
হতে পারে না।
২৪৬ বিক্রোহী কৈবর্ত
কিন্ত সে কথা থাক। হরিগুপ্ত, শোন আমার কথা, আমি
তোমাকে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিচ্ছি, আমার আর রাজপ্রাসাদে
ফিরে যাওয়া হবে না কোন দিন না। কিন্তু সেই সংগে তোমার
কথাটাও শুনতে চাই। বল, তুমি কি এরই মধ্যে আমার ভারে র্লাষ্ত
হয়ে পড়েছ ?
ছিঃ শংখ, এ কি কথা বলছ তুমি? আমার কোন কথা তোমার
জান! নেই ? তবে কেন এমন করে বল?
শংখ দেবী উত্তর দিলেন, না! বলে কি করব, তুমিই যে জোর
করে বলাও । আজ যদি রাজপ্রাসাদে ফিরে যাই, আর কি তোমাকে
কোন দিন এমন করে পাব? সারা জীবন ধরে যাকে চেয়ে এলাম,
এতদিন বাদে তাকে পেয়ে আমার বুক ভরে উঠেছে। আর কি
আমি তাকে হাত-ছাঁড়া করতে পারি? আর হরিগুপ্ত, তোমার
প্রিয়তমাকে বিদায় দিয়ে তুমিই বা কি নিয়ে থাকবে? আমার
ছেলে আছে, ভাই আছে, স্বজন আছে, রাজ্য আছে, তোমার যে
আর কেউ নেই।
হরিগুপ্ত কোন কথা বলতে পারলেন না, অভিভূত হয়ে বসে
রইলেন ।
শংখ দেবী বলে চললেন, এখন আর কুলের কথা ভেবে লাভ নেই।
এখন থেকে এ নিয়ে তোমাকে কোন কিছুই ভাবতে হবে না। হয!
ভাববার আমিই ভাববো । শক্রবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ থেকে পালাবার
সময় স্ুড়ংগ পথে পা বাড়াতে গিয়ে শেষ কথাট। কি বলেছিলাম
মনে আছে? বলেছিলাম, এখন থেকে তোমার পরিচালনার
ভার আমিই নিয়ে নিলীম। সেদিন এই কথাটার তাৎপর্য তুমি
হয় তো৷ বুঝতে পারনি। আমি কিন্তু পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই কথাটা
বলেছিলাম।
ওরা কথার মধ্যে এমন করেই ডুবে গিয়েছিলেন, বেলা যে পড়ে
এসেছে সেদিকে কারও খেয়াল ছিলনা । প্রথম নজর পড়ল,
বিজ্বোহী কৈবর্ত ২৪৭
হরিগুপ্তের | তিনি উৎসাহের বৌকে চেঁচিয়ে উঠলেন, আঃ শংখ, রাখ
তোমার কথা ।
চেয়ে দেখ একবার পশ্চিম আকাশের দিকে ।
সত্যি চেয়ে দেখবার মতই বটে। একবার চোখ পড়লে আর
চোখ ফেরানো যায় না। লাল টক্টকে স্ৃর্য পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ
করেছে । .তারই লালিমায় স্নান করে খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি লাল হয়ে
উঠেছে । সে লাল কোথাও সিঁছুরের মত লাল, কোথাও আবীরের
মত লাল, কোথাও গেরুয়া মাটির মত লাল, কোথাও বা লালের
পাতলা একটু আমেজ । একই আকাশ জুড়ে কত রকম রংয়ের
খেলা ! একই লালিমা, যে যতটুকু পারে গ্রহণ করেছে।
ওর] মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
এমনি করে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল । প্রথমে কথা বললেন
শংখ দেবী।
হরিগুপ্ত তার কথায় সাঁড়া দিয়ে বললেন, হ্যা, এমনি করে হঠাৎ
আমাদের জীবন সন্ধ্যাও একদিন নেমে আসবে । আজও তো! এসে
যেতে পারে, পারে না?
কেন পারবে না? কিস্তু যতক্ষণ তা না আসছে, রাত্রিবাসের
আস্তানাটা ঠিক করে ফেলতে হয়। আজকের রাতটা আমরা
কোথায় কাটাব হরিগপ্ত?
সে কথ! আমি কিজানি! উত্তর দিলেন হরিগুপ্ত। পরিচালনার
ভাট! তে! তুমি নিজের হাতেই তুলে নিলে । এখন তুমি যে পথে
চাও, আমি সেই পথেই চলব।
শংখ দেবী হেসে উঠে বললেন, বেশ বেশ, কিস্তু সব সময় মনে
থাকে যেন সেই কথাটা । আমার কিন্তু এই জায়গাটা বড়
মনে ধরে গেছে, ছাড়তে মায়া লাগছে। এখানে বসেঠ আজ
আমর। আমাদের মনের অনেকগুলো গ্রন্থ খুলে ফেলেছি । দেখ
গো, আমি বলি কি, আজকের রাতটা এখানেই কাটুক
1২৪৮ বিদ্রোহী কৈবর্
না। খোল! আকাশের নীচে এমন অনেক রাতই তো আমরা
কাটিয়েছি!
ঠিক আমার মনের কথাটাই খুলে বলেছ।
আমার নিজের মন দিয়েই আমি তোমার মন দেখতে
পাই যে।
কিন্ত আমরা কি খাব? শুধু কথা দিয়েই কি আমাদের পেট
ভরাতে হরে ?
আঃ, সে ভাবনা তুমি ভাবছ কেন? আমি তোমাকে না খাইয়ে
রাখব না । আমার উপর কি এটুকু নির্ভর করতে পার না তুমি?
আমাকে একটা রাজ-সংসার চালাতে হোত এক কালে, সে কথাটা
ভুলে যাও কেন?
তাই স্থির হয়ে গেল। আজকের রাত এখানেই কাটবে ।
কিন্ত সেই স্থির আর স্থির রইল না। মানুষ ভাবে এক, হয়
আর। ভিক্ষু আর ভিক্ষণীকে নিয়ে যাবার জন্যে শিমুলতলী থেকে
কয়েকজন লোক এসে উপস্থিত। অদ্ভুত যোগাযোগ ! ওদের মধ্যে
“একজন সামনে এগিয়ে এসে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একেবারে
লাফিয়ে উঠল, হ্যা গো, এরাই তো তারা ! আমি আগেই ভেবে-
ছিলাম বলেই সে শংখ দেবীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। সংগে
সংগে আর সবাই।
শংখ দেবী একটু পিছনে হটে গিয়ে বললেন, কে গো তোমরা ?
কি চাও আমাদের কাছে?
লোকটি উঠে দীড়িয়ে বলল, আমি মা! আমি, আমি তোমার
বেরজবাসী।
বেরজবাসী 1? সেআবারকে? শংখ দেবী আকাশ পাতাল
ভাবতে লাগলেন। বেরজবাসী এবার মুখের হতাশ। সুচক শব্দ করে
বলল, আহা মা, এরই মধ্যে ভূলে গেলে ! সেই যে ক'মাস আগে
চক্রুশিল! গীঁয়ে মড়ক লেগেছিল---
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৪৯
হ্যা ইা। মনে আছে আমাদের, শংখদেবী আর হরিগুপ্ত একই
ংগে বলে উঠলেন ।
মনে আবার থাকবে না, সে কথা কি কেউ ভুলতে পারে!
কি দিয়েছিল কালব্যাধি দেখ! দিল ঘরে ঘরে । ভাগ্যিস তোমরা
গিয়ে পড়েছিলে, তা নইলে গাঁয়ের একটা মানুষ বাচত না, চক্রশিলা
গায়ের লোকেরা সবাই এ কথা বলে। চক্রশিল! আমার শ্বশুরের
দেশ। বউ আর ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম বেড়াতে, হারে আমার
বেড়ানো, যাওয়ার সংগে সংগে বউ আর ছেলে ছুটোই পড়ল এক
সংগে । কেবল ঘর আর বার, ঘর আর বার, শেষে আর বাইরে যেতে
পারে ন7া। মরেই তো! গিয়েছিল, তোমরা! গিয়ে বীচালে। আমার
বউর নাম সন্ন আর ছেলে মাণিক। এই বার মনে পড়েছে তো?
সেদিন চক্রশিলা গ্রামে কত ত্বর্ণ আর কত মাণিক সেই দারুণ
রোগে লুটোপুটি খেয়েছে, পুরো একটা মাস কত রোগীর সেব!
করতে হয়েছে, তাদের মধ্যে কারু নাম কি আর মনে করে রাখা
সম্ভব? তবু বেরজবাসীকে খুশী করবার জন্য শংখ দেবী বললেন,
হ্যা, হ্যা, এইবার মনে পড়েছে বটে । তোমার বউর নাম সর ছেলের
নাম মাণিক, কেমন ঠিক বলছি না?
বেরজবাসী গালভরা হাসি হেসে বলল, আযাঃ হা হা! হা হা!
হা! যা বলেছ, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। তাই তো বলি, তুমি
কি কখনও আমাদের কথ! ভূলে যেতে পার! শংখ দেবী জিজ্ঞীস!
করলেন, কিন্তু আমরা যে এখানে, ও ব্রজবাসী, তোমরা কেমন করে
জানলে?
কেমন করে জানলাম ? আমাদের গীয়ের মেয়েরা দই বেচতে
গিয়েছিল হাটে । ফিরবার পথে এইখানেই তো তোমাদের সঙ্গে
ওদের দেখা হয়েছে । ওরাই গিয়ে বলল। আমি বললাম, এ আর
কেউ নয়, আমাদের সেই মা! আর বাবা ।
সবাই বলল, তা তোর! তাদের সংগে করে নিয়ে এলি না কেন?
২৫০ বিদ্রোহী £কৈবর্
ওর। উত্তর করল, আমরা 'বলেছিমন্থ গো, তা তেনারা এলেন না»
আমর! কি করব।
হরিগুপ্ত সেই মেয়েদের পক্ষ সমর্থন করে বললেন, হ্যা, ঠিক
কথাই, তারা অনেক করে আমাদের বলেছিল । আমরাই যাইনি ।
এবার আর কেউ তারা যাবেন কি যাবেন না৷ এ বিষয়ে তাঁদের
মতামত জানতে চাইল না, সবাই মিলে কলরব করতে করতে যেন
তাদের টেবে নিয়ে চলল । সম্মতি বা অসম্মতি জানাবার মত কোন
অবকাশই পেলেন না তারা
ইতিমধ্যে আকাশে ভাংগ। টাদট। দেখ! দিয়েছে ।
আকাশের কোলে জ্যোম্নার পাতলা পর্দাটা! উজ্জল থেকে:
উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে । বির ঝির করে বাতাস বইছে। বট গাছটা
ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে এসেছেন তীরা । শংখ দেবী হতাশাখিক্ন কণ্ঠে
হরিগুপ্তের কানের কাছে গুঞ্রন করে বললেন, দেখ গে। দেখ, একবার,
পিছন ফিরে চেয়ে দেখ। বটগাছটা যেন আমাদের হাতছানি দিযে
ডাকছে । আমর! যে বলেছিলাম ওর তলায় সারাট1 রাত কাটাব। আঃ
রি শুন্দর জ্যোতসা, কি হ্বন্দর বাতাস আর কি সুন্দর ওই গাছটি !
হরিগপ্ত তার প্রত্যুত্তরে বললেন, সত্যই ভারী হুন্দর, কিন্তু এবার,
এদিকে চেয়ে দেখ একবার, কি লুন্দর এই মানুষগুলি ! কেমন করে
ওর] পরকে আপন করে নিতে পারে।
সত্যি বলেছ, কি স্ন্দর এই মানুষগুলি, আমি কাকে ফেলে কার
দিকে তাকাই ! শিমুলতলীতে এসে একট! নৃতন সংবাদ পাওয়া
গেল। পৃ পাড়ার অনংগ গয়ায় গিয়েছিল বাপের পিও দিতে ।
কালই ফিরেছে । আসবার সময় পথে শুনে এসেছে রাজা
শৃরপালদেব কাঞ্চন নগরে তার নৃতন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কাঞ্চন নগর? হরিগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, তবে যে.
শুনেছিলাম গোৌঁড় ছেড়ে তার! ধর্মপুরের দিকে গিয়েছিলেন, সে
কথাটা কি ত৷ হলে ঠিক নয়?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৫১
অনংগ বলল, কথাটা সম্ভবত ঠিকই। আমিও সেই রকমই
শুনেছি।
প্রথমে তারা ধর্মপুরেই গিয়েছিলেন । কিন্তু কৈবর্তেরা ধর্মপুর
আক্রমণ করতে আসছে সংবাদ পেয়ে তারা ধর্মপুর ছাড়লেন ।
তারপর কিছুদিন এখানে কিছুদিন ওখানে এই ভাবে ছুটোছুটি
করে অবশেষে কাঞ্চন নগরে গিয়ে স্থায়ী হয়ে বসেছেন ।
আজকালকার দিনের খবর কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যে
বলা কঠিন। রামপালদেব কোথায়? হরিগপ্ত প্রশ্ন করলেন।
অনংগ উত্তর দিলেন, তার সম্বন্ধে এক একজন লোক এক এক
রকম কথ! বলে। কেউ বলে তিনিও কাঞ্চন নগরেই আছেন,
আবার কেউ বলে তিনি বর্তমানে কোটিবর্ষে।
কোটিবর্ষে? কোটিবর্ষে কেন?
লোকে বলছে কৈবর্তদের বিরুদ্ধে দল বাধবার জন্য তিনি নান!
অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ।
কথায় কথায় কৈবর্তদের কথা উঠে পড়ল। এখানকার লোকদের,
মধ্যে কৈবর্তদের সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা । ' এর! বলে, এদের মত,
সরল ও সৎ স্বভাবের মানুষ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
আর এরা যে বীরের জাত সে কথা তো। প্রমাণ হয়েই গেছে।
এখান থেকে দশ-এগারো ক্রোশ পথ ছাড়লে পর তবে বরেক্দ্ীর
প্রত্যন্ত দেশে পৌছানো যায়। শিমুলতলী গ্রাম আর তার
পাশাপাশি গ্রামগুলিতে বু গোয়ালার বাস। এ অঞ্চলের
গোয়ালারা মহিষ কিনবার জন্ত বরেন্দ্রীর মহিষের হাটে যায়। ভাল
জাতের মহিষ এই অঞ্চলে আর কোথাও পাওয়া যায় না। আগে
গৌড়ের রাজপুরুষের! এই সব হাট থেকে কর তুলত। মহিষের
ক্রেতা আর বিক্রেতা উভয় পক্ষকেই কর দিতে হোত। কিন্তু
কৈবর্তেরা স্বাধীন হয়ে যাবার পর হাটের কর বলে এখন আর কিছু
নেই! এখানকার গোয়ালারা এতে ভারী খুশী।
২৫২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
গড়ের হাত থেকে মুক্ত হবার ফলে বরেন্দ্রীর লোকদের এখন
সব দিক দিয়েই সুবিধা হয়েছে, এখানকার লোকেরা সবাই এই কথা
স্বীকার করে। আগে বরেন্দ্রীর অধিকাংশ ধান বাইরে চালান হয়ে
যেত। তার ফলে প্রায়ই আকাল লাগত। কিন্তু এখন থেকে
আর তা চলবে না, বরেন্দ্রীর প্রয়োজন মিটিয়ে যেট! বাড়তি থাকবে
একমাত্র সেটাই চালান যাবে! এই হচ্ছে রাজা দিবেবোকের আদেশ ।
স্থযোগ স্থুবিধা নান! দিক দিয়েই বেড়েছে । সব চেয়ে বড় সুবিধা
আগে প্রজাকে শস্তের ছ ভাগের এক ভাগ রাজার কর হিসেবে দিতে
হোত। আর এখন তাকে কমিয়ে আট ভাগের এক ভাগ করা
হয়েছে । ওখানে এত দিন ধরেযে জোর জুলুম অত্যাচার চলে
আসছিল, এখন আর তার চিহন্টুকুও অবশিষ্ট নেই। মানুষ এখন বড়
শান্তিতে আছে। আর রাজ! দিবেবোক তো সমস্ত প্রজার বাপ
মায়ের তুল্য।
এখান থেকে যারা বরেন্দ্রীর হাটে মহিষ কিনতে যায়, তারাই
ফিরে এসে এখানে এ সব কথ ছড়ায়। তাদের মারফত কৈবর্তের!
এখানকার লোকদের কাছে ঘন ঘন খবর পাঠাচ্ছে, তোমর! আমাদের
ংগে এসে পড়। ওদের সংগে থেকে কি লাভ ? আমাদের এখানে
কর বলতে ফসলের আট ভাগের এক ভাগ এই মাত্র, এ ছাড়া আর
কোন আদায় নেই। আরও দেখ, যে ফসল রাজভাগ্ারে জম] হয়,
তার সবটাই প্রজাদের ভালোর জন্য খরচ করা হয়ে থাকে । রাজা
দ্রিবেবাক তার একট! কনাও ছুয়ে দেখেন না।
এ সব কথা শুনে অভাবী লোকদের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে । তা
তো হবেই । ফসলের ছ ভাগের এক ভাগ, ছিষ্টির প্রথম থেকে এই
নিয়ম চলে আসছে । কত রাজ! এল, আর কত রাজা! গেল, কিন্ত
এই নিয়ম কেউ বদলাতে পারল না। আর কৈবর্তেরা রাতারাতি
সব কিছু বদলে দিল। তাদের এই নিয়ম যদি এখানেও আসে,
“ভবে এর! খেয়ে পরে বাঁচবে । এরা তো ভালই বলছে।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৫৩
কিন্তু বুড়ো! মোড়লরা এতে একেবারেই নারাজ । তার! বলে,
আরে ওরা আজ আছে, কাল নেই।. দেখ না, আমাদের রাজারা
এই এসে পড়লেন বলে। গৌড় আর ক'দিন ওদের হাতে থাকবে !
কুকুরের কি আর ঠাকুর ঘরে জায়গ! হয়! আমাদের রাজ! তেরা
ছিলেন না, তাই না একটা অঘটন ঘটে গেল। আবার যার ধন
তার হাতেই চলে যাবে। মাঝখানে, ওদের সংগে গিয়ে আমরা
অনর্থক বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব। ওসমস্ত কথা ভেবো না
. তোমরা । আর তা ছাড়! আমাদের রাজা কত বড় রাজা,
সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের নাম। তাদের ছেড়ে আমরা ওই
বর্বর কৈবর্তদের রাজা বলে মানব? আমাদের একট মান
মর্যাদা নেই ?
এই শেষের কথাট। সবার মনেই একটু খুতখুতি জাগায় । কিন্তু
মান বড় না প্রাণ বড়? আবার ওদিকে কেবর্তের প্রচার করে
বেড়াচ্ছে ।. আমর! গরীব মানুষ, আমাদের গরীব রাজাই ভালো ।
গরীব না হলে গরীবের ছুঃখের কথা কে আর বুঝবে। এ কথাটাকেও
তো! একেবারে মিছে কথ৷ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই নিয়ে এখানকার লোকের মনে নানা রকম সংশয়। কয়েক-
জন হরিগুপ্তকে চেপে ধরল, আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি, তার উপর আপনি
আমাদের আপন লোক, আপনি বলুন, এ অবস্থায় আমাদের কি করা!
উচিত। এতক্ষণ ওদের আগ্রহ মিটাবার জন্য অনেক ভাল ভাল
কথা শোনাচ্ছিলেন হরিগুপ্ত। কিন্তু এই প্রশ্নটা এমন ভাবে তার
উপর এসে পড়তে থমকে গেলেন। প্রজার! রাজার সংগে থাকবে
ন। রাজত্রোহীদের সংগে যোগ দেবে? এ প্রশ্বের কি উত্তর দেবেন
তিনি? রাজার সংগে থাক-_এইটাই তার পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক
উত্তর । কিন্ত রাজধানী ছাড়বার পর থেকে এই কয় মাসে এ রাজ্যের
মানুষের ছুঃখ-ছর্দশ! আর আশা-আকাঙ্খার সংগে তার যে প্রত্যক্ষ
পরিচয় ঘটেছে, তার ফলে সেই সহজ ও স্বাভাবিক কথাটাও মুখ
২৫৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
দিয়ে বেরিয়ে এল না। কিন্তু রাজদ্রোহীর সংগে যাও, এমন একটা
কথাও তিনি বলে উঠতে পারলেন না।
শেষকাঁলে অনুরূপ অবস্থায় বিচক্ষণ ব্যক্তিরা যা করে, তিনিও
তাই করলেন-_উত্তরট1 এড়িয়ে গেলেন । বললেন, সংসারের মধ্যে
থাকলেও আমরা সংসারের বাইরে । এ সব কথা আমর! ভাল বুঝি
না। তোমরা দশ জনে মিলে ভেবে দেখ। কোনটা তোমাদের
করণীয়, তৌময়াই তা স্থির কর।
তার মুখ থেকে এমন একটা কথ! কেউ আশা করেনি । ওরা
একটু মনঃক্ষু্র হোল ।
সেই রাত্রিতে সবার কাছ থেকে ওরা যখন নিরালা হলেন, শংখ
দেবী বললেন, ওরা ওদের জীবন মরণ সমস্থা নিয়ে প্রশ্ন করল, আর
তুমি এমনি করে এড়িয়ে গেলে !
হরিগুপ্ত তার কথাটা! বুঝতে পারলেন, তবু জিজ্ঞাসা করলেন,
কিসের কথা বলছ?
কিসের কথা বলছি? বুঝতে পারছ না তুমি? ওরা রাজার
পক্ষে থাকবে, ন৷ কৈবর্তদের পক্ষে যাবে, ওরা তোমার মুখ থেকে এই
প্রশ্বের উত্তরটাই শুনতে চাইছিল । তোমার কি এর উত্তরে কোন
কিছুই বলবার মত ছিল না?
হরিগুপ্ত একটু সময় চুপ করে থেকে বললেন, হ্থ্যা, উত্তর একটা
ছিল। কিন্তু কে জানে কেন, ওদের কাছে বলে উঠতে পারলাম
না। সত্য কথাটা! আমার ঠোঁটের কাছে এসেও আটকে গেল।
আমার কাছেও কি বলতে পার না?
হ্যা, পারি । কিন্ত তোমার হয় তো ভাল লাগবে না। তবে
শুনতে যখন চাইছ, তখন বলি ।
এ পর্যস্ত যা কিছু দেখে এসেছি, আর এখন যে সব কথা শুনছি,
তাতে মনে হয়, আমাদের সভ্য রাজাদের রাজত্বের চেয়ে বৰর
কৈবর্তদের রাজত্ব অনেক ভাল ।
চৌদ্দ
এক বছর বাদে ওলান ঠাকুরের পরবের দিন আবার ঘুরে
'আসছে। বরেন্দ্রী আর গড়ের কৈবর্তেরা নেচে উঠেছে । সারা বছরে
.এই একটা দিন, এ দিনের সংগে আর কোন দিনের তুলনা হয় না ।
সেই কবে থেকে ওরা দিন গুণে শুণে আসছে! তিনশোর উপরে
'আরও তিন কুড়ি পাঁচ দ্রিন, এতগুলো দিন পেরিয়ে তবে আসবে
সেই পরবের দ্রিন। ধৈধ কি বাধ মানতে চায়! মাসখানেক আগে
থেকেই উয্ুগ আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। ঢাকীরা! আর ঢুলীরা
তাদের যন্ত্রের সারাই করবার কাজে লেগে গিয়েছে । পরবের পাচ
দিন আগে থেকেই ওরা লোকের কানে তাল! ধরিয়ে ছাড়বে । ঘরে
ঘরে মদের চোলাই হচ্ছে। কি পুরুষ কি মেয়ে, সবাই সাধ মিটিয়ে
নাচবে, গাইবে, আর ঢোকে ঢোকে মদ গিলবে। চোখ পলাশ ফুলের
'মত লাল হয়ে উঠবে, গা ঝিমঝিম, পা টলমল করবে, শেষে দীডিয়ে
থাকতে পারবে না, ধুলোয় পড়ে লুটোপুটি খাবে। আর মনটা!
দেহের পি'জরা ছেড়ে পাখীর মত আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াবে!
মানুষ কি আর তখন মানুষ থাকে !
প্রতি বছর এমন দিনে পরবের নামে এমনি করে মেতে ওঠে
সবাই। কিন্তু মাত্র দিন দশেক আগে সংকট দেখা দিল। ওলান
ঠাকুরের পরব নিয়ে এমন সংকট আর কখনও দেখা দেয়নি। কথাট!
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । থেমে গেল আনন্দ উৎসব, লোকের চোখে
আতংকের চিহ্ন, পথে ঘাটে এ ওর সংগে কানাকানি করে।
রাজা! দিব্বোক নাকি আদেশ দিয়েছেন এবার থেকে গলান-
“ঠাকুরের কাছে মানুষ বলি দেওয়া চলবে না। সেই কোন যুগ ষুগ্রাস্ত
২৫৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
ধরে এই প্রথ! চলে আসছে, তার উপর হাত দিতে চায় রাজা,
এতই তাঁর ছুঃসাহপ। এই দিনে ওলান ঠাকুরের কাছে শুধু মানুষ
বলিই যে হয় তা নয়, মহিষ, শুয়োর, ছাগল মোরগ আরও কত
রকম বলি পড়ে । ওলান ঠাকুর যে বটবৃক্ষের উপর ভর করে আছেন,
তার তলায় মাটি রক্তে কাদ। হয়ে যাবে । কিন্তু সকল প্রাণীর সেরা
প্রানী মানুষ । দেজন্তে মানুষ বপিই শ্রেষ্ট বল। আর যত কিছু
বলি পড়ুক না কেন, মানুষ বলি না পড়লে ওলান ঠাকুর তৃপ্ত হন না।
এ কথ! কৈবর্তদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জানে । সেই বলি
বন্ধ করতে চাইছেন রাজ । ওলান ঠাকুরের দয়াতেই কৈবর্তদের সব
কিছু, তিনিই যদি ক্রুদ্ধ হন, তবে আর কাউকে বাঁচতে হবে না।
প্রথমে কথাট। শুনেও লোকে বিশ্বাস করতে চায় নি। এট! কি
একট! বিশ্বাস করবার মত কথা ॥ কিন্ত মোড়লর৷ আর রাজপুরুষরা
যখন এই নিয়ে প্রকাশ্টে বলাবলি শুরু করল, তখন বিশ্বাস না করে
উপায় কি?
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কৈবর্তেরা পরবের অন্তত এক মাস
অ্ুগে বরেন্দ্রীর বাইরে অন্ত সমাজ থেকে বলির মানুষ চুরি করে বা
মূল্য দিয়ে কিনে নিয়ে আসে । ওলান ঠাকুরের বিধানে এ চুরিতে
কোন পাপ নেই, বরঞ্চ এটাই প্রশস্ত । তারপর বলির আগ পর্যন্ত
এক মাস কাল সেই মানুষকে তার! প্রতি দিন গঞ্ধতেল মাখিয়ে
ল্লান করার, স্ত্বাহু খাগ্ভ খাওয়ায়, পরম সমাদরে তার পরিচর্ধ। করে।
এখানে এই রীতি আবহমান কাল ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে।
এবার ওরা এক কিশোর ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে । ক' দিন
আগে সেই ছেলেটাকে স্নান করাবার জন্য পুকুরের ঘাটে নিয়ে
যাচ্ছিল। আর ঠিক সেই সময় রাজ! দিবেবাক সেখান দিয়ে
যাচ্ছিলেন । তাকে দেখে কি মনে হোল ছেলেটার, সে এক ঝটকায়
ওদের হাত ছাড়িয়ে ছুটতে ছুটতে এসে রাজাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে
উঠল, বাঁচান, আমাকে বাঁচান ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৫৭
এই থেকেই সংকটের উৎপত্তি । রাজা বলে দিয়েছেন, এ রাজ্যে
মানুষ বলি দেওয়। চলবে না।
ওলান ঠাকুরের পৃজক যারা তারা বলছে, রাজা রাজ্যের শাসন
পালনের কর্তা, দে কথা মানি আমরা, কিন্ত ওলান ঠাকুরের পূজা!
পরবের ব্যাপারে তার কোন কথা বলবার অধিকার নেই । তা
ছাঁড়া আর কোন দেবতা নয়, সব দেবের রাজা স্বয়ং ওলান ঠাকুর ।
এমনিতে তিনি খুবই ভাল, যাকে প্রসন্ন হয়ে দেনঃ ছু হাত ভরে দেন,
কিন্ত একবার যদি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তবে আর কারু রক্ষা নেই।
এ সব কথা শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেল। সত্য কথাই তো,
স্বখে থাকি আর ছুঃখে থাকি, যার দয়ায় খেয়ে পরে বেঁচে আছি, সেই
ওলান ঠাকুরের সংগে এমন ব্যবহার | ওলান ঠাকুরের চাহিদা তে।
বেশী নয়, বছরে মান্ধ একটি করে মানুষ, সেটুকুও যোগাতে পারব ন!
আমরা? প্রথমে কানাকানি, তার পরে দলে দলে লোক রাজ!
দিব্বোকের কাছে এসে ধর্ণা দিতে লাগল । তারা বলল, আপনি
এমন করে সর্বনাশ ডেকে আনবেন না। আমাদের বহু ভাগ্য
আপনার মত রাজ! পেয়েছি, আর তারই ফলে এত দিন বাদে একই
সখের মুখ দেখেছি। কিন্তু ওলান ঠাকুরকে যদি এমনি করে চটিয়ে
তোলেন, তবে কি আর কিছু থাকবে! সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
দিবেবোক নিজের ঘরে বসে বসে এই সব কথাই ভাবছিলেন ।
এই পরবে যোগ দেবার জন্য এখানকার সকলের অন্থুরোধে তাকে
গৌড় থেকে কিছুটা আগেই চলে আসতে হয়েছে । গতবার এ
সময়ে গৌঁড়ে থাকাটা ভার পক্ষে অত্যাবস্তক ছিল, এখানকার
লোকের মনে সেই তুঃখট। আছে। তারা বলে, তিনি না থাকলে
উত্সব নাকি মোটে জমেই না। সেই জন্যই ছোট. ভাই রুূদৌকের
হাতে রাজধানীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি বরেক্্রীতে চলে এসেছেন।
কিন্ত আসার সংগে সংগেই অশান্তি বেধে উঠল। আর এই অশান্তি
তাকেই কেন্দ্র করে। এখন কি হবে এর পরিণতি কে জানে !
১৭--
২৫৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
এক বছর হোল তাদের দেশ তাদের হাতে চলে এসেছে। মাত্র
এক বছরে এই দরিদ্র দেশের কতটুকুই বা উন্নতি কর! যায় ! কিছুই
না। তবু লোকদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, যেন তারা কত
কিছুই পেয়ে গেছে । হ্যা, পাবে, তারা নিশ্চয়ই পাবে। সার!
জীবন ধরে যে স্বপ্ন তিনি দেখে এসেছেন, সে দ্বপ্ণ এক দিন সার্থক
হয়ে উঠবেই। ভাগ্যের নিষ্ঠুর বিধানে এত কাল যারা পদদলিত
হয়ে এসেছে; বর্বর বলে সকলের কাছে অবজ্ঞ! ও দ্বণার পাত্র বলে
গ্প্য হয়েছে, এক দিন তারাও মাথা উচু-করে দাড়াবে ।
হ্যা, এ স্বপ্ন সফল হবেই, কেননা এ তো। তার একার স্বপ্নই নয়,
এ যে বরেন্দ্রীর সকল মানুষের স্বপ্ন । ম্বাধীনতা লাভের সংগে সংগে
সারা দেশ জুড়ে কি এক অদ্ভুত কর্মচাঞ্চল্য জেগে উঠেছে ! সাধারণ
মানুষগ্চলি কোন্ মন্ত্রের জোরে এমন নৃতন মানুষ হয়ে উঠল । তিনি
গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, আর অনুপ্রাণিত হয়ে ফিরে
এসেছেন। তখন মনে হয়েছে, কে এদের ঠেকিয়ে রাখবে।
মাঝে মাঝে নানা সুত্রে সংবাদ আসে শক্রুপক্ষ গৌড় পুনর্দখল
করবার জন্য তাদের শক্তি সমাবেশ করছে । এমনও সংবাদ এসেছে,
ওর! যে কোন সময় অতঞ্কিত এসে ঝাপিয়ে পড়তে পারে । তিনি
গৌড় আর বরেন্দ্রীর প্রান্তে প্রান্তে গিয়ে লোকদের উদ্ধ,দ্ধ করে
তুলেছেন। ওর! বিন্দু মাত্র ভয় পায় নি। সতেজ কণ্ঠে জানিয়ে
দিয়েছে, আপনি সামনে থাকলে আমরা কাউকে ভয় করি না।
আর তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন আর আমি তোমাদের মুখের দিকে
যখন তাকাই, তখন আমার মনেও কোন ভয় থাকে না। ওরা শুনে
হেসেছে। কিন্তূ তিনি ভাল করেই জানেন, এ হাপির কথা নয়,
গাছ যেমন করে আকাশ থেকে আলোক পান করে সতেজ হয়ে
ওঠে, তিনিও তেমনি এদের মুখের দিকে তাকিয়ে নৃতন শক্তি
আহরণ করেন ।
কিস্ত এ হোল এক দিক । এর বিপরীত দিকও আছে । মাঝে
বিপ্রোহী কৈবর্ত হ৫৯
মাঝে এমন এক একটা ঘটন]1 ঘটে, ঘা মনকে বড় গীড়িত করে
তোলে, কেমন একট] অনির্দিষ্ট আশংক1 ঘিরে ধরতে চায়। মনে
পড়ে, গৌড় বিজয়ের পর নগরীর ভাল ভাল বাড়ীগুলিকে দখল করে
বনবার জন্য বরেন্দ্রীর বিশিষ্ট কৈবর্ত দলপতিদের পরস্পরের মধ্যে
সে কি প্রতিযোগিতা ! তাদের সামলাতে কম বেগ পেতে হয় নি
সেদিন । আর তার জের যে পুরোপুরি কেটে গেছে তাও নয়।
সে সময় নগরীর বড় ছোট প্রতিটি গৃহ লুঠ্টিত হয়েছিল। আদেশ
দেওয়া হয়েছিল, এই সমস্ত লুহ্টিত দ্রব্য সাধারণের সম্পত্তি, সাধারণের
কল্যাণার্থে নিয়োজিত হবে। এতএব যে মা পায় সবাই যেন রাঁজ-
ভাগুারে জম! দেয়। অনেকে জম৷ দিয়েছিল, কিন্তু সবাই দেয় নি।
সবাই যে দেয় নি, সেই সত্যটা জান! গেল যখন তিনজন লোক
লুষ্টিত মাল নিয়ে একেবারে হাতে নাতে ধরা পড়ল। পরতু ক্ষিপ্ত
হয়ে তিনজনকে ঘটাস্থলেই হত্যা করল। কথাটা পরে দিব্বোকের
কানে এসেছিল। শোনার পর তিনি মনে মনে বলেছিলেন,
অপরাধীর দণ্ডবিধান তো!হোল। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে নৃতন
সমস্ত! দেখা দিল, তার সমাধান কোথায়? আমরা তো কেউ
এজন্য প্রস্তত ছিলাম না।
কৈবর্তদের মধ্যে এ রোগ কোন দিন ছিল না। এ রোগ গৌঁড়ের
সভ্য জাতির রোগ এই কথাই তারা জেনে এসেছেন। তবে কি ধন
সম্পদ এই রোগকে তার সাথী করে নিয়ে আসে?
এই কথাই যদি সত্য হয়, তবে এম্বর্যময়ী গৌড় নগরীর অধিকারী
কৈবর্তা্দের ভিষ্যংটাই বা কি? যে মব কেবর্েরা! গ্রাম ছেড়ে নগরে
চলে এসেছে, তাদের ত্বভাব আর চালচলন বড় বেশী দ্রেত গতিতে
বদলে যাচ্ছে।
গ্রামের মানুষ নগরবাসী হয়েছে, স্বভাবের পরিবর্তন হবে, এটা
অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পরিবর্তনের রকমটা তার কাছে স্বাস্থ্যকর
বলে মনে হচ্ছে না।
২৬৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
লোকে বলে, বর্বর কৈবর্ত। মুখের সামনে নাই বলুক, কৈবর্তদের
সম্পর্কে অসাক্ষাতে অনেকেই এই কথা বলে ! এই কথাট1 মনে হলে
তার গায়ের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় চড়ে যায়। অথচ ঠাণ্। মাথায়
ভেবে দেখলে কথাটা কি একেবারেই অমূলক ? মূর্খ অশিক্ষিত
লৌক, আর বরের মধ্যে তফাৎটা! কি? কৈবর্ত সমাজে লেখাপড়ার
চর্চা কোন দিনই ছিল না, আজও নাই। আর তা নিয়ে কারু মাথা
ব্ঘাওনাই । এ নিয়ে কয়েকজন মোড়লের সংগেই আলাপ করে
দেখেছেন তিনি । কেউ যেন কথাটা! গায়ে মাখতে চায় না । তার
পরেও যদ্দি জোর করে কথাটা! চালিয়ে বাওয়া যায়, তখন তার
ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে । আর সরে পড়বার জন্য ছুতো
খোজে ।
আবার কেউ কেউ সোজা আপত্তি জানিয়েই বসে। বলে, দরকার
নাই বাপু বেশী লেখাপড়া শিখে । এমনিতেই ভাল আছি। লেখাপড়া!
শিখলে মানুষ আর মানুষ থাকে না । ওই পুঁথিগুলির পাতায় পাতায়
যত রাজ্যের ছষ্ট বুদ্ধি আর বজ্জাতির বীজ রয়েছে। গৌড়ের
মানুষগুলো! এত কুবুদ্ধি কোথা থেকে যোগাড় করত? ওদের ওই
পু'খি-লো থেকেই তো৷। তুমি কি আমাদের ছেলেগুলোকে ওদের
মত করে তুলতে চাও নাকি ? দিবেবোক অনেক চেষ্টা করেও ওদের
বুঝিয়ে উঠতে পারেন না । এদের আর সব কাজেই উৎসাহ আছে
এই একট! কাজ ছাড়া । এমন একটা মানুষ নাই যার সংগে এই নিয়ে
মন খুলে আলাপ করতে পারেন, বুদ্ধি পরামর্শ করতে পারেন বা
কোন কাজের ভার দিতে পারেন । ঠিক এই রকম সময়ই মনে পড়ে
যায় পদ্নাভের কথা ! গৌড়ের অনেক লোকের সংগেই তার আলাপ
পরিচয় ছিল। কিন্তু এমন একটা মানুষ কোন দিন ভার চোখে
পড়েনি । মাত্র তিনটি দিনের পরিচয় । এই তিন দিন তার! ধসে বসে
কত কল্পনাই না করেছিলেন । পদ্মনাভ বলেছিলেন, আমি আমার
নিজের জায়গা! ছেড়ে এইখানে এসেই সংসার পেতে বসব।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৬১
কৈবর্তদের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারই হবে আমার জীবনের একমাত্র উদ্দোশ্ঠু,
দিবেবাক সেদিন তার কথাগুলি বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন । কিন্ত কি
হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত, তাদের হাতেই পদ্মানাভের মৃত্যু ঘটল। তীর
সেই চিঠিটা! তিনি এখনও ষত্ব করে রেখে দিয়েছেন । চিঠিঠা পড়লে
মনে হয় মানুষটির মন যেন সেই রকমই ছিল। নাঃ এমন একটা
মানুষ তিনি আর কোন দিন দেখেন নি।
একটা কথা নিয়ে ভাবতে বসলে কত দিক থেকে কত কথাই না
ভেসে আসে ! কৈবতর্দের কথা ভাবতে ভাবতে পক্সনীভের কথায়
এমে পৌছলেন। কিন্তু" হঠাৎ চমক ভাংগল তীর। এ সমস্ত কি
কথা নিয়ে এখন ভাবতে বসেছেন তিনি! তিনি কত বড় এক
সংকটের মুখে এসে দীড়িয়েছেন, এ কথ কেমন করে ভূলে
গিয়েছিলেন ! ছেলেটাকে সেদিন আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, কোন,
ভয় নাই তোমার। আমি কথ! দিচ্ছি, কেউ তোমাকে মারতে
পারবে না। কিন্তু তার সেই আশ্বাস এখন বৃস্তলগ্ন শুকনো পাতার
মতই কাপছে? এখন দেখছেন এ বিষয়ে সবাই তার বিপক্ষে । এ
অবস্থায় কেমন করে তিনি ওকে বাচাবেন !
সবার মুখেই এক কথা-_এমন সর্বনাশ করবেন না । ওলান ঠাকুর
চিরকাল এই বলি পেয়ে আসছেন ! কোন দিন নিয়মের নড় চড়
হয়নি। আর আঙ্গ যদি সেই নিয়ম ভাংগে তবে কি যে মহাবিপদ
ঘটবে সে কথা কি কেউ বলতে পারে!
বলে বলে হার মেনে গিয়েছেন তিনি, কিন্ত ওদের বুঝিয়ে উঠতে
পারেন নি। কোথাকার কোন দুরের, কোন্ সমাজের, কাদের এক
ছেলে তার জন্য এত কিসের টান। ও আমাদের কে যে, ওর কথা
মনে করে সমস্ত কৈবর্ত সমাজের উপর এমন বিপদ টেনে আনতে
হবে? সকল ব্যাপারে এমন বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ রাজা, কিন্ত
এমন বুদ্ধিত্রংশ তার কেমন করে ঘটল, সব মানুষ এই কথাই বলে।
দিব্বোকের কথাটা মনের সংগে মেনে নিয়েছে শুধু কয়েকটা
২৬২ বিদ্রোহী কৈবর্ঘ
ছেলে--কয়েকটা কাচা বয়সের ছেলে । কিন্তু ওদের কথায় কি
আসে যায়, ওদের কথার দাম দেয় কে!
ওদের মধ্যে হছজন কাল এসেছিল । ওরা টুপি চুপি বলল, আপনি'
বলুন, আমরা ওদের হাত থেকে ছেলেটাকে চুরি করে কোথাও
সরিয়ে ফেলি ।
কিস্ত ওদের কথায় সায় দিতে পারেন নি তিনি । বলে দিয়েছেন,
না না, এমন কাজ করতে যেওন', এতে অশান্তি আরও বাড়বে।
বরেন্দ্রীর সমস্ত কৈবর্ত সমাজ দিব্বোকের যে কোন আদেশ বিনা
বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এইটাই
তারা অন্থভব করেছে যে এই একট! মানুষ যার কথার উপর তারা
নিশ্চিন্ত মনে নির্ভর করতে পারে, এই একটা মানুষ ধার কোন কথা
কখনও ভূল হয় না। আজ দিবেবাক ওদের কাছে শুধু রাজা নয়,
দেবতা হয়ে উঠেছেন। দিবেবাকের নিজের কাছেও এ কথা অজানা
নয়। সেই জন্যই সেই ছেলেটাকে যখন প্রাণের আশ্বাস দিয়েছিলেন,
তখন ভাবতে পারেন নি যে তাকে এত বড় বিরুদ্ধতার সামনে
দাড়াতে হবে। কেমন করে বুঝবেন? ওলান ঠাকুরের প্রতিঘন্দী
হয়ে আর তো! কখনও দাড়াতে হয়নি ।
ব্যাপারটা কতদূর গুরুতর হয়ে দীডিয়েছে, কালই তা৷ প্রথম
ভাল করে বৃঝলেন। গৌড় থেকে রূদোক এই খবর জানতে পেরে
উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোড়-সওয়ার মারফৎ চিঠি পাঠিয়েছে । লিখেছে, কথাটা
শোনার পর থেকে আমাদের মনে একটু শান্তি নেই। খবরটা আসার
সংগে সংগেই সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এখানকার রাজপুরুষ
আর সৈন্যদের মধ্যে এই নিয়ে খুবই অসম্তোষ আর চাঞ্চল্য দেখ
দিয়েছে। বাইরে শক্রুপক্ষ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এই খবর
নান। স্ত্রে আমাদের কাছে আসছে । এ সময় ওলান ঠাকুরের বলির
বিষয়ট। নিয়ে যদি আত্মকলহ বেঁধে ওঠে তবে পরিণাম খুবই ভয়ের ॥
সে জন্য এখানকার সকলের পক্ষ হয়ে আপনার কাছে প্রার্থনা
বিষ্বোহী কৈবর্ত ২৬৩
জানাচ্ছি, সাজের সকলের মনের কথা বিবেচনা করে আপনার এই
আদেশ তুলে নিন, মানুষ হয়ে দেবতার সংগে বাদ সাধতে যাবেন
না। আমার এখন এখান থেকে নড়বার উপায় নেই, নয় তো নিজেই
ছুটে যেতাম।
এরই মধ্যে কথাটা গৌড়ে গিয়ে পৌছেচে ! বরেন্দ্রী আর
গৌড়ের ব্যবধান তো৷ কম নয়। এই ক: দিনের মধ্যে কারু পক্ষে
সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। খবরটা এখান থেকে ঘোড়-
সওয়ার মারফত পাঠানে হয়েছে, এটা অনুমান করে নেওয়। যেতে
পারে। তার চোখের আড়ালে এই সব চলেছে ! আরও কত
কিছু চলেছে, তাইবা কে জানে! পরিস্থিতি গুরুতর, সে বিষয়ে
সন্দেহ নেই।
সার! দেশের মানুষ বলছে--তোমার এই আদেশ ফিরিয়ে নাও।
আর তিনি তার্দের সকলের ইচ্ছার উপরে নিজের ইচ্ছাটাকেই
বজায় রেখে চলবেন ৭ এ তো কৈবর্ত সমাজের নিয়ম নয়। সমাজ
একজনের কথায় নয়, দশজনের কথায় চলে।
কিন্তু এ আদেশ কেমন করে তিনি ফিরিয়ে নেবেন? দেবতার
সামনে নরবলি, এ যে সত্যসত্যই বীভৎস, এর নামই তো বর্বরতা!
এক কালে এই প্রথা নাকি অনেক দেশেই ছিল, কিন্তু এখন লোপ
পেতে পেতে মাত্র কয়েকট। জায়গায় ঠেকে আছে। প্রতিবেশী
কোচের! পর্যন্ত এই নিয়ে কেবর্তদের শিন্দা করে বেড়ায়। কেন
করবে না? করবেই তো। শুধু আজ নয়, বু দিন থেকে এই
প্রশ্ন তার মনকে গীড়া দিয়ে এস্ছে। কিন্তু কিছুট। নিজের মনের
প্রাচীন সংস্কারের অন্য আর তার চেয়েও বেশী আর সকলের মনের
কথাটা ভেবে বলি বলি করেও বলে উঠতে পারেন নি। কিছ
সেদ্দিন একট বিশেষ অবস্থার মধ্যে মনের কথাটা মুখ ফুটে বে'রয়ে
গেছে। তিনি নন, তার চেয়েও বড় কে ষেন একজন তার ভিতর
থেকে এই আদেশ ঘোষণ। করল।
২৬৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
সেই অসহায় আর নিষ্পাপ ছেলেটির ভয়াতুর দৃষ্টি তার চোখের
সামনে এখনও ভাসছে ॥। তিনি তাকে অভয় দিয়েছিলেন, ভয় নেই
তোমার, আমি তোমাকে বাচাব। তার মুখের এই কথাটা শুনে ওর
চোখ ছুটি আশার আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সেই প্রতিশ্রুতি
কেমন করে ভংগ করবেন তিনি ? ও যে তীর সেই মুখের কথাটাকে
আকড়ে ধরে এখনও আশায় আশায় দিন গুণছে।
সবাই সমস্বরে বলছে, তোমার এই আদেশ ফিরিয়ে নাও,
ফিরিয়ে নাও। কিন্তু মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, কিছুতেই মেনে নিতে
চায় না।
হায় ভগবান, তার আর তার সমাঁজের মানুষের মধ্যে এই ছুত্তর
ব্যবধান কেমন করে স্থষ্টি হয়ে গেল? এ যে কল্পনাতীত।
সেবার কীধের উপর যেখানে তীরট! বিদ্ধ হয়েছিল, হঠাৎ সেই
জায়গাটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। সেই জায়গাট! নয়, তার
গভীর তলদেশ থেকে তীব্র বেদনা দমকে উঠে আসছে । অসন্থ
যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর মুচড়ে উঠল | ক্ষতস্থানট শুকিয়েও শুকায় না।
ওষুধ প্রলেপের ফলে মাঝে মাঝে চাপা থাকে, আবার কখনও কখনও
তার মুখ থেকে পৃণঘ গড়িয়ে পড়ে । আর এই বেদনাট। এমনি করেই
মাঝে মাঝে জেগে ওঠে । কখন যে উঠবে আগে থেকে কিছুই বোঝা
যায় না।
দিব্বোক.বসেছিলেন, শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই কে একজন
তার পাশে এসে বসল, আর তার মাথায় আর কপালে হাত বুলিয়ে
দিতে লাগল। তার হাত থেকে যেন মমতা ঝরে পড়ছিল। দিবেবাক
চোথ বুজেছিলেন, বুজেই রইলেন । চোখ ন! খুলেও বুঝলেন এ
কে।
তোমার সেই ব্যথাটা আবার উঠল বুঝি? নরম কণ্ে প্রশ্ন
করল উনছলি।
হ্যা, কিন্ত তুমি কেমন করে বুঝলে ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৬৫
উনছলি এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না, নিঃশব্দ হাত বুলিয়ে
চললেন ।
হাতের গুণেই হোক বা আপনা থেকেই হোক, ব্যথাটা কমে
আসতে লাগল ।
কেন এমন করে কষ্ট পাচ্ছ? তার চেয়ে ওরা যা চাইছে তাই
করুক না। বাধা দিতে গেলে ফল ভাল হবে না।
দিবেবাক বুঝলেন, তার মনের ছবিট1 উনছলির চোখে ধরা পড়ে
গেছে । কিন্তু এ বিষয়ে একটা কথাও তো! তিনি ওর কাছে বলেন
নি। যতক্ষণ ঘরে থাকেন, মনের আগুন মনের মধ্যেই চেপে রাখেন ।
কিন্তু আশ্চর্য, ও কেমন করে যেন সব কিছু টের পেয়ে যায়। শুধু
'আজকার কথাই নয়, চিরদিনই এমনি দেখে আসছেন ।
ওই কথাটা নিয়েই যে মনোকষ্ট পাচ্ছি, এমন কথ! ভাবছ কেন
উনছলি 1 রাজ্য শাসনের বোঝ! যার মাথার উপর তাকে তো! কত
কিছু নিয়েই চিস্তা ভাবন1 করতে হয় !
আমাকে ভুল বুঝিয়ে কি হবে? উনছলি বললেন, কাল রাত্রি-
বেল। তুমি খেতে বসে আধপেট খেয়েই উঠে পড়লে, সারা রাত একটু,
'ঘুমোলে না, শুধু এপাশ ওপাশ করলে । আর আজ কোন কাজেই
মন নাই তোমার, সকাল থেকে চুপ করে বসে আছ--এ সব কি
আমি দেখি না? তুমি যতক্ষণ কাজ নিয়ে থাক আমি নিশ্শন্ত
থাকি। কিন্তু যখন তোমার কাজে মন বসে না, তখন বড় ভয় হয়
আমার, মনে হয়, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। যেদিন থেকে পুকুর-
ঘাটে সেই ছেলেটাকে নিয়ে__বলেই একটু থামলেন উনছলি।
তারপর বললেন, তখন থেকেই তোমার এই অবস্থা শুরু হয়েছে।
বল, সত্যি করে বল, ঠিক বলছি কিন] ।
দিব্বোক এ কথার কোন প্রতিবাদ করলেন না, বললেন, উনছলি
এ অবস্থায় তুমি কি করতে বল আমাকে? তুমি ঠিকই বলেছ,
সত্যিই কষ্ট পাচ্ছি আমি।
২৬৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
দিব্বোক এ পর্যন্ত রাজকার্ষের ব্যাপারে কোন দিনই উনছলির
পরামর্শ চাননি । কিন্ত আজ মনে হচ্ছে আজ যেন একমাত্র উনছলি
ছাড়া আর কোন অবলম্বনই তার নেই। আর কার কাছেই বা এ
নিয়ে কথা বলতে পারেন! উনছলির মনের কথাটা কি, সে কথা!
জানা নেই, কিন্তু যাই থাক, তার ছুঃখটা! সে দরদ দিয়ে বুঝবে।
উনছলি উত্তর দিল, কিন্ত এ তো নৃতন কিছু নয়, চিরকাল চলে'
আসছে। কই, তুমিও তো। কোন দিন কিছু বলনি, এবারই বা এমন,
করছ কেন? সবাই তো। এই কথাই বলছে।
চিরকাল চলে এসেছে, তাই বলে চলতেই থাকবে? কাজটা
যদি খারাপ হয় তবুও ?
তুমি বলছ খারাপ, কিন্ত কই আর কেউ তো তা বলছে না।
দশের মুখেই ভাল, আর দশের মুখেই খারাপ। সেই জন্যই তো?
বলে দশের কথায় মরাও ভাল ।
তার মানে এই বাচ্চা ছেলেটাকে মেরেই ফেলুক ওরা, এই কথাই
তো! বলতে চাইছ? কিন্তু এ যদি তোমার নিজের ছেলে হোত, এমন
একটা কথা বলতে পারতে তুমি? এওতো৷ এর বাপমায়েরই ছেলে !
কথাটা ফস্ করে তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়েছে । উনছলি
প্রথমে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেলেন । নিঃসস্তান উনছলির যেখানে
সব চেয়ে বড় ব্যথা, স্বামী হয়েও দ্িবেবোক সেই জায়গাটাতেই
আঘাত করলেন। ভিতর থেকে হুহ্ছ করে কান্না ঠেলে উঠতে
লাগল তার। উনছলি চেষ্টা করেও আপনাকে সামলাতে পারলেন
না, মুখে কাপড় দিয়ে ফুলে ফুলে কাদতে লাগলেন ।
কথাটা বেরিয়ে যেতেই হুশ এসে গিয়েছিল দিব্ধোকের ।
উনছলিকে কেদে উঠতে দেখেই তিনি উঠে বসে ওর মাথাটা! নিজের
বুকের উপর টেনে নিয়ে ওকে সাম্বনা দিতে লাগলেন, আমাকে
মাপ কর, মাপ কর উনছলি। আমি কোন কিছু মনে করে কথাটা"
বলিনি । হঠাৎ কেমন করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৬৭
উনছলি. তার কাল্লাটা চেপে বিকৃত কে বলল, শোও, শুয়ে
পড় তুমি। আজ আর কোথাও বেরোতে পারবে না। বলে
জোর করে তাকে শুইয়ে দিল।
দিবেবাক একটু অনুনয়ের স্বরে বলল, ব্যথাট। তো! কমেই গ্রেছে।
ন! কমে নিঃ বলে উনছলি আগেকার মতই তার মাথায় হাত,
বুলিয়ে চললেন ।
দিব্বোকের মনে হোল ওর হাতট। যেন একটু কাপছে।
উনছলি ঠিকই বলেছিল, ব্যথাট মাঝখানে একটু কমেছিল বটে,
কিন্ত আবার সেটা ফিরে এসেছে। দিব্বোক আপনাকে সম্পূর্ণভাবে.
তার হাতে ছেড়ে দিলেন।
ব্যথাট! এই রকমই । কখন উঠবে, কখন নামবে, কিছুই বলা
যায় না।
বরেক্দ্রীর লক্গ্রণদাস কৈবর্তদের মধ্যে সব চেয়ে প্রাচীন চিকিৎসক।
সার! বরেক্ত্রী জুড়ে তার নাম ডাক । লোকে বলে লক্ষণদাস রোগীর
গায়ে হাত দিয়ে তার বিশ বছর আগেকার রোগের খবর বলে দিতে
পারেন। তিনি এক দিন মুখখানা গম্ভীর করে বলেছিলেন, এঁই
রোগের লক্ষণটা বড় বেশী ভাল ঠেকছে না আমার কাছে। ক্রমেই
যেন ভিতরে, আরও ভিতরে চলে যাচ্ছে । কেজানে হয় তো এই
রোগেই এক দ্বিন_-
কথাটা! আর কেউ জানে ন!। লক্ষ্ণদাম উনছলির কাছে চুপি
চুপি এই কথাটা! বলেছিলেন । আরও সাবধান করে দিয়েছিলেন,
রোগীর মনটা! ধাতে ভাল থাকে, সেদিকে যেন সব সময় দৃষ্টি রাখে,
কোন রকম ছুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ যেন তাকে পেয়ে না বসে।
লক্ষণদাস তো বলেই খালাস। কিন্ত ছুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ
দিব্বোকের সব সময়কার সাথী । উনছলি তাকে তা থেকে কেমন
করে রক্ষা করবেন ? কোলের ছেলে হলে না হয় সামলে রাখতে
পারতেন। কিন্তু এ যে রাজা, সারা দেশের মানুষ তার মুখের দিকে
২৬৮ বিজ্রোহী কৈবর্ত
তাকিয়ে আছে। উনছলির মত সামান্য মেয়ে কি কথ! বলবে
তাকে? আর বললেই সে কি তা শুনবে !
কিন্ত লক্ষণদাসের সেই সতর্কবাণী যখনই মনে পড়ে, ভয়ে বুক
কেঁপে ওঠে উনছলির। মনের এই বোঝাট1 একাই তাঁকে বহন
করে চলতে হয়।
দিবেবাকের ওই কথাটার ফলে যে অস্বস্তিকর ও আড়ষ্ট
পরিস্থিতির স্থর্টি হয়েছিল, একটু একটু করে তা স্বাভাবিক হয়ে
এল। আবার তার ফিরে এলেন আগেকার কথায়।
উনছলি বলছিল, কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, আমি তার
কতটুকু বুঝি, কিইব৷ বলব! কিন্তু একটা কথা জেনো, শেষ পর্যন্ত
তোমার এই কথা কেউ মানতে চাইবে না। দেবতাকে কে ন1 ভয়
করে। বিশেষ করে ওলান ঠাকুরের মত জাগ্রত দেবতা ।
মানতে চাইবে না? নাই বা মানল। ওর! আমাকে মুক্তি
দিক, তার পরে ওদের প্রাণ বা চায়, ওর! তাই করুক। আমার
আর ভাল লাগছে ন1। চাইন। আমি রাজত্ব করতে।
কথ শুনে অবাক হয়ে গেলেন উনছলি।' বললেন, তুমি বলছ
কি? সার! দেশের মানুষ তোমার উপর নির্ভর করে আছে, আর
তুমি রাগ করে এই ছঃসময়ে ওদের ছেড়ে চলে যাবে? তোমার
মুখেই তে। শুনেছি, বড় কঠিন দিন আসছে সামনে । শক্ররা দল
বেঁধে তৈরী হচ্ছে, যে কোন সময় এসে হানা দিতে পারে। আর
এবার যখন আসবে, দলে বলে ভারী হয়েই আসবে। বলনি তুমি ?
হ্যা বলেছি। দ্িবেবাক উত্তর দিলেন, কথাটা তো! মিথ্যে নয়।
ওরা আসবেই । ওদের সমস্ত শক্তি নিয়েই আস্বে। গৌড় থেকে
রূদৌকও পেই রকম কথাই জানিয়েছে।
আর সে সময় কৈবর্তদের রাজ। যদি তাদের সামনে না থাকে,
তবে কি হবে তাদের দশা, সে কথাটা ভেবে দেখেছ ?
দিবেবোক নিরুত্তর হয়ে রইলেন। তীর থাকা! আর না! থাকার
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৬৯
মধ্যে প্রভেদটা! যে কত সে কথা তার কাছে অজানা নয়। তাকে
অবলম্বন করে যে.বিরাট একতা! গড়ে উঠেছে, এই মুহুর্তে তিনি সরে
গেলে তা ধূলিসাৎ হয়ে পড়ে যেতে পারে; এ আশংকা অমূলক নয়।
এমন কোন দ্বিতীয় লোক নেই, যার উপর সমস্ত দেশের মানুধ
নিশ্চিন্ত মনে নির্ভর করতে পারে।
দিব্বোককে চুপ করে থাকতে দেখে উনছলি আবার বললেন,
ওলান ঠাকুর. না করুন কিন্তু ওরা যদি আবার আমাদের এই দেশ
দখল করে' নিতে পারে, তখন কেউ কি আর বাঁচাবে ? সারা দেশমগ্র
ওরা রক্তের নদী বইয়ে দেবে না? এত দিন এত ছুঃখ এত কষ্ট করে
আমরা যেটুকু পেয়েছি, তার সব কিছুই ধুলো-ধুলো হয়ে 'যাবে। এই
একটা ছেলের জন্য তুমি ভেবে মরছ, আর তোমার সারা সমাজের
মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে, সেটা তোমার সইবে ?
দরিবেবাক এবারও কোন কথা বললেন না। বিন্ময়মিশ্রিত দৃষ্টিতে
তাকিয়ে রইলেন উনছলির মুখের দিকে ।
উনছলি যেন অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিলেন । বলে চললেন,
যখন প্রথম তোমার ঘরে এলাম, তুমি এক দিন কথায় কথায়
বলেছিলে, আমি সব চেয়ে বেশী ভালবাসি আমার সমাজের
লোৌকদের। সে দিন কথাটা শুনে আমার মনে বড় ছঃখ হয়েছিল ।
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার চেয়েও? তুমি সোজা উত্তর
দিয়ে দিলে, হ্যা। তোমার কথা শুনে আমার তখন বড় কানা
পেয়েছিল। সে কথা তোমার নিশ্চয়ই মনে নেই, কিন্তু আমি ভূলিনি।
দিব্বোক ভেবে দেখলেন সত্যিই মনে নেই তার। এই দীর্ঘ
বিবাহিত জীবনে উনছলির সংগে কত দিন কত কথাই তো হয়েছে,
তার ক'ট1 কথাই বা মনে আছে!
কিন্তু এটা প্রথম সময়কার কথা । পরে এ নিয়ে আমার মনে
কোন ছুঃখ ছিল না। তোমার কথ শুনে শুনে আর তোমার কাজ
দেখে দেখে আমিও কেমন যেন বদলে গেলাম'। তখন মনে হোল,
২৭০ বিক্রোহী কৈবর্ত
এটাই তো! ঠিক কথা। সমাজের সমস্ত মানুষের চেয়ে কি আর
আ'মি বড় হতে পারি? কিন্ত দিব্বোক--
দিবেবাক চমকে উঠলেন। তার কানে যেন মধু ঝরে পড়ল।
বিয়ের আগে উনছলি তাকে এমনি করে নাম ধরে ডাকত, বিয়ের
পর থেকে আর সে নামে ডাকে না। কেন ডাকে না? এতদিন
বাদে আজ এই প্রশ্বটা প্রথম তার মনে জাগল।
কিন্ত দরিবেবোক, আঙ্গ তুমি কিনা স্বচ্ছন্দে বলে দিলে, এই
বিপদের মুখে সেই সমাজের লোকদের তুমি ছেড়ে চলে যাবে।
আর ত৷ একট। মাত্র ছেলের প্রাণের জন্ত !
উনছলি কথা বলছিলেন, কিন্তু তার হাতটা! দ্িবেবাকের মাথার
চুলগুলি নিয়ে খেলা করে চলেছিল। দিবেবাক তার সেই হাতটা
তার বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে গভীর কণ্ঠে বললেন, তুমি যে এ সব
কথা নিয়ে এমন করে ভাব, আমি তো৷ কখনও তা৷ ভাবতে পারিনি
উনছলি।
উনছলি উত্তর দ্বিলেন, কেন ভাবব না, আমি যে তোমারই
ছায়ায় ছায়ান বেড়ে উঠেছি।
এর পর ছুজনেই কতক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে রইলেন।
একটু পরে দিব্বোক জড়িত কণ্ঠে বললেন, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে
উনছলি |
ঘুমাও। কাল সারারাত একটুও তো! ঘুমাও নি !
উনছলি তার বন্দী হাতটাকে টেনে নিতে চাইল,কিস্ত পারল না,
দিবেবাক শক্ত করে চেপে ধরে আছেন ।
তারপর দিন খবর ছড়িয়ে পড়ল, রাঁঞ্জা তার আদেশ ফিরিয়ে
নিয়েছেন, অন্তান্ত বারের মত এবারও নরবলি হবে। মানুষগুলি এ
কয়দিন মুহমান হয়ে পড়েছিল, খবরট। পাবার সংগে সংগেই চাংগ!
হয়ে উঠল সবাই । ওলান ঠাকুরের কৃপায় রাজার হুমতি হয়েছে। জয়,
ওলান ঠাকুরের জয়! বরেন্দ্রীতে আনন্দের প্লাবন বয়ে গেল।
বিদ্রোহী কৈবর্ত
২৭১
গর দিন সকাল বেল! অনেক লোক এসে জড় হয়েছিল, ওর
রাজাকে মামনে নিয়ে মিছিল করে ওলান ঠাকুরের বটতলায় যাবে।
কিন্ত একটু বাদেই ভিতর থেকে খবর এল, রাজা কালই গৌড়ে চলে
গেছেন। এমন একটা কথা কেউ ভাবতেও তো পারেনি । এ
কেমন হোল! লোকগুলি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইল।
পনেরো
ওর! পায়ে পায়ে বন্ধ তীর্থ ভ্রমণ করে এল। এ দেশে কত তীর্থ
আর কত রকমের দেব দেবী! দেব দেবীর জাতে কেউ
হিন্দু; কেউ বৌদ্ধ, কেউ জৈন,আবার এমন অনেকে আছেন--তাদের
ংখ্যাই সব চেয়ে বেশী-_ঘাদের জাতের ঠিকানা খুজে পাওয়া ভার।
তাদের মধ্যে কেউ বনবিহারী, কেউ বৃক্ষ বিশেষে অধিষ্ঠান করেন,
কেউ গহ্বরে, কেউ বা বিশেষ কোন প্রস্তরখণ্ডে--এই ভাবে জলে
স্থলে সবত্র ছড়িয়ে আছেন। তারা প্রকৃতির মতই থেয়ালী-_-তাদের
এক হাতে স্থৃষ্টি, অপর হাতে ধ্বংসের খেলা। তার! প্রসন্ন হলে
প্রাচুর্যে ভাসিয়ে দেন, আবার ক্রুদ্ধ হলে সবনাশ বর্ষণ করেন। মানুষ
এদের কথা স্মরণ করে ভয়ে ভয়ে দিন যাপন করে।
এই বৌদ্ধ ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীর কোন জাত বিচার নাই। এর!
সব তীর্থে গিয়েই মাথা নোয়ালেন, সবাইকেই পৃজা৷ দিলেন, তীর্থে
তীর্থে বিচরণ করে সব ধর্মের, সব বর্ণের, আর সব জাতের মানুষের
সংগেই মেলা মেশা করলেন, ক্ষণিকের এই আনন্দ মেলায় ভাদের
হাসি কান্নার ভাগ নিলেন ।
এক দ্দিন শংখদেবী বলেছিলেন, শোন হরিগুপ্ত আমি একটা কথা
ভাবছিলাম। আমরা! তো! নিধিচারে সব দেবতাকেই পূজো দিয়ে
চলেছি। কিন্তু এর ফলে তারা! আমাদের উপর তুষ্ট হচ্ছেন না রুষ্ট
হচ্ছেন? আমরা ভাল মানুষ, সবাইকেই সম দৃষ্টিতে দেখছি কিন্তু
তাদের নিজেদের মধ্যে রেশারেশি আর প্রতিযোগিতার অন্ত নেই।
এক জাতের মানুষ আর এক জাতের মানুষকে যতটা! সহ
বিস্োহী কৈবর্ত ২৭৩
করতে পারে, এরা! তাও পারে না। এ বিষয়ে এরা আমার্দের সভ্য
জাতগুলির চেয়েও অসহিষ্ণ আর বর্বর ।
দেবতাদের সম্পর্কে শংখদেবী সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ । হিন্দুই হোক বা
বৌদ্ধই হোক বা যে কোন ধর্মের দেবতাই হোক, তাদের নিয়ে তিনি
সব সময়ই লঘুচিত্ততার সংগে কথা বলে থাকেন। হ্থযোগ পেলে
খোঁচা মারতে ছাড়েন না । হরিগুপ্ত গোড়া থেকেই এটা লক্ষ্য করে
আসছেন। শংখ দেবী একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, তার সেই
শিক্ষাদাতা পিতৃব্য তার কৈশোরের নরম মনে এর বীজ বুনে দিয়ে-
ছিলেন। প্রথম প্রথম এ ধরনের কথা শুনে হরিগুপ্তের কেমন একটু
অস্বস্তি লাগত। অবাক হয়ে ভাবতেন, ওর কি কিছুই মুখে বাধে
না! কিন্ত পরে শুনে শুনে গা-সওয়া হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়,
তখন তার নিজের মুখও এ বিষয়ে কিছুটা! অসংলগ্ন হয়ে এসেছে,
আপনার অজান্তে তিনিও মাঝে মাঝে এই সব অসংগত আলোচনায়
যোগ দিয়ে বসেন। কিন্ত কিছু দিন থেকে শংখ দেবীর
স্বভাবের মধ্যে একটা মতন রূপ ফুটে 'উঠেছে, যেটা আগে
ছিল না।
হরিগ্প্ত মৃতু হেসে বললেন আমাদের সভ্য জাতিগুলি সম্পর্কে
সম্প্রতি তুমি কিছুট। প্রখর হয়ে উঠেছ দেখতে পাচ্ছি । অসহিষু
কথাটা ন। হয় নাই ধরলাম, কিন্তু তাই বলে বর্বর? সভ্য আর বর্বর
এই ছুটো কথা কি পরস্পর বিরোধী নয় ?
এই সংসারটাই তো! পরস্পর বিরোধী, উত্তর দিলেন শংখদেবী,
হাঁসি কান্না, সুখ দ্বঃখ আর পাপ পুণ্যের বিচিত্র সমাবেশ এই সংসারে,
এ কথাটা কি অস্বীকার করতে পার? আমার পিতৃব্য এক দ্বিন
বলেছিলেন, আমাদের এই বর্বর সভ্যতা ! কথাটা কেমন করে মনে
রয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেদিন এই কথাটার মর্ম গ্রহণ করবার মত শক্তি
আমার ছিল না। অবশেষে তোমার দয়াতেই এই কথাটার অর্থ
বুঝতে পেরেছি ।
১৮
২৭৪ বিক্রোহী কৈবর্ত
হরিগুপ্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমার দয়ায়? চ্তার মানে?
আমি কি করলাম ?
তুমি কি করেছ, শুনবে হরিঞ্প্ত ? রাজপ্রাসাদে বন্দিনী আমি
সমস্ত জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধ হয়েছিলাম । তোমার
দয়ায় এই পৃথিবীকে দেখছি, আর দেখছি এই পৃথিবীর সত্যিকার
মানুষদের ।
সত্যিকার মানুষদের 1?
যা, সত্যিকার মানুষদের যারা এই মাটির সন্তান । আমার মনের
মধ্যে কিসের খেলা চলছে, তাঁর সব কথা! আজ তোমাকে বুঝিয়ে
বলতে পারব না। এত দিন আমার শুন্য প্রাণকে কতগুলো
আবর্জনা দ্রিয়ে ভরে রেখেছিলাম । তোমাকে পেয়ে সেই আবর্জনা
থেকে মুক্তি পেয়েছি আমি, আর দিন দিনই ভরে উঠছে আমার মন ।
তোমাকে পেয়ে আমি পেয়েছি এই অনস্ত নীল আকাশকে যেখানে
ঘর ছাড়া পাখীর! উড়ে বেড়ায়, পেয়েছি চোখ-জুড়ানে। মন-জুড়ানো
এই শ্যামল! পৃথিবীকে, পেয়েছি অন্তহীন চলার পথকে আর পেয়েছি
এই মাটির সন্তান সরল সহজ মানুষগুলিকে । এর! সবাই মিলে
আমার চোখের দৃষ্টি বদলে দিয়েছে । আর সেই দৃষ্টি দিয়েই গৌড়ের
নগর সভ্য তার সত্যিকার রূপট। আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে ।
হরিগুপ্ত, আমার কথ বুঝতে পারছ তে! ?
কিছু কিছু পারছি, সবটা নয়। মনে আছে বহুদিন আগে,
পল্পনাভের মুখে ঠিক এই রকমই একটা কথা শুনেছিলাম ।
পদ্মনাভ, কে পল্পনীভ? মহাসদ্ধিবিগ্রহিক? তিনি বলেছিলেন
একথ। বল কি তুমি?
হ্যা আমার বেশ মনে আছে । তিনি মাঝে মাঝে এমনি এক
একটা! বিচিত্র কথা বলতেন । কিন্ত আমর! সেই কথাটার অর্থ সেদিন
বুঝতে পারি নি।
এখন কোথায় তিনি? শংখদেবী প্রশ্ন করলেন ।
বিদ্রোহী কৈবর্ত
২৭৫
কোথায় তিনি? সে কথা কে বলবে? এই যুদ্ধের ফলে কে
কোথায় ভেমে গেছে, তাঁর ঠিক আছে কিছু, বেঁচে আছেন না মারা
গেছেন, তাই বা কে জানে !
ঘুরতে ঘুরতে ওরা বৌদ্ধ গয়ায় এসে পড়লেন। এখানে এসে
নতুন খবর শুনতে পেলেন ওরা |. পক্ষকাল আগে রাজা রামপালদেব
সদলবলে এখানে এসেছিলেন ।
রাজা রামপাল দেব। শুরপালদেবের কি হয়েছে? ওরা আশ্চর্য
হয়ে প্রশ্ন করলেন।
শুর পালদেব সম্পর্কে নানা জনে নান! রকম কথা বলছে। কেউ
বলেন, তিনি নাকি শিকার করতে গিয়েছিলেন । শিকারের পিছন
পিছন ধাওয়া করতে গিয় দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ।
তারপর থেকে আর তার সংবাদ পাওয়! যায়নি । কেউ বলেন, তা
নয়, শুনেছি তিনি সংসার বিরাগী হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কে
জানে হয়তো বা রাজপুত্র সিদ্ধার্থের মতই একদিন বৃদ্ধ হয়ে ফিরে
আসবেন। এ ছাডা আরও এক রকম কথা শোন! গেল।
কয়েকদিন হয় রাজধানী থেকে কে একজন লোক এসেছে। সে
এসে বলেছে, রাজধানীর মধ্যে নাকি কানাকানি চলেছে যে শুরপাল
দেবের এ ভাবে অনৃশ্ঠ হয়ে যাবার পিছনে রামপালদেবের হাত
আছে। অবন্ঠ অধিকাংশ লোকই এ কথা বিশ্বাস করে না। তার!
বলে রামপালদেবের মত লোকের পক্ষে এ কাজ কখনোই সম্ভব নয়!
শংখ দেবী হরিগুপ্তকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি তো! তোমাকে
আগেই বলেছিলাম ।
শৃরপাল আর রামপাল এই ছুজনকে এই সিংহাসনে ধরবে না।
ছু, জনের এক জনকে এই সংসার থেকে সরে পড়তেই হবে ।
হরিগপ্ত জীতকে উঠে বললেন, ছি ছি, এসব কি বলছ শংখ!
এ তোমার খুবই অন্যায়। নিজের ছেলের সম্পর্কে এমন করে
কথা বলছ!
২৭৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
শংখ দেবী বললেন, মা বলেই তো৷ ভিতরের অনেক খবর আমার
জানা আছে। তা ছাড়া আমি তো সাধারণ মা নই। আমি এ
জন্য প্রধানত রামপালকে দায়ী করছি না। তার শৈশব থেকেই
এক দিকে তাঁর মা শংখ দেবী, আর এক দিকে তার মাতুল মথনদেব
তার কাঁনে কানে মন্ত্র দিয়ে এসেছে, তোমাকে রাজা হতে হবে!
এই কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়ে উঠেছিল সে। রাজ! হবার
উচ্চাশ! তার ছিল।. তুমি জান না, অনেকেই জানে না, মহীপাল
বৃুথাই তাকে কারারুদ্ধ. করে রাখেনি । আর যে যাই বলুক, আমি
মহীপালকে এ জন্য দৌষ দিতে পারি না। মহীপাল নানা ভাবে
আমার সংগে ছুব্যবহার করেছে, এ কথা সবাই বলে। কিন্তু আমি
কি তার সংগে সদ্যবহার করেছি? রাজবংশের চিরাচরিত
গ্রথাম্যায়ী এই সিংহাসন তারই প্রাপ্য । আর তাকে তার এই
ন্াষ্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবার জন্য এমন কোন বড়ঘন্ত্র বা হৃফতি
নাই যাতে আমি অংশ গ্রহণ করিনি। হরিগ্প্ত, তুমি গৌঁড়ের
স্থসভ্য নাগরিক হলেও তোমার মন এই মাটির সন্তানদের মতই
পবিত্র আর বিশুদ্ধ। এ সব কথা তুমি ভাবতে পার না। কিন্তু
তোমার এই শংখ বাইরে শংখ ধবল হলেও অন্তরে অন্তরে কলংকিনী।
হরিগুপ্ত বাধা দ্রিয়ে বললেন, থাক, ও কথা এখন থাক।
কিন্তু শংখ দেবীকে থামানো গেল না। তিনি বলে চললেন,
রাজপ্রসাদ ছেড়ে টঈলে আসবার পর থেকে তুমি আমাকে রামপালের
কাছে ফিরে যাবার জন্য বার বার বলে আসছ। কিন্তু আমি
যাইনি, এই কট! বছর ছদ্মবেশে তোমার সংগে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
তা হলে কি হোত জান? এই আমিই হয়তো মথনদেবের দক্ষিণহস্ত
হয়ে শুরপালকে হত্যা করবার জন্য রামপালকে প্ররোচনা দিতাম,
উৎসাহিত করে তুলতাম। সেই ছু্কৃতি থেকে আমি রক্ষা
পেয়েছি।
এ কথা বিশ্বাম করি না আমি; হরিগুপত দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন ।
বিজ্রোহী কৈবর্ড ফী
বিশ্বাস করনা? কেন করনা? আরও বলতে যাচ্ছিলেন
শংখ দেবী। কিন্তু বলতে পারলেন না। হরিগুপ্ত তার প্রশস্ত
করতল দিয়ে তার মুখ চাপ! দিয়ে ধরেছেন।
কিন্ত রাজা রামপালদেব এমন সময় হঠাৎ গয়ায় এসেছিলেন
কেন? খবর নিয়ে জানা গেল, কয়েক বছর ধরে বু অনুসন্ধানের
পর মায়ের কোন খোঁজ-খবর না'পেয়ে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত
হয়েছিলেন যে মা কৈবর্তদের হাতে মারা গেছেন। হিন্দু মায়ের
আত্মার সদগতির জন্য তিনি গয়ায় পিও দিতে এসেছিলেন। সেই
সংগে বৃদ্ধ মন্দিরেও পৃজ। দিয়ে গিয়েছেন ।
খবরটা শুনে হরিগুপ্ত বজ্রাহতের মত নিস্পন্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
রইলেন, আর শংখ দেবী হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে ।
কৈশোরের সেই হাসির চাপল্য এখনও তাকে ছেড়ে যায় নি।
মুক্ত, এবার মুক্ত আমি, ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে বসলেন শংখ দেবী,
রামপাল এবার আমায় মুক্তি দিয়েছে । রাজপ্রাসাদের সংগে যেটুকু
বন্ধন অবশিষ্ট ছিল, তাও ছিন্ন হয়ে গেল। আজ আমার নবজন্।
হরিগুপ্ত বিষ দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোম্মার
রহস্ত বুঝতে পারি না শংখ। একি তোমার কাছে এতই আনন্দের
কথ! !
শংখ দেবী উচ্ছুসিত হয়ে বলে উঠলেন, কেন নয়? রাজমাতার
মৃত্যু হয়েছে, তার প্রেতাত্মার সদ্গতি ঘটল । আমি নূতন করে জন্ম
নিলাম। আজ একমাত্র তুমি ছাড়া আমার উপর কারু কোন দাবী
দাওয়া নেই।
ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীর পথেরও শেষ নেই, চলারও ক্ষান্তি নেই।
গত দশ দিন তার! একটানা! চলা চলতে চলতে পীঠিরাজ্যে এসে
পৌছলেন |
প্রাচীন মগধের দক্ষিণাংশ তখন গীঠিরাজ্য নামে পরিচিত।
রাজার নাম দেবরক্ষিত। রাজা ধর্মে বৌদ্ধ.।
২৭৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
পীঠিনগরে পৌঁছেই তারা দেখলেন, নগরী উৎসবসজ্জায় সেজেছে,
পথে পথে লোকের ভিড় । কি ব্যাপার, কিসের এই উৎসব,
কৌতুহলী হয়ে খোজ করতে জানলেন, রাজার আমন্ত্রণে গৌড়রাজ
গীঠিভ্রমণে এসেছেন। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এই
আয়োজন । গীঠিরাজ আর গৌড়রাজ একই রথে বসে নগরী
পরিভ্রমণ করবেন-। তাদের দেখবার জন্য দলে দলে নর নারী পথের
ছু ধারে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
শংখ দেবী সশংক চিত্তে বলে উঠলেন, সর্বনাশ, রামপাল ! হরিগ্প্ত,
ফের, ফের, আর এক মুহুর্ত নয়।
হরিগুপ্তের মুখে আকর্ণ হাসি ভেসে উঠল ! বললেন, রামপালের
মার মৃত্যু হয়েছে, তার আত্মা সদ্গতি লাভ করেছে। তুমি নধজান্ত,
রামপাল তোমার কেউ নয়, তবে তুমিই বা তার জন্য এমন হুশ্চিন্ত'-
গ্রস্ত হয়ে পড়লে কেন ?
শংখ দেবীও হেপে বললেন, পূর্বসংস্কার যে এমন করে পিছন
পিছন ধাঁওয়। করে ফরবে, মে কথাটা অ'গে বুঝিনি ।
ত৷ নেই বুঝলে, কিন্ত গৌড় যে আমাদের হাত-ছাড়া হয়ে গেছে,
সেটা কি এরই মধ্যে ভুলে গেলে? অতএব গৌড়রাজ বলতে
বর্তমানে রামপাঁলকে বোঝায় না, বোঝায় দিব্বোককে ।
শংখ দেবী অগ্রস্তত হয়ে বললেন, তাই তো, এমন ভূল কি করে
করলাম |!
হরিগুপ্ত বললেন, ভালই হয়েছে, ঠিক সময়.মতই আমরা এখানে
এসে পৌছেচি। এত দিন ধরে নাম শুনে আসছি দিবেবাকের,
একবার স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছা ছিল। গৌড়ে গিয়ে দেখব, সে স্থযোগ
তো! আর হবে ন। গৌড় রর্তমানে আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ।
হ্যা), গৌড় আজ আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ। সেজন্য তোমার
মনে ছঃখ আছে হরিগুপ্ত ? শংখ দেবী প্রশ্ন করলেন।
হঃখ? একটু ছুঃখ থাকবে বই কি। যেখানে জন্মগ্রহণ করলাম,
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৭৯
আর সারাটা জীবন যেখানে কাটালাম, স্খোনকার জন্য একটু মায়
হবে না?
শংখ দেবী বললেন, আমার কিন্তু গৌড়ের নামে আতংক । গৌড়
আমার কারাগার। সেই কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই
আমার সামনে বিপুল পৃথিবীর দরজা খুলে গেছে । আর আমি
সেখানে ফিরতে চাই না। বাইরে এসে আমি শাস্তি পেয়েছি ।
সেখানে গেলে স্মৃতির দাহে জ্বলে গুড়ে মরতে হবে।
হরিগপ্ত হেসে বললেন, রামপালদেব বৃথাই তার মায়ের উদ্দেশ্টে
পিগুদান করে এলেন, তার আত্মার সদগতি হয় নি। শংখ, তুমি
কি ও সব কথা কিছুতেই ভুলে যেতে পার না?
না, পারি না । দেখছি, মরেও আমার রেহাই নাই।
হরিগুপ্ত ইচ্ছা করেই আলাপের মোড়টা ঘুরিয়ে দিলেন, কিন্তু
শংখ, এই গীঠিরাঞ্য কি এক দিন গোৌড়ের অধীনস্থ সামন্তরাজ্য
ছিল না৷?
হ্যা, তাই ছিল।
কিন্ত ওরা এত সহজেই কৈবর্তদের বশ্যতা স্বীকার করল ? এ
পর্যস্ত আর কোন রাজ্য এদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে তো
শুনিনি ।
ংখ দেবী বললেন, তুমি ভুল করছ. হরিগুপ্ত, এরা কৈবর্তদের
বন্যতা স্বীকার করে নি। সম্রাট মহীপালের পতনের সুযোগ নিয়ে
এর! নিজেদের স্বাধীন রাজ্য বলে ঘোরণ। করেছে । কৈবর্তদের
গোৌঁড় এখন গীঠির মিত্ররাজ্য । তুমি কি এরই মধ্যে ভুলে গেলে,
কৈবর্তদের গৌড় আক্রমণের সময় এই পীঠিরাঁজ দেবরক্ষিতই তাদের
অশ্বীরোহী সৈন্ত দিয়ে সাহাব্য করেছিলেন ।
হ্যা-হ্যা, কথাটা! শুনেছিলাম বটে। কিন্তু এত সব কথা আমার
মনে থাকতে চায় না। কিন্তু সভ্য অসভ্যের এই মিলন--এমন
অঘটন কি করে ঘটল ?
২৮০ বিজ্রোহী কৈবর্ত
এ সংসারে বু অঘটনই ঘটে থাকে, উত্তর দিলেন শংখ দেবী, তা
না হলে তুমি আর আমি যে এমন করে হাতে হাত ধরে উদ্মুক্ত
আকাশের নীচে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেটাই বা কেমন করে
সম্ভব হোল?
আসছেন, আসছেন, ওই যে আসছেন, বহু কণ্ঠের কোলাহল
জেগে উঠল। হরিগুপ্ত বললেন, চল, শংখ আমরা ওই দর্শকদের
ভিড়ের মধ্যে মিশে যাই ।
দেখতে দেখতে অশ্ববাহিত হ্সত্জিত রথ ঘর্থর শব্দ তাদের
চোখের সামনা দিয়ে চলে গেল। ছু পার্শের দশকের! উচ্চ কণ্ঠে
মহারাজ দেবরক্ষিতের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। রথ চলে যাবার
সংগে সংগেই ভিড় ভাংগতে লাগল। নান! জনে নানা কথা বলে
চলেছে।
দেখেছিস, কি কালো আর ফি কুচ্ছিত! আর আমাদের
মহারাজ কিনা না ওর সংগেই হাতে হাত ধরে বসেছিলেন । ছু জন
জনের একেবারে বিপরীত--যেন দিন আর রাত্রি।
বিপরীত হলে কি হবে, দিন আর রাত্রি তো এমনি ভাবে
পাশাপাশিই থাকে, একজন মন্তব্য করল।
কিন্ত এই হোল গ্োৌড়ের রাজ ! কোথায় সম্রাট. মহীপালদেব
আর কোথায় এই কৈবর্ত দিবেবোক। আমাদের মহারাজের সবই
ভাল, কিস্ত মাঝে মাঝে এমন এক একটা অবিবেচনার কাজ করে
বসেন! এই বর্ধর কৈবর্তকে আমন্ত্র: করে আনবার আর এভাবে
সম্মান দেখাবার কোন্ প্রয়োজন ছিল? এর ফলে সমস্ত সভ্য
সমাজের মধ্যে তার মর্যাদাহানি ঘটল। শুধু তাই নয় রাজ্যশুদ্ধ
অপমান । যে কৈবর্তেরা এত কাল ধরে দাস বলেই গণ্য হয়ে
আসছিল, আমরা৷ কিনা তাঁকেই মাথায় তুলে নিলাম! গীঠির এই
কলংক কোন দিন মুছবে না।
শুনেছি সেনাপতি ভীমঘশের' নাকি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৮১
ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্ত মহারাজ তার কথায় আমল দেন নি।
কিন্তু সেনাপতি এই বর্বর কৈবর্তের কাছে কিছুতেই মথা নোয়াতে
রাজী নন। তাই কাল থেকেই অন্থুস্থৃতার নাম করে তিনি শব্য।
নিয়েছেন, এ পর্ষস্ত একবারও ঘর থেকে বার হন নি। কিন্তু তার
এই রোগের মূল কোথায়, মে কথা বুঝতে কারু বাকী নাই।
শুনছ, এরা! কি সব বলাবলি করছে ? হরিগুপ্ত বললেন।
শুনছি বই কি। এইটাই তো স্বাভাবিক । . আমি আশ্চর্য হয়ে
গেছি রাজ দেবরক্ষিতকে দেখে কেমন হৃগ্ভতার সংগে দিবেবোকের
একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসেছিলেন তিনি, যেন
অভিন্নহ্ৃদয় বন্ধু! অবশ্য রাজনৈতিক স্বার্থ হয় তো এর পিছনে
রয়েছে, কিন্তু তা হলেও তার মুখে আন্তরিকতার ভাব লক্ষ্য করেছি।
যাই বল, দ্িবেবোকের মুখে কিন্তু অসাধারণত্বের কোন চিহ্ছই দেখতে
পেলাম না। যে কোন এক জন সাধারণ কৈবর্তের মতই। বোকা
বোকা চেহারা ।
কিন্ত এই সাধারণ চেহারার মধ্যে একটি আসাধারণ'মান্ুষ বিরাজ
করছে। কে জানে হয়তো তার এই বিভ্রান্তি্থট্িকারী চেহারা প্রতি?
পক্ষকে পথজষ্ট করতে সহায়তাই করেছে।
সত্যি কথাই বলেছ তুমি, শংখ দেবী সমর্থন করে বললেন,
এই বর্ধর কৈবর্ত গৌড়ের ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞদের নিয়ে কি খেলাই
ন! খেলেছেন ! গৌড় আক্রান্ত হবার পূর্ব মুত” পর্যস্ত বরাহস্বামীর
মত কুটবুদ্ধিসম্পন্ন লোক এই দিব্বোককে নিজের হাতের লোক
বলেই মনে করে এসেছেন। এর চেয়ে আশ্চর্য কথা৷ আর কি হতে
পারে?
হরিগুপ্ত বললেন, আশ্চর্ধ শুধু সেইটাই নয়। সবাই. মনে করে
ছিল, আমাদের নিজেদের দলাদলির, ফলেই এমন অভাবিত একটা!
দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু ক'দিন ওরা টিকে থাকতে পারবে ! এই
মুর্খ বর্বররা রাজ্য শাসনের কি জানে । আর সবার মত আমার
২৮২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
মনেও সেই ধারণাই ছিল। কিন্তু এই ক'ব্ছরে কি দেখতেপাচ্ছি ?
ওরা ভেংগে পড়বে দূরে থাক, আরও দিন দিন শক্তিশালী হয়ে
উঠছে। আরও শুনতে পাচ্ছি ওদের স্থশাসনের ফলে প্রতিবেশী
স্বেচ্ছায় ওদের রাজ্যের সংগে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
শংখ দেবী তার এই কথায় সায় দিয়ে বললেন, অপস্ভব নয়।
তোমার মনে আছে, বরেন্দ্রীর কৈবতে'রা শিমূলতলীয় গোয়ালদের
এই উদ্দেম্তটে আহ্বান জানিয়েছিল। ওরা তোমার কাছে এ বিষয়ে
পরামর্শ চেয়েছিল, আর তুমি _
হ্যা, আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে আমার।
শংখ দেবা হেসে বললেন, এত দিন তার! হয়তে! আর আমাদের
মতামতের জন্য অপেক্ষা করে বসে নেই। কিন্তু বিচিত্র সব কাহিনী,
এমন যে ঘটতে পারে এ তো! কল্পনাও করতে পারি নি কোন দিন।
কে যে সভ্য আর কে যে ব্বর, সব কিছুই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
তাঁরা নিজেদের কথার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলেন, আর কোন দ্রিকে
খেয়াল ছিল ন1। হঠাৎ একটা ডাক শুনে চমকে উঠলেন। চেয়ে
দেখলেন ইতিমধ্যে লোকের ভিড় কেটে গিয়ে পথ পরিষ্কার হয়ে
গিয়েছে। ইতস্তত ছুচার জন লোক যাতায়াত।করছে। আর
দেখলেন তাদের সামনে ফীড়িয়ে আছেন তাদের মত গীতবসনধারী
এক ভিক্ষু। কাছাকাছি আর কেউ নাই, কাজেই বোঝ! গেল ইনিই
ডেকেছেন ।
ভিক্ষু প্রশ্ন করলেন, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনারা
গৌড়ের অধিবাসী । আমার অনুমান কি ঠিক 1
হরিগুপ্ত উত্তর দিলেন, না, হ্যা, আমরা গৌড়ের অধিবাসীই
বটে।
তবে গৌড়ের সংগে আমাদের সম্পর্ক বু কাল আগেই কেটে
গেছে।
এখন কোখেকে আসছেন আপনারা ?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৮৩
আমর! তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছি, সম্প্রতি বৃদ্ধগয়া থেকে.আসছি।
ভিক্ষু খুশী হয়ে বললেন, বেশ বেশ, আপনাদের মুখ থেকে অনেক
দেশের অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে। চলুন আমাদের বিহারে।
অনেক পথ হেঁটে ক্লাস্ত হয়ে আছেন। এখানে কয়েকটা দিন বিশ্রাম
নিয়ে নিন। আপনাদের পেলে আমাদের এখানকার সবাই খুব
খুণী হবেন ।
শংখ দেবীর মুখে ছুশ্চিষ্ত।র চিহ্ন দেখ। দিল। হরিগ্ণপ্ত জিজ্ঞাস!
করলেন, কোথায়, কতদূরে আপনাদের বিহার?
শংখ দেবী হরিগুপ্তকে চোখের ইংগিতে কি যেন বলতে চাইলেন,
কিন্ত হরিগুপ্ত কিছু বুঝলেন কিন। বোঝ! গেল ন!।
দূরে নয়, এই তো, এই যে হলদে রংগের উঁচু বাড়ীটা। চলুন।
হরিগুপ্ত বললেন, না, আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন যান। আমরা
নগররট। দেখে নিয়ে তারপর আপনাদের ওখানে যাব।
ভিক্ষু সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, আমার এখন তেমন কোন কাজ
নাই, চলুন, আপনাদের নগরট। দেখিয়ে নিয়ে আসি। গৌঁড়ের
সংগে অবশ্য এর তুলন] হয় না, তবে ছোটর মধ্যে সুন্দর |
কিন্ত হরিগুপ্ত ত'তে রাজী নন। তাদের ছজনের মত নৌকা,
এতে তিন জন ধরে না। তিনি বললেন, ন! না, তার কোন দরকার
নাই । আমরা! নিজেরাই পারব, অনর্থক আপনাকে আর কষ্ট দেব না।
বলেই হরিগ্প্ত অস্বাভাবিক রকম দ্রুততার সংগে পা চালিয়ে
দিলেন। শংখ দেবীও গতিবেগ সংগ্রহ করে তার পশ্চাদন্মরণ করে
চললেন। ভিক্ষু বিশ্মিত দৃষ্টিতে সেই গতিশীল মৃত্তি ছুটির দিকে
তাকিয়ে রইলেন ।
কিছু দূর এগিয়ে যেতেই শংখ দেবী অভিযোগ মাখা কণ্ঠে বলে
উঠলেন, এ তুমি কি করলে?
কিকরলাম আমি? বিহারে যাবার কথা বলে এলে কেন?
না, সে কিছুতেই হবে না। তোমাকে কতদিন বলেছি__
২৮৪ বিদ্বোহী কৈবর্ত
হরিগুপ্ত হেসে বললেন, আহা, বলেছি বলেই কি বিহারে যাচ্ছি
নাকি? খোলা আকাশের তলায় থেকে এতই অত্যন্ত হয়ে উঠেছি
যে, এখন আর একমাত্র বর্ধাকাল ছাড়া আর কোন সময় চালার
নীচে মাথা গু'জতে ইচ্ছা করে না।
ও, তা হলে যাচ্ছ না ওখানে, বাচালে ! শংখ দেখী পরম
স্বপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন । বাঃ, দ্রিব্যি স্বন্দর মিছে কথা বলতে
শিখে গেছ দেখছি। মনে আছে, আগে একট! মিছে কথা বলতে
হলে তোমাকে দশ বার ঢোক গিলতে হত ?
ওটা সংসর্গগণে ! পরলোকে এ জন্য যদ্দি কোন জবাবর্দিহি
করতে হয় তোমাকে দেখিয়ে দেব। বলব, আমি কিছু জানি না,
যা বলবার ইনিই বলবেন।
বেশ তাই বোলো । এক বোঝা পাপ মাথায় নিয়ে চলেছে,
তার সংগে তোমার এটুকু যোগ দিলে আমার কিই বা এসে যাবে?
কিন্ত ও কথ! থাক এখন। চল তাড়াতাড়ি পালাই, নইলে ওদের
হাতে ধরা পড়ে.যেতে হতে পারে।
পিছনে পড়ে রইল পীঠি নগর। আকা বাকা গ্রামের পথ
ছাড়িয়ে শন্তে ভর! প্রান্তর, তার পর নির্জন নিষ্পাদপ কঠিন কংকরময়
ভূমি, তার পর আবার গ্রাম-এমনি করে সামনে, আরও সামনে
এগিয়ে চললেন তারা । রাত্রি বেল! নৌকায় করে নদী পাড়ি দিয়ে
চললেন। সার! রাত ধরে নৌকো চলবে, পর দিন অজানা অচেনা
এক রাজ্যে পৌছে দেবে। ভোর হতে না হতে ঘুম ভেগগে যাবে
অপর এক দেশের পাখীর কলতানে। আকাশের বুকে অন্তত্র
তারা। তার নীচে অসীম নিস্তব্ধতা । এর তুলনা নেই।
শংখ দেবী মাবিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন এ নদীর নাম কি
মাঝি?
মাঝি উত্তর দিল, দিস্তাং।
দিত্তাং! বাঃ নুন্দর নাম তো। শুনেছ হরিগুপ্ত, দিস্তাং!
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৮৫
হরিগচপ্ত উত্তর দিলেন, হ্যা, সাধারণ লোকেরা তাই বলে। তবে
আমাদের সভ্য লোকেরা এর নাম দিয়েছেন ত্রিশ্রোতা।
হায় ভগবান, এই সেই ত্রিশ্রোতা? ব্রিআ্রোতার নাম তো! গোঁড়ে
বসেই শুনেছি । দিস্তাংই বল আর ত্রিস্রোতাই বল, ছুটোই আমার
মিষ্টি লাগে। আমি ভাবি নদীগুলি তাদের নাম কি নিজেরাই
তাদের সংগে করে নিয়ে আসে? তা৷ না! হলে এমন, মিষ্টি নাম মানুষ
কোথা থেকে খুঁজে পায়?
দিস্তাং নাম কি এতই মিষ্টি? আসল কথা মামুষ তার মনের
মাধুর্য বার উপর ঢেলে দেয়, তাই মধুর হয়ে ওঠে । দেখ না শংখ,
কি আর এমন একট নাম, কিন্তু আমার কাছে-_
থাক থাক, শংখ দেবী একটি মিষ্টি ধমক দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে
দিলেন।
হরিগুপ্ত, যদি আজ সেই বিহারে রাত কাটাতে হোত, তা হলে
কি আর এমন করে-_
থেমে গেলেন শংখদেবী ।
কি এমন করে?
এমন করে তোমাকে কাছে পেতাম? শুধু আমার পাশে থাক,
আর কিছু আমি চাই না।
অনেক রাত্রিতে প্রায় একই সংগে জনে ধড়মড় করে জেগে
উঠলেন। উঠে বসতেই শংখ দেবী হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।
এ কি, কি হয়েছে, নৌকাট। এমন করে ছুলছে কেন? তিনি
্রস্ত কে বলে উঠলেন। হরিগ্প্ত অতি সন্তর্পণে তাকে ধরে তুলে
বসিয়ে দিয়ে বললেন, শুনছে না, ভীষণ ঝড় হচ্ছে।
তাই তো, কি প্রচণ্ড তার গর্জন! মনে হচ্ছে যেন এক দল
দানব প্রলয় হংকারে ধেয়ে আসছে। বুঝি দৈবী মায়ায় কোন গিরি
গহবরের বন্দীশালায় শৃংখলিত হয়ে পড়ে ছিল। আজ কেমন করে
সেই শুখল ছিড়ে, বন্দীশালার দরজা! ভেংগে বেরিয়ে পড়েছে।
২৮৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
আজ আর ওরা কিছু রাখবে না, বিধাতার স্ষ্টিকে খান খান করে
ভেংগে ফেলবে । তাদের ক্রুদ্ধহিংশ্র ভয়াবহ গর্জন এদ্ক থেকে
ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে যেন একই সংগে চারিদিক থেকে
ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে। ঝড়? এর নাম ঝড়?
শংখ দেবী তার জীবনে ঝড় কি কোন দিন দেখেন নি? অনেক
দেখেছেন। রাজপ্রাসাদের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে ঝড়কে কতই
না উপভোগ করেছেন । ঝড়ের গর্জন তার মন ময়ুরের মত পেখম
মেলে নেচে উঠত । কিন্ত উন্মুক্ত আকাশের নীচে আর উম্মত্ত নদীর
বুকে তার যে বিভীষিকাময়ী মৃন্তি, এ মূত্তি আর কোন দিন
দেখেননি। এ অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
মাঝি, মাঝি, নৌকা কৃূলের দিকে নিয়ে যাঁও, হরিগুপ্ত চীৎকার
করে উঠলেন।
মাঝি কি তার চেষ্টার ত্রটি করছে! কিন্তু নৌকা এখন আর
তার আয়ত্বের মধ্যে নাই, ঝড়ের মুখে তৃণের মত ছুটে চলেছে ।
কোথায় কত দূরে কূল তাই বা কে জানে !
ভয় করছে শংখ ?
ভয়? না, ঠিক ভয় নয়, এ এক বিচিত্র অনুভূতি । এরকি
নাম দেব, বুঝতে পারছি না ।
ক্ষেপে গিয়েছে দিস্তাং। মত্ত ঢেউগুলি একটু বাদেই এসে
ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেই আঘাতে নৌকাটা থর থর করে কেঁপে
উঠছে।
সীতার জান শংখ?
না।
হরিগুপ্ত নিজের এই প্রশ্নের উপর নিজেই হেসে উঠে বললেন,
নদী যেই ক্ষেপা ক্ষেপেছে, তাতে সীতার জান! আর ন! জানার মধ্যে
কোন তফাৎ নেই।
মাঝি এবার হতাশ হয়ে উচ্চ স্বরে দেবতার নাম করছে। তার
বিক্রোহী কৈবর্ত ২৮৭
মাঝখানে মে একবার ডেকে বলল সাধুবাবা, দেবতাদের কাছে,
প্রার্থনা করুন। যদি তারা দয়া করেন, একমাত্র তবেই রক্ষা
পাওয়া যাবে। আপনারা সাধু, মহাপুরুষ, আপনাদের প্রার্থনায়
কাজ হতে পারে।
কথাটা! বলতে বলতে হঠাং নৌকাটা সৌ করে ঘুরে গেল।
সংগে সংগেই নৌকাঁটা এক দিকে কাত হয়ে যেতেই নৌকার মধ্যে
ঝলকে ঝলকে জল উঠতে লাগল।
কি, কি হল মাঝি? নৌকা'ট1 হঠাৎ এমন করে ঘুরে গেল কেন?
হরিগুপ্ত প্রশ্ন করলেন ।
মাঝি উত্তর দিল, দড়ি ছিড়ে গিয়ে দাড়টা! নদীর জলে ভেসে
চলে গেছে। আমার আর কিছুই করবার নাই।
আমরা কি মরতে চলেছি হরিগুপ্ত? শংখ দেবী শান্ত কণে প্রশ্ন
করলেন ।
লক্ষণগুলে! দেখে তে। সেই রকমই মনে হচ্ছে, সেই রকম শাস্ত
স্থরেই উত্তর এল । তবে কাছে এস আরও কাছে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যস্ত
আমর। পরস্পরের কাছ থেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হব না।
আর মৃত্যুর পরে ?
কি জানি, সেখানকার খবর আমার জানা নাই ।
০ ৯ ৯৫
এ অঞ্চলে এমন সাংঘাতিক ঝড় শীগগির নাকি হয়নি।
বুড়োবুড়ীরা বলে, তাদের ছোট বয়সে এ রকম ঝাড় এক বার
হয়েছিল। ঝড়ে ঘর' বাড়ী গাছপাল। ভেংগে চুরে মিশমার করে
দিয়েছে । বু লোক সর্বস্বাস্ত হয়ে গেছে । তার! মাথায় হাত দিয়ে
বসে কাদছে।
এত সব কাণ্ড ক!রখানার পর নদী এখন শাস্ত, লঙ্গ্মীশ্রী।
গত রাত্রিতে এত যে মাতামতি করেছে, এখন তাকে দেখে সে কথা
কে বুঝবে |
২৮৮ বিদ্রোহী কৈবর্
নদীর গা ঘেঁষা চন্ত্রকোণা গ্রাম। নদীর ঘাটে এই গ্রামের
লোকদের কয়েকখান! নৌকা! বাধ! ছিল। তাদের মধ্যে একখানাকেও
পাওয়। যাচ্ছে না। যাদের নৌকা তারা ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি
করছিল। তাদের মধ্যে এক জনের নজরে গড়ল, নদীর জলে বস্তার
মত কি একটা তেমে আসছে! ওর মধ্যে কোন মূল্যবান জিনিস
পাওয়া যেতে পারে মনে করে চেষ্টা-চরিত্র করে তাকে সামনে টেনে
নিয়ে এল। কিন্তু কাছে আনতেই আঁতকে উঠল সে-_এ কি কাণ্ড
কোথায় বস্তা । এ যে এক ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীর মৃতদেহ! . ছুজনের
শরীর একটা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বীধা। ওরা পরম্পরকে জড়িয়ে
ধরে মহাঘুমে ঘুমিয়ে আছে।
বোল
কাল ব্যাধি দিবেবাকের ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খেয়ে চলেছিল ।
কিন্ত বাইরের লোকের কাছে সে কথ জানা ছিল না । জানার মধ্যে
এক জানতেন চিকিৎসক বৃদ্ধ লক্ষ্পণদীস, আর জানতেন উনছলি।
লক্ষণদাস অনেক দিন থেকে শেষ বয়সের নানা ব্যাধিতে ভুগে ভূগে
শয্যাশায়ী অবস্থায় আছেন। তিনি যে আর কোন দিন উঠে কঈাড়াতে
পারবেন, সে আশা কম। চিকিৎসক আরও আছে দেশে। তারা
কাধের ক্ষতটাকে সারাবার জন্য নান! রকম জড়িবটি এবং মলমজাতীয়
ওষুধ দিয়ে থাকেন। তাতে যে একেবারেই কাঁজ হয় না, তা নয়,
কিন্ত কয়েক দিন বাদে আবার যে সেই। যে সেই বললেও ঠিক বল
হয় না। তার কারণ রোগের রক মট। দ্বিন দিনই খারাপ হয়ে চলেছে।
কিন্ত রোগীর কথাবাত্া আর চলন এমন যে চিকিৎসকরা রোগের
গুরুত্ব ধরতে পারেন না। একমাত্র বুঝতে পারেন উনছলি। কিন্তু
কি করবেন তিনি! যদি সেবা দিয়েই সব রোগ সারানো ষেত, উনছলি
চেষ্টার ক্রটি করতেন না। কিন্তুএ যে তার হাতের বাইরে । তাই
মাঝে মাঝে তাঁর মনট। বড় বেশী উতলা হয়ে ওঠে । কারণে অকারণে
তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে ।
যতই দ্রিন যাচ্ছে দিব্বোকের কাজ ততই বেড়ে চলেছে।
মাঝে মাঝে কাজ দিয়ে তিনি তার রোগযন্ত্রনাটাকে চেপে রাখতে
চান। বাইরের লোকের কাছে চাপা দিলে কি হবে, উনছলির চোখে
ধুলে! দিতে পারেন না । উনছলি কেমন করে তা টের পেয়ে যান,
ভেবে বিস্ময়ের অস্ত থাকে না তার।
সে কি তবে দূরে বসেও তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন অনুভব করতে
১৯-_
২৯০ বিদ্বোহী' কৈবর্ত
পারে? যেদিন প্রথম ওকে ভালবেসেছিলেন সেদিনও উন্ছলি তার
কাছে ছিলেন অতল রহস্তময়ী। আর এত কাল একত্রবাসের পর
আজও যেন মনে হয় যে তিনি ওর রহস্যের তল খুঁজে পাচ্ছেন না।
এত দিন কাঁজের মধ্যে এমন করে মত্ত হয়ে ছিলেন, ওর কথা মনে
থাকত না, কিন্তু সে তার সংগে সংগেই ফিরত, ছায়ার মত। অনুসরণ
করে চলত । প্রয়োজনের সময় হাতের কাছেই পেয়ে এসেছেন। কিন্তু
ওর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখেন নি এক বার । যে কথা মনে
করে অন্থুশোচনায় ভরে আসে মন। শুধু অনুশোচনা নয় আরও কত
কি ফিরে আসছে ! গভীর আবেগ আর হুর্বার আকর্ষণ। এ আকর্ষণ
এত দিন কোথায় ছিল? এক দিন নিজের মনে মনেই ভাবছিলেন,
তদ্দিন বাদে সময় হারিয়ে এই উন্মাদনা কেমন করে ফিরে এল?
তবে কি বাতিটার তেল ফুরিয়ে আসছে? নিভে যাঁবার আভাস পেয়ে
সেকি তবে একবার পূর্ণ শিখায় জ্বলে উঠতে চায়? তবে জলে উঠ্ক,
উঠুক জ্বলে শেষবারকার মত।
উনছলি ভেবে পান না, সেই দুর্দান্ত ছেলেট। এত দ্রিন কোথায়
বন্দী হয়ে ছিল, কেমন করেই ব৷ ছাড়া পেয়ে ফিরে এল? প্রমত্ত
নদী তরংগের মতই সে তার বুকের উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, নিষেধ
মানে না, বাঁধা মানে না, সেদিনকার সেই অবুঝ ছেলেটার মতই ।
উনছলি তার সেই আদর সোহাগের অত্যাচার আনন্দ-উজ্জ্বল
চিন্তে গ্রহণ করে, কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন একটু শংকাও জাগে ।
এক দিন মন্ততার এক চরম মুহূর্তে উনছলি বাধ! দিয়ে বলল, না,
না, তুমি অনুস্থ। এ তোমার শরীরে সইবে না ।
পূর্ণ স্থরাপাত্র সে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু
অবুঝ শিশুর মত দ্রিবেবাঁক সেই নিষেধ মানলেন না, আবেগের তোড়ে
বাধা ভাসিয়ে নিতে চাইলেন।
ভেসেই যাচ্ছিল উনছলি, কিন্ত মুহুর্তের মধ্যে নিজের মনটাকে শক্ত
করে নিয়ে সে শব্য। ছেড়ে উঠে বসল।
বিপ্রোহী কৈবর্ত ২৪৯১
এই সুস্পষ্ট প্রত্যাখানে ক্ষোভে, লজ্জায়, ঘৃণায়, দিবেবাক আড়ষ্ট
কঠিন হয়ে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। রাত্রির অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়
'না। দেখা গেলে দেখতে পেতেন উনছলির ব্যথা-ঘন দৃষ্টি থেকে প্রিয়ার
প্রেম আর জননীর সশংক স্নেহ একই সংগে ঝরে পড়েছে । কিছুক্ষণ
বাদে ঘুমিয়ে পড়লেন দিবেবাক, কিন্তু উনছলির চোখে ঘুম এল না।
তারপর থেকে দিবেবাক আরও বেশী করে জড়িয়ে পড়লেন
কাজে । কাঁজ-কাজ-কাজ, কাজের কি আর অস্ত আছে! ছোট
ভাই রুদোকের হাতে গৌড়ের ভার ছেড়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময়
তিনি বরেক্দ্রীতেই কাটান। কৈবর্তদের শক্তির মূল উৎস গৌড়ে নয়,
বরেক্জীতে । এ কথা তিনি বোঝেন, শত্ররাও বোঝে । তাই তারা
এই বরেন্দ্'€র উপরেই ছু ছ্ব বার আক্রমণ করেছে । ছু বারই তাদের
হটে যেতে হয়েছে। ওদের নান! রাজ্য থেকে সংগ্রহ কর! ভাড়াটে
সৈন্যের দুর্ধর্ষ কৈবর্ত যোদ্ধাদের সংগে যুদ্ধে এটে উঠতে পারে নি।
কৈবর্তদের মেয়ের! পর্যস্ত ওদের বল-বীর্ষের কথা নিয়ে হাসাহাসি
করে।
কিন্তু দ্রিবেবাক জানেন, ওদের তুচ্ছকরলে পরিণামে বিপদে পড়তে
হবে। এ যুদ্ধ ওরা দীর্ঘ কাল ধরে চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ এই ছু
পক্ষের এক পক্ষ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন নাহয়ে যায় । কোন পক্ষ নিশ্চিহ্ন হবে,
একমাত্র ভবিষ্যৎই সেকথাঁর উত্তর দিতে পারে। বরেক্্রী আর গৌড়ে
স্থশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে উঠতে লাগল । কিন্তু অশ্বারোহী
বাহিনী গড়ে তুলতে গেলে শুধু অর্থ ব্যয় করলেই চলে না, উপযুক্ত
শিক্ষকেরও প্রয়োজন গীঠিরাঁজ্য থেকে বন্ধু দেবরক্ষিত সেই অভাবটা
কিছুটা পুরণ করলেন।
শেব পর্যস্ত কোচরা তাদের সংগে প্রকান্তঠে ও পুরোপুরি যোগ
দিয়েছে। তারাও দিব্বোককে তাদের রাজ। বলেই মেনে নিয়েছে।
কৈবর্তদের মতই ফোজ! সরল বুদ্ধির মানুষ, যে কথা মুখে বলে সহজে
তরে নড়চড় হয় না। শুধু কোচরাই নয়, ছোট ছোট উপজাতি যার!
২৯২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
পাশ্ববর্তা অঞ্চলগুলিতে ছড়িয়ে ছিল, তারাও তাদের সংগে যোগ দিতে
লাগল। বরেক্দ্রীর সীম! ক্রমেই প্রসারিত হয়ে চলল । রাজ্য যতই
বাড়ছে, দ্রিবেবাকের কাজের দায়িত্ব ততই বেড়ে চলেছে । নানারকম
লোকের নানারকম সমস্তা ! আর সেই সব সমস্তা সমাধানের জন্য
সবাই তারই উপর একান্ত ভাবে নির্ভর করে থাকে । ফলে একটু
অবসর নেই তার।
উনছিল উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকান, আর মাঝে
মাঝে বলেন, তুমি কিছু দিনের জন্ত বিশ্রীম নাও। তোমার এই
শরীরে এত খাটুনি সইবে না ।
দিব্বোক অগ্রাহ্যের ভংগিতে তার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন,
বিশ্রাম? বিশ্রীম নেবার সময় কোথায় এখন ? একেবারেই বিশ্রাম
নেব, যখন বিশ্রীম নেবার দিন আসবে । কথাটার মধ্যে কেমন,
একটা অশুভ ইংগিত নিহিত রয়েছে । দিবেবাকের স্বাস্থ্যহীন মুখের
দিকে তাকিয়ে উনছলি শিউরে ওঠেন।
শরীরের উপর এত অত্যাচার আর বেশী দিন সইল না। রাজা
দেবরক্ষিতের আমন্ত্রণ রক্ষা করবার জন্য গীঠিরাজ্যে গিয়েছিলেন ।
সেখানে হঠাৎ রোগট। গুরুতর রূপ ধারণ করল । গীঠির বৈচ্েরা তার
শরীর পরীক্ষা করে বললেন, সর্বনাশ, আপনার শরীরে যে কিছুই
নেই। আপনি কিসের উপর নির্ভর করে চলছিলেন?
রাজবৈগ্চ তার রোগের সমস্ত ইতিহাঁসট। শুনে নিয়ে বললেন,
আপনার কীধের যেখানে বাণটা ফুটেছিল, সেখানে কি এখনও মাঝে;
মাঝে ব্যথা হয়?
দিবেবাক মাথা নেড়ে বললেন, হ্যা, এখনও হচ্ছে।
বৈদ্য বললেন, আমার সন্দেহ হয়, সেই বাণের ফলায় এমন কিছু
মিশানো ছিল, যা আপনার রক্তকে দূষিত করে তুলেছে । সেই দোষটা,
যখনই একটু উপলক্ষ পায় মাথ! জাগিয়ে ওঠে । আর ভিতরে;
ভিতরে তা আপনাকে খেয়ে চলেছে ।
ববব্রোহী কৈবর্ত ২৯৩
রাজ। দেবরক্ষিত রাজবৈছ্যকে একান্তে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
এই রোগের চিকিৎসা কি?
ধন্বত্তরীর অসাধ্য এই রোগ, উত্তর দিলেন বৈদ্য, এই বিষ এত দিন
ধরে ভিতরে ভিতরে কাজ করে এসেছে। খুব শক্ত ধাতের মানুষ
বলেই এত দিন দীড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু আর পারবেন না। যে সমস্ত
লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তা থেকে মনে হয়, ক্রমে ক্রমে সমস্ত শরীর অবশ
হয়ে আসবে বড় জোর আর বছর খানেক টিকে থাকতে পারেন,
তার বেশী নয়।
বরেদ্রী আর গীঠিরাজ্য পরম্পর মৈত্রীন্থত্রে আবদ্ধ। কিন্তু
দিবেবাকহীন বরেদ্রীর অবস্থাটা! কি দাড়াবে, বরেক্দ্রীর পরবর্তা নেতাদের
সংগে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলা কত দূর সম্ভব হবে, এই চিন্তা!
দেবরক্ষিতের মনকে আলোড়িত করে তুলল।
বর্বর কৈবর্তদের সংগে হাত মিলিয়েছেন বলে প্রতিবেশী রাজারা তার
সম্পর্কে বিরূপ। গুপ্তদূতেরা সংবাদ নিয়ে আসছে, রামপালদেব
গীঠিরাজ্য আক্রমণ করবার জন্য প্রস্তত হচ্ছেন। এদিকে সেনাপতি
ভীমযশ এই. একই কারণে তার বিরুদ্ধে প্রজাদের মধ্যে অসস্তোফ
ছড়িয়ে চলেছেন। সব জেনে শুনেও কোন কিছু করবার উপায়
নেই। এমন সময় এই সংবাদটা প্রচণ্ড আঘাঁতের মত তার উপরে
এসে নামল ।
এর কোনই প্রতিকার নেই? দেবরক্ষিত শুক্ষ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ।
বৈদ্য উত্তর দ্রিলেন, সর্বশক্তিমান ভগবান যদি করেন একমাত্র তিনিই
এর প্রতিকার করতে পারেন । এর প্রতিকার আমাদের শক্তির বাইরে ।
খোলাখুলি ভাবে তীর সামনে এ কথা কেউ তাকে বলেনি । কিন্তু
কোন কিছুই বুঝতে বাকী রইল না দিব্বোকের । কিছু দিন আগে
থেকেই তিনি ভিতরে ভিতরে অনুভব করতে পারছিলেন যে, তার
সময় এগিয়ে এসেছে । এখন মৃত্যুর পরোয়ান! হাতে নিয়ে তিনি ফিরে
এলেন বরেক্দ্রীতে।
২৯৪ বিজ্বোহী কৈবর্ত
বরেন্দ্রীতে ফিরে আসবার কিছুদিন পর আবার শষ্য নিতে হোল
তাকে। সেই যে শয্য। নিলেন, আর উঠবার সুযোগ পেলেন না ।
অবস্থাটা বুঝতে এখন আর কারও বাকী ছিল না। দিবেবোকের
সংগে যারা গীঠিতে গিয়েছিল, সেখানকার রাজবৈদ্ধের চূড়াস্ত অভিমত
তারাই বহন করে নিয়ে এসেছে । সে কথা লোকের মুখে মুখে সর্বত্র
ছড়িয়ে পড়েছে। বরেন্দ্রী আর গৌড় শোকের ছায়ায় মুহামান।
তুমি" আমাকে বিশ্রাম নেবার কথ। বলেছিলে উনছলি, তোমার
কথাই রইল । দিব্বোক হাসিমুখে উনছলিকে উদ্দেশ্ত করে বললেন ।
উনছলি করুণ দৃষ্টিতে. তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, এর উত্তরে
কোন কথাই বলতে পাঁরল না । সেকি এই ভাবে বিশ্রাম নেবার কথা
বলেছিল! ওর সেই বোবা দৃষ্টি দিবেবাকের বুকে যেন তীরের মতই
বিধল। ওর দিকে তাকালে মন তীব্র অন্ুশোচনায় ভরে আসে । মনে
হয়, এতদিন তিনি একে যেন উপেক্ষা করে এসেছেন, কিন্তু উনছলি
তাই নিয়ে কোন দিন ভুলেও কোন অভিযোগ করেনি । প্রথম যৌবনের
সেই রংগীন দ্রিনগুলির কথা মনে পড়ে যায় । তিনি কেমন ওর কাছ
(থেকে যেন দূরে সরে গিয়েছিলেন । কিন্তু উন্ছলি এখনও সেই উনছলিই
আছে। চিরদিনই ছিল । রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে অমেক দিনের অনেক
কথাই মনে পড়ে যায় তার। অতি তুচ্ছ সামান্য সেই সব কথা মনের
প্রান্তে কোথায় কেমন করে লুকিয়ে ছিল, সেগুলি এখন বিশেষ রূপ
নিয়ে ফুটে উঠছে। |
এক দিন ওর ছুটো হাত ধরে অভিভূত কণ্ঠে বললেন, আমাকে
মাপ কর, মাপ কর উনছলি।
উনছলি তার বেদনাঘন ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে বলল, এ কি কথা
বলছ তুমি?
অনেক দিন অনেক অন্যায় করেছি তোমার উপর ।
নানা, কোন দিন না, আমার উপর কোন অন্যায় তুমি করনি । তুমি
কি তেমন মানুষ? তুমি কি কারুর উপর কোন অন্যায় করতে পার?
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৯৫
কিন্ত উনছলির কথায় মনকে প্রবোধ দেওয়। যায় না। সমাজের
সমস্ত মানুষের কথা ভেবে এসেছেন তিনি, শুধু একজনের কথা ছাড়া ।
আর সেই এক জন, যে চিরদিন তার দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল |
মনের মধ্যে যে সব কথা জমে উঠেছে, তার কোন কিছুই বলা হয়
না। শুধু মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে, আমার মাথাটা একটু বুলিয়ে দাও
উনছলি ৷
আর এইটুকু কথার মধ্য দিয়ে উনছলি যেন অনেক কিছুই পেয়ে
যায়।
কিন্ত এর নাম বিশ্রাম? লোকের পর লোক আসছে তাকে
দেখতে । পুরুষেরা আসে, মেয়েরা আসে-__সব বয়সের মানুষই
আসে । ওরা এত দিন যে সব দেবতাকে পুজা দিয়ে আসছে, তাদের
চোখে দেখা যায় না । আর যে দেবতাকে চোখে দেখা যায়, ওরা এখন
তাকেই পুজো দিতে আসে । আসে, প্রণাম করে চলে যায়। রোগীর
কাছে এত ভীড় ভাল নয়, এ কথা সবাই বলে, আবার সবাই আসে ।
উনছলি মাঝে মাঝে এই নিয়ে আপত্তি জানায়। কিন্ত দিবেবেকের
চোখে এমন নিঃশব্দ মিনতি ফুটে ওঠে যে, শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে বাঞ্চ
দেওরা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
রোগীর কক্ষ যখন তখন মন্ত্রণাকক্ষে পরিণত হয়ে যায়। গৌড়
থেকে মাঁঝে মাঝে তার নির্দেশ নেবার জন্য লৌক আসে । বরেন্দ্রীর
রাজপুরুষরাও আমে । নান! জায়গার নানা সমাজের দলপতিরাঁও
আসে । রাজ্যের কোথায় কি ঘটছে না ঘটছে, তাদের মুখ থেকে খুঁটে
খুঁটে সমস্ত সংবাদই সংগ্রহ করে নেন তিনি ।
এক দিন পরভূ এসে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ দিল, রামপালদেবের
মাতুল মথনদেব গীঠিরাজ্য আক্রমণ করেছিলেন ।
তার পর? তার পর? উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলেন দিব্বোক।
তার পর? ওর! বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে । বলে .একটু
থামল পরভু তার পর আবার বলল, আমি তো আপনাকে প্রথমেই
২৯৬ বিদ্রোহী কৈবর্ত
বলেছিলাম, ওদের কথায় কোন বিশ্বাস নেই, ওর! আজ যা বলে,
কালই তা উলটে দিতে পারে । তা ছাড়া ওদের নিজেদের মধ্যে যতই
ঝগড়াঝাটি থাক না কেন, শেষ পর্যস্ত আমাদের কৈবর্তদের বিরুদ্ধে
ওর! একজোট হয়ে যাবেই। মুখে যে যাই বলুক ওর! সবাই সমান ।
দিবেবাক পরতুর এই কথাট। পুরোপুরি মেনে নিতে পারলেন না।
বললেন, ন৷ না, রাজ দেবরক্ষিত তেমন লোক নন। তুমি তো সব
কথা জান না, তার সেনাপতি আর রাজ্যের অধিকাংশ লোক তার
বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। রাজা দেবরক্ষিত অবশ্য মুখ ফুটে সে কথ!
আমাকে বলেননি । কিন্তু লক্ষণ দেখে আমার কাছে সেই রকমই
মনে হয়েছিল। শুনেছি আমাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্টা সেনাপতি ভীমযশ
কোন দিনই ভাল চোখে দেখেন নি । আমার মনে হয় রাজা দেবরক্ষিত
যাই করে থাকুন, বাধ্য হয়েই করেছেন ।
অন্ত সময় হলে পরভু চুপ করে এ কথাঁট। মেনে নিত না। কিন্তু
দিবেবাকের শরীরের অবস্থার কথা বিবেচনা করে কোন প্রতিবাদ
করল না।
কিছু দিন বাদে পরভুই এসে খবর দিল আবার, দেবরক্ষিতের সংগে
মথনদেবের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । শুধু এইটুকুই বলল, পরভু, এই
প্রসংগে আর কোন কথ বলল না। কিন্তু তার বলার মধ্যে যে
ইংগিতটা ছিল তা৷ যাকে বলা হোল তিনি ভাল করেই বুঝলেন!
সংবাদটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। গীঠি ওদের হস্তগত হয়েছে।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, এটা ওদের প্রথম পদক্ষেপ। এবার
গৌড় আর বরেন্দ্রীর পাল! ।
গীঠিরাজ্যের আত্মসমর্পণের সংবাদটা শোনার পর থেকেই কথাটা
তার মনে জেগেছে । কিন্তু বলি বলি করেও বল! হয় নি। এত বড়
মারাত্মক ভুল তিনি কেমন করে করলেন ? ডেকে বললেন, পরভু শোন
এখনই গৌড়ে সংবাদ পাঠাও, তার! যেন যুদ্ধের জন্ত প্রস্তুত থাকে।
ওরা যে কোন সময় চলে আসতে পারে। আর তোমরাও, হ্থ্যা
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৯৭
তোমরাও তৈরী হও। সবাইকে খবর দাও। সৈল্ত যারা, তারা তো
আছেই, তা ছাড় রাঁজ্যের সমস্ত সমর্থ পুরুষ, যাঁর যাঁর হাতিয়ার আছে,
তা যেন ঘসে মেজে সারাই করে রাখে । এবার কিন্তু ওরা দলে ভারী
হয়ে আসবে । সবাইকে বলবে, এবার ওদের এমন করে শিক্ষা দিয়ে
দিতে হবে যেন শীগগির আর এ যুখো হতে সাহস না করে। আর
সমস্ত রাজ্যের গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে জানিয়ে দেবে যদি প্রয়োজন হয়
তবে মেয়েদেরও নামতে হবে ।
পরভু হেসে বলল, আমাদের মুখ থেকে এই কথাই তো ওর!
শুনতে চায়। তারপর এই নিয়ে পরামর্শ চলল দুজনে ।
বছর খানেক ধরে একটান। শান্তি চলছে, যুদ্ধ বিগ্রহের নাম গন্ধ
নাই, বড় একঘেয়ে আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল পরভুর। এবার সে
একটু চাংগা হয়ে উঠল ।
যাবার আগে দিব্বোক তাঁকে বলে দিলেন, কোচদের সমাজের
মাথা যারা তাদের ক'জনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও । আর তোমরা
ওদের জওয়ান ছেলেদের সংগে মিশে ঠিক করে নাও ওদের।
তোমাদের আর ওদের মধ্যে যেন কোন ফাক না থাকে ।
সার! রাজ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল । ঘরে ঘরে, মাঠে ঘাটে এই
নিয়েই আলোচনা । এখানে ওখানে লড়াইয়ের মহড়া চলছে । বড়দের
দেখাদেখি বাচ্চারাও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে। ঘোঁড়সওয়ার সৈন্যেরাও মাঠে
ময়দানে তাদের ঘোড়াগুলিকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াছে। ঘোড়াগুলিও
যেন যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সারা দেশ জুড়ে বয়ে
চলেছে উত্তেজনার ঢেউ । কৈবর্তেরা চিরদিনই উৎসবপ্রিয়। এও যেন
তাদেব একটি উৎসব ।
দিব্বোক বলেছিলেন, ওর আক্রমণ করতে আসছে । সমস্ত
দেশের মানুষ কথাটাকে স্থনিশ্চিত সত্য হিসাবেই গ্রহণ করে নিয়েছিল।
দিবেবোক যখন বলেছেন তখন আসবেই । দিবেবাক এ পর্যস্ত যে সব
কথা বলেছেন, তার কোনটা মিথ্যা হয়েছে, এমন কথা৷ কেউ স্মরণ
২৯৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
করতে পারে না। দেখতে দেখতে ছু দুটো মাস কেটে গেল । কিন্ত
কোথায় আক্রমণ, নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে দিনের পর দিন কেটে যেতে
লাগল । প্রতীক্ষার ছুঃসহ.ভারে অস্থির হয়ে উঠল মানুষ । এত
প্রস্তুতি, এত আয়োজন, এই হোল তার পরিণতি ! এ ভাবে কত দিন
চলে! শক্ত করে আটা ধনুকের গুণের মত উত্তেজিত মানুষগুলি সময়ের
সংগে সংগে টিলে হয়ে আসতে লাগল । বড় মনঃক্ষুণ হোল পরভু।
তার মত আরও অনেকেই মনঃক্ষুপ্ন হোল।
দিবেবাক তার রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে এই সব কথাই ভাবছিলেন ।
আজও সকালে পরভু হতাশ কণ্ে তার মনের ছুঃখ জানিয়ে গিয়েছে,
কই, এল ন! তো! ওরা? এই হতাশার সংগে মূ একটু অভিযোগের
স্বরও মিশে আছে, সে কথা বুঝতে বাঁকী ছিল না তার। তিনি হেসে
বললেন, না আসাটাই তো! ভাল। পরভু এ কথার কোন উত্তর দিল না।
কিন্তু না আসাটা যে ভাল, তার মুখ দেখে সে কথাটা মনে হোল না।
পরভুর কথাট! শুধু পরভুরই কথা৷ নয়, এট] যে তারও নিজের
মনের কথা৷ দিবেবাক মনে মনে এই নিয়েই জল্পনা কল্পনা করছিলেন ।
ওরা যখন আক্রমণ করবেই তখন এ রকম প্রস্তত অবস্থার মধ্যে সেট।
হয়ে গেলেই ভাল। এখানকার মানুষের মনোবল এমন উচু স্তরে আর
কোন দ্রিন ওঠে নি, রোগশধ্যায় শুয়ে শুয়েও সেই কথাঁট। তিনি অনুভব
করতে পারছিলেন । আযুর স্ত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে,
কখন একটা হ্যাচক। টানে ছিড়ে যাবে কেজানে! তার আগে
শক্তি পরীক্ষাটা দেখে যাবার জন্য ভিতরে ভিতরে খুবই আগ্রহ ছিল
তার।
এমন সময় ডুব ডুব করে ঢোলের শব্দ ভেসে এল। উনছলি
পাশে বসে মাথায় বাতাস করছিলেন । ও কিসেরু শব্দ উনছলি ?
দিবেবাক জিজ্ঞাসা করলেন।
উনছলি উত্তর দিল, আর ক'দিন বাদেই যে ওলান ঠাকুরের পরব।
ও) হো, আর কদিন বাদেই ওলান ঠাকুরের পরব। কি আশ্চর্য,
বিদ্রোহী কৈবর্ত ২৯৯
সে কথা যে মনেই ছিল না ত্ার। আর কেউ মনে করিয়েও
দেয় নি।
পরবের কথা মনে করতে গিয়েই হঠাৎ সেই ছেলেটার কথা৷ মনে
পড়ে গেল, যাঁকে তিনি প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই
প্রতিশ্রুতি রক্ষ। করতে পারেন নি। সে কথাটা মনে করতেই প্রাণটা।
কেমন অস্থির হয়ে উঠল । চোখ বুজে শুয়েছিলেন, সেই অবস্থাতেই
ডাকলেন, উনছলি ?
উনছলি ব্যস্ত হয়ে ঝুকে পড়ে বলল, কি? কি বলছ?
এবার ওর! বলির জন্য যে মানুষ সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে, সে কি
বয়স্ক না কমবয়সী ?
উনছলির মনে পড়ল, আসল কথাটাই তো! বল হয় নি। সে
বলল, তোমাকে বলতে ভূলে গেছি, এবার থেকে নরবলি বন্ধ করে
দেওয়া হবে । সেই জন্যই কোন মানুষ নিয়ে আসা হয় নি। কথা!
আজই আমি শুনলাম ।
দিবেবাক চমকে উঠে বললেন বলছ কি তুমি, নরবলি বন্ধ করে
দেওয়া হবে? কিন্তু কেন? কেন? বিন্মিত দৃষ্টি মেলে তিনি উনছলিঞ্ধ
মুখের দিকে তাকালেন।
উনছলি ধীরে অথচ ম্পষ্ট কে উচ্চারণ করলেন, তোমার আপত্তি
আছে বলে, তুমি ছঃখ পাও বলে।
দিবেবাক আবাঁ তার ছু চোখ বুজলেন। তিনি কতক্ষণ কোন কথ৷
বলতে পারলেন না, স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলেন। একটু পরেই তার
নিজের অজান্তে তার তব চোখ থেকে ছু ফৌটা জল বেরিয়ে এল।
উনছলি অবাক হয়ে দেখলেন, দিবেবাকের চোখে জল ! তার জীবনে
এমন আর কখনও দেখেননি । পরম স্পেহে তার আচল দিয়ে চোখের
জল মুছিয়ে দিয়ে উনছলি প্রশ্ন করলেন, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার ?
কষ্ট? কই না তো।
তবে তোমার চোখে জল কেন?
৩৩৩ বিদ্রোহী কৈবর্ত
চোখে জল? ও কিছু না। উনছলি, আজ আমার কি আনন্দের
দিন! এত আনন্দ আমি ধরে রাখতে পারছি না, তাই বুঝি চোঁখের
জল হয়ে বেরিয়ে এসেছে । আচ্ছা উনছলি, আমি ছুঃখ পাই বলে
ওরা এত দিনের নরবলি বন্ধ করে দিল! এত ভালবাসে ওরা
আমাকে? উনছলি উত্তর দিল, তোমাকে ভালবাসবে না তো কাকে
ভালবাসবে? তোমার মত আপন লোক ওদের আর কে আছে?
শুয়ে শুয়ে পরবের কথা ভাবছিলেন তিনি । হঠাৎ একটা কথা মনে
পড়তে তার চিস্ত।টা থমকে দাড়িয়ে পড়ল, আর এগোতে পারলেন না ।
গৌড়ে প্রথম পরব অনুষ্ঠানের সময়কার একট ছবি তার চোখের
সামনে ভেসে উঠল- রাজধানীতে পরবের প্রথম অনুষ্ঠানের সময়
রাজপথে যে দৃশ্ট দেখেছিলেন । দেখেছিলেন মেয়ে পুরুষ মদ খেয়ে
অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, কেউ ব1 ভাল-মন্দ বোঁধ বিবেচনা হারিয়ে
পাগলের মত মাতামাতি করছে। শুধু দেশের একপ্রাস্ত থেকে অপর
প্রান্ত পর্যন্ত এই একই ছবি। এটাই কৈবর্তদের চিরাচরিত প্রথা,
চলে আসছে। সেদিন ওদের এই অবস্থায় দেখে তার মনে হয়েছিল,
শক্রপক্ষের কাছে এ কথ। তো অজানা নয়, কৈবর্তদের তারা ভাল করেই
চেনে। এই স্থযোগ নিয়ে ওরা যদি অতকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন
কে তাদের প্রতিরোধ করবে !
এত দিন শক্ররা বিপর্যস্ত ছত্রভংগ হয়ে ছিল, হয়তো! সেইজন্যই এই
স্ুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারেনি । কিন্তু এবার ওরা ভাল করে
আট ঘাট বেধেই আসছে । তার ওপর গীঠিরাঁজ্যের সৈম্বল এবার
ওদের পক্ষে । কৈবর্তদের শক্তি কোথায় আর ছুর্বলতার স্থানই বা
কোথায়, গীঠিরাজ্যের সেনাপতির কাছে তার কোন কথাই অজান৷
নেই। কে জানে হয়তে। সেই জন্যই তারা এই বিশেষ দিনটির জন্য
অপেক্ষা করে আসছে।
এই আশংকাট। বিছ্যতের মত ঝলসে উঠল তার মনে। এমন
'আকম্মিক যে মনে হোল এট। তার নিজের চিন্তা নয়, আকাশ থেকে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩০৬
দৈববাণীর মতই নেমে এসেছে। যা ছিল কল্পনা, তা দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত
হয়ে গেল। দলপতিদের ডাকিয়ে এনে বললেন, আমার বিশ্বীসা এই
পরবের দিনটিকে বেছে নিয়েই ওরা আক্রমণ করবে । সেই জন্য সৈন্য
যারা, আর যারা দেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধ,করতে চায় তারা যেন একমাত্র
নিয়ম রক্ষার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, শুধু ততটুকু মদই খায়, তার বেশী
খেয়ে মাতাল হয়ে না পড়ে । শত্রু যখনই আসুক, তারা যেন*আমাদের
অপ্রস্তত অবস্থায় না পায়।
বিশ্বাম করবার শক্তি সবাঁর নয় । ছু” মাস কাল অপেক্ষা করে করে
ওদের মনের বাঁধুনিটা একটু আলগা হয়ে এসেছে । এ কথা সবাই
স্বীকার করল, সে দিনটায় আক্রমণ হলে বিপদের কথাই । কিন্তু এত
ভেবে কি ওর! কাজ করবে? বছরের এমন একটা দিন অপ্রমত্ত
অবস্থায় কাটিয়ে দিতে হবে, এ যে কি কঠিন পরীক্ষা কৈবর্ত ছাড়া এ
কথা আর কে বুঝবে ! কিন্তু তা হলেও মৃত্যুপথযাত্রী নেতার এই শেষ
ইচ্ছা! ওরা অপূর্ণ রাখবে না। তার কথায় ওর! সবাই সম্মতি জানিয়ে
গেল।
নতুন করে যুদ্ধের আয়োজন শুরু হয়ে গেল আবার। তারই ভামা'
ডোঁলের আড়ালে পরবের ঢোলের ডূমুড়ুমু শব্দ চাপা পড়ে গেল ।
দিবেবাকের এই ভবিষ্যদ্ধাণী কারও কারও উপর মন্ত্রের মতই কাজ করছে ।
রাজা! যখন বলেছেন, তখন না হয়ে পারে না। পরবের আর ক" দিন
বাকি, তারা অধীরভাবে গুণে চলে । প্রতিবারেই এমনি করেই
গোণে কিন্তু অন্যবারের সংগে এবারের তুলন। হয় ন!।
রাজার কথা কখনও মিথ্যা! হয় না এ বারেও সেই কথাটাই প্রমাণ
হয়ে গেল। পরবের আগের দিন বিকাল বেলা উনছলি হাঁপাতে
ইাপাঁতে এসে খবর দিল, ওরা আসছে! আব্রমণ করতে আসছে !
ওর কারা, সে প্রশ্ন করা বাহুল্যমাত্র। ওরা বললে কাদের
বোঝায় বরেক্দ্রীর শিশুরাও তা' জানে ।
উঠে বসবার শক্তি ছিল না দিবেবাঁকের, কিন্তু খবরটা শোনার সংগে
৩৩২ বিদ্রোহী কৈবর্ত
সংগেই কেমন করে উঠে বসলেন। উঠে দাঁড়াতেই চেয়েছিলেন,
কিন্তু পা ছুটো৷ ফুলে বিষম ভারী হয়ে গেছে, তার! তার নির্দেশ মানল
না। এ কি,একি,কি করছ! বলে উনছলি ব্যাকুল পক্ষিণীর মত
তুই ডানা মেলে জড়িয়ে ধরলেন তাকে । তার পর আস্তে করে তাকে
শুইয়ে দিয়ে তার শিয়রের কাছে বসে পড়লেন। ইতিমধ্যে পরভূআর
তার ছুজন সংগী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছে। ওদের চোখে মুখে
প্রবল উত্তেজনা। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ওরাও সেই একই কথা বলে
উঠল, ওর! আসছে। ওরা আসছে।
সতের
পরাজিত শক্রর! ছত্রভংগ হয়ে পালিয়ে গিয়েছে । রাজধানী গৌড়
আর বরেক্দ্রীতে একই দিনে ওরা আক্রমণ করেছিল। ছুজায়গ৷
থেকেই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে হয়েছে। রাজা দ্িবেবাকের কথা অক্ষরে
অক্ষরে ফলেছে। আক্রমণের জন্য ওলান ঠাকুরের পরবের দ্রিনটাকেই
ওরা বাছাই করে নিয়েছিল। কিন্তু ওরা যে আশ! করেছিল, সে
'আশায় ছাই পড়েছে। গৌড় আর বরেন্দ্রীর কৈবর্তেরা ওদের উপযুক্ত
অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিল । শক্রুপক্ষের
প্রচুর সৈন্য হত হয়েছে । কৈবর্তের ওলান ঠাকুরের প্রাপ্য নরবলি
এবারকার মত স্থগিত রেখেছিল, কিন্ত সে জন্য ওলান ঠাকুরের
মনঃক্ষুপ্ন হবাঁর কারণ ঘটেনি, পরের দিন বনু নরবলি পড়েছে এবার ।
কিন্ত কৈবর্তদের যা ক্ষতি হয়েছে তাও কম নয়। এ ঘা শুকোতে
বেশ কিছু কাল সময় লাগবে । তবে এই বিপুল সাফল্যের মুখে
তাই নিয়ে কেই ব! মন খারাপ করে বসে থাকতে পারে !
কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও উৎসব তেমন করে জমল না। সব
কিছুর মূলে যিনি, তার জীবন প্রদীপ একটু একটু করে নিভে আসছে।
এ বাতি যখন নিভে ধাবে, তারপর? লোকে বলাবলি করে, রাজা
দিব্বেক কি মানুষ? তিনি নর দেহে দেবতা । কখন কি ঘটবে না
ঘটবে, তিনি দূরে বসেও তা দেখতে পান। শক্রদের মনের গোপন
কথাও তার কাছে 'অজান! থাকে না। তার জোরেই কৈবর্তদের জোর ।
তার অবর্তমানে কি গতি হবে তাদের? আসন্ন শোকের ছায়৷ দীর্ঘায়ত
হয়ে নেমে আসছে বরেক্দ্রীর বুকে ।
গৌড় থেকে রুদৌক, তার ছেলে ভীম আর বিশিষ্ট লোকেরা শুধু
১১১৪৪ বিদ্রোহী কৈবর্ত
যুদ্ধ জয়ের শুভ সংবাদ দেবার জন্যই যে এসেছেন, তা নয়, দিব্বোককে
দেখবার জন্ত ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছেন । প্রতি দিনের সূর্য দিনশেষে
অস্ত যায়, রাত্রি অস্তে আবার তার উদয় হয়। কিন্ত এ সূর্য যদি
অস্ত যায় আর তাঁর উদয় হবে না। আর দিবেবাকহার৷ কৈবর্ত
সমাজের অবস্থা যে ন্ূর্যহারা পৃথিবীর মতই করুণ ।
রুূদৌকের ছেলে তারুণ্যের প্রতিমূত্তি ভীম । এ বংশের একমাত্র
বাতি। সকলের আদরের ধন, নয়নের মণি। এবারকার গৌড়ের
যুদ্ধে তার খুবই স্থনাম হয়েছে। দ্িবেবাকের কাছে বসে যুদ্ধের সেই
কাহিনীই সে শোনাচ্ছিল। জীবনের এই সন্ধি সময়ে সিংহের মাথায়
কেশর গজায়, ময়ূরের পেখমে বণচ্ছিটা জেগে উঠে, আর মানুষ তার
নিজের কৃতিত্ব আর গৌরবের কথা নান! ভাবে প্রকাশ করতে চায়।
সবাই করে থাকে । ভীমও তাই করছিল । দিবেবাক ধৈর্য ধরে তার
কথা শুনছিলেন, আর মৃছ যুছ হাসছিলেন। গৌড় থেকে যার!
এসেছেন, তারাও গোল হয়ে বসে শুনছিলেন। দিিব্বোক নিঃসন্তান,
ভবিষ্যতে এ রাজ্যের শীসনভার তারই হাতে আসবে, এ বিষয়ে ভীম
যে খুবই সচেতন, তার কথার মধ্য দিয়েই তা প্রকাশিত ।
দেশরক্ষা সম্পর্কে তার নানা রকম পরিকল্পনা আছে । তারই
একটা নিয়ে সে আপাতত আলোচনা করছিল । বলছিল, সমস্ত
রাজ্যটাকে একটা! প্রশস্ত আর উঁচু জাংগাঁল তুলে ঘেরাও করে ফেলতে
হবে। জাংগালের ওপারেই থাকবে পরিখা । এ ভাবে একবার
রাজ্যকে সুরক্ষিত করে তুলতে পারলে তখন আর শক্রদের আক্রমণের
জন্য সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে না ।
যারা উপস্থিত ছিল, তাদের মধ্যে একজন সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
এ কি কখনও সম্ভব? প্রাচীর তুলে নগরীকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা!
সর্বত্রই আছে। কিন্তু তাই বলে সমস্ত রাজ্যকে ডাংগাল দিয়ে ঘিরে
রাখা, এমন কথা কেউ কোন দিন শোনেনি ।
ভীম এ কথার প্রতিবাদ করে বলল, যা কোন দিন হয়নি, তা যে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩০৫
কখনোই হবে নাঃ হতে পারে না, এ কি একটা কথা হোল? ওদের
গৌড় যে কোন দিন আমাদের হাতে আসবে, আর আমাদের লাথি
খেয়ে ওরা কুকুরের মত পালিয়ে যাবে এমন কথাই কি কেউ কোন
দিন ভাবতে পেরেছিল ? আমরাও না, ওরাও না। কিন্তু শেষ পর্যস্ত কি
হোল? যা কেউ ভাবতে পারেনি, তেমন ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়লাম তো
আমরা । তবে?
ভীম সমর্থনের আশায় দিবেবোকের মুখের দিকে তাকাল ।
ভীমের উৎসাহ প্রদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে মন:
করতে দ্িবেবাকের মায়া লাগল। তিনি বললেন, কোন দিন হয় নি
বলে যে তা হতে পারে না, এটা সত্য নয়, ভীম ঠিকই বলেছে
কথাটা। ভবিষ্যতে এ রকম জাংগাল তোলা যদি সম্ভব হয় আঁর
সেটা সত্যসত্যই কাজে আসে, তবে তা করবে না কেন? কিন্তু ভীম,
এই জাংগালের চেয়েও শক্তিশালী মানুষের জাংগাল, সে কথাটা ভূলে
যেও না যেন। সব চেয়ে বেশী নজর রাখতে হবে তার দিকে ।
মানুষের জাংগাল! সে আবার কি? ভীম আশ্চর্ধ হয়ে প্রশ্ন
করল ।
হ্যা, মনের সংগে মন গেঁথে গেঁথে এই মানুষের জাংগাল গড়ে
তুলতে হয়। আমরা কৈবর্ত, কোচ এবং আরও অন্তান্ত জাতের
মানুষদের মন গেঁথে গেঁথে এই জাংগাল তুলতে পেরেছিলাম বলেই,
ওরা এই জাংগাল ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারেনি । কিন্ত আরও
অনেক দৃঢ়, অনেক সুগঠিত করে তুলতে হবে একে । মাটি-পাথরে
গড়া জাংগালের চেয়েও এই জাংগালের শক্তি অনেক বেশী। যত দিন
এই'জাংগাল ঠিক থাকবে, তত দিন আমাদের ভয় নেই।
ভীম এ কথার তাৎপর্য কতটুকু বুঝল, বোঝ। গেল না। রুদোক
দিবে্বোকের কথায় সায় দিয়ে বললেন, হ্যা এই শক্তিই যে সব চেয়ে
বড় শক্তি সে সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নইে। বরেন্দ্রী আর গৌড়ের
মানুষ এবার যে একতার পরিচয় দিয়েছে, তার তুলন! হয় না। ওরা
২ ০--
৩০৩ বিদ্রোহী কৈবর্ত
এবার ভাল করেই বুঝে গেছে, আমাদের মধ্যে কোন ফাঁক নেই,
এখানে প্রবেশ করতে হলে মাথা ঠুকে মরাই সার হবে ।
ভুল, ভূল বলছ রুদোক, আজ না হয় ফাঁক নেই, তাই বলে সব
সময়ই ঠিক এমনি থাকবে এমন কোন নিশ্চয়তা আছে? 'আর আমরা
যে যাই ভাবি না কেন, ওই পরাজয়কে ওরা চুড়ান্ত বলে মেনে নেবে
না। ওরা সব সময় চেষ্টা করে চলবে যাতে আমাদের মধ্যে
গৃহবিবাদ বাঁধিয়ে তুলে ফাটলের স্থষ্টি করে তুলতে পারে । আমরা যদি
এ বিষয়ে সব সময় সতর্ক না থাকি, এই প্রাচীর ধ্বসে পড়তে সময়
লাগবে না। এ কথা অস্বীকার করতে পারবে না, কুটবুদ্ধি আর
ধূর্ততার দিক দিয়ে ওদের তুলনায় আমরা নিতান্ত শিশু ।
যুদ্ধ জয়ের পর একে একে অনেকেই তার সংগে দেখা করতে
এল । কিন্ত এবারকার বরেন্দ্রীর যুদ্ধে যাদের ভূমিকা সব চেয়ে বেশী
উল্লেখযোগ্য সেই ছুইজনই আসেনি । একজন পরভু। তার পক্ষে
আসা সম্ভব নয়। যুদ্ধের সময় দারুণভাবে জখম হয়েছিল সে।
প্রাণে বেঁচেছে এই ভাগ্য। তার সেরে উঠতে বেশ কিছুটা সময়
লাগবে।
আর এক জন আকন। সবাই বলে, আকনই এবার যুদ্ধের শেষ
রক্ষা করেছে। সে না থাকলে কি যে হোত বলা যায় না।. পরভু
যখন সামনের সারিতে যুদ্ধ করতে করতে জখম হয়ে পড়ল, শক্রসৈন্
উল্লাসে চীৎকার করে উঠল, আর সমস্ত কৈবর্ত সৈন্য পরভুকে পড়ে
যেতে দেখে হতবুদ্ধির মত দীড়িয়ে পড়ল। পরভূ নেই, কে তাদের
পরিচালনা করবে ? সেই সংকটমুহূর্তে কোথা থেকে ছুটে এল আকন,
পরতুর শৃন্ত জায়গাটা দখল করে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে।
তরোয়ালের মুখে বিহ্যৎ শিখার সঞ্চার করে আগুনের হলকার মত
সে শত্রু সৈন্যের মাবখানে গিয়ে পড়ল। এই দুঃসাহসিক আক্রমণে
ওরা কেমন বিহ্বল হয়ে ছু দিকে সরে গেল, ফলে ব্যুহের মধ্যে একটা
'ভাঙনের স্থষ্টি হোল। ইতিমধ্যে কৈবর্তের৷ তাদের সম্বিত ফিরে
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩৩৭
পেয়েছে । তাদের উন্মত্ত সেনাপতির মত তারাও উন্মত্ত হয়ে সেই রক্ধধ
পথ ধরে ছুটে চলল । সেই প্রচণ্ড আঘাতে ওদের ব্যুহ টুকরো টুকরে!
হয়ে ভেংগে গেল।
এমন দ্রুত এমন একট! পরিণতি ঘটে যেতে পারে, এটা কোন
পক্ষই ধারণা করতে পারে নি। সেই থেকে আকনের নাম সকলের
মুখে মুখে ।
আকন নিজে থেকে এল না। দ্রিবেবাক একে ওকে দিয়ে খবর
পাঠালেন, তবুসে এল না । এ কেমন মানুষ, অবাক হয়ে ভাবলেন
দিবেবাক। কত লোক আসছে তার হাত থেকে পুরফার নেবার জন্য,
তার মুখের প্রশংসা শুনবার জন্য, আর আকনকে খবর দিয়েও আননো
যায় না, যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আকনের নাম তার কাছে
সুপরিচিত। ইতিপূর্বে পরভূর মুখে ওর অনেক প্রশংসা শুনেছেন ।
তরোয়াল পরিচালনায় ওর মত দক্ষ হাত নাকি এখানে দ্বিতীয় একটি
নেই । আর তার হাতের তীর অব্যর্থ ।
এমন একটা যোদ্ধা অথচ তার সংগে আলাপ পরিচয় হওয়া দূরে
থাক, এক দিনের জন্যও দেখা হয়নি ! এটাই বা কেমন করে হোল?
এত মানুষের সংগে তার এত ঘনিষ্ঠ পরিচয়, কিন্তু আকনের মত
লোকের সংগে তার পরিচয় নেই, এরই ব। কারণ কি ?
তার গীড়াগীড়ির ফলে এক দিন কয়েক জন মিলে তাকে যেন ধরে
বেঁধে নিয়ে এল । আকন চোখ তুলে তাকাতে চায় না, মুখ ফুটে কথা
বলতে চায় না। কয়েক বার প্রশ্ন করবার ফলে সে শুধু এইটুকুই
বলল, ওদের ঘর থেকে চলে যেতে বলুন ।
দিবেবোক বুঝলেন, এর পিছনে অবশ্য কোন গভীর রহস্ত
আছে। তার নির্দেশে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু তাতেও
মন মানল না আকনের। সে উঠে গিয়ে দরজাটা ভিতর থেকে
বন্ধ করে দিয়ে দিবেবাকের শয্যার পাশে খালি মেঝের উপর বসে
পড়ল ।
৩০৮ বিদ্রোহী কৈবর্ত
ওখানে নয়, ওই যে আসন রয়েছে, ওখানে উঠে বসো আকন।
দিবেবাক স্নেহের স্বরে বললেন।
আকন যেমন ছিল তেমনি বসে রইল, একটু নড়ল ন৷ পর্যস্ত।
দিবেবাক লক্ষ্য করলেন, সে যেন বিশেষ উদ্দেশ্ট নিয়েই মাথা নীচু করে
বসে আছে, তার চোখের সংগে চোখ মিলাতে চাইছে না । তার
কৌতুহল আরও বেড়ে উঠল।
তার এ-রকম ব্যবহারের কারণ কি সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন না করে
তিনি বললেন, আকন, সবাই বলছে, এবারকার যুদ্ধে তোমার কৃতিত্বই
সব চেয়ে বেশী, সব চেয়ে বড় সম্মান তোমারই প্রাপ্য । তুমিই বল,
কি. পুরস্কার তোমাকে দিতে পারি। আকন মাথা তুলল না, ওই
ভাঁবেই বলল, যদি দিতে চান, আমাকে মৃত্যু দণ্ড দিন।
চমকে উঠলেন দিব্বোক। পাগল হয়ে গেল নাকি ছেলেটা !
এ কি বলছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে আবার তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন, এ অদ্ভুত
প্রার্থনা কেন তোমার ?
আমি জঘন্য অপর।ধে অপরাধী । অপরাধের দণ্ড না পাওয়া পর্যস্ত
আমি তিলে তিলে জ্বলে পুড়ে মরছি। এ যন্ত্রণা আমার আর সহ হয়
না।
দিবেবোক লক্ষ্য করলেন, তার গলার স্বর ভারী হয়ে এসেছে।
এমন কি অপরাধ করেছ তুমি? সব কথা খুলে বল আমাকে ।
আকন মাথা তুলে কি বলতে গেল, কিন্তু কোন কথা না বলে
আবার মুখ নীচু করল।
বল, বল, আমার কাছে বলতে ছিধা কোরো না। আমি
মৃত্যুপথযাত্রী । আজ আছি কাল নাই, আমার কাছে কোন কথা
বলতে সংকোচ কোরো না।
এই কথার উপর ছেলেমানুষের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল
আকন। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য দিব্বোক একেবারেই প্রস্তত
বিদ্রোহী কৈবর্ত ৩৩৯
ছিলেন না । তিনি হতবুদ্ধির মত তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ,
শেষে বললেন, কি হয়েছে আকন ?
আপনার এই অবস্থা আমারই ছৃ্র্মের ফলে। সে কথা আপনি
জানেন না, কেউ জানে না, শুধু জানি আমি। বুদ্ধির ভূলে, যে কাজ
করে বসেছি আমি, এখন কেমন করে তার প্রতিকার করব। সারা
দেশের মানুষ যে আজ কেঁদে মরছে, সে তো! আমার জন্যই । আমি
পাগী, মহাপাপী।
কি বলতে চাইছে আকন, দিবেবাক তখনও বুঝে উঠতে পারছিলেন
না। হঠাৎ তার মনে একটা সন্দেহ জাগল। তিনি ডাকলেন, কাছে
এসে! আকন, আমি জোরে কথ। বলতে পারছিনে ।
আকন তার মাথার কাছে এগিয়ে এসে বসল ।
সেই বাণট! কি তুমিই মেবেছিলে আকন ?
আকন খাটটার উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফু'পিয়ে কেঁদে উঠল।
দিধ্বোক এই কান্নার মধ্য দিয়ে তার প্রশ্ের উত্তর পেয়ে গেলেন ।
কিন্তু তুমি কোন অন্তায় কর নি।
অন্তায় করিনি? আকন আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল।
মোটেই না! তোমার বিবেক যেটা ন্যায় বলে মনে করেছিল,
তুমি সে দিন তাই করেছিলে । তবে তুমি বুঝতে ভুল করেছিলে,
কিন্তু সে দোষও তোমার নয়। এমন ক্ষেত্রে ভূল হওয়াই স্বাভাবিক ।
আমি কিন্তু সেই অজানা লোকটির কথ! বহুদিন, ভেবেছি। বিশ্বাস
করবে তুমি, আমার মনে তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না!
ভীষণ আগ্রহ ছিল তাকে দেখবার । কত দিন কত লোককে তার
কথা গেজ্ঞাসা করেছি, কেউ বলতে পারে নি।
কেমন করে বলবে । আমার একটি মাত্র বন্ধু ছিল যে এই কথাটা!
জানত । সে দিন সেও আমার সংগেই ছিল। কিন্তু গৌড় অধিকারের
সময় যে যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে সে মার! যায়।
দিবেবাক বললেন, জান আকন, আমি কি আগ্রহ নিয়ে তোমাকে
৩১০ বিদ্রোহী কৈবর্ত
খুঁজছিলাম। মরবার আগে তোমার দেখা পেয়ে বড় সুখী হোলাম।
কিন্ত ওসব কথা৷ ভুলে যাও তুমি ।
ভুলে যাব? কেমন করে ভুলে যাব? আমার সেই বন্ধু আমাকে
তীরের মুখে বিষ মাখাতে নিষেধ করেছিল, কেন আমি তার কথা
শুনলাম না! তা হলে তো৷ এমন হোত না। সেই কথা ভেবে ভেবে
আমার অন্তর বলে যাচ্ছে, এই জীবন আমি আর বইতে পারছি না।
এর পর থেকে. যখনই আমি যুদ্ধে গিয়েছি প্রতিবারই মরার সংকল্প
নিয়ে গিয়েছি । কিন্তু কি আশ্চর্য, ডাইনে-বীয়ে কত লোক মরে,
কিন্তু আমি কিছুতেই মরি না! এ কেমন প্রাণ আমার !
মর্বার জন্য এমন অস্থির হয়ে উঠেছ কেন আকন? তুমি ছিলে”
তাই এবার বরেন্দ্রী শত্রর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, এ কথা সবাই
বলছে। তোমাদের মত বীরের উপর নির্ভর করছে বরেন্দ্রী আর
কৈবর্তদের ভবিষ্যং। ও সব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দেশের
জন্য কাজ কর। আমার অসমাপ্ত কাজের ভার বুঝে নাও তোমরা,
তাহলে মরবাঁর আগে তোমাদের দিকে চেয়ে আমি নিশ্চিন্ত মনে শেষ
নিঃশ্বাস ছাড়তে পারব ।
বুকের মধ্যে এমন জ্বাল। নিয়ে মানুষ কাজ করতে পারে! আমি
তা পারব না। এত কাল যা গোপন করে এসেছি, আমি এখন তা
সমাজের সকলের কাছে প্রকাশ করে বলব। তারাই আমার বিচার
করুক।
না না, তা হবে না। দিবেবাক দৃঢ়ক্ঠে বললেন । আকন, তুমি
আমার মৃত্যর জন্য দায়ী, তাই না?
হ্যা, উত্তর দিল আকন।
তবে তার পরিবর্তে আমি তোমার জীবন চাই ।
আমার জীবন দিতে আমি প্রস্তুত আছি।
বেশ, ভাল কথা তোমার জীবন নিয়ে নিলাম আমি । তোমার
জীবন এখন থেকে আর তোমার নয়, আমার । আমার আদেশ রইল,
'বিজ্রোহী কৈবর্ত ৩১১
এই জীবন তুমি দেশের কাজে বিলিয়ে দেবে। আর যে গোপন কথ।
তুমি আজ আমার কাছে প্রকাশ করলে, তা তোমার আর আমার
মধ্যেই থাক, আর কেউ যেন এ কথা জানতে না পারে। প্রতিজ্ঞা কর,
'আমার একথ। তুমি রাখবে ।
আকন কথার কোন উত্তর দিল না।
দিব্বোক গভীর স্বরে বললেন, আকন, কথা শোন। বিশ্বাস কর,
সত্যসত্যই আমি মরতে চলেছি। এই শেষবার, আর কোনদিন
তোমাকে কোন অনুরোধ করতে পারব না। প্রতিজ্ঞা কর, আমার এ
কথা তুমি রাখবে ।
আকন এবার আর নিঃশব্দ হয়ে থাকতে পারল না, বলল, হ্যা,
আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আপনি যা বললেন, আমি সেই মতই করব।
দাও, এবার দরজাটা খুলে দাও। ওর! সব বাইরে দীড়িয়ে
অপেক্ষা করছে, ঘরের ভিতরে চলে আস্মথক।
'**বাংলাদেশের বরেন্দ্রী বলতে যা! বোঝায় তার নাম ছিল এককালে
কট্রলি। , কট্টলি আর ুর্ষের সন্তান বরেন্দ্রীর কৈবর্তরা। কৈবর্তদের
বানহুতেজের আগুনকে ছড়িয়ে পড়তে না! দেওয়ার জন্য এদের সঙ্গে
এক অলিখিত চুক্তি করেছিলেন পরম ভট্টারক প্রথম বিগ্রহপাল।
কিন্তু রাজনীতির কৌশলে এই চুক্তি প্রথা বদ হয়ে গিয়েছিল। ভেদনীতি
দিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ কৈধওদের মধ্যে বিভেদ স্থি করে পরবর্তাঁ গৌড়াধিপতিরা
চক্তিকে লঙ্ঘন করেছিল।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে গৌড়ে তখন ভাঙনের প্রাবন। নিধিষ
কৈবর্তরা! এই ভাঙনের মুখে যেন দাবানল ছড়িয়ে দিল। প্রধান
অমাত্যর হাতের পুতুল মহারাজ দ্বিতীয় মহীপাল কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
এই সময়ে বৌদ্ধ ধর্গাবলম্বীদের মধ্যে ভীষণ আত্মকলহ বঙ্গভূমির প্রতিটি
কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজা মহীপালের প্রধান অযাতা হিন্দু
বরাহস্বামী তাতে ইন্ধন দান করেছিলেন।
গৌঁড়ের আর্ধরক্ত বংশোদ্ভবদের বিরুদ্ধে কৈবর্তর ভ্ঙ্কার। সঙ্গে
গীঠিরাজের যড়যন্ত্র মহীপালের বিরুদ্ধে। চারদিকে একটা চাপা
'শ্শাজকতা। এই অরাজকতার সুযোগে কৈবর্ত হৃদয়রাজ দিবেবক
আঘা.-হানলেন কঠিন। আধ নীল রক্ত অঝোরে ঝরল। ব্ছুদিনের
বঞ্চিত মানুষরা! ইতিহাসের নিয়যান্্মারে মিনারের মাথায় হাত রাখল।
এ যেন এক অসম্ভব সম্ভব হয়া।
বঞ্চিত মানুষ কৈবঙদের জীবন সংগ্রাম আর গৌনবাসীদের
অত্যাচারে সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধ রাজার তরুণী পত্তীর পরকীয়া প্রেম । জীবনের
্টপান্তে এসে যে প্রেম দেখঙ্গ পলাশের গাছে গাছে আগুনের নেশা।
সেই নেশায় মাতাল শঙ্খদেবী ও রাজবৈছ্য হরিগ্রপ্ত।
বাংলা দেশের ইন্িহাসে কৈবর্তদের অভ্যরথান নিয়ে রচিত এই
উপন্তাস এক উজ্জল অধ্যার। ওপার বাংলার কথা সাহিত্যিক, সত্যেন
সেন তার ক্ষমতার নতুন সংযোঙ্গন দেখিয়েছেন গ্রন্থটিতে। উত্তেজনাময়
শাণিত বুদ্ধিদীপ্ডিতে ভান্বর এমন এঁতিহাসিক রচন! খুবই বিরল।
আশা করি বিদ্রোহী কৈবর্ত আপনাদের বিদগ্ধ পাঠক মনে এক বিশেষ
রেখাপাত করতে সক্ষম হবে ।:"